চীন-ভারত সম্পর্ক ও আমাদের অবস্থান by প্রকৌশলী এস এম ফজলে আলী
চীন-ভারত এশিয়া মহাদেশের দুটি বৃহত্ দেশ। চীন-ভারত উভয় দেশ প্রায় সমসাময়িক সময়ে বিদেশি দখলমুক্ত হয়। ভারত ১৯৪৭ সালে স্বাধীনতা পায়। আর চীন ১৯৪৯ সালে চিয়াং কাইশেকের অপশাসন থেকে কমরেড মাও সেতুং-এর নেতৃত্বে মুক্ত হয়।
এদিকে পাক-ভারত উপমহাদেশে দু’শ’ বছর ধরে ব্রিটিশ রাজের দমন-শোষণমূলক শাসন চলছিল। সংগ্রাম ও আন্দোলনের মধ্য দিয়ে এ উপমহাদেশ স্বাধীনতা পায় এবং পাকিস্তান ও ভারত নামে দুটি রাষ্ট্র বিশ্ব ম্যাপে স্থান করে নেয়। সেই সময় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়া বিশ্বে আধিপত্য বিস্তারের জন্য দুটি ব্লকে বিভক্ত হয়ে যায়। তারা জোটভুক্ত দেশ ছাড়া অন্যান্য দেশের ওপর বিভিন্নভাবে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক শোষণ-উত্পীড়ন করতে থাকে। সদ্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত ৫টি দেশের তখনকার অত্যন্ত প্রথিতযশা নেতারা এই দুই ব্লকের বাইরে থেকে একটি নন-এলাইন জোটের চিন্তা করেন। তারা হলেন চীনের মাও সেতুং ও চৌএনলাই, ইন্দোনেশিয়ার সুকর্ণ, ভারতের নেহরু, মিসরের জামাল নাসের ও তখনকার সংযুক্ত যুগোস্লাভিয়ার মার্শাল টিটো। তারা বিশ শতকের ষাট দশকে ওই দুই ব্লকের বাইরের দেশগুলো নিয়ে নন-এলাইন মুভমেন্ট শুরু করেন। ১৯৫৩ সালে ইন্দোনেশিয়ার বান্দুং শহরে এই জোটমুক্ত রাষ্ট্রগুলোর প্রথম সম্মেলন হয়। এতে ৯৩টি রাষ্ট্র জোগ দেয়। এর প্রধান ভূমিকায় ছিলেন সুকর্ণ, চৌ এন লাই, নেহরু, নাসের ও টিটো। এই জোটমুক্ত আন্দোলন বেশ বেগবান হতে থাকে। তার সঙ্গে চীন-ভারত সম্পর্কও অত্যন্ত মধুর হতে থাকে। তখন দুই দেশের স্লোগান ছিল নেহরু-চৌএনলাই ভাই ভাই।
এর মধ্যে তিব্বতে রাজনৈতিক পটপরিবর্তন হয়। তিব্বতের কমিউনিস্টরা রাজনৈতিক ক্ষমতা দখল করে নেয়। তখনকার তিব্বতের ধর্মগুরু ও শাসক দালাইলামা ভারতে পালিয়ে আসেন। চীন সরকার তিব্বতের নতুন কমিউনিস্ট সরকারকে সমর্থন ও তিব্বতের উন্নয়নের জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ নিতে শুরু করে। এতে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নেহরু খুবই নাখোশ হন। তিনি দালাইলামাকে শুধু আশ্রয়ই দেননি দালাইলামার অনুগত লোকদের সামরিক ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা করেন। তারা ভারত এবং তিব্বতের বর্ডারে গুপ্ত হামলা চালাতে থাকে। এতে চীনের সঙ্গে ভারতের তিক্ততা বাড়তে থাকে। চীন ভারতের কাছে দাবি করে দালাইলামাকে তিব্বতে ফেরত পাঠানো হোক। কিন্তু নেহরু সে অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করেন। তার ভয় ছিল কোনো সময় হয়তো চীন ভারত সীমান্তে আক্রমণ করবে। তিক্ততা দুই দেশের মধ্যে এমন পর্যায় পৌঁছে যে, চীন তিব্বত ও ভারতের মধ্যের ডুরান্ড লাইন অস্বীকার করে বলে যে তিব্বতের বহু অঞ্চল ভারতের দখলে আছে। এর তেমন কোনো সুরাহা না হওয়ায় চীন ১৯৬২ সালে পুরো ভারত-তিব্বত সীমান্তে সৈন্য সমাবেশ করে এবং লাদাখসহ ভারতের অনেক এলাকা দখল করে নেয়। জোটমুক্ত আন্দোলনের ফলে চীন-ভারত যে মধুচন্দ্রিমা গড়ে উঠছিল তা বুদবুদের মতো উবে গেল। দুটি দেশ চরম শত্রুভাবাপন্ন হয়ে গেল। দীর্ঘ ৪০ বছরেও এর কোনো সমাধান হয়নি। তবে এর মধ্যে বিশ্বের অর্থনীতির গতিধারার অনেক পরিবর্তন হয়েছে। তাই দুই দেশেই আদর্শিক বৈপরিত্ব থাকলেও অর্থনৈতিক যোগাযোগ শুরু করে এবং তাতে কিছুটা সফলতাও আসে। চীনের সঙ্গে ভারত বেশ ব্যবসা-বাণিজ্য শুরু করে।
ভারতে কংগ্রেস সরকার ক্ষমতায় এসেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে তার সম্পর্ক গভীর থেকে গভীরতর করতে শুরু করে। তারা রাশিয়া-চীন থেকে মুখ ফিরিয়ে মার্কিনমুখি হয়ে পড়ে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভারতকে প্রচুর আর্থিক সহায়তা ও সামরিক সরঞ্জাম দিয়ে যাচ্ছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নীতি হলো যেসব রাষ্ট্র আন্তর্জাতিক পারমাণবিক শক্তি কমিশনের সঙ্গে যুক্ত না হবে, তাদের পারমাণবিক কোনো সহায়তা দেবে না। কিন্তু ভারত সে চুক্তিতে যুক্ত না হয়েও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে সর্বশেষ আণবিক অস্ত্র ও প্রযুক্তিসহ সব ধরনের সরঞ্জাম পাচ্ছে। এর বিবিধ কারণ আছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র দেখছে চীন দ্রুত অর্থনৈতিক ও সামরিক দিক থেকে শক্তিশালী হয়ে উঠছে। তাকে ঠেকাতে হলে এ অঞ্চলে ভারতই তাদের জন্য যথার্থ দেশ। তাই আন্তর্জাতিক আইন অমান্য করেই ভারতকে পারমাণবিক চুল্লি, জ্বালানি ও সামরিক যন্ত্রপাতি দিয়ে যাচ্ছে। উদ্দেশ্য ভারত শক্তিশালী হয়ে চীনকে যাতে প্রতিহত করতে পারে। আর ভারত দেখল এই তার মোক্ষম সুযোগ, সেনাবাহিনীকে শক্তিশালী করে চীন তার যে ভূমি দখল করেছে তা পুনরুদ্ধারের প্রচেষ্টা চালাবে। ইতোমধ্যে চীন আবার ভারতের অরুণাচল প্রদেশকে তিব্বতের অংশ বলে দাবি করেছে। অর্থাত্ তা এখন চীনেরই অংশ বলে তারা মনে করে। কারণ, তিব্বত আগেই চীনের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। কিছুদিন আগে দালাইলামা অরুণাচল প্রদেশে সফরে গিয়েছিলেন। চীন ভারতের কাছে এর ঘোর প্রতিবাদ জানিয়েছিল। এমনকি ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং অরুণাচল প্রদেশে সফরে যাওয়ার পরিকল্পনা করলে তাতেও চীন আপত্তি জানায়। এতে স্পষ্ট হয়ে যাচ্ছে চীন-ভারত এখন এক কঠিন সময় অতিবাহিত করছে।
বাংলাদেশ একটি ক্ষুদ্র রাষ্ট্র। তার অর্থনৈতিক অবস্থাও ভালো না। আজও আমরা বিশ্বের অনুন্নত ৪০টি রাষ্ট্রের মধ্যে একটি। অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক কোন্দলের কারণে দেশটি অর্থনৈতিকভাবে সামনের দিকে এগুতে পারছে না। প্রতিবেশী রাষ্ট্র হিসেবে বিভিন্ন কারণে আমাদের উন্নয়ন-অবনয়ন ভারতের কারণেই হচ্ছে। এটা স্বীকার করতে হয়, আমাদের স্বাধীনতার সময় প্রায় ১ কোটি দেশত্যাগী লোককে আশ্রয় দিয়েছিল ভারত। স্বাধীনতা যুদ্ধে ভারত সেকেন্ড লাইনে থেকে সহায়তা দিয়েছে। আসল যুদ্ধ করেছে ফ্রন্ট লাইনে আমাদের মুক্তি সেনার। ত্রিশ লাখ লোকের রক্তের বিনিময়ে এ দেশের স্বাধীনতা এসেছে। বলতে গেলে এক সাগর রক্তের বিনিময়ে আমরা স্বাধীনতা অর্জন করেছি।
ভারত শুধু আমাদের স্বার্থে পাকিস্তানের সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত হয়নি। এর আগে ভারত পাকিস্তানের সঙ্গে দু’বার যুদ্ধে লিপ্ত হয়েও পিছু হটতে বাধ্য হয়। তাই ভারত অপেক্ষায় থাকে কখন সুযোগ আসে, পাকিস্তানকে ঘায়েল করা যায়। সে সুযোগ আসে যখন পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ পাঞ্জাবিদের দ্বারা শোষিত হওয়ায় পশ্চিম পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ শুরু করে এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করে। পাকিস্তানকে দুই টুকরো করতে পারায় ভারতের রাজনৈতিক ও নৈতিক বিজয় হয়। এতে করে পাকিস্তান স্বাভাবিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়ে। শক্তির দিক দিয়ে সে ভারতের সমকক্ষতা হারায়। এটা উপমহাদেশে ভারতের মহাবিজয়। তাই ভারত শুধু আমাদের স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ করছে তা নয়। এ দেশের একশ্রেণীর ভারতঘেঁষা আতেল আছেন, যারা আমাদের স্বাধীনতার জন্য ভারত বন্দনায় সদা-ব্যস্ত; তারা জ্ঞানপাপী। ভারতে বৃষ্টি হলে ঢাকায় ছাতি ঘোরায়।
কিন্তু ভারত স্বাধীনতার পর থেকেই বাংলাদেশের সঙ্গে সত্প্রতিবেশী হিসেবে আচরণ করছে না। তারা বাংলাদেশকে তাদের একটি করদ রাজ্য হিসেবে ব্যবহার করে আসছে। যুদ্ধের পরপরই তারা এদেশ থেকে সামরিক শিল্প ও অফিসের হাজার হাজার কোটি টাকার সরঞ্জাম ও মালামাল লুট করে নেয়। দেশের বাজার একচেটিয়াভাবে দখল করে ভারতের পণ্যে সয়লাব করে দেয়। তারা আমাদের ছিটমহল (প্রায় ১৫০ বর্গকিলোমিটার) বেরুবাড়ী চুক্তির বিনিময় নিয়ে গেলেও আমাদের ছিটমহল আঙ্গরপোতা-দহগ্রামের সংযোগ করিডোর মাত্র ১৮৫–১৭৮ মিটার আজ পর্যন্ত বুঝিয়ে দেয়নি। ফারাক্কা চুক্তি করেও শুষ্ক মৌসুমে চুক্তি মোতাবেক আমাদের পানি দিচ্ছে না। তারা গঙ্গা নদীর উজানে ৩০টির বেশি মিনি ফারাক্কা বাঁধ দিয়ে গঙ্গার প্রায় সব পানি প্রত্যাহার করে নিচ্ছে। ফলে ফারাক্কা পয়েন্টে পানি নেই বললেই চলে। তাই চুক্তি মোতাবেক শতকরা ৫০ ভাগই হোক আর ৬০ ভাগই হোক তা বাংলাদেশের কোনো কাজেই আসছে না। দেশের উত্তরাঞ্চল ও দক্ষিণ অঞ্চলের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ এলাকায় মরুকরণ শুরু হয়ে গেছে। ফসল উত্পাদনসহ নদীর নাব্য হারাচ্ছে, মাছ শূন্যতা দেখা দিচ্ছে, জীববৈচিত্র্য ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। বিশ্বের সেরা ম্যানগ্রোভ সুন্দরবনের গাছ-পালা লবণাক্ততার কারণে মরে যাচ্ছে। আজ সমুদ্রের লবণাক্ত পানি বাঘাবাড়ী ঘাট পর্যন্ত পৌঁছে গেছে। নদীপথে যাত্রী ও মালামাল চলাচল মারাত্মকভাবে কমে গেছে। সুপেয় পানির অভাব দেখা দিয়েছে।
আমাদের তালপট্টি দ্বীপ ভারত গায়ের জোরে দখল করে নিয়েছে। তিস্তা নদীতে ভারতের গজলডোবায় বাঁধ দিয়ে আমাদের তিস্তা প্রজেক্টকে ফারাক্কার মতো অবস্থার সৃষ্টি করছে। বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চল এতে মরুভূমিতে পরিণত হবে। ওদিকে টিপাইমুখ বাঁধ দিয়ে দেশের পূর্ব ও উত্তরাঞ্চলও পানিশূন্য করার পাঁয়তারা শুরু করেছে। ভারত বাংলাদেশ সৃষ্টির পর থেকে তাদের পূর্বাঞ্চলের ৭টি রাজ্যে যাওয়ার জন্য করিডোর চেয়ে আসছে। তা না পাওয়ায় এখন এশিয়ান হাইওয়ের ছত্রছায়ায় এটা পাওয়ার চেষ্টা করছে। আমাদের সমুদ্র বন্দর ব্যবহার করার আবদার করছে। অথচ আমাদের স্বাধীনতার সময়ে চট্টগ্রাম বন্দর বিধ্বস্ত হওয়ায় বিদেশি ত্রাণসামগ্রী আনার জন্য বাংলাদেশ মাত্র ১৫ দিনের জন্য কলকাতা বন্দর ব্যবহারের অনুরোধ করলেও এ মানবিক অনুরোধ ভারত রাখেনি। বাংলাদেশের ওপর দিয়ে তাদের প্রস্তাব মোতাবেক এশিয়ান হাইওয়ে হলে বাংলাদেশের প্রায় ১৫০০ কিলোমিটার বুকচিরে তা করতে হবে এবং দেশটিকে পাঁচটি খণ্ডে বিভক্ত করে ফেলবে। অথচ বাংলাদেশ-নেপাল-ভুটান বিগত ৪ যুগ ধরে ভারতকে অনুরোধ করে আসছে মাত্র ২৩ মাইল করিডোর দিলে তারা ব্যবসা-বাণিজ্য করতে পারত। কিন্তু ভারত নিরাপত্তার অজুহাত তুলে তা আজও দেয়নি।
তারা বাংলাদেশের কাছে হাজারো দাবি করে এসেছে এবং কোনো কোনোটা এরই মধ্যে আদায়ও করে নিয়েছে। কিন্তু বিনিময়ে বাংলাদেশ কিছুই পায়নি। তারা মিয়ানমারকে সঙ্গে নিয়ে আমাদের সমুদ্রসীমা এমনভাবে দখল করতে চায় যার ফলে চট্টগ্রাম বন্দরে কোনো সমুদ্র জাহাজ না আসতে পারে। আর সমুদ্রের তেল-গ্যাস, মত্স্য সম্পদ তো হারাতে হবেই। এসব কাজ কোনো বন্ধুর হতে পারে না। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার বিখ্যাত কবিতায় ভারত চরিত্র বর্ণনা করতে গিয়ে বলেছেন,
‘দিবে আর নিবে/ মিলাবে মিলিবে/ যাবে না ফিরে।’
কিন্তু ভারত সরকার সে নীতি থেকে বহুদূরে সরে গেছে। তারা শুধু নিতেই জানে—দিতে জানে না। ভারতের এই আচরণের জন্য শুধু পাকিস্তানের সঙ্গে নয়; নেপাল, ভুটান, মালদ্বীপ, শ্রীলঙ্কা ও বাংলাদেশের সঙ্গে তার সদ্ভাব নেই।
ভারতের এ আচরণ লক্ষ্য করে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানও ১৯৭৪ সাল থেকে সতর্ক হয়ে যান। প্রথম অবস্থায় ভারতকে বিশ্বাস করে বেরুবাড়ী ও ফারাক্কা চুক্তি করলেও তাকে চাপ দেয়া সত্ত্বেও গ্যাস চুক্তি তিনি করেননি। ভারতকে উপেক্ষা করে তিনি লাহোরে ওআইসি (ঙওঈ) সম্মেলনে যোগদান করেন। প্রাথমিক অবস্থায় রাষ্ট্র চালাতে তিনি যে কিছু ভুলভ্রান্তি করেছেন তা তিনি সাংবাদিকদের কাছে স্বীকারও করেছেন। শেখ মুজিবের পরে বাংলাদেশের ওপর বেশি প্রভাব খাটাতে শুরু করলে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান ভারতমুখী নীতি পরিবর্তন করে মুসলিম বিশ্ব ও চীনের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলা শুরু করেন। তার প্রাচ্য নীতিতে চীন সঙ্গত কারণে প্রাধান্য পায়। চীন বিরাট দেশ। তার অর্থনৈতিক ও সামরিক শক্তি দ্রুত বৃদ্ধি পাওয়ায় বিশ্বে তার প্রভাব বাড়তে থাকে। তাই ভারতকে কাউন্টার করার জন্য তিনি চীনের সঙ্গে বাণিজ্য ও সামরিক যন্ত্রপাতি সস্তায় আমদানি শুরু করেন। ক্রমে চীন আমাদের পরীক্ষিত বন্ধুতে পরিণত হয়। ভারত এটা সুনজরে না দেখলেও আমাদের এছাড়া অন্য কোনো উপায় ছিল না। ভারত বিরাট দেশ। তার অর্থনৈতিক ও সামরিক শক্তি আমাদের চেয়ে অনেক বেশি হলেও তার সঙ্কীর্ণ মনের জন্য ছোট দেশগুলো সব সময় তার ভয়ে শঙ্কিত ছিল। অথচ শক্তি-সামর্থের জন্য এ অঞ্চলের অন্য রাষ্ট্রগুলো তার উদারতা কামনা করত। কিন্তু তারা আগাগোড়াই উল্টাটাই করত। এসব কারণেই বাংলাদেশ তার পররাষ্ট্রনীতি—‘সবার প্রতি বন্ধুত্ব—কারো প্রতি শত্রুতা নয়’— এ নীতি অনুসরণ করছে। চীনের সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে ওঠায় ভারত বাংলাদেশের সঙ্গে কর্তৃত্বসুলভ আচরণের পরিবর্তন করতে বাধ্য হয়। ভারত বুঝে গিয়েছে বাংলাদেশকে যে কোনো ধরনের শক্ত বিপদে ফেললে এখন সে একা নয়—তার পাশে চীন থাকবে। কিন্তু কোনো রাষ্ট্রই এমন একক বন্ধুর দিকে তাকিয়ে থাকে না। তার পররাষ্ট্রনীতি বহুমুখী করতে হয় দেশেরই স্বার্থে। ভারতের আচরণের জন্যই আমাদের চীনের সঙ্গে সম্পর্ক গড়তে হয়েছে দেশের নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার কারণে।
চীন বাংলাদেশের পরীক্ষিত বন্ধু তার প্রমাণ আমরা ইতোমধ্যেই পেয়েছি। তারা বাংলাদেশের উন্নয়নে ৮টি ব্রিজ করেছে, কৃষি ক্ষেত্রেও সহায়তা দিচ্ছে। আমাদের সামরিক বাহিনীকে সমর সজ্জায় সজ্জিত করছে। চীন-মৈত্রী সম্মেলন কেন্দ্র তাদের খরচে করে দিয়েছে। সর্বোপরি সমুদ্রসীমা নিয়ে মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশের যে বিরোধ তা প্রায় নৌযুদ্ধের পর্যায় চলে যাচ্ছিল। চীন এ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করে মিয়ানমারকে আলোচনার মাধ্যমে সমস্যার সুরাহা করার জন্য চাপ সৃষ্টি করে। মিয়ানমারের নৌবাহিনী প্রত্যাহার করতে বাধ্য করে। ওদিকে ভারত সমুদ্রসীমা নিয়ে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে মিয়ানমারকে আরও উসকিয়ে দেয়। কারণ, সমুদ্রসীমা নিয়ে উভয়ের স্বার্থ এক। তাই বাংলাদেশ যাতে কোণঠাসা হয় সেই নীতিই অনুসরণ করে ভারত।
শেখ হাসিনার সরকার ক্ষমতায় আসার পরপরই বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি পাল্টিয়ে ফেলতে শুরু করে। এ সরকার অন্ধভাবে ভারতমুখী হয়ে পড়ে। অভিজ্ঞজন বলছেন, হাসিনা সরকারকে ক্ষমতায় বসাতে আন্তর্জাতিক চক্রকে সঙ্গে নিয়ে ভারতই প্রধান ভূমিকা পালন করে। তাই তার মাশুল দেয়ার জন্য বর্তমান সরকার ভারত বন্দনায় মেতে উঠেছে। তারা বলছে, ভারতকে করিডোর দিলে বাংলাদেশের লাভ, টিপাইমুখ বাঁধ দিলে বাংলাদেশের কোনো ক্ষতি হবে না বরং বিদ্যুত্ পাবে। তালপট্টির ব্যাপারে কোনো কথা বলছে না। সরকারের এসব কর্মকাণ্ডে মনে হয় তারা বাংলাদেশকে ভারতের একটি করদ রাষ্ট্রে পরিণত করতে চায়। এটা কোনো দিন হবে না। বাংলাদেশের মানুষ শান্ত, নিরীহ কিন্তু প্রয়োজনে তারা গর্জে ওঠতে পারে। তা তারা ভাষা আন্দোলনে, উনসত্তর সালের গণঅভ্যুত্থান, সত্তরের গণভোট ও সর্বশেষ একাত্তরের স্বাধীনতা সংগ্রামে দেখিয়েছে। তার পরে এরশাদের স্বৈরশাসন উত্খাতেও তাদের তেজোদীপ্ত পদক্ষেপ লক্ষ্য করা গেছে। তাই শেখ হাসিনার সরকারকে দেশের স্বার্থ জলাঞ্জলি দিয়ে ভারতের সঙ্গে কিছু করলে তাকেও তার মাশুল দিতে হবে। আমরা ভারতের বন্ধুত্ব চাই, প্রভুত্ব চাই না।
ওদিকে হাসিনা সরকার চীনের সঙ্গে বৈরী আচরণ শুরু করেছে। তারা চীন থেকে সামরিক সরঞ্জাম আমদানি বন্ধ করেছে। চীন-মৈত্রী সম্মেলন কেন্দ্রের নাম পাল্টিয়ে বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্র করেছে। সর্বোপরি চীনের বর্তমান শত্রু ভারতের সঙ্গে একমুখী নতজানু পররাষ্ট্রনীতি অনুসরণ করছে যা চীন কোনোভাবেই মেনে নিতে পারে না। তাই তারা বাংলাদেশের ওপর খুবই অসন্তুষ্ট। ওদিকে ভারতপ্রীতির জন্য বাংলাদেশ কিছু পাবে তেমন আশা করার মতো কোনো উদাহরণ আমাদের সামনে নেই। বরং বিভিন্ন ক্ষেত্রে তারা আমাদের বিপাকে ফেলেছে।
বাংলাদেশ ক্ষুদ্র রাষ্ট্র। তার শক্তি সামর্থ্য কম। তাই বলে আমরা দুর্বল না। ইসরাইল ক্ষুদ্র রাষ্ট্র হয়েও মুসলিম বিশ্বের মধ্যে দাপটে চলছে। সুইজারল্যান্ড ক্ষুদ্র রাষ্ট্র। তার প্রতিবেশীরা শক্তিশালী। কিন্তু তার নিরপেক্ষ পররাষ্ট্রনীতির জন্য সবার সম্মান পাচ্ছে। বিশ্বে এটা একটি আদর্শ রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃত। তাই আমাদের পররাষ্ট্র নীতি হতে হবে নিরপেক্ষ। চীনকে ক্ষেপানো মোটেই ঠিক হবে না
No comments