গদ্যকার্টুন-আমরা কাটিব রগ... by আনিসুল হক
রবিঠাকুরের ১৫০তম জন্মবর্ষ পালন করতে গিয়ে একটা লাভ হয়েছে। একটা নতুন শব্দ যোগ হয়েছে আমার শব্দভান্ডারে। সার্ধশত। সাধারণ বুদ্ধিতে বুঝি: স+অর্ধ+শত=সার্ধশত। অভিধানে দেখে নিয়েছি, সার্ধ মানে দেড় বা সাড়ে। সার্ধশত মানে দেড় শত। রবীন্দ্রনাথ নিজে সহজ শব্দ পছন্দ করতেন। তাঁর এক সহকারীর সংস্কৃত দাঁতভাঙা একটা নাম ছিল।
কঠিন সংস্কৃত নাম ধরে তিনি তাঁকে ডাকতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিলেন। সহকারীর ভাইয়ের নাম ছিল পটল। রবিবাবু তাই ওই সহকারীর নাম দিয়েছিলেন ‘আলু’।
রবীন্দ্রনাথের সার্ধশততম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে কবির সমসাময়িকতা নিয়ে ব্যাপক গবেষণা চলছে। তিনি কি আদৌ আমাদের কাছে প্রাসঙ্গিক? এ নিয়ে বিশাল সেমিনার হয়ে গেছে, একেবারে আন্তর্জাতিক সেমিনার। বিশেষজ্ঞ ব্যক্তিরা বক্তব্য দিয়েছেন। তাঁরা নানাভাবে প্রমাণ করার চেষ্টা করেছেন, রবিবাবু এখনো আমাদের নানা কাজে লাগছেন। আমরা এই বক্তাদের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করি না। বরং আমরা তাঁদের বক্তব্যের সমর্থনে আরও বাস্তব, আরও কঠিন প্রমাণ হাজির করতে পারব। যেমন: কণিকা কাব্যগ্রন্থে রবিবাবু লিখেছেন:
কে লইবে মোর কার্য্য, কহে সন্ধ্যারবি।
শুনিয়া জগৎ রহে নিরুত্তর ছবি।
মাটির প্রদীপ ছিল, সে কহিল, স্বামী,
আমার যেটুকু সাধ্য করিব তা আমি। (কর্তব্যগ্রহণ)
এ কবিতাটি আমরা কতভাবেই না প্রতিদিন বাস্তব জীবনে আচরিত হতে দেখি। যেমন:
কে লইবে মোর কার্য্য, কহে সন্ধ্যারবি।
শুনিয়া বিদ্যুৎ বোর্ড নিরুত্তর ছবি।
মোমের প্রদীপ ছিল, সে কহিল, স্বামী,
আমার যেটুকু সাধ্য করিব তা আমি।
কিন্তু সেটাও বাহ্য। এখন সর্বশেষ যা চলছে, তা হলো:
কে লইবে মোর কার্য্য, কহিল শিবির,
রগ কাটা হাত কাটা পারিবে কে বীর?
শুনিয়া নীরব হয় দেশের চৌদিক!
আমরা কাটিব রগ কহে ছাত্রলীগ।
রবিঠাকুর একই কাব্যগ্রন্থে লিখেছেন:
রথযাত্রা, লোকারণ্য, মহা ধুমধাম,
ভক্তেরা লুটায়ে পথে করিছে প্রণাম।
পথ ভাবে আমি দেব রথ ভাবে আমি,
মূর্তি ভাবে আমি দেব—হাসে অন্তর্যামী। (ভক্তিভাজন)
বলে রাখা ভালো, এখানে ‘দেব’ মানে ‘দেবতা’, ‘দেবো’ নয়।
কবিতাটি এখন এভাবে প্রাসঙ্গিক:
নির্বাচন, লোকারণ্য, মহা ধুমধাম,
চক্রীগণ গুপ্তকক্ষে সারিছেন কাম।
কর্মী-নেতা-সৈন্য-টাকা আর আমেরিকা,
আমিই আসল বলে লেখে ভাগ্যলিখা।
পাকি ভাবে আমি কর্তা, ইন্ডিয়া কয় আমি,
গুন্ডা কয় আমি সব, হাসে অন্তর্যামী:
আসলে জেতায় যারা তাহারা পাবলিক,
এবার বিএনপি তো সেবার আ.লীগ।
আবার একই কবিতা এভাবেও পড়া যায়:
নির্বাচনে হেরে গেছি, সব সুমসাম,
ভক্তেরা কাঁদিয়া ঘুম করেছে হারাম।
কে হারাল আমারে রে, ভাবিছেন নেতা,
ইসি, সিজি, সেনা, ডিসি কে ফল-প্রণেতা?
আমেরিকা, পাকি-দাদা, কার এ কারসাজি,
ষড়যন্ত্র নিশ্চয়ই ঘটে গেছে আজি!
বিধাতা বলেন ডেকে, শোনো ওগো নেতা,
পাঁচ বছর কী করেছ ভেবে দেখো সেটা।
তোমারই কর্মদোষে জনতার রায়
আজ দেখো কী রকম বিপক্ষেই যায়।
রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন:
নদীর এপার কহে ছাড়িয়া নিঃশ্বাস,
ওপারেতে সর্বসুখ আমার বিশ্বাস।
নদীর ওপার বসি দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে;
কহে, যাহা কিছু সুখ সকলি ওপারে।
এটা আজকের দিনে সংশোধিত হয়েছে এভাবে:
বিরোধী নেত্রী কহে ছাড়িয়া নিঃশ্বাস,
ওপারেতে সর্বসুখ আমার বিশ্বাস।
নদীর ওপার বসি নেত্রী সরকারি,
কহে, নাহি সুখ আপা, ঘুমাতে না পারি।
‘ঘুম আসে না? তাহলে কি আসবেন এপারে?’
‘একবার পাওয়ার পেলে সহজে কে ছাড়ে?’
সুখ নাই সুখ নাই আছে যে মমতা:
ছাড়িতে পারি না তাই সর্বৈব ক্ষমতা।
এভাবে রবীন্দ্রনাথ আমাদের কাছে সদাই প্রাসঙ্গিক। যেমন—বহুদিন আগে কার্টুন পত্রিকা উন্মাদ-এ পড়েছিলাম, ‘ও আমার দেশের মাটি, তোমার ’পরে ঠেকাই মাথা’। গানটি প্রাসঙ্গিক মিনিবাসের হেলপারের ধাক্কায় ফুটপাতে পড়ে যাওয়া যাত্রীর জন্য। যেমন হয় তো গ্রামীণ ব্যাংকের কর্মচারীদের বারবার মনে হচ্ছে: ‘যেতে নাহি দিব হায় তবু যেতে দিতে হয় তবু চলে যায়’।
কিন্তু রবীন্দ্রসংগীতের একটা ব্যবহারের কথা শুনেছি মেজর কামরুল হাসান ভূঁইয়ার কাছ থেকে। মুক্তিযোদ্ধা মেজর কামরুল মুক্তিযুদ্ধের চলন্ত বিশ্বকোষ। তিনি শোনালেন: একাত্তর সাল। জুলাই মাসের ৪ তারিখ। শ্রীমঙ্গলের দিলখুশ চা-বাগানের মধ্যে যুদ্ধ চলছে। মুক্তিযোদ্ধারা চা-বাগানের পাকিস্তানি সেনাদের অবস্থানে হামলা চালিয়েছেন। বাংকার থেকে পাল্টা আক্রমণ চালাচ্ছে পাকিস্তানিরা। রুহেল আহমেদ চৌধুরী নামের একজন মুক্তিযোদ্ধার ঊরুতে গুলি লাগে। সহযোদ্ধারা তাঁকে কাঁধে তুলে নিয়ে যেতে চাইছেন সীমান্তের ওপার। রুহেল বললেন, ‘আমি তো বাঁচব না। আমার বডি কেন তোমরা ওপারে নিতে চাইছ। তার বদলে আমি এ দেশের মাটিতে শেষ ঘুম দেব। তোমরা আমাকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ো না। যাও, যুদ্ধ করো।’
যুদ্ধ খানিকক্ষণ চলল। এবার সহযোদ্ধারা এলেন আহত মুক্তিযোদ্ধাকে উদ্ধার করতে। এসে দেখলেন, রুহেল মাটিতে মাথা রেখে গান গাইছেন, ‘ও আমার দেশের মাটি, তোমার ’পরে ঠেকাই মাথা’।
রক্তে পুরো মাটি ভেসে গেছে।
মুক্তিযোদ্ধারা তাঁকে জোর করেই নিয়ে গেলেন সীমান্তের ওপারে, ব্যবস্থা করলেন চিকিৎসার। সেযাত্রা তিনি বেঁচে গিয়েছিলেন।
আনিসুল হক: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক।
রবীন্দ্রনাথের সার্ধশততম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে কবির সমসাময়িকতা নিয়ে ব্যাপক গবেষণা চলছে। তিনি কি আদৌ আমাদের কাছে প্রাসঙ্গিক? এ নিয়ে বিশাল সেমিনার হয়ে গেছে, একেবারে আন্তর্জাতিক সেমিনার। বিশেষজ্ঞ ব্যক্তিরা বক্তব্য দিয়েছেন। তাঁরা নানাভাবে প্রমাণ করার চেষ্টা করেছেন, রবিবাবু এখনো আমাদের নানা কাজে লাগছেন। আমরা এই বক্তাদের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করি না। বরং আমরা তাঁদের বক্তব্যের সমর্থনে আরও বাস্তব, আরও কঠিন প্রমাণ হাজির করতে পারব। যেমন: কণিকা কাব্যগ্রন্থে রবিবাবু লিখেছেন:
কে লইবে মোর কার্য্য, কহে সন্ধ্যারবি।
শুনিয়া জগৎ রহে নিরুত্তর ছবি।
মাটির প্রদীপ ছিল, সে কহিল, স্বামী,
আমার যেটুকু সাধ্য করিব তা আমি। (কর্তব্যগ্রহণ)
এ কবিতাটি আমরা কতভাবেই না প্রতিদিন বাস্তব জীবনে আচরিত হতে দেখি। যেমন:
কে লইবে মোর কার্য্য, কহে সন্ধ্যারবি।
শুনিয়া বিদ্যুৎ বোর্ড নিরুত্তর ছবি।
মোমের প্রদীপ ছিল, সে কহিল, স্বামী,
আমার যেটুকু সাধ্য করিব তা আমি।
কিন্তু সেটাও বাহ্য। এখন সর্বশেষ যা চলছে, তা হলো:
কে লইবে মোর কার্য্য, কহিল শিবির,
রগ কাটা হাত কাটা পারিবে কে বীর?
শুনিয়া নীরব হয় দেশের চৌদিক!
আমরা কাটিব রগ কহে ছাত্রলীগ।
রবিঠাকুর একই কাব্যগ্রন্থে লিখেছেন:
রথযাত্রা, লোকারণ্য, মহা ধুমধাম,
ভক্তেরা লুটায়ে পথে করিছে প্রণাম।
পথ ভাবে আমি দেব রথ ভাবে আমি,
মূর্তি ভাবে আমি দেব—হাসে অন্তর্যামী। (ভক্তিভাজন)
বলে রাখা ভালো, এখানে ‘দেব’ মানে ‘দেবতা’, ‘দেবো’ নয়।
কবিতাটি এখন এভাবে প্রাসঙ্গিক:
নির্বাচন, লোকারণ্য, মহা ধুমধাম,
চক্রীগণ গুপ্তকক্ষে সারিছেন কাম।
কর্মী-নেতা-সৈন্য-টাকা আর আমেরিকা,
আমিই আসল বলে লেখে ভাগ্যলিখা।
পাকি ভাবে আমি কর্তা, ইন্ডিয়া কয় আমি,
গুন্ডা কয় আমি সব, হাসে অন্তর্যামী:
আসলে জেতায় যারা তাহারা পাবলিক,
এবার বিএনপি তো সেবার আ.লীগ।
আবার একই কবিতা এভাবেও পড়া যায়:
নির্বাচনে হেরে গেছি, সব সুমসাম,
ভক্তেরা কাঁদিয়া ঘুম করেছে হারাম।
কে হারাল আমারে রে, ভাবিছেন নেতা,
ইসি, সিজি, সেনা, ডিসি কে ফল-প্রণেতা?
আমেরিকা, পাকি-দাদা, কার এ কারসাজি,
ষড়যন্ত্র নিশ্চয়ই ঘটে গেছে আজি!
বিধাতা বলেন ডেকে, শোনো ওগো নেতা,
পাঁচ বছর কী করেছ ভেবে দেখো সেটা।
তোমারই কর্মদোষে জনতার রায়
আজ দেখো কী রকম বিপক্ষেই যায়।
রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন:
নদীর এপার কহে ছাড়িয়া নিঃশ্বাস,
ওপারেতে সর্বসুখ আমার বিশ্বাস।
নদীর ওপার বসি দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে;
কহে, যাহা কিছু সুখ সকলি ওপারে।
এটা আজকের দিনে সংশোধিত হয়েছে এভাবে:
বিরোধী নেত্রী কহে ছাড়িয়া নিঃশ্বাস,
ওপারেতে সর্বসুখ আমার বিশ্বাস।
নদীর ওপার বসি নেত্রী সরকারি,
কহে, নাহি সুখ আপা, ঘুমাতে না পারি।
‘ঘুম আসে না? তাহলে কি আসবেন এপারে?’
‘একবার পাওয়ার পেলে সহজে কে ছাড়ে?’
সুখ নাই সুখ নাই আছে যে মমতা:
ছাড়িতে পারি না তাই সর্বৈব ক্ষমতা।
এভাবে রবীন্দ্রনাথ আমাদের কাছে সদাই প্রাসঙ্গিক। যেমন—বহুদিন আগে কার্টুন পত্রিকা উন্মাদ-এ পড়েছিলাম, ‘ও আমার দেশের মাটি, তোমার ’পরে ঠেকাই মাথা’। গানটি প্রাসঙ্গিক মিনিবাসের হেলপারের ধাক্কায় ফুটপাতে পড়ে যাওয়া যাত্রীর জন্য। যেমন হয় তো গ্রামীণ ব্যাংকের কর্মচারীদের বারবার মনে হচ্ছে: ‘যেতে নাহি দিব হায় তবু যেতে দিতে হয় তবু চলে যায়’।
কিন্তু রবীন্দ্রসংগীতের একটা ব্যবহারের কথা শুনেছি মেজর কামরুল হাসান ভূঁইয়ার কাছ থেকে। মুক্তিযোদ্ধা মেজর কামরুল মুক্তিযুদ্ধের চলন্ত বিশ্বকোষ। তিনি শোনালেন: একাত্তর সাল। জুলাই মাসের ৪ তারিখ। শ্রীমঙ্গলের দিলখুশ চা-বাগানের মধ্যে যুদ্ধ চলছে। মুক্তিযোদ্ধারা চা-বাগানের পাকিস্তানি সেনাদের অবস্থানে হামলা চালিয়েছেন। বাংকার থেকে পাল্টা আক্রমণ চালাচ্ছে পাকিস্তানিরা। রুহেল আহমেদ চৌধুরী নামের একজন মুক্তিযোদ্ধার ঊরুতে গুলি লাগে। সহযোদ্ধারা তাঁকে কাঁধে তুলে নিয়ে যেতে চাইছেন সীমান্তের ওপার। রুহেল বললেন, ‘আমি তো বাঁচব না। আমার বডি কেন তোমরা ওপারে নিতে চাইছ। তার বদলে আমি এ দেশের মাটিতে শেষ ঘুম দেব। তোমরা আমাকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ো না। যাও, যুদ্ধ করো।’
যুদ্ধ খানিকক্ষণ চলল। এবার সহযোদ্ধারা এলেন আহত মুক্তিযোদ্ধাকে উদ্ধার করতে। এসে দেখলেন, রুহেল মাটিতে মাথা রেখে গান গাইছেন, ‘ও আমার দেশের মাটি, তোমার ’পরে ঠেকাই মাথা’।
রক্তে পুরো মাটি ভেসে গেছে।
মুক্তিযোদ্ধারা তাঁকে জোর করেই নিয়ে গেলেন সীমান্তের ওপারে, ব্যবস্থা করলেন চিকিৎসার। সেযাত্রা তিনি বেঁচে গিয়েছিলেন।
আনিসুল হক: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক।
No comments