না কেউ ছিল না by আল মাহমুদ
একাকী বসে থাকলেও দিন তো আর বসে থাকে না। দিন চলে যায়। মাস চলে যায়। নানা টেনশন, তাগাদা ও ভেতরগত উত্তেজনার মধ্যে আমার মতো কবিরও দিন চলে যায়। কোনো কিছুই তো আর ফিরিয়ে আনা যায় না। যে চলে যায় এর মধ্যে এমন দু’একজনও আছেন যারা আর ফিরে আসেন না।
মাঝে-মধ্যে আমিও চলে যাওয়ার কথাই ভাবি। ভাবতে ভালো লাগে। আমার চলে যাওয়াটা কেমন হবে—এটা একটা ভাবনার বিষয় বটে। আমি ভাবি। তবে ভয়ে কাঁপি না। অনেকেই বাসায় এসে আমার কুশল জিজ্ঞাসা করতে গিয়ে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকেন। কী দেখেন তারা, যারা দেখেন তারাই জানেন। তবে খুব অবাক হয়ে আমাকে দেখেন। আমি অবশ্য চোখে ভালো দেখতে পাই না বলে তাদের চেহারার প্রতিক্রিয়াটা বর্ণনা করতে পারব না। তারা যখন আমাকে দেখেন, তখন আমি খানিকটা নিরপেক্ষতা অবলম্বন করি। ভাবি দেখুক না। কিন্তু দেখেই তারা যে চুপ করে থাকেন, এমন নয়। দু’একটা প্রশ্নও করে থাকেন। বেয়াড়া প্রশ্ন। তার মধ্যে একটা হলো ‘কী ভাবছেন’। আমি অবশ্য আমার ভাবনার কথা গুছিয়ে বলতে পারি না বলে তাদের প্রশ্ন এড়িয়ে যাই।
আসলে আমি তো ভাবছি না। এক ধরনের প্রস্তুতি নিচ্ছি চলে যাওয়ার। সারা জীবনই স্থান থেকে স্থানান্তরে ভাগ্যের মার খেয়ে আমি তাড়িত হয়ে ফিরেছি। এখন এসব নিয়ে আমার বোধশক্তিও ভোঁতা হয়ে গেছে। আমি ভাবিও না। ভয়ে কাঁপিও না। তবে আমার মতো আর একটি চরিত্র খুঁজে বেড়াই। পাই না। আগে তরুণ কবিদের আসর ইত্যাদিতে যেতাম। কিন্তু যেদিন দেখলাম আমি বড় বেমানান, তখন যাওয়া-আসা বন্ধ করে দিয়েছি।
শুধু ভাবি আমি খাপ খাই না কেন? কোথাও আমার জন্য কেউ অপেক্ষা করে না—এ কথা বলব না। কবিরা আমার জন্য যে অপেক্ষা করে সেটা বুঝতে পারি আমি যখন কোথাও কবির আসরে যাই। তখন সেখানকার পরিবেশ সহসাই একটু শীতল হয়ে যায়। আমি বুঝতে পারি আমার প্রতি খানিকটা শ্রদ্ধা ও বিনয়ে সবাই কণ্ঠস্বর নামিয়ে এনেছে। এই পরিবেশে আমার পক্ষে বেশিক্ষণ অবস্থান করা অনুচিত ভেবে আমি অত্যন্ত নম্রতার সঙ্গে প্রত্যাবর্তন করি। আমি খাপ খাই না। আর আজকাল কবিতার কোনো উত্সাহ-উদ্দীপনা বা উত্সব হয় না।
আমাকে যারা খুব একটা চতুর-বুদ্ধিমান মনে করেন, তারা ভুল করেন। কারণ, আমি চাতুরি এবং বুদ্ধির দিপ্তী নিয়ে ঘোরাফেরায় অভ্যস্ত নই, আবার সোজা-সরল গোবেচারা মানুষও নই। কোথাও প্রতিবাদযোগ্য কিছু ঘটলে আমি এর প্রতিবাদ করি। তবে হইচই বাধাই না। নিম্নকণ্ঠে প্রতিবাদ করি। আর বর্তমানে সাহিত্যের আসরে তেমন কিছু উল্লেখযোগ্য ঘটনা ঘটছেও না। আমি এ কথা বলব না যে, দেশ থেকে কবিতা উঠে গেছে। এখনও দু-একজন পরিশ্রমী প্রতিভাবান কবির শব্দ আমরা শুনতে পাই। আমি নিকটবর্তী হতে পারি না, কারণ আমার সামর্থ্যে কুলোয় না। আর তা ছাড়া অনেক মানুষের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার আনন্দও আমার মধ্যে অপেক্ষাকৃত কম। আমি এসব বলে নিজকে একটা খুবই দরকারি কবি বলে প্রতিপন্ন করতে চাই না। আমি এত দরকারি মানুষ নই। তবে অদরকারি মানুষও নই। আমাকে ফেলাও যায় না, ঠেলাও যায় না। এর একটা বড় কারণ হলো আমি লিখি। শুধু কবিতা লিখি না, প্রবন্ধাদিও লিখি। আমার চোখ খারাপ হলেও আমার দৃষ্টিভঙ্গি খারাপ নয়। আমার চিন্তা করার অভ্যেস অনেকেরই মর্মস্পর্শ করেছে।
আমি নিরহঙ্কার লোক। নির্বিরোধ। লেখাটা আমার একই সঙ্গে নেশা এবং পেশাও। আমি লিখতে পারলে ভালো থাকি। আমার চলাটা অবশ্য রুটিনমাফিক হয় না। কারণ, আমি গুনে পা ফেলি না। আমি হাঁটি যখন, তখন এলোমেলোভাবে এদিক-সেদিক চলে যাই।
তবে আমি খুবই অস্বস্তিবোধ করি এই জগতে আমার সুহৃদ বন্ধু এবং শুভাকাঙ্ক্ষী অপেক্ষাকৃত কম।
লেখকদের এরকম হতে নেই। কারণ, আমাকে লিখে তো কারও কাছে এর একটা বর্ণনা দিতে হয়। আমি সমর্থন চাই। কিন্তু প্রায়ই সমর্থনের বদলে বিরূপতাই আমার ভাগ্যে জোটে। এমনিতে আমাকে কেউ ঘাঁটায় না। একদা কয়েকজন আমাকে হিংসা করত। আজকাল তারা কে কোথায় আছেন সেটাও আমার জানা নেই। আমি নিজের সমালোচক তৈরি করে নেইনি। কারণ, আমি সমালোচনা সহ্য করতে পারি না। আমি শুধু সমর্থন চাই, প্রশংসা চাই এবং এটাকে লোভী মানুষের স্বভাব এটা আমি জেনেও এরকম করি। ফলে আমার আশপাশে কেউ থাকে না। কেন এমন হলো? আমার মনে হয় আমার আশপাশে এমন কেউ ছিল না যে আমার ভ্রান্তিগুলো চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়। না কেউ ছিল না।
লেখক : কবি
আসলে আমি তো ভাবছি না। এক ধরনের প্রস্তুতি নিচ্ছি চলে যাওয়ার। সারা জীবনই স্থান থেকে স্থানান্তরে ভাগ্যের মার খেয়ে আমি তাড়িত হয়ে ফিরেছি। এখন এসব নিয়ে আমার বোধশক্তিও ভোঁতা হয়ে গেছে। আমি ভাবিও না। ভয়ে কাঁপিও না। তবে আমার মতো আর একটি চরিত্র খুঁজে বেড়াই। পাই না। আগে তরুণ কবিদের আসর ইত্যাদিতে যেতাম। কিন্তু যেদিন দেখলাম আমি বড় বেমানান, তখন যাওয়া-আসা বন্ধ করে দিয়েছি।
শুধু ভাবি আমি খাপ খাই না কেন? কোথাও আমার জন্য কেউ অপেক্ষা করে না—এ কথা বলব না। কবিরা আমার জন্য যে অপেক্ষা করে সেটা বুঝতে পারি আমি যখন কোথাও কবির আসরে যাই। তখন সেখানকার পরিবেশ সহসাই একটু শীতল হয়ে যায়। আমি বুঝতে পারি আমার প্রতি খানিকটা শ্রদ্ধা ও বিনয়ে সবাই কণ্ঠস্বর নামিয়ে এনেছে। এই পরিবেশে আমার পক্ষে বেশিক্ষণ অবস্থান করা অনুচিত ভেবে আমি অত্যন্ত নম্রতার সঙ্গে প্রত্যাবর্তন করি। আমি খাপ খাই না। আর আজকাল কবিতার কোনো উত্সাহ-উদ্দীপনা বা উত্সব হয় না।
আমাকে যারা খুব একটা চতুর-বুদ্ধিমান মনে করেন, তারা ভুল করেন। কারণ, আমি চাতুরি এবং বুদ্ধির দিপ্তী নিয়ে ঘোরাফেরায় অভ্যস্ত নই, আবার সোজা-সরল গোবেচারা মানুষও নই। কোথাও প্রতিবাদযোগ্য কিছু ঘটলে আমি এর প্রতিবাদ করি। তবে হইচই বাধাই না। নিম্নকণ্ঠে প্রতিবাদ করি। আর বর্তমানে সাহিত্যের আসরে তেমন কিছু উল্লেখযোগ্য ঘটনা ঘটছেও না। আমি এ কথা বলব না যে, দেশ থেকে কবিতা উঠে গেছে। এখনও দু-একজন পরিশ্রমী প্রতিভাবান কবির শব্দ আমরা শুনতে পাই। আমি নিকটবর্তী হতে পারি না, কারণ আমার সামর্থ্যে কুলোয় না। আর তা ছাড়া অনেক মানুষের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার আনন্দও আমার মধ্যে অপেক্ষাকৃত কম। আমি এসব বলে নিজকে একটা খুবই দরকারি কবি বলে প্রতিপন্ন করতে চাই না। আমি এত দরকারি মানুষ নই। তবে অদরকারি মানুষও নই। আমাকে ফেলাও যায় না, ঠেলাও যায় না। এর একটা বড় কারণ হলো আমি লিখি। শুধু কবিতা লিখি না, প্রবন্ধাদিও লিখি। আমার চোখ খারাপ হলেও আমার দৃষ্টিভঙ্গি খারাপ নয়। আমার চিন্তা করার অভ্যেস অনেকেরই মর্মস্পর্শ করেছে।
আমি নিরহঙ্কার লোক। নির্বিরোধ। লেখাটা আমার একই সঙ্গে নেশা এবং পেশাও। আমি লিখতে পারলে ভালো থাকি। আমার চলাটা অবশ্য রুটিনমাফিক হয় না। কারণ, আমি গুনে পা ফেলি না। আমি হাঁটি যখন, তখন এলোমেলোভাবে এদিক-সেদিক চলে যাই।
তবে আমি খুবই অস্বস্তিবোধ করি এই জগতে আমার সুহৃদ বন্ধু এবং শুভাকাঙ্ক্ষী অপেক্ষাকৃত কম।
লেখকদের এরকম হতে নেই। কারণ, আমাকে লিখে তো কারও কাছে এর একটা বর্ণনা দিতে হয়। আমি সমর্থন চাই। কিন্তু প্রায়ই সমর্থনের বদলে বিরূপতাই আমার ভাগ্যে জোটে। এমনিতে আমাকে কেউ ঘাঁটায় না। একদা কয়েকজন আমাকে হিংসা করত। আজকাল তারা কে কোথায় আছেন সেটাও আমার জানা নেই। আমি নিজের সমালোচক তৈরি করে নেইনি। কারণ, আমি সমালোচনা সহ্য করতে পারি না। আমি শুধু সমর্থন চাই, প্রশংসা চাই এবং এটাকে লোভী মানুষের স্বভাব এটা আমি জেনেও এরকম করি। ফলে আমার আশপাশে কেউ থাকে না। কেন এমন হলো? আমার মনে হয় আমার আশপাশে এমন কেউ ছিল না যে আমার ভ্রান্তিগুলো চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়। না কেউ ছিল না।
লেখক : কবি
No comments