মিডিয়া সাম্রাজ্যবাদ by ফাহমিদ - উর - রহমান
সাম্রাজ্যবাদ মানে হচ্ছে একটি জাতি বা রাষ্ট্রের স্বার্থে এক বা একাধিক জাতি বা রাষ্ট্রকে নিয়ন্ত্রণাধীন রাখার মতবাদ এবং এই মতবাদের অনুসারীকে বলা হয় সাম্রাজ্যবাদী। কিন্তু এই মতটি স্থান-কাল-পাত্র বিচারে অন্যের ওপর প্রয়োগের জন্য সাম্রাজ্যবাদীকে নানারকম কৌশল অবলম্বন করতে হয়, যা সাম্রাজ্যবাদকে বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য দিয়ে থাকে।
যেমন : সামরিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও মিডিয়া সাম্রাজ্যবাদ। সাম্রাজ্যবাদের সবচেয়ে স্থূল রূপটি হলো এর সামরিক ও রাজনৈতিক কৌশল। এই প্রক্রিয়ায় পররাজ্যকে দখল ও করতলগত রাখতে সাম্রাজ্যবাদীকে নানারকম ধকল সহ্য করতে হয়। আইন, আদালত, আর্মি, সিপাই পুষতে হয়। রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের ঝুঁকি নিতে হয় এবং প্রাণ ক্ষয়, সম্পদ ক্ষয়, সবশেষে পরাজয়ের গ্লানিও বহন করা লাগতে পারে।
অর্থনৈতিক সাম্রাজ্যবাদ নামক ভিন্ন সংস্করণে যদিও আধিপত্য আরোপিত হয় অর্থনীতির সূত্রে, তথাপি এটি সামরিক সহায়তা ছাড়া সচরাচর টিকতে পারে না। আজকে কর্পোরেট পুঁজির বহুজাতিক সাম্রাজ্যবাদকে নিরাপদ রাখতে দেশে দেশে কীভাবে মার্কিন বাহিনী হামলে পড়েছে, তা আর নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে না।
সাম্রাজ্যবাদের সূক্ষ্ম রূপটি হচ্ছে সাংস্কৃতিক ও মিডিয়া সাম্রাজ্যবাদ। দুটোই পরস্পরের অনুঘটক। এই প্রক্রিয়ায় পূর্বতন মডেলগুলোর অস্বস্তিকর পরিস্থিতিগুলোর গুণগত উন্নতি ঘটিয়ে সাম্রাজ্যবাদীরা স্বস্তির সঙ্গে পররাজ্য লুণ্ঠন ও শোষণের ক্ষেত্র তৈরি করে। সাংস্কৃতিক মডেলটিতে সাংস্কৃতিক দীক্ষার মাধ্যমে একদল সুবিধাভোগী শ্রেণীকে সাঙ্গাত বানানো হয় এবং তাদের হাতে পোশাকি স্বাধীনতাটুকু ন্যস্ত করে সাম্রাজ্যবাদীরা স্বীয় রাষ্ট্রে বসে কলকাঠি নাড়ে। মেকলের ভাষায়, ‘কালা সাহেব’রূপী এই সুবিধাভোগী শ্রেণী সাম্রাজ্যবাদীদের সঙ্গে অভিন্ন রুচি ও সংস্কৃতির বন্ধনে আবদ্ধ। এরাই সাম্রাজ্যবাদের সব রকমের স্বার্থ দেখভাল করে।
এই প্রক্রিয়াটি স্থায়ী করার জন্য এবং উপনিবেশিত জনগণ যাতে তার আপন সাংস্কৃতিক সত্তাটি খুঁজে না পায় সেজন্যই প্রবর্তিত হয়েছে মিডিয়া সাম্রাজ্যবাদ। এটি উন্নত প্রযুক্তিনির্ভর বিভিন্ন রকম গণপ্রচার মাধ্যমের সাহায্যে বিভ্রান্তি, আকথা-কুকথা ছড়িয়ে উপনিবেশিত জনগণের মনকে আচ্ছন্ন করে রাখে এবং নানা রকম মিসইনফরমেশন ও ডিসইনফেরমেশন সৃষ্টি করে এক ধূম্রজাল তৈরি করে। এর উদ্দেশ্য হচ্ছে উপনিবেশিত জনগণকে এমনভাবে ঘুম পাড়িয়ে রাখা যাতে সে আত্মআবিষ্কারের সুযোগে সাম্রাজ্যবাদীদের মুখাপেক্ষিতার জাল কেটে বেরিয়ে না আসতে পারে। আগের দিনের সাম্রাজ্যবাদীরা প্রচার করত ডযরঃব গবহ্থং ইঁত্ফবহ-সাদা মানুষের দায়। মানে সাম্রাজ্যবাদীরা হতভাগ্য জাতিটিকে বড়ই দয়াপরবশ হয়ে তার অসভ্যতার অন্ধকার থেকে রাষ্ট্রের সভ্যতার আলোতে উঠিয়ে আনার চেষ্টা করছে। সেজন্য সাম্রাজ্যবাদ দরকার, কারণ এটি এক মহতী মিশন অর্জনের চেষ্টা করছে। এখন সাম্রাজ্যবাদীরা বলছে ফ্রিডম, ডেমোক্রেসির কথা। এর জন্য ইরাকে, আফগানিস্তানে খুন-গণহত্যা সব জায়েজ হয়ে গেছে। স্বাধীনতা, গণতন্ত্র, মুক্তির সংগ্রামে নেটিভদের একটু রক্তপাত তো হবেই।
উপরোক্ত পটভূমিতে মিডিয়া সাম্রাজ্যবাদকে আমাদের বুঝতে হবে, যার কাজ হচ্ছে গণবশীকরণ। সোভিয়েত ঔপন্যাসিক আলেক্সান্ডার সোলঝেনিিসন পশ্চিমে নির্বাসিত জীবনে থাকার সময় হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি বক্তৃতা দিয়েছিলেন। সেই বক্তৃতাটি পরে হার্ভার্ড ম্যাগাজিনে The Exhausted West শিরোনামে বেরিয়েছিল। এখানে তিনি সভ্যতার ভেকধারী পশ্চিমা বিশ্বের উদ্দেশে কিছু অসাধারণ কথা বলেছিলেন। সবকিছুর মধ্যে সোলঝেনিিসন সেখানকার সবচেয়ে শক্তিধর ও ক্ষতিকর হিসেবে চিহ্নিত করেছিলেন পশ্চিমের স্বাধীনতার চরম অসদ্ব্যবহারকারী মিডিয়া নামের দৈত্যটিকে। লেজিসলেচার, প্রশাসন এবং বিচার বিভাগের চেয়েও পশ্চিমের এই শক্তিশালী মিডিয়াকে তিনি নিজ দেশের চরম স্বৈরতন্ত্রী স্ট্যালিনের তুলনায় অধিক ভয়ঙ্কর ডিক্টেটর হিসেবে চিহ্নিত করেছিলেন।
গুলাগ আরকিপেলাগো ও ফাস্ট সার্কেলের স্রষ্টা এই ঔপন্যাসিক তখন প্রশ্ন করেছিলেন : পশ্চিমা সাংবাদিকটি কোন আইনের বলে নির্বাচিত হন, তিনি কার কাছে দায়বদ্ধ, কে তাকে ক্ষমতা দান করে, কতটুকু অধিকারসহ এবং কত সময়ের জন্য!
সোলঝেনিিসন বিস্ময় প্রকাশ করেছেন, যদি এই সাংবাদিক নামের বিশেষ মানুষটির ক্ষমতার উত্স হয় পশ্চিমের ব্যক্তিস্বাধীনতা, বাকস্বাধীনতা প্রভৃতি বস্তু; তাহলে আসল সত্যটা হলো পশ্চিমা সাংবাদিকের আর যা কিছু থাকুক স্বাধীনতা বলে কিছু নেই। পশ্চিমা মাস মিডিয়া মানে চলতি ফ্যাশন, উঠতি হুজুগ এবং ব্যবসায়িক চাহিদার দাসানুদাস। সেখানকার কর্পোরেট পুঁজিপতিরা সবরকমের মিডিয়াকে নিয়ন্ত্রণ করে এবং তাদের রুচি, গরজ ও মুনাফার প্রয়োজনে এসব গণমাধ্যম গণচাহিদার সৃষ্টি করে। একটা কথা বোঝা দরকার, পশ্চিমে মিডিয়ার স্বাধীনতা কথাটা সেখানকার পুঁজিপতিদের বাণিজ্যিক ও মতাদর্শিক স্বার্থকে রক্ষা করেই কার্যকর হয়।
পশ্চিমের আর একজন পণ্ডিত নোয়াম চমস্কি তার গধহঁভধপঃঁত্রহম ঈড়হংবহঃ বইতেও সেখানকার মিডিয়াকে স্রেফ মুনাফানির্ভর হিসেবে উল্লেখ করেছেন। তার কথা হচ্ছে, পশ্চিমা গণমাধ্যমগুলো সেখানকার বড় বড় পুঁজিপতিরা নিয়ন্ত্রণ করে এবং এর দ্বারা তারা বিপুল পরিমাণ মুনাফা হাতিয়ে নেয়। তথ্য পরিবেশনের ক্ষেত্রে তাই এসব গণমাধ্যম যথার্থতা রাখতে পারে না। তথ্যের ধরন, গুণাগুণ, পরিবেশন কৌশল সবটাই মুনাফার প্রয়োজন অনুসারে নির্ধারিত হয় এবং তাতে জনস্বার্থ বিপন্ন হয়। ফলে যারা তথ্যের ক্ষেত্রে যথার্থতা রাখতে চায় তারা এসব কর্পোরেট টাইকুনদের সামনে টিকে থাকতে পারে না। এর ফল হচ্ছে, গণমতের প্রতিনিধিত্বকারী বলে পরিচিত এসব গণমাধ্যমে জনমত উচ্চারিত হয় না। বরং বিশেষ কায়দা ও কৌশলে এসব তথাকথিত গণকণ্ঠ থেকে উচ্চারিত মতামতই জনমত হিসেবে বিবেচিত হয়। এই প্রেক্ষাপটে প্রকৃত জনমত রুদ্ধ হয়ে যায়, উচ্চারিত ও প্রকাশিত হওয়ার সুযোগ পায় না। যোগ্য ব্যক্তি তার যোগ্যতা অনুযায়ী সমাজে ভূমিকা রাখতে পারে না। কারণ সমাজ রূপান্তরের সব যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও মিডিয়া তাকে স্থান দেয় না। এই কারণে দেশও তাকে শুনতে পায় না। তার পণ্যটি মূল্যবান হলেও মিডিয়া সামাজিক, বাণিজ্যিক ও মতাদর্শিক স্বার্থে যে গণচাহিদার সৃষ্টি করে, সেই খাদ্য তালিকায় তার পণ্যটির কোনো বিক্রয়মূল্য থাকে না। জনমতের ভান ধরে মিডিয়া প্রকৃতপক্ষে জনমতকে বিভ্রান্ত করে। সে খুনিকে বানায় নায়ক, নায়ককে বানায় খুনি। প্রচার মাধ্যমই নির্ধারণ করে দেয় কোনটা ভালো, কোনটা মন্দ। পণ্যের অন্তর্গত বৈশিষ্ট্যটি হয়ে পড়ে মূল্যহীন। আপনার-আমার প্রয়োজন আমি বা আপনি নির্ধারণ করতে পারি না। ওটা মিডিয়াই করে দেয়। তেমনি কে গায়ক, কে নায়ক, কে লেখক, কে নেতা, কে বরণীয়, কে উপেক্ষণীয়—তাও ঠিক করে দিচ্ছে গণমাধ্যম নামক ভয়ানক বস্তুটি। আপনাকে কেবল ডাক্তারের পরমার্শ মতো চোখ বুজে ওষুধ খেতে হবে এবং মন্ত্রজ্ঞানে নিদানগুলো মনেপ্রাণে গ্রহণ করতে হবে।
মিডিয়ার এই মাজেজার কারণ হলো প্রযুক্তির অসাধারণ বিকাশ। এই প্রযুক্তির ওপর ভর করে পুরো পাশ্চাত্য সভ্যতা (তাদের অনুকরণে আমরাও) এখন পণ্যভোজী সমাজ থেকে তথ্যভোজী সামজে পরিণত হয়েছে। তথ্যভোজনও এক ধরনের ভোজন—যেমন বিনোদন, কালক্ষেপণ ইত্যাদি। পাঠ মাধ্যম শ্রুতি মাধ্যমের (Textual and Audio Media) চেয়ে এখন দৃষ্টি মাধ্যম (Visual Media) বহুগুণে শক্তিশালী।
ডিশ অ্যান্টিনার কল্যাণে এখন বেশুমার টিভি চ্যানেল, কেবল টিভি, ভিসিপি, ভিসিআর ইত্যাদি ছাড়াও আরও কত কী আমাদের স্নায়ুকে অষ্টপ্রহর উত্তেজিত করে চলেছে। এসব তথাকথিত মাসমিডিয়া নামের ঝুড়িতে আছে কমিক স্ট্রিপ, সোপ অপেরা, ওয়েস্টার্ন, মালটিমিডিয়া সমর্থিত লাভ সং আর হরর মুভি। এসব দেখতে দেখতে এখন পশ্চিমা মানুষের মতো আমাদের এখানকার কারও কারও অবস্থা ফাঁপা বেলুনে পরিণত হয়েছে। ব্যক্তিস্বাধীনতার অবাধ চর্চার ঠেলায় এখন সমাজই রীতিমত অসহায়। মানবাধিকার চর্চার শেষ নেই। অথচ মানবিক মূল্যবোধ বলে যা কিছু তা কিন্তু উবে যাচ্ছে। পুঁজিতান্ত্রিক শিল্প সভ্যতা তাদের মাসমিডিয়া নামক শিল্প-কারখানায় যেসব গল্প, কাহিনী, অপেরা, সিনেমা, নাটক, থিয়েটার তৈরি করে; তাই কিন্তু একালের মানুষের মন-মনন-বুদ্ধিমত্তার প্রাথমিক বুনিয়াদ তৈরি করে। এসব কিছুর গণসম্প্রচার একালের নৈতিক দারিদ্র্য, লঘু চরিত্র ও আত্মস্বার্থপরতার জন্য দায়ী। এসব বিনোদনের নামে চালু মাস প্রডাক্টগুলো কিন্তু এক ধরনের গোপন দীক্ষাদান কর্মসূচিও বটে। কমিক স্ট্রিপ, টিভি মুভি, ম্যাগাজিন, ভিসিপি, ভিসিআর, কম্পিউটার গেমস প্রভৃতি শুধু বাইরে থেকে অভিনব ফ্যাশন, সহিংসতা, যৌন উদ্ভাবনই শেখাচ্ছে না—এর মাধ্যমে শেখাচ্ছে গভীরতর বিষয়। যেমন—কীভাবে অতীত ইতিহাসকে হারিয়ে ফেলতে হয়, কীভাবে ভবিষ্যেক দাবিয়ে রাখতে হয়, কীভাবে বর্তমানটাকেই মানিয়ে নিতে হয় আর কীভাবে বিদ্রোহ-বিপ্লবের কথা না বলে সাম্রাজ্যবাদী-পুঁজিবাদী কায়েমি স্বার্থের সেবায় জনগণের স্থিতিবস্থাটা অক্ষুণ্ন রাখতে হয়। সাম্রাজ্যবাদীদের মাস মিডিয়া নামের ভয়ানক যন্ত্রটির কলাকৌশলে এখন মুসলিম দুনিয়া তথা অপশ্চিমা জগতের মানুষদের অবস্থা এমন হয়ে দাঁড়িয়েছে যে, তারা তাদের সুপ্রাচীন সংস্কৃতি, ঐতিহ্য ও উন্নততর জীবনবোধকে জলাঞ্জলি দিয়ে পশ্চিমানুসারী হওয়ার স্বপ্নে বিভোর হয়ে উঠেছে। এই আত্মঘাতী প্রক্রিয়াটি অনুকরণ ছাড়া মাস মিডিয়া আমাদের বোঝাতে সমর্থ হয়েছে, আমরা সাবালক হয়ে উঠতে পারব না। এই প্রক্রিয়ায় অলক্ষ্যে পুঁজিতান্ত্রিক শিল্প সভ্যতাও এক গুরুতর সঙ্কটের মধ্যে পড়ে গেছে। একদিকে পশ্চিমা নাগরিকরা তাদের কাঙ্ক্ষিত স্বাধীনতা আর কনজুমারিজমের সীমাহীন উচ্চতায় আরোহণ করেছে; অন্যদিকে অপুঁজিবাদী দুনিয়ার মানুষেরা নিছক অনুকরণের স্রোতে ভেসে যাচ্ছে। কিন্তু এসবের সর্বগ্রাসী পশ্চাদ্ধাবন মানুষকে ভুলিয়ে দিয়েছে তার আত্মিক ও নৈতিক উন্নতির প্রয়োজনীয়তার বিষয়টি। সে ভুলে যাচ্ছে উচ্চতর মূল্যবোধ, আত্মত্যাগ ও বিশ্বাসের শক্তির কথাটা। এই আত্মঘাতী আত্মসর্বস্বতা পশ্চিমের মানুষকে পরিণত করেছে স্রেফ ত্বকে ঢাকা মাংসসর্বস্ব একটি দেহপিণ্ডে। সেজন্যই গণতন্ত্র ও সভ্যতার রাজধানী বলে কথিত পশ্চিমা জগতে অল্প সময়ের জন্য বাইরের আলো না থাকলে ভেতরের অন্ধকারের দাপাদাপিতে মুহূর্তের মধ্যে লুটতরাজ, খুন-জখম, নারী ধর্ষণের মতো তাণ্ডবলীলায় যে দোজখের আজাব নেমে আসে তাতেই প্রমাণ হয়, ‘সমৃদ্ধতম’ ও ‘আলোকিত’ এ সভ্যতার মানুষ এক দুরারোগ্য ব্যাধিতেও জরাজীর্ণ।
পশ্চিমা সভ্যতার সমস্যাটা তাহলে কোথায়? সেটা সোলঝেনিিসন তার বক্তৃতায় ইঙ্গিত দিয়েছেন। তার মতে, রেনেসাঁ ও শিল্প বিপ্লবের যে ইউরোপীয় ঘটনা; তা-ই সেখানকার মানুষকে আত্মাহীন দেহচর্চায় ডুবিয়ে দিয়েছে। উচ্চতর কোনো মূল্যবোধের কাছে কোনো জবাবদিহিতা না থাকায় তারা মনে করেছে, দেহসর্বস্ব মানুষটি হচ্ছে স্বয়ংসম্পূর্ণ। তাদের সেবায় গোটা দুনিয়ার সবকিছুই নতজানু হয়ে থাকবে।
সোলঝেনিিসন প্রশ্ন করেছেন : এ জগতে মানুষ যদি সুখের জন্যই জন্মে তাহলে সে মরে কেন? অন্তত পশ্চিমের মানুষেরা, সুখ যার ক্রমবর্ধমান, প্রাচুর্য যার ফল্গুধারার মতো প্রবাহমান?
২.
পশ্চিমের মানুষেরা নিজের বোধ-বুদ্ধিকে জলাঞ্জলি দিয়ে প্রচারযন্ত্রের নাচের পুতুলে পরিণত হয়েছে। প্রচারযন্ত্রের প্রচারণার নিরিখেই তারা জীবনের সবকিছু মাপতে চায়, তারা বুঝতে চায় কে কতখানি উন্নত বা অনুন্নত। প্রচারযন্ত্রই সাম্রাজ্যিক স্বার্থে তাদের মাথায় ঢুকিয়ে রেখেছে, অপশ্চিমা বিশ্বের মানুষেরা নিজেদের ভালোমন্দ বুঝতে পারে না। সুতরাং এদের সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও বাস্তবায়নে পশ্চিমের উন্নত মানুষদের সহায়তা জরুরি।
একটু উদাহরণ দেয়া যাক : চিলিতে সালভেদর আলেন্দের জনপ্রিয় সরকার ক্ষমতায় আসার পর বহুজাতিক কোম্পানি ও তার পাহারাদার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মাথা খারাপ হয়ে যায় এবং আলেন্দের সরকারকে উত্খাতের জন্য তারা সর্বস্ব পণ করে। চিলিতে মার্কিন হস্তক্ষেপের সপক্ষে নিক্সন সরকারের ভূমিকাকে আন্তর্জাতিক রাজনীতির তত্কালীন ‘গুডবয়’ হেনরি কিসিঞ্জারের উক্তিটি ‘কিংবদন্তি’ হয়ে আছে :
I Do not see why need to stand by and watch a country go communist due to the irresponsibility of its own people.
এরপর ১৯৭০ থেকে ’৭৩ পর্যন্ত চিলিতে যা ঘটেছে তা মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের ছক অনুযায়ী। আলেন্দে সরকারের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র এক মিডিয়াযুদ্ধ শুরু করে এবং সেই অপপ্রচারের তোড়ে আলেন্দে সরকার উত্খাতের জন্য চিলির মানুষের মনোগঠন সম্পন্ন হয়। শেষ পর্যন্ত মিলিটারি ক্যু’র মাধ্যমে আলেন্দে সরকারের অপমৃত্যু ঘটে। সমস্ত প্রক্রিয়াটি বাস্তবায়নে যুক্ত হয়েছিল বহুজাতিক পুঁজির অধিপতিরা, যারা মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের পক্ষে সাংস্কৃতিক ও মিডিয়ার যন্ত্রগুলো নিয়ন্ত্রণ করে। ক্যু পৃথিবীর কোথাও বিদেশি স্বার্থ ও এলিট শ্রেণীর স্বার্থের নামে হয় না। তা হয়ে থাকে নৈতিকতা, দেশপ্রেম, ঐতিহ্য, জাতিসত্তা এমনকি দুর্নীতির বিরুদ্ধে জেহাদের স্লোগান দিয়ে। এরকম উদাহরণ আমাদের দেশেও আছে। চিলিতেও সেরকম ঘটনা ঘটানো হয়েছিল। সেখানে বলা হয়েছিল, আলেন্দের লোকজন কমিউনিজমের নামে দেশটিকে এক অপসংস্কৃতির দিকে নিয়ে গেছে। বিশেষ করে আলেন্দের দল ক্ষমতায় থাকলে প্রথমে দেশে ঘটবে গৃহদাহ, রক্তস্নান, তারপর দেশটির সুপ্রাচীন সভ্যতারই বিনাশ ঘটে যাবে। এ অবস্থায় চিলির গৌরবময় ঐতিহ্য রক্ষা করতে মিলিটারি ক্যু’র কোনো বিকল্প আছে কি? এই প্রক্রিয়ায় যখন ক্যু ঘটেই যায় তখন সেটিকে কেউ প্রতিবিপ্লব বা মার্কিনি ষড়যন্ত্র বলবে না। সবাই মনে করবে, এ ধরনের ঘটনা অবধারিতই ছিল কিংবা এ হচ্ছে প্রকৃতির প্রতিশোধ! আমাদের স্মৃতি থেকে মুছে যায়নি এমন কিছু সাম্প্রতিক ঘটনা হচ্ছে ইরাক ও আফগানিস্তান। সাদ্দামকে খলনায়ক নির্মাণের আগে গণমারণাস্ত্র ভাণ্ডারের গল্পকাহিনী নিয়ে বুশ-ব্লেয়ার ও তাদের অনুগত মিডিয়া যেভাবে লাফিয়ে বেড়িয়েছে, তা পৃথিবীর মানুষ দেখেছে। গণধ্বংসের অস্ত্র জমা করার জন্য সাদ্দামের ইরাক বিপজ্জনক রাষ্ট্র হয়ে ওঠার গল্পটা যে কতখানি অন্তঃসারশুন্য তা এতদিনে সবাই হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছে। ওটা যে আগাগোড়াই মিথ্যা প্রচার ছিল, ইরাক আগ্রাসনের ছল বা অজুহাত ছিল—সেসব কথা আজ দিনের আলোর মতো পরিষ্কার। অথচ এই গল্পকাহিনীই আমাদের পশ্চিমা মিডিয়া বিশ্বাস করতে বাধ্য করেছে। আবার কমিউনিস্ট শয়তানদের সাম্রাজ্য থেকে মুক্তি দেয়ার পর ইসলামিক সন্ত্রাসবাদীদের মূর্খের স্বর্গটিকে রসাতলে পাঠিয়ে এ বিশ্বকে আমেরিকার শিশুদের বাসযোগ্য করে তোলার অঙ্গীকার পালন চলছে, চলবে। এখানেও সাম্রাজ্যবাদীদের মিডিয়ার ‘কর্তব্যপরায়ণতা’য় কোনো ভুল নেই।
স্পেকটার অব কমিউনিজমের পর পশ্চিমা মিডিয়া স্পেকটার অব ইসলামের বিরুদ্ধে লড়াই শুরু করেছে। নোয়াম চমস্কি ঠিকই বলেছেন। কমিউনিজমের পর সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধের আড়ালে ইসলামবিরোধিতাকে পশ্চিমা জগত আজ জাতীয় ধর্মে পরিণত করে ফেলেছে। স্বাভাবিকভাবেই পশ্চিমের প্রযুক্তি শাসিত শক্তিশালী মিডিয়া পুঁজিবাদ সাম্রাজ্যবাদের একান্ত অনুগত খেদমতগার হিসেবে ইসলামকেই এই মুহূর্তে তার বড় শত্রু হিসেবে নিশানা করেছে।
কমিউনিজমের পতনের পর ইসলামকে এই নিশানা করা কেন? কারণ এটি একটি সুগঠিত মতাদর্শ। এটি কর্পোরেট পুঁজিকে সমর্থন করে না। সমর্থন করে না বাজার অর্থনীতি, বিশ্বায়নের নামে নতুন কালের অর্থনৈতিক শোষণের দাপাদাপি। পশ্চিমের অবাধ কনজুমারিজম, ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবা
অর্থনৈতিক সাম্রাজ্যবাদ নামক ভিন্ন সংস্করণে যদিও আধিপত্য আরোপিত হয় অর্থনীতির সূত্রে, তথাপি এটি সামরিক সহায়তা ছাড়া সচরাচর টিকতে পারে না। আজকে কর্পোরেট পুঁজির বহুজাতিক সাম্রাজ্যবাদকে নিরাপদ রাখতে দেশে দেশে কীভাবে মার্কিন বাহিনী হামলে পড়েছে, তা আর নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে না।
সাম্রাজ্যবাদের সূক্ষ্ম রূপটি হচ্ছে সাংস্কৃতিক ও মিডিয়া সাম্রাজ্যবাদ। দুটোই পরস্পরের অনুঘটক। এই প্রক্রিয়ায় পূর্বতন মডেলগুলোর অস্বস্তিকর পরিস্থিতিগুলোর গুণগত উন্নতি ঘটিয়ে সাম্রাজ্যবাদীরা স্বস্তির সঙ্গে পররাজ্য লুণ্ঠন ও শোষণের ক্ষেত্র তৈরি করে। সাংস্কৃতিক মডেলটিতে সাংস্কৃতিক দীক্ষার মাধ্যমে একদল সুবিধাভোগী শ্রেণীকে সাঙ্গাত বানানো হয় এবং তাদের হাতে পোশাকি স্বাধীনতাটুকু ন্যস্ত করে সাম্রাজ্যবাদীরা স্বীয় রাষ্ট্রে বসে কলকাঠি নাড়ে। মেকলের ভাষায়, ‘কালা সাহেব’রূপী এই সুবিধাভোগী শ্রেণী সাম্রাজ্যবাদীদের সঙ্গে অভিন্ন রুচি ও সংস্কৃতির বন্ধনে আবদ্ধ। এরাই সাম্রাজ্যবাদের সব রকমের স্বার্থ দেখভাল করে।
এই প্রক্রিয়াটি স্থায়ী করার জন্য এবং উপনিবেশিত জনগণ যাতে তার আপন সাংস্কৃতিক সত্তাটি খুঁজে না পায় সেজন্যই প্রবর্তিত হয়েছে মিডিয়া সাম্রাজ্যবাদ। এটি উন্নত প্রযুক্তিনির্ভর বিভিন্ন রকম গণপ্রচার মাধ্যমের সাহায্যে বিভ্রান্তি, আকথা-কুকথা ছড়িয়ে উপনিবেশিত জনগণের মনকে আচ্ছন্ন করে রাখে এবং নানা রকম মিসইনফরমেশন ও ডিসইনফেরমেশন সৃষ্টি করে এক ধূম্রজাল তৈরি করে। এর উদ্দেশ্য হচ্ছে উপনিবেশিত জনগণকে এমনভাবে ঘুম পাড়িয়ে রাখা যাতে সে আত্মআবিষ্কারের সুযোগে সাম্রাজ্যবাদীদের মুখাপেক্ষিতার জাল কেটে বেরিয়ে না আসতে পারে। আগের দিনের সাম্রাজ্যবাদীরা প্রচার করত ডযরঃব গবহ্থং ইঁত্ফবহ-সাদা মানুষের দায়। মানে সাম্রাজ্যবাদীরা হতভাগ্য জাতিটিকে বড়ই দয়াপরবশ হয়ে তার অসভ্যতার অন্ধকার থেকে রাষ্ট্রের সভ্যতার আলোতে উঠিয়ে আনার চেষ্টা করছে। সেজন্য সাম্রাজ্যবাদ দরকার, কারণ এটি এক মহতী মিশন অর্জনের চেষ্টা করছে। এখন সাম্রাজ্যবাদীরা বলছে ফ্রিডম, ডেমোক্রেসির কথা। এর জন্য ইরাকে, আফগানিস্তানে খুন-গণহত্যা সব জায়েজ হয়ে গেছে। স্বাধীনতা, গণতন্ত্র, মুক্তির সংগ্রামে নেটিভদের একটু রক্তপাত তো হবেই।
উপরোক্ত পটভূমিতে মিডিয়া সাম্রাজ্যবাদকে আমাদের বুঝতে হবে, যার কাজ হচ্ছে গণবশীকরণ। সোভিয়েত ঔপন্যাসিক আলেক্সান্ডার সোলঝেনিিসন পশ্চিমে নির্বাসিত জীবনে থাকার সময় হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি বক্তৃতা দিয়েছিলেন। সেই বক্তৃতাটি পরে হার্ভার্ড ম্যাগাজিনে The Exhausted West শিরোনামে বেরিয়েছিল। এখানে তিনি সভ্যতার ভেকধারী পশ্চিমা বিশ্বের উদ্দেশে কিছু অসাধারণ কথা বলেছিলেন। সবকিছুর মধ্যে সোলঝেনিিসন সেখানকার সবচেয়ে শক্তিধর ও ক্ষতিকর হিসেবে চিহ্নিত করেছিলেন পশ্চিমের স্বাধীনতার চরম অসদ্ব্যবহারকারী মিডিয়া নামের দৈত্যটিকে। লেজিসলেচার, প্রশাসন এবং বিচার বিভাগের চেয়েও পশ্চিমের এই শক্তিশালী মিডিয়াকে তিনি নিজ দেশের চরম স্বৈরতন্ত্রী স্ট্যালিনের তুলনায় অধিক ভয়ঙ্কর ডিক্টেটর হিসেবে চিহ্নিত করেছিলেন।
গুলাগ আরকিপেলাগো ও ফাস্ট সার্কেলের স্রষ্টা এই ঔপন্যাসিক তখন প্রশ্ন করেছিলেন : পশ্চিমা সাংবাদিকটি কোন আইনের বলে নির্বাচিত হন, তিনি কার কাছে দায়বদ্ধ, কে তাকে ক্ষমতা দান করে, কতটুকু অধিকারসহ এবং কত সময়ের জন্য!
সোলঝেনিিসন বিস্ময় প্রকাশ করেছেন, যদি এই সাংবাদিক নামের বিশেষ মানুষটির ক্ষমতার উত্স হয় পশ্চিমের ব্যক্তিস্বাধীনতা, বাকস্বাধীনতা প্রভৃতি বস্তু; তাহলে আসল সত্যটা হলো পশ্চিমা সাংবাদিকের আর যা কিছু থাকুক স্বাধীনতা বলে কিছু নেই। পশ্চিমা মাস মিডিয়া মানে চলতি ফ্যাশন, উঠতি হুজুগ এবং ব্যবসায়িক চাহিদার দাসানুদাস। সেখানকার কর্পোরেট পুঁজিপতিরা সবরকমের মিডিয়াকে নিয়ন্ত্রণ করে এবং তাদের রুচি, গরজ ও মুনাফার প্রয়োজনে এসব গণমাধ্যম গণচাহিদার সৃষ্টি করে। একটা কথা বোঝা দরকার, পশ্চিমে মিডিয়ার স্বাধীনতা কথাটা সেখানকার পুঁজিপতিদের বাণিজ্যিক ও মতাদর্শিক স্বার্থকে রক্ষা করেই কার্যকর হয়।
পশ্চিমের আর একজন পণ্ডিত নোয়াম চমস্কি তার গধহঁভধপঃঁত্রহম ঈড়হংবহঃ বইতেও সেখানকার মিডিয়াকে স্রেফ মুনাফানির্ভর হিসেবে উল্লেখ করেছেন। তার কথা হচ্ছে, পশ্চিমা গণমাধ্যমগুলো সেখানকার বড় বড় পুঁজিপতিরা নিয়ন্ত্রণ করে এবং এর দ্বারা তারা বিপুল পরিমাণ মুনাফা হাতিয়ে নেয়। তথ্য পরিবেশনের ক্ষেত্রে তাই এসব গণমাধ্যম যথার্থতা রাখতে পারে না। তথ্যের ধরন, গুণাগুণ, পরিবেশন কৌশল সবটাই মুনাফার প্রয়োজন অনুসারে নির্ধারিত হয় এবং তাতে জনস্বার্থ বিপন্ন হয়। ফলে যারা তথ্যের ক্ষেত্রে যথার্থতা রাখতে চায় তারা এসব কর্পোরেট টাইকুনদের সামনে টিকে থাকতে পারে না। এর ফল হচ্ছে, গণমতের প্রতিনিধিত্বকারী বলে পরিচিত এসব গণমাধ্যমে জনমত উচ্চারিত হয় না। বরং বিশেষ কায়দা ও কৌশলে এসব তথাকথিত গণকণ্ঠ থেকে উচ্চারিত মতামতই জনমত হিসেবে বিবেচিত হয়। এই প্রেক্ষাপটে প্রকৃত জনমত রুদ্ধ হয়ে যায়, উচ্চারিত ও প্রকাশিত হওয়ার সুযোগ পায় না। যোগ্য ব্যক্তি তার যোগ্যতা অনুযায়ী সমাজে ভূমিকা রাখতে পারে না। কারণ সমাজ রূপান্তরের সব যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও মিডিয়া তাকে স্থান দেয় না। এই কারণে দেশও তাকে শুনতে পায় না। তার পণ্যটি মূল্যবান হলেও মিডিয়া সামাজিক, বাণিজ্যিক ও মতাদর্শিক স্বার্থে যে গণচাহিদার সৃষ্টি করে, সেই খাদ্য তালিকায় তার পণ্যটির কোনো বিক্রয়মূল্য থাকে না। জনমতের ভান ধরে মিডিয়া প্রকৃতপক্ষে জনমতকে বিভ্রান্ত করে। সে খুনিকে বানায় নায়ক, নায়ককে বানায় খুনি। প্রচার মাধ্যমই নির্ধারণ করে দেয় কোনটা ভালো, কোনটা মন্দ। পণ্যের অন্তর্গত বৈশিষ্ট্যটি হয়ে পড়ে মূল্যহীন। আপনার-আমার প্রয়োজন আমি বা আপনি নির্ধারণ করতে পারি না। ওটা মিডিয়াই করে দেয়। তেমনি কে গায়ক, কে নায়ক, কে লেখক, কে নেতা, কে বরণীয়, কে উপেক্ষণীয়—তাও ঠিক করে দিচ্ছে গণমাধ্যম নামক ভয়ানক বস্তুটি। আপনাকে কেবল ডাক্তারের পরমার্শ মতো চোখ বুজে ওষুধ খেতে হবে এবং মন্ত্রজ্ঞানে নিদানগুলো মনেপ্রাণে গ্রহণ করতে হবে।
মিডিয়ার এই মাজেজার কারণ হলো প্রযুক্তির অসাধারণ বিকাশ। এই প্রযুক্তির ওপর ভর করে পুরো পাশ্চাত্য সভ্যতা (তাদের অনুকরণে আমরাও) এখন পণ্যভোজী সমাজ থেকে তথ্যভোজী সামজে পরিণত হয়েছে। তথ্যভোজনও এক ধরনের ভোজন—যেমন বিনোদন, কালক্ষেপণ ইত্যাদি। পাঠ মাধ্যম শ্রুতি মাধ্যমের (Textual and Audio Media) চেয়ে এখন দৃষ্টি মাধ্যম (Visual Media) বহুগুণে শক্তিশালী।
ডিশ অ্যান্টিনার কল্যাণে এখন বেশুমার টিভি চ্যানেল, কেবল টিভি, ভিসিপি, ভিসিআর ইত্যাদি ছাড়াও আরও কত কী আমাদের স্নায়ুকে অষ্টপ্রহর উত্তেজিত করে চলেছে। এসব তথাকথিত মাসমিডিয়া নামের ঝুড়িতে আছে কমিক স্ট্রিপ, সোপ অপেরা, ওয়েস্টার্ন, মালটিমিডিয়া সমর্থিত লাভ সং আর হরর মুভি। এসব দেখতে দেখতে এখন পশ্চিমা মানুষের মতো আমাদের এখানকার কারও কারও অবস্থা ফাঁপা বেলুনে পরিণত হয়েছে। ব্যক্তিস্বাধীনতার অবাধ চর্চার ঠেলায় এখন সমাজই রীতিমত অসহায়। মানবাধিকার চর্চার শেষ নেই। অথচ মানবিক মূল্যবোধ বলে যা কিছু তা কিন্তু উবে যাচ্ছে। পুঁজিতান্ত্রিক শিল্প সভ্যতা তাদের মাসমিডিয়া নামক শিল্প-কারখানায় যেসব গল্প, কাহিনী, অপেরা, সিনেমা, নাটক, থিয়েটার তৈরি করে; তাই কিন্তু একালের মানুষের মন-মনন-বুদ্ধিমত্তার প্রাথমিক বুনিয়াদ তৈরি করে। এসব কিছুর গণসম্প্রচার একালের নৈতিক দারিদ্র্য, লঘু চরিত্র ও আত্মস্বার্থপরতার জন্য দায়ী। এসব বিনোদনের নামে চালু মাস প্রডাক্টগুলো কিন্তু এক ধরনের গোপন দীক্ষাদান কর্মসূচিও বটে। কমিক স্ট্রিপ, টিভি মুভি, ম্যাগাজিন, ভিসিপি, ভিসিআর, কম্পিউটার গেমস প্রভৃতি শুধু বাইরে থেকে অভিনব ফ্যাশন, সহিংসতা, যৌন উদ্ভাবনই শেখাচ্ছে না—এর মাধ্যমে শেখাচ্ছে গভীরতর বিষয়। যেমন—কীভাবে অতীত ইতিহাসকে হারিয়ে ফেলতে হয়, কীভাবে ভবিষ্যেক দাবিয়ে রাখতে হয়, কীভাবে বর্তমানটাকেই মানিয়ে নিতে হয় আর কীভাবে বিদ্রোহ-বিপ্লবের কথা না বলে সাম্রাজ্যবাদী-পুঁজিবাদী কায়েমি স্বার্থের সেবায় জনগণের স্থিতিবস্থাটা অক্ষুণ্ন রাখতে হয়। সাম্রাজ্যবাদীদের মাস মিডিয়া নামের ভয়ানক যন্ত্রটির কলাকৌশলে এখন মুসলিম দুনিয়া তথা অপশ্চিমা জগতের মানুষদের অবস্থা এমন হয়ে দাঁড়িয়েছে যে, তারা তাদের সুপ্রাচীন সংস্কৃতি, ঐতিহ্য ও উন্নততর জীবনবোধকে জলাঞ্জলি দিয়ে পশ্চিমানুসারী হওয়ার স্বপ্নে বিভোর হয়ে উঠেছে। এই আত্মঘাতী প্রক্রিয়াটি অনুকরণ ছাড়া মাস মিডিয়া আমাদের বোঝাতে সমর্থ হয়েছে, আমরা সাবালক হয়ে উঠতে পারব না। এই প্রক্রিয়ায় অলক্ষ্যে পুঁজিতান্ত্রিক শিল্প সভ্যতাও এক গুরুতর সঙ্কটের মধ্যে পড়ে গেছে। একদিকে পশ্চিমা নাগরিকরা তাদের কাঙ্ক্ষিত স্বাধীনতা আর কনজুমারিজমের সীমাহীন উচ্চতায় আরোহণ করেছে; অন্যদিকে অপুঁজিবাদী দুনিয়ার মানুষেরা নিছক অনুকরণের স্রোতে ভেসে যাচ্ছে। কিন্তু এসবের সর্বগ্রাসী পশ্চাদ্ধাবন মানুষকে ভুলিয়ে দিয়েছে তার আত্মিক ও নৈতিক উন্নতির প্রয়োজনীয়তার বিষয়টি। সে ভুলে যাচ্ছে উচ্চতর মূল্যবোধ, আত্মত্যাগ ও বিশ্বাসের শক্তির কথাটা। এই আত্মঘাতী আত্মসর্বস্বতা পশ্চিমের মানুষকে পরিণত করেছে স্রেফ ত্বকে ঢাকা মাংসসর্বস্ব একটি দেহপিণ্ডে। সেজন্যই গণতন্ত্র ও সভ্যতার রাজধানী বলে কথিত পশ্চিমা জগতে অল্প সময়ের জন্য বাইরের আলো না থাকলে ভেতরের অন্ধকারের দাপাদাপিতে মুহূর্তের মধ্যে লুটতরাজ, খুন-জখম, নারী ধর্ষণের মতো তাণ্ডবলীলায় যে দোজখের আজাব নেমে আসে তাতেই প্রমাণ হয়, ‘সমৃদ্ধতম’ ও ‘আলোকিত’ এ সভ্যতার মানুষ এক দুরারোগ্য ব্যাধিতেও জরাজীর্ণ।
পশ্চিমা সভ্যতার সমস্যাটা তাহলে কোথায়? সেটা সোলঝেনিিসন তার বক্তৃতায় ইঙ্গিত দিয়েছেন। তার মতে, রেনেসাঁ ও শিল্প বিপ্লবের যে ইউরোপীয় ঘটনা; তা-ই সেখানকার মানুষকে আত্মাহীন দেহচর্চায় ডুবিয়ে দিয়েছে। উচ্চতর কোনো মূল্যবোধের কাছে কোনো জবাবদিহিতা না থাকায় তারা মনে করেছে, দেহসর্বস্ব মানুষটি হচ্ছে স্বয়ংসম্পূর্ণ। তাদের সেবায় গোটা দুনিয়ার সবকিছুই নতজানু হয়ে থাকবে।
সোলঝেনিিসন প্রশ্ন করেছেন : এ জগতে মানুষ যদি সুখের জন্যই জন্মে তাহলে সে মরে কেন? অন্তত পশ্চিমের মানুষেরা, সুখ যার ক্রমবর্ধমান, প্রাচুর্য যার ফল্গুধারার মতো প্রবাহমান?
২.
পশ্চিমের মানুষেরা নিজের বোধ-বুদ্ধিকে জলাঞ্জলি দিয়ে প্রচারযন্ত্রের নাচের পুতুলে পরিণত হয়েছে। প্রচারযন্ত্রের প্রচারণার নিরিখেই তারা জীবনের সবকিছু মাপতে চায়, তারা বুঝতে চায় কে কতখানি উন্নত বা অনুন্নত। প্রচারযন্ত্রই সাম্রাজ্যিক স্বার্থে তাদের মাথায় ঢুকিয়ে রেখেছে, অপশ্চিমা বিশ্বের মানুষেরা নিজেদের ভালোমন্দ বুঝতে পারে না। সুতরাং এদের সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও বাস্তবায়নে পশ্চিমের উন্নত মানুষদের সহায়তা জরুরি।
একটু উদাহরণ দেয়া যাক : চিলিতে সালভেদর আলেন্দের জনপ্রিয় সরকার ক্ষমতায় আসার পর বহুজাতিক কোম্পানি ও তার পাহারাদার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মাথা খারাপ হয়ে যায় এবং আলেন্দের সরকারকে উত্খাতের জন্য তারা সর্বস্ব পণ করে। চিলিতে মার্কিন হস্তক্ষেপের সপক্ষে নিক্সন সরকারের ভূমিকাকে আন্তর্জাতিক রাজনীতির তত্কালীন ‘গুডবয়’ হেনরি কিসিঞ্জারের উক্তিটি ‘কিংবদন্তি’ হয়ে আছে :
I Do not see why need to stand by and watch a country go communist due to the irresponsibility of its own people.
এরপর ১৯৭০ থেকে ’৭৩ পর্যন্ত চিলিতে যা ঘটেছে তা মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের ছক অনুযায়ী। আলেন্দে সরকারের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র এক মিডিয়াযুদ্ধ শুরু করে এবং সেই অপপ্রচারের তোড়ে আলেন্দে সরকার উত্খাতের জন্য চিলির মানুষের মনোগঠন সম্পন্ন হয়। শেষ পর্যন্ত মিলিটারি ক্যু’র মাধ্যমে আলেন্দে সরকারের অপমৃত্যু ঘটে। সমস্ত প্রক্রিয়াটি বাস্তবায়নে যুক্ত হয়েছিল বহুজাতিক পুঁজির অধিপতিরা, যারা মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের পক্ষে সাংস্কৃতিক ও মিডিয়ার যন্ত্রগুলো নিয়ন্ত্রণ করে। ক্যু পৃথিবীর কোথাও বিদেশি স্বার্থ ও এলিট শ্রেণীর স্বার্থের নামে হয় না। তা হয়ে থাকে নৈতিকতা, দেশপ্রেম, ঐতিহ্য, জাতিসত্তা এমনকি দুর্নীতির বিরুদ্ধে জেহাদের স্লোগান দিয়ে। এরকম উদাহরণ আমাদের দেশেও আছে। চিলিতেও সেরকম ঘটনা ঘটানো হয়েছিল। সেখানে বলা হয়েছিল, আলেন্দের লোকজন কমিউনিজমের নামে দেশটিকে এক অপসংস্কৃতির দিকে নিয়ে গেছে। বিশেষ করে আলেন্দের দল ক্ষমতায় থাকলে প্রথমে দেশে ঘটবে গৃহদাহ, রক্তস্নান, তারপর দেশটির সুপ্রাচীন সভ্যতারই বিনাশ ঘটে যাবে। এ অবস্থায় চিলির গৌরবময় ঐতিহ্য রক্ষা করতে মিলিটারি ক্যু’র কোনো বিকল্প আছে কি? এই প্রক্রিয়ায় যখন ক্যু ঘটেই যায় তখন সেটিকে কেউ প্রতিবিপ্লব বা মার্কিনি ষড়যন্ত্র বলবে না। সবাই মনে করবে, এ ধরনের ঘটনা অবধারিতই ছিল কিংবা এ হচ্ছে প্রকৃতির প্রতিশোধ! আমাদের স্মৃতি থেকে মুছে যায়নি এমন কিছু সাম্প্রতিক ঘটনা হচ্ছে ইরাক ও আফগানিস্তান। সাদ্দামকে খলনায়ক নির্মাণের আগে গণমারণাস্ত্র ভাণ্ডারের গল্পকাহিনী নিয়ে বুশ-ব্লেয়ার ও তাদের অনুগত মিডিয়া যেভাবে লাফিয়ে বেড়িয়েছে, তা পৃথিবীর মানুষ দেখেছে। গণধ্বংসের অস্ত্র জমা করার জন্য সাদ্দামের ইরাক বিপজ্জনক রাষ্ট্র হয়ে ওঠার গল্পটা যে কতখানি অন্তঃসারশুন্য তা এতদিনে সবাই হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছে। ওটা যে আগাগোড়াই মিথ্যা প্রচার ছিল, ইরাক আগ্রাসনের ছল বা অজুহাত ছিল—সেসব কথা আজ দিনের আলোর মতো পরিষ্কার। অথচ এই গল্পকাহিনীই আমাদের পশ্চিমা মিডিয়া বিশ্বাস করতে বাধ্য করেছে। আবার কমিউনিস্ট শয়তানদের সাম্রাজ্য থেকে মুক্তি দেয়ার পর ইসলামিক সন্ত্রাসবাদীদের মূর্খের স্বর্গটিকে রসাতলে পাঠিয়ে এ বিশ্বকে আমেরিকার শিশুদের বাসযোগ্য করে তোলার অঙ্গীকার পালন চলছে, চলবে। এখানেও সাম্রাজ্যবাদীদের মিডিয়ার ‘কর্তব্যপরায়ণতা’য় কোনো ভুল নেই।
স্পেকটার অব কমিউনিজমের পর পশ্চিমা মিডিয়া স্পেকটার অব ইসলামের বিরুদ্ধে লড়াই শুরু করেছে। নোয়াম চমস্কি ঠিকই বলেছেন। কমিউনিজমের পর সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধের আড়ালে ইসলামবিরোধিতাকে পশ্চিমা জগত আজ জাতীয় ধর্মে পরিণত করে ফেলেছে। স্বাভাবিকভাবেই পশ্চিমের প্রযুক্তি শাসিত শক্তিশালী মিডিয়া পুঁজিবাদ সাম্রাজ্যবাদের একান্ত অনুগত খেদমতগার হিসেবে ইসলামকেই এই মুহূর্তে তার বড় শত্রু হিসেবে নিশানা করেছে।
কমিউনিজমের পতনের পর ইসলামকে এই নিশানা করা কেন? কারণ এটি একটি সুগঠিত মতাদর্শ। এটি কর্পোরেট পুঁজিকে সমর্থন করে না। সমর্থন করে না বাজার অর্থনীতি, বিশ্বায়নের নামে নতুন কালের অর্থনৈতিক শোষণের দাপাদাপি। পশ্চিমের অবাধ কনজুমারিজম, ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবা
No comments