যেন পেরিয়ে এলেম অন্তবিহীন পথ by ডা. ওয়াহিদ নবী
চিলাহাটি বাংলাদেশের সবচেয়ে উত্তরে অবস্থিত রেলওয়ে স্টেশন। সেখান থেকে তিতুমীর রেলগাড়িটি ছাড়ে। রাজশাহী স্টেশনে এসে তার যাত্রা শেষ হয়। দূরত্বটা ঠিক কতটুকু ঠিক বলতে পারব না। গার্ড এবং চেকার সাহেবকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম। তাঁরাও ঠিক বলতে পারেননি। আমার সহযাত্রীদের জিজ্ঞাসা করেও ঠিক জানতে পারিনি।
তবে ট্রেনটির লাগা উচিত সাড়ে ছয় ঘণ্টা রেলের টাইম টেবিল অনুযায়ী। এই পথটকু ইদানীং আমাকে দুবার পেরুতে হয়। ভ্রমণশেষে কবিগুরুর গানের পঙ্ক্তিটি মনে পড়ে। নীলফামারী স্টেশনটি চিলাহটি থেকে দুই স্টেশন দূরে। ট্রেনটি ছাড়ার কথা বিকেল ৩টা ২ মিনিটে। ট্রেনটি এলো বিকেল পৌনে পাঁচটায়। যাঁরা আমাদের পেঁৗছে দিতে এসেছিলেন এবং শেষ পর্যন্ত ধৈর্য ধরেছিলেন তাঁদের সঙ্গে সমকালীন রাজনীতি নিয়ে আলোচনা এবং বাঙালির সময়জ্ঞান নিয়ে রসিকতা করে সময় কাটালাম। অবশেষে ট্রেন ছাড়লেও ট্রেনটি ঢিমে-তেতালায় চলতে লাগল। কারণ রেল লাইনের অবস্থা ভালো নয়। বহু বছর ধরে ট্রেনটি এমনভাবেই চলছে। এমনভাবেই যাত্রীদের নিরাপত্তার দিকে নজর রাখছে রেল কর্তৃপক্ষ। বহু বছর যখন যাত্রীদের নিরাপত্তা অটুট রয়েছে তখন নতুন কোনো পন্থা অবলম্বনের দরকার কি? নতুন পন্থা কাজ নাও করতে পারে! কাজেই রেল লাইন ভালো করাটা সমীচীন মনে করেনি রেল কর্তৃপক্ষ বা সরকার। বেশ কিছুটা দূরত্ব শম্বুকগতিতে চললে ট্রেনটির যে বেশি সময় লাগে গন্তব্যে পেঁৗছতে, সে কথাটি টাইম টেবিলে বিবেচনা করা হয়নি। কারণ বোধ হয় এই যে সব কিছু সব সময় ছাপার অক্ষরে প্রকাশ করে নিজের জন্য ভোগান্তি ডেকে আনার তে বোকামি রেল কর্তৃপক্ষ রাজি নয়।
কোনো কোনো স্টেশনে গাড়ি থামলে আর 'নো নড়ন-চড়ন'। ব্যাপার কি জিজ্ঞাসা করলে শুনি, 'ক্রসিং' হবে। উত্তর-দক্ষিণে গাড়ি কয়েকটি স্থানে যায়। যেমন নীলফামারী থেকে খুলনা। পূর্ব-পশ্চিমে ঘোরার আগে গাড়িগুলোকে উত্তর-দক্ষিণ করতে হয়। যেমন নীলফামারী থেকে ঢাকা কিংবা নীলফামারী থেকে রাজশাহী। এসব কারণে ক্রসিং হয় অনেক। তাই অপেক্ষার সময় দীর্ঘ। আমরা ছোটবেলায় দেখেছি এই পথে দুটি লাইন ছিল। আমরা বড়দের বলতে শুনেছি, একটি লাইন ধরে আপ ট্রেন ও অন্যটি দিয়ে ডাউন ট্রেন যায়। এ জন্য ক্রসিংয়ের জন্য ট্রেনকে কোথাও থেমে থাকতে হতো না। দেখতাম দুটি বিপরীতগামী ট্রেন নিমিষের মধ্যে বিপরীত দিকে চলে যেত। এখন একটি লাইন তুলে নেওয়া হয়েছে। কাজেই ক্রসিং অনিবার্য। আপ ও ডাউন দুটো লাইন দেখতাম আমাদের ছোটবেলায় যখন শুনতাম পূর্ব পাকিস্তানের লোকসংখ্যা সাড়ে চার কোটি। আজ বাংলাদেশের লোকসংখ্যা ১৬ কোটি। লোকসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে সব রকমের সুযোগ-সুবিধা বাড়বে জনসাধারণের জন্য, এটাই কাম্য। কিন্তু বাস্তবে সেটি হচ্ছে না। যেখানে লোকসংখ্যা বেড়েছে প্রায় চার গুণ, সেখানে রেল লাইন হয়েছে অর্ধেক। সাধারণ মানুষের জন্য রেলভ্রমণ অনেক দিক দিয়ে সুবিধাজনক। অনেক মানুষ একটি ট্রেনে যাতায়াত করতে পারে। রেলভ্রমণ তুলনামূলকভাবে নিরাপদ। দরকার হলে যাত্রীরা হাত-পা ছড়িয়ে-ছাড়িয়ে নিতে পারেন। রেলভ্রমণ খুব একটা ব্যয়বহুল নয়। এত কিছু কারণ সত্ত্বেও রেলভ্রমণকে অবহেলা করা হয়েছে। কিন্তু কেন এই অবহেলা? কর্তা ব্যক্তিরা এর কোনো ব্যাখ্যা কোনোদিন দেননি। হয়তো নিজেদের প্রভূত শক্তিশালী মনে করায় ব্যাখ্যাদানের প্রয়োজন আছে বলেও মনে করেন না। কিন্তু দুষ্ট লোকরা বলে যে নীতিনির্ধারকরা সব সময় মনে করেন, কিছু একটা নির্মিত হলে তাঁর নিজের কি লাভ হবে তা থেকে_ এটাই তাঁদের প্রধান ভাবনা। হয়তো এই জন্যই রেল লাইন নির্মিত হচ্ছে খুব কম আর রাস্তাঘাট নির্মিত হচ্ছে তুলনামূলক বেশি। আর রাস্তাঘাটের তুলনায় নতুন গাড়ির লাইসেন্স দেওয়া হচ্ছে বেশি। এর ফলে যানজট বেড়ে যাচ্ছে আর রাস্তাঘাটে দুর্ঘটনা লেগেই আছে।
চিলাহাটি-রাজশাহী রেলপথে ফিরে আসা যাক। তথাকথিত এই আন্তনগর রেলগাড়িটি হিলি স্টেশনের কাছে এলে যা ঘটে, তা অবিশ্বাস্য ও ন্যক্কারজনক। ব্যপারটি এতই লজ্জাজনক যে সন্দেহ হয় দেশে কোনো সরকার আছে কি না? কয়েকবার চেন টেনে ট্রেনটি থামিয়ে দেওয়া হয়। কারা এসব করে এই প্রশ্নের সোজাসুজি উত্তর হচ্ছে, কালোবাজারিরা। সহযাত্রীদের কাছে শুনলাম, মাসের পর মাস এভাবেই চলছে। ট্রেন থামামাত্র যা ঘটে তাকে বর্ণনা করা যায় 'নরক-গুলজার' হিসেবে। চারদিকে চিৎকার। তারস্বরে চিৎকার। দৌড়াদৌড়ি। গাড়ির ছাদের ওপর দিয়েও দৌড়াদৌড়ি। পায়ের দুপদাপ শব্দ ছাদের ওপর দিয়ে। বাইরেও চিৎকার। দৌড়াদৌড়ি। অন্ধকার ভেদ করে শক্তিশালী টর্চের আলো। টর্চ হাতে সীমান্তরক্ষী বাহিনী যাদের তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে তাদের মধ্যে রয়েছে শিশু, নারী ও যুবক। এর মধ্যেও চোরাচালানিরা জিনিসপত্র রেলগাড়িতে নিয়ে আসছে। চোরাচালানিদের সাহস দেখে আশ্চর্য হতে হয়। সীমান্তরক্ষী বাহিনীর ধাওয়া সত্ত্বেও তারা ভয় তো পাচ্ছেই না, বরং জিনিসপত্র গাড়িতে উঠাচ্ছে। টর্চলাইটের ক্ষণিক আলোয় দেখলাম অনেক চোরাচালানি সীমান্তরক্ষা বাহিনীর আগে আগে ছুটছে। কাউকেই ধরা পড়তে দেখলাম না। এর মধ্যে কান্নাকাটির শব্দও শোনা গেল। সহযাত্রীদের মুখে শুনলাম, চোরাচালানিদের মধ্যে বিভিন্ন দল রয়েছে। এক দলের লোক অন্য দলের কাছ থেকে জিনিসপত্র কেড়ে নেয়। তখনই কান্নাকাটির শব্দ কানে আসে।
দুই স্টেশন পর শুরু হয় আরেক নাটক। সীমান্ত বাহিনী, র্যাব আর পুলিশ রেলগাড়ি তল্লাশি শুরু করে। কজন ধরা পড়ে জানি না। কিছু জিনিস উদ্ধার হয় তা আমাদের জানার উপায় নেই; তবে ট্রেনের আরো দেরি হয়। আমার মনে হয়, চেইন টেনে যেখানে গাড়ি থামানো হয় সেই জায়গাটিতে কড়া ব্যবস্থা নিলে সবদিক দিয়ে ভালো হতো। কড়া ব্যবস্থা নিলে চোরাচালানিরা এসব চালিয়ে যেতে সাহস পেত না। চেইন টেনে গাড়ি থামাতে তারা সাহস পেত না। বিভিন্ন বাহিনী কর্তৃক গাড়ী তল্লাশির প্রয়োজন হতো না। এতে করে চোরাচালান বন্ধ হতো আর ট্রেন লেট হতো না। মাসের পর মাস এসব অগ্রহণযোগ্য ব্যাপার চলছে; অথচ এ সব দূর করার কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না।
লেখক : লন্ডনপ্রবাসী, বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ও গবেষক
কোনো কোনো স্টেশনে গাড়ি থামলে আর 'নো নড়ন-চড়ন'। ব্যাপার কি জিজ্ঞাসা করলে শুনি, 'ক্রসিং' হবে। উত্তর-দক্ষিণে গাড়ি কয়েকটি স্থানে যায়। যেমন নীলফামারী থেকে খুলনা। পূর্ব-পশ্চিমে ঘোরার আগে গাড়িগুলোকে উত্তর-দক্ষিণ করতে হয়। যেমন নীলফামারী থেকে ঢাকা কিংবা নীলফামারী থেকে রাজশাহী। এসব কারণে ক্রসিং হয় অনেক। তাই অপেক্ষার সময় দীর্ঘ। আমরা ছোটবেলায় দেখেছি এই পথে দুটি লাইন ছিল। আমরা বড়দের বলতে শুনেছি, একটি লাইন ধরে আপ ট্রেন ও অন্যটি দিয়ে ডাউন ট্রেন যায়। এ জন্য ক্রসিংয়ের জন্য ট্রেনকে কোথাও থেমে থাকতে হতো না। দেখতাম দুটি বিপরীতগামী ট্রেন নিমিষের মধ্যে বিপরীত দিকে চলে যেত। এখন একটি লাইন তুলে নেওয়া হয়েছে। কাজেই ক্রসিং অনিবার্য। আপ ও ডাউন দুটো লাইন দেখতাম আমাদের ছোটবেলায় যখন শুনতাম পূর্ব পাকিস্তানের লোকসংখ্যা সাড়ে চার কোটি। আজ বাংলাদেশের লোকসংখ্যা ১৬ কোটি। লোকসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে সব রকমের সুযোগ-সুবিধা বাড়বে জনসাধারণের জন্য, এটাই কাম্য। কিন্তু বাস্তবে সেটি হচ্ছে না। যেখানে লোকসংখ্যা বেড়েছে প্রায় চার গুণ, সেখানে রেল লাইন হয়েছে অর্ধেক। সাধারণ মানুষের জন্য রেলভ্রমণ অনেক দিক দিয়ে সুবিধাজনক। অনেক মানুষ একটি ট্রেনে যাতায়াত করতে পারে। রেলভ্রমণ তুলনামূলকভাবে নিরাপদ। দরকার হলে যাত্রীরা হাত-পা ছড়িয়ে-ছাড়িয়ে নিতে পারেন। রেলভ্রমণ খুব একটা ব্যয়বহুল নয়। এত কিছু কারণ সত্ত্বেও রেলভ্রমণকে অবহেলা করা হয়েছে। কিন্তু কেন এই অবহেলা? কর্তা ব্যক্তিরা এর কোনো ব্যাখ্যা কোনোদিন দেননি। হয়তো নিজেদের প্রভূত শক্তিশালী মনে করায় ব্যাখ্যাদানের প্রয়োজন আছে বলেও মনে করেন না। কিন্তু দুষ্ট লোকরা বলে যে নীতিনির্ধারকরা সব সময় মনে করেন, কিছু একটা নির্মিত হলে তাঁর নিজের কি লাভ হবে তা থেকে_ এটাই তাঁদের প্রধান ভাবনা। হয়তো এই জন্যই রেল লাইন নির্মিত হচ্ছে খুব কম আর রাস্তাঘাট নির্মিত হচ্ছে তুলনামূলক বেশি। আর রাস্তাঘাটের তুলনায় নতুন গাড়ির লাইসেন্স দেওয়া হচ্ছে বেশি। এর ফলে যানজট বেড়ে যাচ্ছে আর রাস্তাঘাটে দুর্ঘটনা লেগেই আছে।
চিলাহাটি-রাজশাহী রেলপথে ফিরে আসা যাক। তথাকথিত এই আন্তনগর রেলগাড়িটি হিলি স্টেশনের কাছে এলে যা ঘটে, তা অবিশ্বাস্য ও ন্যক্কারজনক। ব্যপারটি এতই লজ্জাজনক যে সন্দেহ হয় দেশে কোনো সরকার আছে কি না? কয়েকবার চেন টেনে ট্রেনটি থামিয়ে দেওয়া হয়। কারা এসব করে এই প্রশ্নের সোজাসুজি উত্তর হচ্ছে, কালোবাজারিরা। সহযাত্রীদের কাছে শুনলাম, মাসের পর মাস এভাবেই চলছে। ট্রেন থামামাত্র যা ঘটে তাকে বর্ণনা করা যায় 'নরক-গুলজার' হিসেবে। চারদিকে চিৎকার। তারস্বরে চিৎকার। দৌড়াদৌড়ি। গাড়ির ছাদের ওপর দিয়েও দৌড়াদৌড়ি। পায়ের দুপদাপ শব্দ ছাদের ওপর দিয়ে। বাইরেও চিৎকার। দৌড়াদৌড়ি। অন্ধকার ভেদ করে শক্তিশালী টর্চের আলো। টর্চ হাতে সীমান্তরক্ষী বাহিনী যাদের তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে তাদের মধ্যে রয়েছে শিশু, নারী ও যুবক। এর মধ্যেও চোরাচালানিরা জিনিসপত্র রেলগাড়িতে নিয়ে আসছে। চোরাচালানিদের সাহস দেখে আশ্চর্য হতে হয়। সীমান্তরক্ষী বাহিনীর ধাওয়া সত্ত্বেও তারা ভয় তো পাচ্ছেই না, বরং জিনিসপত্র গাড়িতে উঠাচ্ছে। টর্চলাইটের ক্ষণিক আলোয় দেখলাম অনেক চোরাচালানি সীমান্তরক্ষা বাহিনীর আগে আগে ছুটছে। কাউকেই ধরা পড়তে দেখলাম না। এর মধ্যে কান্নাকাটির শব্দও শোনা গেল। সহযাত্রীদের মুখে শুনলাম, চোরাচালানিদের মধ্যে বিভিন্ন দল রয়েছে। এক দলের লোক অন্য দলের কাছ থেকে জিনিসপত্র কেড়ে নেয়। তখনই কান্নাকাটির শব্দ কানে আসে।
দুই স্টেশন পর শুরু হয় আরেক নাটক। সীমান্ত বাহিনী, র্যাব আর পুলিশ রেলগাড়ি তল্লাশি শুরু করে। কজন ধরা পড়ে জানি না। কিছু জিনিস উদ্ধার হয় তা আমাদের জানার উপায় নেই; তবে ট্রেনের আরো দেরি হয়। আমার মনে হয়, চেইন টেনে যেখানে গাড়ি থামানো হয় সেই জায়গাটিতে কড়া ব্যবস্থা নিলে সবদিক দিয়ে ভালো হতো। কড়া ব্যবস্থা নিলে চোরাচালানিরা এসব চালিয়ে যেতে সাহস পেত না। চেইন টেনে গাড়ি থামাতে তারা সাহস পেত না। বিভিন্ন বাহিনী কর্তৃক গাড়ী তল্লাশির প্রয়োজন হতো না। এতে করে চোরাচালান বন্ধ হতো আর ট্রেন লেট হতো না। মাসের পর মাস এসব অগ্রহণযোগ্য ব্যাপার চলছে; অথচ এ সব দূর করার কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না।
লেখক : লন্ডনপ্রবাসী, বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ও গবেষক
No comments