হাসিনার ভারতনীতি ও সেদিনের আওয়ামী লীগ by মনজুর আহমদ
ভারত সফরকে ‘সাফল্য’ হিসাবে অভিহিত করেছেন আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলছেন, তার এ সাফল্য শতভাগ। পক্ষান্তরে বিরোধীদল বিএনপি শেখ হাসিনার ভারত সফরের বিরুদ্ধে সমালোচনায় সোচ্চার। তাদের দাবি প্রধানমন্ত্রীর এ সফর শতভাগই ব্যর্থ।
আসলে দু’জনের কেউই ভুল বা বেঠিক বলছেন না। দু’জনের হিসাবে দু’জনই সঠিক। শেখ হাসিনা যে উদ্দেশ্য নিয়ে ভারতে গিয়েছিলেন, হতে পারে তা বাংলাদেশের পক্ষ থেকে ভারতকে তাদের দীর্ঘদিনের দাবি অনুযায়ী কিছু সুবিধা প্রদান, তা তিনি দিয়ে এসেছেন। এ উদ্দেশ্য সাধনে তিনি শতভাগ সফল। আর ভারতকে এসব সুবিধা দানের বিরোধী বিএনপি একেই ভারতীয় স্বার্থের কাছে শেখ হাসিনার আত্মসমর্পণ ও বাংলাদেশের স্বার্থ রক্ষায় তার ব্যর্থতা হিসেবে অভিহিত করেছে। দু’জনের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দু’জনেই নিশ্চয় ঠিক বলছেন। এ নিয়ে বিতর্ক চলবে। এ নিয়ে উত্তপ্ত হবে রাজনীতি। এ থেকে সুবিধা লুটবে সুযোগ সন্ধানীরা।
কিন্তু এ প্রসঙ্গ নয়। সংবাদ সম্মেলনে দেয়া শেখ হাসিনার বক্তব্যের একটি অংশ নিয়ে কিছু বলার জন্য আজকের এই লেখা। ‘ভারত বিরোধিতার’ বিষয় উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ভারতবিরোধী প্রচারণা নতুন কিছু নয়। একটি মহল সব সময় ভারতবিরোধী প্রচারণা চালিয়ে আসছে। বহু আগে থেকেই এটা হয়ে আসছে। ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনের সময় ভারতবিরোধী ক্যাম্পেইন ছিল। ভারতবিরোধী ক্যাম্পেইন বাংলাদেশের কিছু মানুষের স্বভাবজাত।
কথাটি কি যথার্থ বলেছেন তিনি? ভারত বিরোধিতা নিশ্চয় বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর। বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে আমাদের জাতীয় জীবনে সৃষ্ট সমস্যাবলী এবং এসব বিষয়ে ভারতের অনুসৃত ভূমিকার পরিপ্রেক্ষিতে। প্রতিবেশী ক্ষুদ্র দেশগুলোর প্রতি বৃহত্ শক্তি ভারতের আচরণ। যাকে রাজনৈতিকভাবে আধিপত্যবাদী হিসেবে অভিহিত করা হয়, তা মোকাবিলায় বাংলাদেশকে তার নিজের স্বার্থেই ভারতের বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে হয়ে। ফারাক্কায় বাঁধ দিয়ে ভারত বাংলাদেশের জন্য সমস্যার সৃষ্টি করেছে—দহগ্রামের তিনবিঘা করিডোর নিয়ে বাংলাদেশকে সমস্যায় রেখেছে, সীমান্তে বিরাজ করছে সমস্যা, বাংলাদেশের এমন আরও বহু সমস্যার কারণ হয়ে রয়েছে ভারত। বাংলাদেশের মানুষের অভিজ্ঞতা তো এটাই যে, ভারত তার স্বার্থে প্রয়োজনীয় যে কোনো কার্যক্রম গ্রহণ করবে, বাংলাদেশের সমস্যা তার বিবেচ্য নয়।
এসব বিষয় শেখ হাসিনা বিবেচনায় নেননি। তিনি সার্বিকভাবে ভারত বিরোধিতারই নিন্দা করেছেন। তার বক্তব্য থেকে সুস্পষ্টভাবে এটাই প্রতীয়মান হয় যে, কোনো ব্যাপারেই ভারতের সমালোচনা করা যাবে না। তিনি বলেছেন, একটি মহল বহু আগে থেকেই ভারতবিরোধী প্রচারণা চালিয়ে আসছে, এটা তাদের স্বভাবজাত। এ প্রসঙ্গে তিনি ১৯৫৪ সালে নির্বাচনের সময়ের কথা উল্লেখ করেছেন।
শেখ হাসিনা ১৯৫৪ সালের কথা উল্লেখ করেছেন। আশা করি তিনি ১৯৫৬-১৯৫৭ সালের কথা বিস্মৃত হননি। তিনি নিশ্চয় বিস্মৃত হননি সেদিন ভারতের বিরোধিতায় কারা সোচ্চার ছিল। ১৯৫৬-৫৭ সালে তত্কালীন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন আওয়ামী লীগের হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী আর পূর্ব পাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন আতাউর রহমান খান। অর্থাত্ পাকিস্তানের শাসন ক্ষমতার কেন্দ্র ও প্রদেশ সবখানেই আওয়ামী লীগ। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব তখন প্রথম দফায় আতাউর রহমান খানের মন্ত্রিসভায় মন্ত্রিত্ব করার পর দ্বিতীয় দফায় দলীয় সিদ্ধান্ত অনুযায়ী মন্ত্রী না হয়ে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে সার্বক্ষণিকভাবে দলের সাংগঠনিক কাজে আত্মনিয়োগ করেন।
তখন ভারতবিরোধী ভূমিকা কারা পালন করেছিল? ভারতবিরোধী প্রচার-প্রচারণায় কারা সোচ্চার ছিল? কাশ্মীর প্রশ্নে ভারতের বিরুদ্ধে কারা দেশজুড়ে বিক্ষোভের ঝড় তুলেছিল? এবং কারা সেদিন মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীকে ভারতের দালাল ও নেহরুর চর আখ্যায়িত করেছিল?
শেখ হাসিনা ১৯৫৪ সালের কথা বললেন, পাতা উল্টে দেখলেন না ’৫৬-৫৭ সালের ইতিহাস। দেখলেন না তত্কালীন পাকিস্তানের শাসন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত আওয়ামী লীগের প্রচণ্ড ভারতবিরোধী ভূমিকার কথা। ভারতের সঙ্গে পাকিস্তানের বিরোধীয় বিষয় কাশ্মীর নিয়ে দেশজুড়ে তাদের ভারতবিরোধী বিক্ষোভ গড়ে তোলার কথা। সেই সময়ই পূর্ব পাকিস্তানের জন্য পূর্ণাঙ্গ স্বায়ত্তশাসন ও জোট নিরপেক্ষ স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতি প্রশ্নে মওলানা ভাসানীর সঙ্গে সোহরাওয়ার্দী-আতাউর-মুজিবের মতবিরোধ ঘটে। এই সময়ই মওলানা ভাসানী আয়োজন করেন কাগমারি সম্মেলনের। আর এসবকে কেন্দ্র করে মওলানা ভাসানীর বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগ যে ব্যাপক অপপ্রচার চালিয়েছিল সেদিনের দৈনিক ইত্তেফাকের পাতায় পাতায় তার পরিচয় ছড়িয়ে রয়েছে। সেই সময়ই ইত্তেফাকের মাস্ট হেডের নিচে থেকে মুছে দেয়া হয়েছিল প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে মওলানা ভাসানীর নাম। আর তখনই মওলানাকে আওয়ামী লীগ আখ্যা দিয়েছিল ভারতের দালাল ও নেহরুর চর হিসেবে। শেখ হাসিনা বলেছেন, একটি মহল সব সময় ভারতবিরোধী প্রচারণা চালিয়ে আসছে। সব সময় বলতে তিনি সাম্প্রতিক সময় কিংবা স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ের মধ্যে আবদ্ধ থাকেননি। তিনি চলে গেছেন পেছনে চুয়ান্ন সাল পর্যন্ত। তখন থেকে এ পর্যন্ত তার ভাষ্য অনুযায়ী যে ‘একটি মহল’ ভারতবিরোধী প্রচারণা চালিয়ে আসছে ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় তা থেকে তার দল আওয়ামী লীগকেও পৃথক করা যাবে না।
লেখক : যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক
No comments