বৃত্তের ভেতর বৃত্ত-পূর্ণিমা : একটি প্রতীক by দেবব্রত চক্রবর্তী বিষ্ণু

২০০১ সালে জাতীয় নির্বাচনোত্তর বাংলাদেশে যে অন্ধকার যুগ নেমে এসেছিল, এর শিকার হয়েছিল অসংখ্য মানুষ। তারা যে শুধু সংখ্যালঘু শ্রেণীর ছিল তা-ই নয়, নির্যাতিত-নিপীড়িত হয়েছিল সংখ্যাগুরু শ্রেণীর মানুষও; এবং সেই সংখ্যাও কম ছিল না। সেই তাণ্ডবের একটি তদন্ত প্রতিবেদন পাওয়া গেছে কয়েক দিন আগে।


সরকার এখন সেই মোতাবেক কী ব্যবস্থা নেয়, আমরা তারই অপেক্ষায় আছি। অসংখ্য নির্যাতিত-নিপীড়িত মানুষেরই একজন পূর্ণিমা এখনো বিপন্ন সময়ের দুঃসহ স্মৃতি বয়ে বেড়াচ্ছে। পশুশক্তির ছোবলে পূর্ণিমা সবকিছু হারিয়েছিল। প্রাণে বেঁচে ছিল বটে, কিন্তু সেই বাঁচা তো বলা যায়, জীবন্মৃত অবস্থা মাত্র। তবে বিলম্বে হলেও দীর্ঘ ১০ বছর পর গত ৪ মে দেশব্যাপী বহুল আলোচিত সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়ার পূর্ণিমা রানী ধর্ষণ মামলার রায় হয়েছে। সিরাজগঞ্জের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের শ্রদ্ধাস্পদ বিচারক ওসমান হায়দার গত ৪ মে দুপুরে জনাকীর্ণ আদালতে চাঞ্চল্যকর এই মামলার রায় দেন। মামলার রায়ে অভিযুক্ত ১১ জনকে যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ড দেওয়া হয় এবং একই সঙ্গে প্রত্যেককে এক লাখ টাকা করে জরিমানা করা হয়। জরিমানার ওই টাকা পূর্ণিমাকে প্রদানের নির্দেশ দেওয়া হয় রায়ে। রায় প্রকাশের পর শুধু পূর্ণিমার পরিবারই সন্তোষ প্রকাশ করেনি, সংগত কারণেই দেশের শুভবুদ্ধিসম্পন্ন সবাই সন্তোষ প্রকাশ করেছেন।
কিন্তু আশঙ্কা অন্যত্র। পূর্ণিমা এবং তার পরিবার এখন অনিরাপদ। এই রায়ের বিরুদ্ধে দণ্ডপ্রাপ্তরা আপিল করবে; এবং তা নিষ্পন্ন হতে আরো কত বছর লাগবে, সেটা জানে শুধু ভবিষ্যৎই। এর মধ্যে ক্ষমতাবান দণ্ডপ্রাপ্তদের খুঁটির জোরে কত কিছুই তো ঘটে যেতে পারে। পূর্ণিমা এবং তার পরিবারের সদস্যদের ওপর তারা নানাভাবে চড়াও হতে পারে, জরিমানার টাকা দিলেও রাতের আঁধারে তা আবার ছিনিয়ে নেওয়া হতে পারে। শঙ্কা আরো আছে। আগামী কয়েক বছরে দেশের রাজনৈতিক গতিপ্রবাহ কোন দিকে যায়, তাও বলা মুশকিল। যদি কোনো কারণে তাদের অনুকূলেই যায়, তাহলে তো আর কথাই নেই। পূর্ণিমাসহ তার গোটা পরিবারই 'নাই' হয়ে যেতে পারে। এ রকম 'নাই' হয়ে যাওয়াটা এই ভূখণ্ডে একেবারেই অস্বাভাবিক নয়। এমনকি মামলাটি 'রাজনৈতিক বিবেচনায়' বাতিলও হয়ে যেতে পারে। এমন দৃষ্টান্ত তো আমাদের সামনে আছেই। কাজেই প্রত্যাশা থাকবে, মামলাটি (যদি আপিল হয়) যেন দ্রুত নিষ্পত্তি হয়, সেই রকম ব্যবস্থা রাষ্ট্রপক্ষ করবে এবং পূর্ণিমাদের রক্ষার জন্য সরকারের পক্ষ থেকে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হবে। আমাদের অতীত অভিজ্ঞতা তিক্ত। আর তিক্ত বলেই আশঙ্কাও খুব পুষ্ট। এই মামলার শ্রদ্ধাস্পদ বিচারককে ন্যায়বিচারের জন্য অবশ্যই ধন্যবাদ। কিন্তু এর পাশাপাশি আইজিপির কাছে দাবি, পূর্ণিমা আক্রান্ত হওয়ার পর থেকে তদন্ত কার্যক্রম পর্যন্ত সংশ্লিষ্ট থানার ওসি শহীদুল্লাহ যে তুঘলকি কাণ্ড চালিয়েছিলেন এবং দুর্বৃত্তদের আড়াল করার অপচেষ্টা করেছিলেন, সে জন্য তাঁকে বিচারের আওতায় আনার ব্যবস্থা করা হোক। শহীদুল্লাহ্র মতো এমন পুলিশ কর্মকর্তার সংখ্যা এই ভূখণ্ডে কম নয়; এবং তাঁরা কোনোভাবেই দায়মুক্তির সংস্কৃতির কারণে যেন পার না পেয়ে যায়, তা খেয়াল রাখার দায় রাষ্ট্রশক্তির।
পূর্ণিমার মামলার রায় যেদিন প্রকাশিত হয়, সেদিন অতীতের অনেক দুঃসহ স্মৃতি মানসপটে ভেসে ওঠে। ওই বিপন্ন সময়ে লালমোহন-আগৈলঝাড়াসহ বেশ কয়েকটি বিপর্যস্ত জনপদে অবস্থান করে পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে দুর্বৃত্তদের পাশাপাশি প্রশাসনেরও রক্তচক্ষুর রোষানলে পড়েছিলাম। সেই দুঃসহ স্মৃতি কখনো অতীত হওয়ার নয়, ক্ষতও শুকানোর নয়। শিক্ষা ও ইতিহাসবিদ মুনতাসীর মামুন, সাংবাদিক ও চিত্রনির্মাতা শাহরিয়ার কবীর, সাংবাদিক-কলামিস্ট-গবেষক-সংগঠক প্রয়াত ওয়াহিদুল হক, শিক্ষাবিদ ও বিজ্ঞানী অজয় রায়সহ প্রগতিশীল মহলের অনেকেই তখন বিপর্যস্ত জনপদগুলো চষে বেড়িয়েছেন এবং বিপন্নদের পাশে থেকে তাঁদের আগলে রাখার চেষ্টা করেছেন। এর জন্য তাঁদের, বিশেষ করে শ্রদ্ধাস্পদ মুনতাসীর মামুন ও শাহরিয়ার কবীরকে রাষ্ট্রশক্তির নির্যাতন-নিপীড়ন সহ্য করতে হয়েছে সীমাহীন, যা স্বাধীন বাংলাদেশের আরো একটি কালো অধ্যায়। ওইসব জনপদে কাজ করতে গিয়ে তখন মনে হয়েছিল, একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশের বিজয়োৎসব দেখিনি, কিন্তু ২০০১ সালে পরাজয় দেখেছি। থাক সেই প্রসঙ্গ। সেগুলো এই সংক্ষিপ্ত পরিসরে বর্ণনা করে শেষ করা যাবে না।
২০০১ সালে জাতীয় নির্বাচনোত্তর বাংলাদেশে যা ঘটেছিল রাষ্ট্রশক্তির প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ মদদে এবং তখন প্রথমে ক্ষমতাসীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ও পরে তথাকথিত নির্বাচিত গণতান্ত্রিক সরকার মানুষের বিরুদ্ধে যে অবস্থান নিয়েছিল, তাও বাংলাদেশের ইতিহাসে কালো অধ্যায় হিসেবেই বিবেচিত হবে। গায়ের জোরে আর যা-ই করা হোক না কেন, ওইসব ক্ষতচিহ্ন মুছে ফেলতে পারবে না কেউ। আজ যখন ওই সভ্যতা ও মানবতাবিরোধীদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দানকারী অনেকের মুখেই আইনের শাসন, ন্যায়বিচার, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ এবং মানবতা-সভ্যতার বড় বড় বুলি শুনি, তখন মনে হয়, এ দেশের রাজনীতিতে স্ববিরোধিতাই মুখ্য উপাদান। কিন্তু তাদের ভুলে যাওয়া উচিত নয়, পূর্ণিমা মামলার রায়ের মধ্য দিয়ে প্রমাণিত হলো, ২০০১ সালের নির্বাচনের পর যে তাণ্ডব ঘটেছিল, তা সত্য; এবং এই মামলার রায় তার একটি দালিলিক প্রমাণ। ২০০১ থেকে ২০০৬ সালে মানুষের ওপর যে নারকীয় নির্যাতন চালানো হয়েছিল, সে জন্য হাইকোর্টে রিট হয় এবং সরকারকে তদন্ত করে রিপোর্ট দেওয়ার জন্য আদালতের আদেশ জারি হয়। সরকার একটি কমিশন গঠন করে এবং সম্প্রতি ওই কমিশন তদন্ত প্রতিবেদন সরকারের কাছে জমা দিয়েছে। এখন দাখিলকৃত তদন্ত প্রতিবেদনের ভিত্তিতে প্রতিকারের উদ্যোগ নিলে আরো অনেক প্রমাণই সামনে হাজির হবে, এ নিয়ে সংশয় থাকার কোনোই কথা নয়। পূর্ণিমা এবং তার পরিবারকে মাথা নত করে শ্রদ্ধা জানাই। তাদের কাছ থেকে আমরা শিখে নিতে পারি প্রতিবাদের ভাষা। যে মহাক্ষমতাধর অপশক্তির বিরুদ্ধে তারা যুদ্ধ করেছে, অপমানের প্রতিবিধান করতে দৃঢ়ভাবে দাঁড়িয়েছে, তা থেকে শিক্ষা নেওয়ার অনেক কিছুই আছে। পূর্ণিমা প্রমাণ করে দিয়েছে, নিজে দাঁড়ালে এই সমাজে এখনো অনেক শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ আছেন, যাঁরা পাশে এসে দাঁড়ান। পূর্ণিমা একটি প্রতীক। সে তথাকথিত গণতন্ত্রী-মানবতাবাদী-ন্যায়বিচারের বুলি কপচানোদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে, সত্য একসময় না একসময় প্রতিষ্ঠিত হয়ই।
আমাদের হয়তো অনেকেরই মনে থাকার কথা, এই মামলায় মূল আসামিদের বাদ দিয়ে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের জড়ানোর কত ধরনের অপচেষ্টা হয়েছিল চারদলীয় জোট সরকারের সংসদ সদস্য এম আকবর আলীসহ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কতিপয় স্বেচ্ছাচারী কর্মকর্তা এবং পুলিশের কারো কারো মাধ্যমে। সে ক্ষেত্রেও পূর্ণিমা এবং তার পরিবার দৃঢ় অবস্থানে ছিল বলেই অনেক কিছু 'তামাদি' করে দেওয়া তাদের পক্ষে সম্ভব হয়নি। ওই ক্ষমতাবান চক্রটি ভুলে গিয়েছিল, নিরস্ত্র মানুষ একবার হারে, কিন্তু বার বার হারে না। তারা ভুলে গিয়েছিল, ক্ষমতা, ক্ষমতার শত্রু-মিত্র দুইই হতে পারে। তারা ভুলে গিয়েছিল, এই দেশ গরিব-পিছিয়ে থাকা মানুষের মধ্যেও অনেক প্রতিবাদীর জন্ম দিয়েছে। তারা ভুলে গিয়েছিল আমাদের ইতিহাস। তারা ভুলে গিয়েছিল, ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত না হলে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয় না। আমাদের বিশ্বাস, পূর্ণিমার মামলার রায়ের মধ্য দিয়ে তাদের বোধোদয় ঘটবে। শুভবুদ্ধিসম্পন্ন সবার কামনা, এমন অন্ধকার যুগ যেন এই স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশে আর ফিরে না আসে। এই সমাজে যেন মানুষরূপী দানবদের আর বাড়বাড়ন্ত না হয়। এই ভূখণ্ডে যারা তথাকথিত রাজনীতির নামে বারবার রক্তগঙ্গা বইয়ে দিতে চেয়েছে, আমরা তাদের বিনাশ চাই। পূর্ণিমা আমাদের শিখিয়ে দিয়েছে, চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে, মানুষ কখনো অমানুষের কাছে পরাজিত হয় না। পূর্ণিমা, তুমি আমাদের বোধোদয় ঘটিয়েছ, দুঃসময়ের স্মারক হয়ে প্রতিবাদী একজন শিরদাঁড়া টান করে দাঁড়িয়ে বেঁচে থাকার মধ্য দিয়ে।
পুনশ্চ : লেখাটি শেষ করার পর ১৪ মে কালের কণ্ঠে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন দৃষ্টিতে এল এবং এতে নতুন করে কিছু প্রশ্নের জন্ম হলো। 'গাজীপুরে সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতন চলছে' শিরোনামে প্রকাশিত ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গাজীপুর জেলার রাথুরা পল্লীর সংখ্যালঘুদের ওপর স্থানীয় দখলদাররা হামলা ও লুটপাটের চেষ্টা করছে এবং প্রাণনাশের হুমকি দিচ্ছে। ভয়ে সন্ত্রস্ত স্থানীয় অধিবাসীরা সংবাদ সম্মেলন করে জানিয়েছে, স্থানীয় প্রশাসন এবং জনপ্রতিনিধিদের দ্বারে দ্বারে ঘুরেও কোনো প্রতিকার পাচ্ছে না তারা। প্রশ্ন হচ্ছে, এখনো এই চিত্র পরিলক্ষিত হচ্ছে কেন? স্থানীয় প্রশাসন এবং জনপ্রতিনিধিরা কোন্ রহস্যজনক কারণে অপশক্তির বিরুদ্ধে নিশ্চুপ? স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে কি বিপন্নদের আর্তনাদ স্পর্শ করবে?
লেখক : সাংবাদিক
deba_bishnu@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.