প্রবৃদ্ধি অর্জনে ব্যাংকের তত্পরতা যথেষ্ট নয়ঃ সরকারের ভূমিকাই গুরুত্বপূর্ণ
দেশের অর্থনীতি নিয়ে আশার কথা বলা মোটেই নতুন নয়। ক্ষমতাসীনদের মুখের কথা যদি সঠিক হতো, তবে বাংলাদেশের চেহারাই এতদিনে পাল্টে যেত। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। কথার সঙ্গে কাজের কোনো মিল নেই। আমাদের গণদারিদ্র্য, বেকারত্ব যেন চিরস্থায়ী।
প্রত্যেক সরকারের আমলেই কিছু ব্যক্তির নজরকাড়া উন্নতির দেখা মিললেও আমজনতার জীবনে চোখে পড়ার মতো পরিবর্তন ধরা-ছোঁয়ার বাইরেই রয়ে গেছে। মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর অনেকে এই ধারা পরিবর্তনে বুক বেঁধেছিল। কিন্তু এক বছরেই তাদের হতাশা প্রকাশ হয়ে পড়ছে। কিন্তু এতে করে কথার পরিবর্তন ঘটেছে বলা যাবে না। গত শনিবার অর্থনীতি সমিতির এক অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ ব্যাংক গভর্নরের মুখে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি নিয়ে আশার কথা শোনা গেছে। ব্যাংকগুলো যদি গরিবমুখী, মানবিকতামুখী এবং পরিবেশমুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করে, তাহলে বাংলাদেশের পক্ষে ডাবল ডিজিট প্রবৃদ্ধি অর্জন সম্ভব। এই প্রবৃদ্ধি টেকসই হবে বলেও তিনি মন্তব্য করেছেন। নিচ থেকে হওয়া এই প্রবৃদ্ধির ফলে বাংলাদেশের পক্ষে বিশ্বব্যাংকের ধারার বাইরে নিজস্ব ধারায় প্রবৃদ্ধি অর্জনের সম্ভাবনার কথাও তিনি শুনিয়েছেন। যদি বাস্তবে তার কথা সত্য হয়ে ওঠে, তবে আমাদের দিন আসলেই বদলে যাবে—এতে সন্দেহ নেই।
বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের যুক্তি হলো, আমাদের জাতীয় বাজেট এক লাখ কোটি টাকার। অন্যদিকে ব্যাংকগুলোর মিলিত বাজেট আড়াই লাখ কোটি টাকারও বেশি। এই টাকা যদি ব্যাংকগুলো গরিবমুখী, মানবিকতামুখী, পরিবেশমুখী ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে কাজে লাগায়, তবে প্রবৃদ্ধি ডাবল ডিজিট হতে বাধ্য। অথচ বিশ্বব্যাংকের মতে, চলতি বাজেটে নির্ধারিত প্রবৃদ্ধি অর্জন করা সম্ভব হবে না। লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ১ শতাংশ কম প্রবৃদ্ধি হবে। এর বিরোধিতা করে প্রবৃদ্ধি বাড়বে—এমন নিশ্চয়তা দিয়েছেন গভর্নর। শুধু ব্যাংকিং খাতের কর্মকাণ্ড টেকসই অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ঘটাবে—এমন আশায় বিশ্বাস রাখা কঠিন বৈকি। কারণ, ব্যাংক মাত্রই মুনাফা বা লাভভিত্তিক কারবারে লিপ্ত। তারা গ্রাহককে ঋণ দেবে এবং শর্তানুযায়ী লাভসহ ঋণের টাকা ফেরত নেবে। এর অন্যথা হলে ঋণগ্রহীতার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়াই ব্যাংকের স্বাভাবিক নিয়ম। আমাদের দেশে সমাজের নিচের মানুষজন, যাদের নানাবিধ অর্থনৈতিক, সামাজিক সীমাবদ্ধতার মধ্যে বসবাস, তাদের মধ্যে ব্যাংকঋণ কার্যক্রমের নানা কথা শোনা গেলেও এতে করে টেকসই প্রবৃদ্ধি অর্জনের সম্ভাবনা খুবই অস্বাভাবিক। ইদানীং বেসরকারি খাতের উন্নতি চোখে পড়ার মতো হলেও কাঙ্ক্ষিত সামাজিক, অর্থনৈতিক উন্নয়নের দেখা এখনও পাওয়া যায়নি। যে প্রবৃদ্ধি সামাজিক উন্নতি নিশ্চিত করে না, তা কখনই টেকসই হতে পারে না। অতীতে বিভিন্ন সরকারের আমলে অর্জিত প্রবৃদ্ধি নিয়ে এমনটাই দেখা গেছে। টেকসই উন্নয়নের জন্য সাধারণ বিশেষ করে গরিব মানুষের জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সরকারের ভূমিকা ছাড়া অন্য কেউই এর নিশ্চয়তা দিতে পারে—এমন কোনো উদাহরণের কথা আমাদের জানা নেই।
ব্যাংক বা বেসরকারি খাতের তুলনায় সরকারের পরিকল্পিত ব্যয় বৃদ্ধিই সামাজিক উন্নতি তথা জনমানুষের জীবনমানের উন্নতি নিশ্চিত করতে পারে। তবে সেটা শুধু সরকারি কর্মচারীদের বেতন বৃদ্ধি নয়, কর্মসংস্থান সৃষ্টির পাশাপাশি শিক্ষা, চিকিত্সা, বাসস্থানসহ অবকাঠামোগত উন্নয়নে বাড়তি ব্যয় হতে হবে । এসব ছাড়া ব্যাংকিং খাতের কর্মকাণ্ড থেকে এমন ফল আশা করা মোটেই বিশ্বাসযোগ্য নয়। প্রসঙ্গক্রমে জনসংখ্যার বেশিরভাগ নিয়োজিত কৃষি খাতের কথা বলা যায়। কৃষককে ব্যাংকঋণ দেয়াই যথেষ্ট মনে করার কোনো কারণ নেই। পাশাপাশি বীজ, সার, সেচ, কীটনাশকের মতো কৃষি উপকরণাদি যদি সময়মত না পাওয়া যায়, উত্পাদিত পণ্যের ন্যায্যমূল্য কৃষক না পায়, তবে তার ঋণগ্রস্ত হওয়া ঠেকিয়ে রাখা কঠিন। এর ওপর রয়েছে প্রকৃতির ভূমিকা। এজন্য প্রায়ই কৃষিঋণ মওকুফের প্রয়োজনীয়তা অগ্রাহ্য করা যায় না। এমন বাস্তবতায় সরকার এগিয়ে না এলে শুধু ব্যাংকের ভূমিকা কী ফল দেবে—সেটা নিশ্চয়ই কারও অজানা নয়।
অতএব, ডাবল ডিজিট প্রবৃদ্ধি অর্জনের পেছনে শুধু ব্যাংকের ভূমিকার ওপর বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর যে জোর দিয়েছেন, সেখানেই সীমাবদ্ধ থাকাটা মোটেই বুদ্ধিমানের কাজ হবে বলে মনে হয় না। এক্ষেত্রে সরকারের ভূমিকা অন্য সবকিছুর চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। অবশ্য তা যদি গরিবমুখী, মানবিকতামুখী ও পরিবেশমুখী না হয়, তবে সবই অর্থহীন।
No comments