প্রকৃতিকে বাঁচাতে হয় by সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী
কেউ যদি বলেন, বর্ষা তাঁর মায়ের মতো, তবে এক মুহূর্ত বিলম্ব হবে না আমার তাঁর সঙ্গে একমত হতে। মায়ের মতোই। তেমনি স্নেহপ্রবণ ও উদ্বিগ্ন, বিষণ্ন, তবু সবাইকে কাছে পেয়ে প্রসন্ন। যেন সেবকের ভূমিকা, শাসকের নয়। শাসক হচ্ছে গ্রীষ্ম। কী তার আস্ফালন, কী তার দম্ভ! আমরা তো গ্রীষ্মপ্রধান,
গ্রীষ্মের ঘের থেকে পালাব কোথায়! বর্ষাতে সে থাকে, শীতের রয়ে যায় তার আশঙ্কা। শীতই হয়তো শ্রেষ্ঠ, আমাদের জন্য; কিন্তু শীত ক্ষণস্থায়ী। আর শরৎ, হেমন্ত ও বসন্ত? তারা পঞ্জিকায় আছে, জীবনে নেই।
বর্ষাকে শ্রেষ্ঠ বলি না, তাকে বলি স্বাভাবিক। আমাদের মাটির সঙ্গে, প্রাণের সঙ্গে তার অবিকল যোগাযোগ। ব-দ্বীপের মানুষ আমরা, পানির ওপর ভাসি; পানি না হলে বাঁচি কী করে! গ্রীষ্ম যখন শেষ করে দেয় সব কিছু, মাঠ ফাটে, ফাটে বুকের ছাতি; ঘামে-তৃষ্ণায় নাভিশ্বাস ওঠে মানুষের, মনে হয় প্রকৃতি যুদ্ধ ঘোষণা করেছে মানুষের বিরুদ্ধে, পালাবার পথ নেই, তখন ঘন ঘন আকাশে তাকাই আমরা, মেঘ দেখি ছায়া খুঁজি, আশা করি আষাঢ়ের। তারপর সত্যি সত্যি আষাঢ় আসে একদিন, কালো হয়ে যায় আকাশ, ঝম ঝম করে নামে বৃষ্টি, জেগে ওঠে ঘাস, সতেজ হয় পশু ও পাখি, বেঁচে যায় মানুষ। গ্রীষ্মের জ্বালা ও পোড়া থমকে যায়, আমরা আপাতত শীতল হই, ধুয়েমুছে পরিষ্কারও হই। ভাগ্য ভালো, বর্ষা ছিল, নইলে আমরা বাঁচতাম কী করে! শীতই শ্রেষ্ঠ বটে, কিন্তু বর্ষাই স্বাভাবিক। এ আমাদের নিজেদের ঋতু, খাঁটি বাঙালি।
বর্ষার কথা বলেছি আমরা কাব্যে, গানে, চিত্রে, বলা হয়েছে আষাঢ়ে-গল্পে, নৌকাভ্রমণে, নাইওর নেওয়ার কালে, বলা হয়েছে নদীপথে যাতায়াতের সময়। কিন্তু যা বলা হয়েছে তা ওপরের মাত্র, ৯ ভাগের এক ভাগ, বর্ষা আছে আরো গভীরে, একেবারে সত্তার সঙ্গে মিশে, সেখান থেকে তাকে উৎপাটন করবে এ সাধ্য বর্বর শাসক গ্রীষ্মের নেই। পারো তুমি জব্দ করতে। কিন্তু পারো না বদলে দিতে। না, বদলায়নি। কত পীড়ন গেছে, গেছে দুঃশাসন, এসেছে বহিঃশত্রু, এসেছে বণিক ও সিপাহি, কিন্তু বর্ষা যায়নি, বর্ষা আছে বাইরের প্রকৃতিতে, তার চেয়ে বেশি ভেতরের স্বভাবে। বর্ষা থাকবে, আহা, যেন থাকে। নইলে তো আমরা থাকব না।
আমরা মায়ের কথাও বলেছি। মা মা করে অনেক কান্না আছে, আবদার আছে, অভিমান আছে আমাদের। মেঘের মতো অনুভূতি, বৃষ্টিভরা মেঘ যেমন, ঝরবে বুঝি_এখন-তখন। এই যে মাতৃবন্দনা, এই যে উচ্ছ্বসিত মাতৃভক্তি এর পেছনে মায়ের প্রতি অনুরাগ আছে নিশ্চয়ই, থাকবেই; কিন্তু এর পেছনে আত্মপ্রেম যে কতটা আছে তা তো জানা হয়নি। থাকে। খুব করেই থাকে। মায়ের প্রতি শ্রদ্ধা-ভক্তি-অনুরাগের সঙ্গে মিলেমিশে থাকে নিজের প্রতি ভালোবাসা। আমার মা আমার বলেই এত ভালো, আমার মা আমার জন্য আশ্রয়, শেষ আশ্রয়, অনেক সময়। কিন্তু ওই যে বর্ষা আর এই যে মা_এ দুইয়ের ভেতরে যোগাযোগ ও নৈকট্য তা আমরা অস্বীকার করি কোন মুখে। মা ও বর্ষা একাকার হয়ে যায় সমতায় ও মমতায়।
বর্ষা আসলে সমতার ঋতু, ঋতু সে মমতার। বর্ষাকে আদর্শায়িত করার উপায় নেই, প্রয়োজনও নেই। তার দোষ আছে, যেমন গুণ আছে দুঃসহ গ্রীষ্মেরও। সংসারে অবিমিশ্র কেউ নয়। কোথাও নয়। রোদ না উঠলে সব তো ভিজে থাকত, পচত অনেক কিছু_পাটের মতো করে, দেখা দিত দাগ ও দুর্গন্ধ। না, বর্ষা আদর্শ নয়। সে আনে রোগ, আনে কীটপতঙ্গ, তৈরি করে কর্মহীনতা, বিচ্ছিন্ন করে মানুষকে, ভেঙে দেয় আশ্রয়। আছে, ত্রুটি আছে। মা-ও তো মানুষই, একজন, ফেরেশতা নন। কিন্তু এসব অতি সামান্য, ঘাতক গ্রীষ্মের উৎপাতের তুলনায়। আমরা রোদ চাই কখনো কখনো, কিন্তু গ্রীষ্ম চাই না।
না, আমরা পছন্দ করি না গ্রীষ্মকে। আমাদের প্রকৃতির সঙ্গে মেলে না। মনে হয়, অস্বাভাবিক সে। অথচ গ্রীষ্মই তো শাসন করে। আমাদের সমাজ যেমন মাতৃতান্ত্রিক নয়, পিতৃতান্ত্রিক, আমাদের প্রকৃতিও তেমনি বর্ষাপ্রধান নয়, গ্রীষ্মপ্রধান। শাসন মানেই যে শোষণ, আমাদের দেশে সেটি বড় জাজ্বল্যমান হয়ে ওঠে গ্রীষ্মের শাসন দেখলে। যেন পিতার মতো। কিন্তু পিতারও তো পিতা থাকে। পিতামহ তো থাকবেই, থাকে কর্তাও। পিতার মতোই যে শাসন করে পিতাকে। আছে। পিতার যে কর্তা পিতৃত্বকে সে লাঞ্ছিত করছে নির্মমভাবে। এ বড়ই করুণ একটি সত্য। শাসক আসলে বিদেশি; যুগের পর যুগ ধরে সেই শাসক এ দেশের মানুষের ওপর যে নিপীড়নের ঘটনা ঘটিয়েছে, তা প্রথমে ও সরাসরি পড়েছে পুরুষের ঘাড়ে। পুরুষ জর্জরিত হয়েছে, পৌরুষের লাঞ্ছনায় সে সিক্ত হয়ে উঠেছে বর্ষার মতোই।
দম্ভে নয়, বর্ষার মতো নিশ্চুপে ফিরেছে ঘরে। কিন্তু ফিরে রূপ ধরেছে ভয়ংকর, অপমানের শোধ নেবে সে ঘরে। দায়িত্ব ভুলে কর্তৃত্বকে প্রখর করেছে। গৃহের বর্ষা তখন আরো সিক্ত হয়, পীড়িত হয়। মাতা হয়ে পড়েন কোণঠাসা। তাই তো পিতা যথেষ্ট পিতা নন আমাদের জন্য। আমরা বাপ বাপ করি, আবার বাবাও খুঁজি। বলি আপনি আমার পিতৃতুল্য, আপনি আমাদের দায়িত্ব নিন, আমাকে উদ্ধার করুন। ব্যক্তির জন্য তো বটেই, জাতির জন্যও পিতার আবশ্যকতা দেখা দেয়, যেন তিনিই সর্বস্ব, তাঁর পরিচয়েই আমাদের পরিচয়। আমাদের ইতিহাস পিতৃত্বের ব্যর্থতার ইতিহাস। আমরা পরাজয় মেনেছি বহিঃশত্রুর কাছে, যারা দখল করে নিয়েছে আমাদের দেশ; আমরা নত হয়েছি প্রকৃতির কাছেও, যে দাঁড়াতে দেয়নি আমাদেরকে সমষ্টিগত উচ্চাকাঙ্ক্ষায়। আমাদের ইতিহাস কলঙ্কিত হয়েছে ওপরতলার মানুষদের প্রভু খোঁজার ব্যাকুলতার দ্বারা। দোষ পড়েছে মায়ের ওপর। মা-ই আমাদের ঘরকুণো করেছে, নষ্ট করেছে আদর দিয়ে, স্যাঁতসেঁতে করে রেখেছে একেবারে ভেতর থেকে। দোষ আসলে মায়ের যত নয়, তারও অধিক পিতার। পিতার ব্যর্থতাই মায়ের সীমানা; পিতার শাসনেই মায়ের আত্মসমর্পণ। আমাদের বর্ষা পুরোপুরি বর্ষা নয়; মুক্তি নয় সে গুমোট ও গরমের কবল থেকে।
তাই তো সন্তানকে বিদ্রোহ করতে হয়েছে, সেই উৎপীড়ক শক্তির বিরুদ্ধে পিতাকে যে লাঞ্ছিত করে এবং পরিণামে মাতাকে করে নিগৃহীত। সন্তানই আন্দোলন করেছে স্বাধীনতার জন্য; একবার নয়, বারবার। বেরিয়ে এসেছে রাজপথে, যোগ দিয়েছে অবরোধ ও প্রতিরোধে, অস্ত্র হাতে চলে গেছে যুদ্ধে, বলেছে সে মাতাকে বাঁচাবে, হটিয়ে দেবে হানাদারকে। মায়ের নামেই শপথ তার, বাপের নামে নয়। আগের সেই বর্ষা নেই এখন আর, বাংলাদেশে। খরা এসেছে, বন্যা আসে। বর্ষা কখন আসবে, অনিশ্চিত অনেকটা।
এও মানুষেরই কাজ, প্রকৃতির নয়। নির্দিষ্ট করে বলা যায়, ব্যর্থতা পিতার। নদীতে বাঁধ পড়েছে, পানি যাচ্ছে শুকিয়ে। তার কারণটা রাজনৈতিক। ভাগ করেছি আমরা বাংলাকে, কিন্তু সমাধান করতে পারিনি সমস্যার। বরঞ্চ তৈরি করেছি নতুন সংকটের। হিমালয় থেকে বরফ-গলা পানি আসে, তাতে বন্যা হয়; বন্যা বর্ষা নয়, বন্যা বর্ষার পরিপূর্ণ বিকৃতি। ওদিকে গাছ কাটা হচ্ছে নির্দয় হাতে, যাতে বৃষ্টির জন্য সুযোগটা আসছে কমে। এই কাঠ ধনী ঠিকাদারই কাটুক, কিংবা কাটুক দরিদ্র কৃষক, প্রথম ক্ষেত্রে প্ররোচনা এবং দ্বিতীয় ক্ষেত্রে আবশ্যকতা সৃষ্টি করছে পুঁজিবাদ। ঠিকাদার গাছ কাটে মুনাফার লোভে, তার আদর্শ পুঁজিবাদ, গরিব কৃষক গাছ কাটে জ্বালানির প্রয়োজনে, পুঁজিবাদের অসহায় শিকার সে।
মরলে বাঁচি_এ কথা তো বলি আমরা, কিন্তু তাতে মরবার নয়, বাঁচবার ইচ্ছাটাই ধরা পড়ে। তবে যে মা একান্তে বলে, কাউকে না শুনিয়ে, নিজে নিজে যে মরণ ছাড়া তার উপায় নেই, সে কত গভীর বেদনা থেকে যে বলে কথাটা তা জানে শুধু সে নিজে। অনেক মা বলে এ কথা। প্রতিদিন বলছে। না-বলেও বলতে হয়। বর্ষাও বলে। বর্ষা বড় বিপন্ন এখানে। বর্ষা যেন মরে যাবে। তার স্বভাবে আছে সমতা ও মমতা। পানি উঁচু-নিচু মানে না, স্তরভেদকে স্বীকার করে না, পানি থাকে সমান সমান, উঁচু হলে গড়িয়ে চলে যায় নিচুর দিকে, নিচুকে সমান করবে বলে। ভেঙে দিতে চায় স্তরবিন্যাস। গ্রীষ্মের ভেতর এ স্বভাব নেই, গ্রীষ্ম বৈষম্যবাদী, প্রত্যেককে সে আক্রমণ করে আলাদাভাবে। ধাওয়া করে, এবং তখন যে যেমনভাবে আত্মরক্ষার উপায় খোঁজে। কারো ঘরে থাকে এয়ারকুলার, কারো জোটে না তালের পাখাও। একই গৃহে ভৃত্য একভাবে মুখোমুখি হয় গ্রীষ্মের, কিংবা হয় না; গৃহস্বামী আরেকভাবে। বর্ষার আছে মমতা, সে আক্রমণ করে না, আদর করে। গ্রীষ্মকে চ্যালেঞ্জ যে দেয় তা দম্ভ থেকে নয়, ভালোবাসা থেকে, প্রকৃতিকে বাঁচাতে চায়, বাঁচাতে চায় মানুষকে।
এই দুই গুণের বড় অভাব এখন বাংলাদেশে। আর এই দুইয়ের খুবই প্রয়োজন আমাদের জন্য। আমরা যদি চলতে চাই সামনে এবং হতে চাই সৃষ্টিশীল, তাহলে সমতা দরকার হবে মানুষে মানুষে, মমতার প্রয়োজন হবে একের প্রতি অপরের; ঐক্য বলি আর একত্রকর্মই বলি_ভিত্তি হবে ভেতরের মমতা। আমরা এগোবার চেষ্টা করছি, কিন্তু সে চেষ্টা গ্রীষ্মের মতো। তাতে তাপ অত্যধিক, স্বার্থপরতা তার মর্মবস্তু, পীড়ন তার অস্ত্র। হায়! গ্রীষ্মই যদি প্রধান সত্য হয় তাহলে বর্ষার কী হবে, আমরা তাকে পাব কোথায়? পাণ্ডবেরা আসেনি, হানা দেয়নি আলেকজান্ডার, শান্ত বর্ষা তাদের ভয় পাইয়ে দিয়েছে। তবু যারা এসেছে বর্ষাকে অমান্য করেই এসেছে। এখন যদি বর্ষা না থাকে তবে তো অবাধে ঢুকবে তারা। ঢুকছেও। বাঁচার পথ বর্ষাকে বাঁচানো, ভেতরের এবং বাইরের পৃথিবীকে কারা তপ্ত করছে আমরা জানি, সমুদ্রের পানি ফেঁপে উঠছে গ্রাস করে নেবে বলে। খরা দেখা দিয়েছে ব্যাপক হারে, বন্যার আশঙ্কা থাকে প্রতিবছর_এর ভেতরে বর্ষার সমতা ও মমতাই ভরসা আমাদের।
লেখক : শিক্ষাবিদ ও সমাজ বিশ্লেষক
বর্ষাকে শ্রেষ্ঠ বলি না, তাকে বলি স্বাভাবিক। আমাদের মাটির সঙ্গে, প্রাণের সঙ্গে তার অবিকল যোগাযোগ। ব-দ্বীপের মানুষ আমরা, পানির ওপর ভাসি; পানি না হলে বাঁচি কী করে! গ্রীষ্ম যখন শেষ করে দেয় সব কিছু, মাঠ ফাটে, ফাটে বুকের ছাতি; ঘামে-তৃষ্ণায় নাভিশ্বাস ওঠে মানুষের, মনে হয় প্রকৃতি যুদ্ধ ঘোষণা করেছে মানুষের বিরুদ্ধে, পালাবার পথ নেই, তখন ঘন ঘন আকাশে তাকাই আমরা, মেঘ দেখি ছায়া খুঁজি, আশা করি আষাঢ়ের। তারপর সত্যি সত্যি আষাঢ় আসে একদিন, কালো হয়ে যায় আকাশ, ঝম ঝম করে নামে বৃষ্টি, জেগে ওঠে ঘাস, সতেজ হয় পশু ও পাখি, বেঁচে যায় মানুষ। গ্রীষ্মের জ্বালা ও পোড়া থমকে যায়, আমরা আপাতত শীতল হই, ধুয়েমুছে পরিষ্কারও হই। ভাগ্য ভালো, বর্ষা ছিল, নইলে আমরা বাঁচতাম কী করে! শীতই শ্রেষ্ঠ বটে, কিন্তু বর্ষাই স্বাভাবিক। এ আমাদের নিজেদের ঋতু, খাঁটি বাঙালি।
বর্ষার কথা বলেছি আমরা কাব্যে, গানে, চিত্রে, বলা হয়েছে আষাঢ়ে-গল্পে, নৌকাভ্রমণে, নাইওর নেওয়ার কালে, বলা হয়েছে নদীপথে যাতায়াতের সময়। কিন্তু যা বলা হয়েছে তা ওপরের মাত্র, ৯ ভাগের এক ভাগ, বর্ষা আছে আরো গভীরে, একেবারে সত্তার সঙ্গে মিশে, সেখান থেকে তাকে উৎপাটন করবে এ সাধ্য বর্বর শাসক গ্রীষ্মের নেই। পারো তুমি জব্দ করতে। কিন্তু পারো না বদলে দিতে। না, বদলায়নি। কত পীড়ন গেছে, গেছে দুঃশাসন, এসেছে বহিঃশত্রু, এসেছে বণিক ও সিপাহি, কিন্তু বর্ষা যায়নি, বর্ষা আছে বাইরের প্রকৃতিতে, তার চেয়ে বেশি ভেতরের স্বভাবে। বর্ষা থাকবে, আহা, যেন থাকে। নইলে তো আমরা থাকব না।
আমরা মায়ের কথাও বলেছি। মা মা করে অনেক কান্না আছে, আবদার আছে, অভিমান আছে আমাদের। মেঘের মতো অনুভূতি, বৃষ্টিভরা মেঘ যেমন, ঝরবে বুঝি_এখন-তখন। এই যে মাতৃবন্দনা, এই যে উচ্ছ্বসিত মাতৃভক্তি এর পেছনে মায়ের প্রতি অনুরাগ আছে নিশ্চয়ই, থাকবেই; কিন্তু এর পেছনে আত্মপ্রেম যে কতটা আছে তা তো জানা হয়নি। থাকে। খুব করেই থাকে। মায়ের প্রতি শ্রদ্ধা-ভক্তি-অনুরাগের সঙ্গে মিলেমিশে থাকে নিজের প্রতি ভালোবাসা। আমার মা আমার বলেই এত ভালো, আমার মা আমার জন্য আশ্রয়, শেষ আশ্রয়, অনেক সময়। কিন্তু ওই যে বর্ষা আর এই যে মা_এ দুইয়ের ভেতরে যোগাযোগ ও নৈকট্য তা আমরা অস্বীকার করি কোন মুখে। মা ও বর্ষা একাকার হয়ে যায় সমতায় ও মমতায়।
বর্ষা আসলে সমতার ঋতু, ঋতু সে মমতার। বর্ষাকে আদর্শায়িত করার উপায় নেই, প্রয়োজনও নেই। তার দোষ আছে, যেমন গুণ আছে দুঃসহ গ্রীষ্মেরও। সংসারে অবিমিশ্র কেউ নয়। কোথাও নয়। রোদ না উঠলে সব তো ভিজে থাকত, পচত অনেক কিছু_পাটের মতো করে, দেখা দিত দাগ ও দুর্গন্ধ। না, বর্ষা আদর্শ নয়। সে আনে রোগ, আনে কীটপতঙ্গ, তৈরি করে কর্মহীনতা, বিচ্ছিন্ন করে মানুষকে, ভেঙে দেয় আশ্রয়। আছে, ত্রুটি আছে। মা-ও তো মানুষই, একজন, ফেরেশতা নন। কিন্তু এসব অতি সামান্য, ঘাতক গ্রীষ্মের উৎপাতের তুলনায়। আমরা রোদ চাই কখনো কখনো, কিন্তু গ্রীষ্ম চাই না।
না, আমরা পছন্দ করি না গ্রীষ্মকে। আমাদের প্রকৃতির সঙ্গে মেলে না। মনে হয়, অস্বাভাবিক সে। অথচ গ্রীষ্মই তো শাসন করে। আমাদের সমাজ যেমন মাতৃতান্ত্রিক নয়, পিতৃতান্ত্রিক, আমাদের প্রকৃতিও তেমনি বর্ষাপ্রধান নয়, গ্রীষ্মপ্রধান। শাসন মানেই যে শোষণ, আমাদের দেশে সেটি বড় জাজ্বল্যমান হয়ে ওঠে গ্রীষ্মের শাসন দেখলে। যেন পিতার মতো। কিন্তু পিতারও তো পিতা থাকে। পিতামহ তো থাকবেই, থাকে কর্তাও। পিতার মতোই যে শাসন করে পিতাকে। আছে। পিতার যে কর্তা পিতৃত্বকে সে লাঞ্ছিত করছে নির্মমভাবে। এ বড়ই করুণ একটি সত্য। শাসক আসলে বিদেশি; যুগের পর যুগ ধরে সেই শাসক এ দেশের মানুষের ওপর যে নিপীড়নের ঘটনা ঘটিয়েছে, তা প্রথমে ও সরাসরি পড়েছে পুরুষের ঘাড়ে। পুরুষ জর্জরিত হয়েছে, পৌরুষের লাঞ্ছনায় সে সিক্ত হয়ে উঠেছে বর্ষার মতোই।
দম্ভে নয়, বর্ষার মতো নিশ্চুপে ফিরেছে ঘরে। কিন্তু ফিরে রূপ ধরেছে ভয়ংকর, অপমানের শোধ নেবে সে ঘরে। দায়িত্ব ভুলে কর্তৃত্বকে প্রখর করেছে। গৃহের বর্ষা তখন আরো সিক্ত হয়, পীড়িত হয়। মাতা হয়ে পড়েন কোণঠাসা। তাই তো পিতা যথেষ্ট পিতা নন আমাদের জন্য। আমরা বাপ বাপ করি, আবার বাবাও খুঁজি। বলি আপনি আমার পিতৃতুল্য, আপনি আমাদের দায়িত্ব নিন, আমাকে উদ্ধার করুন। ব্যক্তির জন্য তো বটেই, জাতির জন্যও পিতার আবশ্যকতা দেখা দেয়, যেন তিনিই সর্বস্ব, তাঁর পরিচয়েই আমাদের পরিচয়। আমাদের ইতিহাস পিতৃত্বের ব্যর্থতার ইতিহাস। আমরা পরাজয় মেনেছি বহিঃশত্রুর কাছে, যারা দখল করে নিয়েছে আমাদের দেশ; আমরা নত হয়েছি প্রকৃতির কাছেও, যে দাঁড়াতে দেয়নি আমাদেরকে সমষ্টিগত উচ্চাকাঙ্ক্ষায়। আমাদের ইতিহাস কলঙ্কিত হয়েছে ওপরতলার মানুষদের প্রভু খোঁজার ব্যাকুলতার দ্বারা। দোষ পড়েছে মায়ের ওপর। মা-ই আমাদের ঘরকুণো করেছে, নষ্ট করেছে আদর দিয়ে, স্যাঁতসেঁতে করে রেখেছে একেবারে ভেতর থেকে। দোষ আসলে মায়ের যত নয়, তারও অধিক পিতার। পিতার ব্যর্থতাই মায়ের সীমানা; পিতার শাসনেই মায়ের আত্মসমর্পণ। আমাদের বর্ষা পুরোপুরি বর্ষা নয়; মুক্তি নয় সে গুমোট ও গরমের কবল থেকে।
তাই তো সন্তানকে বিদ্রোহ করতে হয়েছে, সেই উৎপীড়ক শক্তির বিরুদ্ধে পিতাকে যে লাঞ্ছিত করে এবং পরিণামে মাতাকে করে নিগৃহীত। সন্তানই আন্দোলন করেছে স্বাধীনতার জন্য; একবার নয়, বারবার। বেরিয়ে এসেছে রাজপথে, যোগ দিয়েছে অবরোধ ও প্রতিরোধে, অস্ত্র হাতে চলে গেছে যুদ্ধে, বলেছে সে মাতাকে বাঁচাবে, হটিয়ে দেবে হানাদারকে। মায়ের নামেই শপথ তার, বাপের নামে নয়। আগের সেই বর্ষা নেই এখন আর, বাংলাদেশে। খরা এসেছে, বন্যা আসে। বর্ষা কখন আসবে, অনিশ্চিত অনেকটা।
এও মানুষেরই কাজ, প্রকৃতির নয়। নির্দিষ্ট করে বলা যায়, ব্যর্থতা পিতার। নদীতে বাঁধ পড়েছে, পানি যাচ্ছে শুকিয়ে। তার কারণটা রাজনৈতিক। ভাগ করেছি আমরা বাংলাকে, কিন্তু সমাধান করতে পারিনি সমস্যার। বরঞ্চ তৈরি করেছি নতুন সংকটের। হিমালয় থেকে বরফ-গলা পানি আসে, তাতে বন্যা হয়; বন্যা বর্ষা নয়, বন্যা বর্ষার পরিপূর্ণ বিকৃতি। ওদিকে গাছ কাটা হচ্ছে নির্দয় হাতে, যাতে বৃষ্টির জন্য সুযোগটা আসছে কমে। এই কাঠ ধনী ঠিকাদারই কাটুক, কিংবা কাটুক দরিদ্র কৃষক, প্রথম ক্ষেত্রে প্ররোচনা এবং দ্বিতীয় ক্ষেত্রে আবশ্যকতা সৃষ্টি করছে পুঁজিবাদ। ঠিকাদার গাছ কাটে মুনাফার লোভে, তার আদর্শ পুঁজিবাদ, গরিব কৃষক গাছ কাটে জ্বালানির প্রয়োজনে, পুঁজিবাদের অসহায় শিকার সে।
মরলে বাঁচি_এ কথা তো বলি আমরা, কিন্তু তাতে মরবার নয়, বাঁচবার ইচ্ছাটাই ধরা পড়ে। তবে যে মা একান্তে বলে, কাউকে না শুনিয়ে, নিজে নিজে যে মরণ ছাড়া তার উপায় নেই, সে কত গভীর বেদনা থেকে যে বলে কথাটা তা জানে শুধু সে নিজে। অনেক মা বলে এ কথা। প্রতিদিন বলছে। না-বলেও বলতে হয়। বর্ষাও বলে। বর্ষা বড় বিপন্ন এখানে। বর্ষা যেন মরে যাবে। তার স্বভাবে আছে সমতা ও মমতা। পানি উঁচু-নিচু মানে না, স্তরভেদকে স্বীকার করে না, পানি থাকে সমান সমান, উঁচু হলে গড়িয়ে চলে যায় নিচুর দিকে, নিচুকে সমান করবে বলে। ভেঙে দিতে চায় স্তরবিন্যাস। গ্রীষ্মের ভেতর এ স্বভাব নেই, গ্রীষ্ম বৈষম্যবাদী, প্রত্যেককে সে আক্রমণ করে আলাদাভাবে। ধাওয়া করে, এবং তখন যে যেমনভাবে আত্মরক্ষার উপায় খোঁজে। কারো ঘরে থাকে এয়ারকুলার, কারো জোটে না তালের পাখাও। একই গৃহে ভৃত্য একভাবে মুখোমুখি হয় গ্রীষ্মের, কিংবা হয় না; গৃহস্বামী আরেকভাবে। বর্ষার আছে মমতা, সে আক্রমণ করে না, আদর করে। গ্রীষ্মকে চ্যালেঞ্জ যে দেয় তা দম্ভ থেকে নয়, ভালোবাসা থেকে, প্রকৃতিকে বাঁচাতে চায়, বাঁচাতে চায় মানুষকে।
এই দুই গুণের বড় অভাব এখন বাংলাদেশে। আর এই দুইয়ের খুবই প্রয়োজন আমাদের জন্য। আমরা যদি চলতে চাই সামনে এবং হতে চাই সৃষ্টিশীল, তাহলে সমতা দরকার হবে মানুষে মানুষে, মমতার প্রয়োজন হবে একের প্রতি অপরের; ঐক্য বলি আর একত্রকর্মই বলি_ভিত্তি হবে ভেতরের মমতা। আমরা এগোবার চেষ্টা করছি, কিন্তু সে চেষ্টা গ্রীষ্মের মতো। তাতে তাপ অত্যধিক, স্বার্থপরতা তার মর্মবস্তু, পীড়ন তার অস্ত্র। হায়! গ্রীষ্মই যদি প্রধান সত্য হয় তাহলে বর্ষার কী হবে, আমরা তাকে পাব কোথায়? পাণ্ডবেরা আসেনি, হানা দেয়নি আলেকজান্ডার, শান্ত বর্ষা তাদের ভয় পাইয়ে দিয়েছে। তবু যারা এসেছে বর্ষাকে অমান্য করেই এসেছে। এখন যদি বর্ষা না থাকে তবে তো অবাধে ঢুকবে তারা। ঢুকছেও। বাঁচার পথ বর্ষাকে বাঁচানো, ভেতরের এবং বাইরের পৃথিবীকে কারা তপ্ত করছে আমরা জানি, সমুদ্রের পানি ফেঁপে উঠছে গ্রাস করে নেবে বলে। খরা দেখা দিয়েছে ব্যাপক হারে, বন্যার আশঙ্কা থাকে প্রতিবছর_এর ভেতরে বর্ষার সমতা ও মমতাই ভরসা আমাদের।
লেখক : শিক্ষাবিদ ও সমাজ বিশ্লেষক
No comments