অপ্রাপ্তি by ফাইয়াজ রহমান

রিয়ার খুব মন খারাপ। কারণ, মা আজ ওকে অকারণে বকা দিয়েছেন। মেরেছেনও। এমন কী আবদারটাই বা করেছিল? ও তো শুধু একটা অ্যাকুরিয়াম চেয়েছিল মায়ের কাছে। কয়েক দিন আগে ওর প্রিয় বান্ধবী রীতির বাসায় বেড়াতে গিয়েছিল রিয়া। রীতিদের বাসা এত্ত সুন্দর যে বলে বোঝানো যাবে না।


তবে সবচেয়ে বেশি ভালো লেগেছে বসার ঘরে রাখা অ্যাকুরিয়ামটা। কাচের একটা ঘরে লাল, নীল, হলুদ, কমলা আরও কত্ত রঙের মাছের মেলা। এ রকম সুন্দর জিনিস রিয়া আগে কখনো দেখেনি। তাই রীতিকে জিজ্ঞেস করল, ‘এই কাচের বাক্সের মাছগুলো কি রং করা হয়েছে?’ প্রশ্ন শুনে রীতি তো হেসেই মরে। ওর জবাব, ‘আরে বোকা, এটা তো অ্যাকুরিয়াম। আর এই মাছগুলোর রংই এমন রঙিন।’ কথাটা শুনে রিয়া তো থ। কারণ, মাছ যে এমন রঙিন হয়, তা রিয়া জানতই না। সেদিনের পর থেকে রিয়া মাকে প্রতিদিনই বলে চলেছে, ‘মা, আমাকে একটা অ্যাকুরিয়াম কিনে দিবে?’ মায়ের একটাই জবাব, ‘দিব মামণি, দিব।’ কিন্তু অ্যাকুরিয়াম আর কেনা হয় না। আজ সকালে ঘুম থেকে উঠতেই মা রিয়ার চোখের সামনে হোমওয়ার্কের খাতা মেলে ধরেন। এই সাতসকালে কারই বা ইচ্ছে করে হোমওয়ার্ক করতে? রিয়া তাই মাকে জানিয়ে দেয় যে ওকে অ্যাকুরিয়াম কিনে না দিলে ও হোমওয়ার্ক করবে না, স্কুলেও যাবে না। কথাটা বলতে না-বলতেই মা ঠাস্ করে দুই গালে চড় বসিয়ে দেন, বকাবকিও করেন প্রচুর। কিন্তু দুই ফোঁটা চোখের জল ফেলা ছাড়া রিয়ার আর কিছুই করার ছিল না। ও বুঝে গেছে যে মা ওকে অ্যাকুরিয়াম কিনে দেবেন না। একটা অ্যাকুরিয়াম কিনে দিলে কী বা হয়? ও তো আর অন্য মেয়েদের মতো মাসে মাসে আবদার করে না। আজ শুক্রবার, রিয়ার স্কুল নেই, বাবারও অফিস ছুটি। বাবা তাই খুব ভোরে উঠে বাজারে গিয়েছিলেন। শাকসবজি ও অন্যান্য সদাইয়ের সঙ্গে কিছু জ্যান্ত কই মাছও কিনেছেন। রান্নাঘরে জ্যান্ত কই দেখে রিয়ার মাথায় এক বুদ্ধি এল। ও চিন্তা করল, অ্যাকুরিয়ামের মতো ছোট্ট কাচের ঘরে যদি মাছ পোষা যায়, তবে পানির ট্যাংকিতে তো মাছ পোষা যাবে। যেই ভাবা সেই কাজ। রিয়া মা-বাবার অলক্ষ্যে দুটো কই মাছ নিয়ে পানিভর্তি একটা মগে রাখল। তারপর ছাদের দিকে পা বাড়াল। ছাদে গিয়ে একটু হতাশই হলো। কারণ, ট্যাংকির উচ্চতা যে ওর চেয়ে বেশি। কী করা যায়, কী করা যায় ভাবতেই হঠাৎ চোখ পড়ল ছাদের এক কোণে রাখা কাঠের পুরোনো চেয়ারের দিকে। মাছ রাখা মগটা কিছুক্ষণের জন্য নিচে রেখে এগিয়ে গেল চেয়ারটার দিকে। অনেক কষ্টে ঠেলে ঠেলে চেয়ারটাকে নিয়ে এল ট্যাংকির কাছে। মগটা হাতে নিয়ে উঠল চেয়ারের ওপর। তারপর আস্তে করে মাছ দুটো ফেলল ট্যাংকির ভেতর। বেশি পানি পেয়ে মাছ দুটোও প্রবল উদ্যমে সাঁতরাতে শুরু করল। রিয়ার আনন্দ তখন দেখে কে। মাছ দুটোকে পানিতে তো ছাড়া হলো। কিন্তু ওদের তো খেতে দিতে হবে। রীতি তো ওর অ্যাকুরিয়ামের মাছগুলোকে কেনা বিশেষ খাবার দেয়। কিন্তু রিয়া ওই খাবার কোথায় পাবে? পরে চিন্তা করল, মানুষ যদি মাংস, ভাত, শাকসবজি খেতে পারে তবে মাছেরা কেন পারবে না? আর তাই রিয়া বাসায় গিয়ে ফ্রিজ খুলে আগের দিনের বাসি ভাত এক মুঠো নিয়ে উঠে যায় ছাদে। ট্যাংকিতে ছুড়ে ফেলে ভাতগুলো। মাছেরা ঘুরেফিরে আর ভাতের দু-একটা দানা মুখে দেয়। দুপুরের অলসতায় মা যখন একটু ঘুমিয়ে পড়েন প্রতিদিন রিয়া তখন পা বাড়ায় ছাদের দিকে। ট্যাংকির দিকে তাকিয়ে মাছগুলোর সাঁতরানো দেখে। খাবারও দেয় ওদের। কিন্তু হঠাৎ একদিন ঘটে যায় দুর্ঘটনা। মাছের চঞ্চলা সাঁতরানো দেখতে দেখতে অসাবধানী রিয়া পড়ে যায় ট্যাংকির ভেতর। ট্যাংকি থেকে উঠতে পারে না শত চেষ্টায়ও। হাবুডুবু খেতে থাকে রিয়া।
বিকেলে ঘুম থেকে উঠে রিয়াকে ধারে-কাছে কোথাও না দেখে জোরে ডাক দেন মা। ‘রিয়া! রিয়া!’ নাহ্, কোনো সাড়াশব্দ নেই। কোথায় গেল মেয়েটা? নির্ঘাত পাশের তুলিদের বাসায় গেছে পুতুল খেলতে। ওহ্! মেয়েটাকে নিয়ে আর পারা গেল না। কী দরকার অন্যের পুতুল দিয়ে খেলতে যাওয়ার? আজ ঘরে ফিরলেই আচ্ছামতো বকা দিতে হবে। এসব ভাবতে ভাবতেই মা এগিয়ে যান বেসিনের দিকে হাতমুখে পানির ঝাপটা দেওয়ার জন্য। কয়েকবার পানির ঝাপটা দিতেই পানি থেকে মাছের আঁশটা গন্ধ পান মা। বেশ কয়েক দিন ধরেই এমন গন্ধ পাচ্ছেন। তবে আজকের গন্ধটা একটু বেশি তীব্র। ঠিক করলেন ছাদে গিয়ে ট্যাংকির ভেতরটা একটু দেখে আসবেন। ছাদে গিয়ে মা অবাক। কারণ, ট্যাংকির ঢাকনাটা খোলা। ট্যাংকির কাছে আবার পুরোনো চেয়ারটা রাখা। আশ্চর্য, ট্যাংকির ঢাকনাটা খুলল কে? আর চেয়ারটাই বা কে রাখল এখানে? মা ধীরে ধীরে এগিয়ে যান ট্যাংকির কাছে। উঁকি দেন ভেতরটায়। ভেতরে তাকাতেই মাথা ঘুরে পড়ে যান। একটু পরই শোনা যায় মায়ের গগনবিদারি আর্তনাদ।
রিয়াদের বাসার ড্রয়িংরুমে অ্যাকুরিয়াম আনা হয়েছে। নানা রঙের মাছ সেখানে খেলা করে। কিন্তু যার জন্য অ্যাকুরিয়াম কেনা হলো সেই রিয়ারই কোনো পাত্তা নেই। কারণ, সে চলে গেছে না ফেরার দেশে। মায়ের এখন সারাটা দিন বলতে গেলে অ্যাকুরিয়াম নিয়েই কাটে। অ্যাকুরিয়ামের ভেতর সে রিয়াকে খোঁজার চেষ্টা করেন। কখনো বা গাল বেয়ে ঝরে পড়ে অশ্রু।

৫ম শ্রেণী, এসওএস হারম্যান মাইনার স্কুল
খুলনা।

No comments

Powered by Blogger.