লেখালেখিতে ভাবনার চুরি by শাহনেওয়াজ বিপ্লব

নিজের নামকে সবার কাছে ছড়িয়ে দেওয়া অথবা বিখ্যাত হয়ে ওঠার চেষ্টা মানুষের নিরন্তর, কিন্তু চাইলেই তো আর বিখ্যাত হওয়া যায় না। লেখালেখি বা সাহিত্যে বিখ্যাত হওয়ার জন্য দরকার এমন কোনো বড় রকমের সাহিত্য বা শিল্পকর্ম, যা হতে হবে সর্বোচ্চ সৃজনশীল আর স্বতন্ত্র।


অথচ পৃথিবীর অনেক বিখ্যাত কবি, গল্পকার, ঔপন্যাসিকের বিরুদ্ধে ভাবনার দৈন্যের অভিযোগ আছে, অনেক বিখ্যাত সাহিত্যকর্মের বিরুদ্ধে রয়েছে চৌর্যবৃত্তির অভিযোগ।
তবে সাহিত্যে বা সাহিত্যিক লেখালেখিতে লেখকদের দ্বারা অপরের ভাব বা ভাবনার চুরি নতুন কোনো ব্যাপার নয়। লেখালেখিতে কবি, সাহিত্যিকদেরও মাঝেমধ্যে ভাবনার দীনতায় পেয়ে বসে অথবা এমন হয়, প্রভাবিত হয়ে বা অনিচ্ছাকৃতভাবে অন্য কবি, ঔপন্যাসিক অথবা নাট্যকারের সাহিত্যভাবনা অনুকরণ এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে অনেকে পুরো ভাবনা, ভাষা বা ঘটনাপ্রবাহের হুবহু চুরি করে থাকেন।
লেখকদের মধ্যে ভাবনা চুরির শুরু হয় খ্রিষ্টপূর্ব প্রথম শতাব্দীতে। রোমান কবি মার্শাল সে সময় অভিযোগ তুলেছিলেন, অন্য এক কবি তাঁর একটি কবিতা চুরি করেছেন। আর সেই থেকে সাহিত্যে অপর লেখকের ভাব বা রচনা চুরিকে ‘প্লেজিয়্যারিজম’ নামে আখ্যায়িত করা হয়। ল্যাটিন শব্দ ‘প্লেজিয়্যারিয়াস’-এর অর্থ হচ্ছে সাহিত্যভাবনার চুরি বা অপহরণ।
ইংরেজ নাট্যকার বেন জনসন ১৬০১ সালে শব্দটিকে ইংরেজি সাহিত্যে পরিচয় করিয়ে দেন। তাঁর মতে, অপর কবি, ঔপন্যাসিক বা নাট্যকারের সাহিত্যভাব বা রচনা অপহূত হওয়ায়ই ‘প্লেজিয়্যারিজম’।
তবে সাহিত্যে প্রায় অষ্টাদশ শতাব্দী পর্যন্ত লেখকেরা একে অপরের ভাব, ভাষা এমনকি কোনো কোনো ক্ষেত্রে পুরো সাহিত্যধারণাটাই নকল করে নিয়েছেন একে অপরের কাছ থেকে এবং এতে নিন্দিত হওয়ার কোনো ভয় ছিল না। উনিশ শতক পর্যন্ত মানুষের ধারণা ছিল যে সাহিত্য কোনো ব্যক্তিগত বিষয় নয়। ব্যক্তির দ্বারা সাহিত্য রচিত হলেও এটি সর্বজনীন এবং লেখকদের ভেতর একে অপরের ধারণা বা ভাষার অনুকরণ দোষণীয় কিছু ছিল না বরং আগে রচিত সাহিত্যকর্মের প্রতি আনুগত্যকে শ্রেষ্ঠ সাহিত্যকর্ম হিসেবে বিবেচনা করা হতো। এমনকি আমাদের বাংলাদেশেও মাইকেল মধুসূদন দত্ত মেঘনাদবধ কাব্য রচনা করার পর মূল রামায়ণের প্রতি অনুগত না থেকে রাবণের প্রতি তাঁর মমত্ববোধ নিয়ে পক্ষপাতের অভিযোগ তুলেছিলেন অনেক সমালোচক। বিংশ শতাব্দীতে আধুনিকতাবাদ বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে সাহিত্যে অপর লেখকের ভাবনা চুরি, অনৈতিক, লেখালেখির নীতিমালা ভঙ্গ ও লেখক অসততা হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।
তবে লেখালেখিতে ভাবনার চুরি প্রতিরোধে আজও কোনো আইন তৈরি হয়নি, যদিও অনেকে কপিরাইট আইনকে সাহিত্যে ভাবনার চুরি প্রতিরোধক হিসেবে গুলিয়ে ফেলেন। কপিরাইট আইন হচ্ছে, কারও ভাবনার; হোক সে বই অথবা নিবন্ধ—এর হুবহু নকল, কিন্তু ‘প্লেজিয়্যারিজম’ হচ্ছে অন্যের সাহিত্যভাবনার অংশবিশেষের চুরি বা অংশবিশেষের প্রভাব, একেবারে হুবহু নকল নয়।
লেখকদের যেসব ভাবনা চুরির কথা জানা যায়, তার মধ্যে রয়েছে একাদশ শতাব্দীতে ইরাকের বিখ্যাত লেখক আল খতিব আল বাগদাদির জীবজন্তুদের নিয়ে লেখা বই আল জাহিদ (৮৬৯)-এর কথা। বইটি কমবেশি অ্যারিস্টটলের লেখা কিতাব আল হাইওয়ান-এর অনুকরণ বলে অভিযোগ আছে।
১৮৭২ সালে আমেরিকার তরুণ লেখিকা হেলেন কেলারের লেখা গল্প ‘দ্য ফ্রস্ট কিং’-এর বিরুদ্ধে অভিযোগ আনেন গল্পকার মার্গারেট টি ক্যানবি। তিনি হেলেন কেলারের ‘দ্য ফ্রস্ট কিং’ গল্পটিকে তাঁর ‘দ্য ফ্রস্ট ফেয়ারিজ’ গল্পের অনুকরণ বলে অভিযোগ আনেন। পারকিন্স ইনস্টিটিউট ফর দ্য ব্লাইন্ড আদালতে হেলেন কেলার স্বীকার করেন, তিনি মার্গারেটের গল্পটি পড়েছিলেন এবং তাঁর গল্পে কিছুটা প্রভাব থাকতে পারে।
অস্কার ওয়াইল্ডের বই দ্য পিকচার অব ডোরিয়ান গ্রে-র ধারণাগুলো লেখক জে কে হাইসম্যানের (১৮৮৪) এগেনস্ট দি গ্রেইন (এ রিবোর্স ) গ্রন্থ থেকে নেওয়া বলে অভিযোগ তোলার পর অস্কার ওয়াইল্ড তা স্বীকার করে নিয়েছিলেন। এডিনবার্গ ইউনিভার্সিটি প্রেস তাদের ২০০৭ সংখ্যায় জানিয়েছে, অস্কার ওয়াইল্ড এ প্রসঙ্গে বলেছিলেন, অপরের ধারণা যুক্ত করে চূড়ান্ত সৃষ্টিশীল হয়ে ওঠা লেখকের অধিকারের মধ্যে পড়ে।
ইংরেজ কবি টি এস এলিয়টের বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে ইংল্যান্ডের অপরিচিত কবি ম্যাডিসন কেইনের কবিতা চুরির।
আলফ্রেড হিচককের ১৯৪০ সালে নির্মিত ড্যাফনে দ্যু মরিয়েরের রেবেকা উপন্যাসটিও চৌর্যবৃত্তির অভিযোগে অভিযুক্ত হয়েছিল। এডউইন ম্যাকডোনাল্ড নামে এক লেখক আদালতে অভিযোগ করেছিলেন, রেবেকা উপন্যাসটি তাঁর ব্লাইন্ড উইডো উপন্যাসের ধারণা থেকে নেওয়া। শেষে অবশ্য বিচারকেরা দুটি উপন্যাসের ভেতরে কোনো মিল খুঁজে পাননি।
লেখক ইয়ান ফ্লেমিংয়ের (১৯০৮-১৯৬৮) সেক্স, সেডিজম অ্যান্ড স্নবারি বইটির বিরুদ্ধে ভাবনা চুরির অভিযোগ এনেছিলেন লেখক কেভিন ম্যাকগ্লোরি। ম্যাকগ্লোরি আদালতে জানান, সেক্স, সেডিজম অ্যান্ড স্নবারি বইটি লিখেছিলেন ইয়ান ফ্লেমিং, তিনি এবং অপর লেখক জ্যাক হুইটিংহাম মিলে, কিন্তু ইয়ান ফ্লেমিং অন্যদের নাম বাদ দিয়ে নিজের নামেই বইটি প্রকাশ করেন। অভিযোগ সত্যি হওয়ায় আদালত সেক্স, সেডিজম অ্যান্ড স্নবারি বইয়ের প্রকাশককে ৩৫ হাজার পাউন্ড ক্ষতিপূরণের নির্দেশ দেন।
বিখ্যাত লেখক ড্যান ব্রাউনের দ্য ভিঞ্চি কোড বইটির বিরুদ্ধেও ভাবনা চুরির অভিযোগে দুবার মামলা হয়েছে। ড্যান ব্রাউনের বিরুদ্ধে প্রথম অভিযোগ আনেন লেখক মিখাইল বাইগনেট। তিনি দ্য ভিঞ্চি কোড বইটিকে তাঁর দ্য হলি ব্লাড অ্যান্ড দ্য হলি গ্রেইল বইয়ের অনুকরণ বলে অভিযোগ করেন। দ্বিতীয় অভিযোগটি আনেন লেখক লুইস পারডু। তিনি দ্য ভিঞ্চি কোড বইটির ধারণা তাঁর দ্য ভিঞ্চি লিগাসি (১৯৮৩) থেকে নেওয়া বলে অভিযোগ আনেন। দুটো মামলাই বিচারকেরা খারিজ করে দেন অভিযোগ সঠিক নয় দাবি করে।
১৯৯৯ সালে ঔপন্যাসিক জে কে রাউলিংয়ের হ্যারি পটার উপন্যাসের বিরুদ্ধে তথ্য চুরির অভিযোগ আনেন ন্যান্সি স্টোগার নামের এক লেখিকা। শেষে অভিযোগ যথার্থ নয় বলে মামলা খারিজ করে দেওয়া হয়।
ভারতের কাব্য বিশ্বনাথনের লেখা প্রথম উপন্যাস হাউ অপাল মেহতা গট কিসড উপন্যাসটির বিরুদ্ধে একাধারে অন্য পাঁচটি উপন্যাসের বিভিন্ন অনুচ্ছেদ সরাসরি চুরির অভিযোগ তোলা হয়। অভিযোগ সত্যি হওয়ায় শেষ পর্যন্ত ওই লেখক বাজার থেকে সব বই প্রত্যাহার করে নিতে বাধ্য হন।
আমেরিকান ঔপন্যাসিক অ্যালেক্স হ্যালি ১৯৭৭ সালে আরেক আমেরিকান ঔপন্যাসিক হ্যারল্ড কোয়োরল্যান্ডারের বিরুদ্ধে চৌর্যবৃত্তির অভিযোগ করেন। আদালতে দায়ের করা মামলায় তিনি উল্লেখ করেন, হ্যারল্ড কোয়োরল্যান্ডারের দ্য আফ্রিকান উপন্যাসটির প্রায় ৮০ পৃষ্ঠা অ্যালেক্স হ্যালির উপন্যাস রুটস থেকে নেওয়া। নিউইয়র্কের আদালতে মামলা বিচারাধীন অবস্থায় কোয়োরল্যান্ড ছয় লাখ ৫০ হাজার ডলারের বিনিময়ে আপস করেছিলেন অ্যালেক্স হ্যালির সঙ্গে।
২০১১ সালে আমেরিকার লেখক কোয়েন্টিন রায়ানের প্রথম উপন্যাস অ্যাসাসিন অব সিক্রেটস প্রকাশিত হলে একই সঙ্গে ১১ জন লেখক তাঁর বিরুদ্ধে চৌর্যবৃত্তির অভিযোগ আনেন। ঘটনা সত্যি হওয়ায় দুঃখ প্রকাশ করে তিনি সঙ্গে সঙ্গেই সব বই বাজার থেকে প্রত্যাহার করে নেন।
১৯৯৭ সালে আমেরিকার বেস্ট সেলার লেখিকা জ্যানেট ডাইলে স্বীকার করে নেন যে তাঁর নাইনটি থ্রি বডিস রিপার উপন্যাসটি, যেটি বিক্রি হয়েছিল ২০০ মিলিয়ন কপি, সে উপন্যাসটির অনেক অংশ আরেক ঔপন্যাসিক নোরা রবার্টসের উপন্যাস থেকে চুরি করা। অপরাধ স্বীকার করতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘লেখালেখিতে ক্রমাগত অপরের ভাবনা নকল বা অনুসরণ করা আমার জন্য মনস্তাত্ত্বিক এক বড় সমস্যা হয়ে দেখা দিয়েছে। আমার বইয়ে নোরা রবার্টসের যেসব ধারণা বা অংশের নকল আমি করেছি, তা নকল করার ইচ্ছা আমার কোনো সময়েই ছিল না। এ সমস্যা নিয়ে আমি বর্তমানে মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞের শরণাপন্ন হয়েছি। ভবিষ্যতে এ ধরনের ঘটনা আর ঘটবে না—এ আশ্বাস দিতে পারি আমার পাঠকদের।’
তাই নানা সময়ে লেখকদের মধ্যে ভাবনা চুরি নিয়ে অভিযোগ এবং এ বিষয়ে মামলা-মোকদ্দমা হয়ে থাকলেও সেসবের বেশির ভাগই অমীমাংসিত থেকে গেছে শেষ পর্যন্ত। এ প্রসঙ্গে বিখ্যাত আমেরিকান নাট্যকার উইলসন মিজনার বলেন, ‘একজনের লেখা বা ভাবনা অনুকরণ যদি দোষণীয় হয়, তবে দুজন বা ততোধিক লেখকের ধারণা বা ভাবনার অনুসরণ; কী করে গবেষণার স্বীকৃতি পেতে পারে?’
শাহনেওয়াজ বিপ্লব: গবেষক, ভিয়েনা আন্তর্জাতিক বিশ্ববিদ্যালয়, অস্ট্রিয়া।

No comments

Powered by Blogger.