উন্মুক্ত পুরনো ক্ষত by এম আবদুল হাফিজ
বঙ্গবন্ধু বিশাল হৃদয় আবেগপ্রবণ মানুষ ছিলেন। সন্দেহ, সংশয় বা কোনো প্রকার ক্ষুদ্রতা তার মনে ঠাঁই পেত না। তাই তিনি অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হোক বা দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের ক্ষেত্রে হোক, অবলীলায় বড় বড় অঙ্গীকারে আবদ্ধ হতে পারতেন, যদিও পরে তার ফল সবসময় শুভ হয়নি।
কিন্তু কোনো বিষয়ে অগ্র-পশ্চাৎ ভেবে সময়ক্ষেপণ না করে ইতিহাসের অত্যুজ্জ্বল মুহূর্তগুলোকে দ্বিধাদ্বন্দ্বের আবরণে হারিয়ে যেতে না দিয়ে সেগুলোকে তিনি আলিঙ্গনাবদ্ধ করতেন।
স্বাধীনতার অব্যবহিত পর তিনি ঘোষণা দিয়েছিলেন, বাংলাদেশ কারও সঙ্গে সংঘাত-সংঘর্ষে না জড়িয়ে জাতিরাষ্ট্র গঠনেই মনোনিবেশ করবে। আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ হবে প্রাচ্যের সুইজারল্যান্ড। আর নিকটতম এবং ঘনিষ্ঠতম মিত্র ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সীমান্ত হবে 'বর্ডার অব এটারনাল পিস'_ শান্তি, সৌহার্দ্য ও সম্প্রীতির সীমান্ত, যে অবস্থা অনন্তকাল অক্ষয় থাকবে। হয়তো বঙ্গবন্ধুর এমন উক্তিতে বিধাতা বোধহয় অন্তরাল থেকে হেসেছিল।
১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু সপরিবারে নিহত হওয়ার পর প্রতিবাদীরা প্রতিরোধ গড়ে তুলতে সীমান্ত পাড়ি দিয়েছিল। ওই সময়ে অধুনালুপ্ত বিডিআরে চাকরি করার সুবাদে সীমান্তে এই প্রতিরোধকারীদের সঙ্গে আমাদের সীমান্তরক্ষীদের গুলিবিনিময় দেখেছি। পরে ভারতে সরকার বদলের পর মোরারজি দেশাইয়ের প্রধানমন্ত্রিত্বকালে কী যেন এক প্রটোকলের অধীনে ওই সংক্ষিপ্ত সীমান্ত সংঘর্ষ থেমে যেতেও দেখেছি। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের বাংলা-ভারত সীমান্ত নিরতিকারই থেকে গেছে। এখন তো তা সীমান্তবাসীদের জন্য একপ্রকার বধ্যভূমি। এখন তা কদর্য কাঁটাতারের বেড়ায় আংশিকভাবে ভারত ঘিরে ফেলেছে। তা শুধু দৃষ্টিকটুই নয়, ভীতি সঞ্চারক।
চাকরিজীবনে বিভিন্ন কারণে বা অকারণে পৃথিবীর অনেক সীমান্ত দেখার সুযোগ হয়েছে। বার্লিন প্রাচীর দেখেছি, যেখানে স্নায়ুযুদ্ধের সময়েও দু'ধারের প্রহরীরা বাক্যবিনিময় করত। উভয় কোরিয়ার সীমান্ত রেখা পানসুনজমে গিয়েছি। সেখানকার প্রহরীরা উভয়ে উভয় দেশের খোঁজখবর নিত। কাউকে বাধা দিতে দেখিনি। সবচেয়ে কঠিন দেখেছি তোরখামে পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের মধ্যকার সীমান্ত। কিন্তু অধুনা সেই স্থলে দখল করতে যাচ্ছে সম্ভবত বাংলা-ভারত সীমান্ত, যা জলজ্যান্ত একটি মৃত্যুফাঁদ। ইংরেজিতে চৎড়ভবংংরড়হধষ ঈধসধৎধফবৎরব (পেশাগত সৌহার্দ্য) বলে একটি কথা আছে এবং সাধারণত একই পেশার লোকেরা পরস্পরকে বড় একটা ঘাঁটায় না। বাংলা-ভারত তার ব্যতিক্রম।
পেশাগত পরিচয় ও সৌহার্দ্য থাকা সত্ত্বেও গুলি করে হত্যা এখানকার সীমান্তে নিত্যদিনের বাস্তবতা। অথচ এই সীমান্ত ব্যবহারকারী বাংলা-ভারতের বন্ধুত্বের ভান কিংবদন্তিতুল্য। কত রকম ইতিবাচক অঙ্গীকারে ঢাকা পড়ে থাকে উভয়পক্ষের সীমান্ত কর্মকর্তাদের অসংখ্য ফ্লাগ মিটিং বা ঢাকা ও দিলি্লতে অনুষ্ঠিত বার্ষিক সম্মেলনের আতিথেয়তা ও আপাত বদান্যতা, যা এতদিনের অভিজ্ঞতায় মনে হয় একে অপরকে পরিমাপ করার মহড়া। এ সীমান্ত অস্তিত্বে আসার পর থেকে যতই সময় পেরিয়ে যাচ্ছে_ কোনো প্রকার সৌহার্দ্য তো দূরের কথা, বর্ডার মানেই আতঙ্ক। বর্ডার মানেই কাঁটাতারে আটকে থাকা ফেলানীর লাশ এবং বিএসএফ জওয়ানদের লক্ষ্যভেদ বাংলাদেশিদের তাক করে।
আসলেই কি শুধু আবেগ দিয়ে বন্ধুত্ব হয়? বন্ধুত্ব তো দূরের কথা, বঙ্গবন্ধুর আওয়ামী লীগের দ্বিতীয় মেয়াদে বাংলা-ভারত সীমান্তের বড়ইবাড়ী ও রৌমারীতে সীমান্ত যুদ্ধও হয়েছিল। এ নিয়ে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের অনেক তিক্ততারও সৃষ্টি হয়েছিল। এখন সীমান্তের ওপর কর্তৃত্ব প্রায় একতরফা হয়ে গেছে।
এখন বঙ্গবন্ধুর এটারনাল পিসের বর্ডারে হঠাৎ কী ঘটল যে, স্বয়ং বিএসএফের বড় কর্তারাও চোখ রাঙিয়ে 'প্রয়োজনে গুলি চালনা' অব্যাহত থাকার কথাই বলেন। অথচ আমার মনে পড়ে, কলেজে পড়ার সময় বৈচিত্র্যের সন্ধানে কতবার হিলি সীমান্তে গিয়েছি। সীমান্তের রেললাইনে দাঁড়িয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা গল্প করেছি। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মাটির পেয়ালায় চা খেয়েছি। কেউ বাধা দেয়নি। তাও আবার তখন ছিল পাকিস্তান আমল। তবু কেউ বাধা দেয়নি।
কখনও কখনও মনে হয়, শুধু আবেগ দিয়ে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের ভিত রচনা করা যায় না। আবেগের সঙ্গে আবার মাঝে মধ্যে পুরনো অবিশ্বাস উঁকিঝুঁকি দেয়, উন্মোচিত হয় অনেক দুঃখ-স্মৃতির ক্ষত। তাই নতুন সম্পর্ক, তাও আবার আবেগনির্ভর_ তার সঙ্গে অবশ্যই থাকতে হবে কিছু অনুভবক্ষম উপাদান। সেটা নেই বলেই বন্ধুত্বের ভিত জমে না, বারবার তা খসে পড়ে।
আশ্চর্য হলেও অনেক দেশের মধ্যে কোনো সীমান্তই নেই। পুরনো দিনের ইউরোপ বহুবার যুদ্ধে ক্ষতবিক্ষত হয়েছে। সেখানে হালের ইউরোপীয় ইউনিয়নের ২৭টি দেশের মধ্যে এখন কোনো সীমান্তই নেই।
ব্রিগেডিয়ার (অব.) এম আবদুল হাফিজ : সাবেক মহাপরিচালক বিআইআইএসএস এবং কলাম লেখক
স্বাধীনতার অব্যবহিত পর তিনি ঘোষণা দিয়েছিলেন, বাংলাদেশ কারও সঙ্গে সংঘাত-সংঘর্ষে না জড়িয়ে জাতিরাষ্ট্র গঠনেই মনোনিবেশ করবে। আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ হবে প্রাচ্যের সুইজারল্যান্ড। আর নিকটতম এবং ঘনিষ্ঠতম মিত্র ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সীমান্ত হবে 'বর্ডার অব এটারনাল পিস'_ শান্তি, সৌহার্দ্য ও সম্প্রীতির সীমান্ত, যে অবস্থা অনন্তকাল অক্ষয় থাকবে। হয়তো বঙ্গবন্ধুর এমন উক্তিতে বিধাতা বোধহয় অন্তরাল থেকে হেসেছিল।
১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু সপরিবারে নিহত হওয়ার পর প্রতিবাদীরা প্রতিরোধ গড়ে তুলতে সীমান্ত পাড়ি দিয়েছিল। ওই সময়ে অধুনালুপ্ত বিডিআরে চাকরি করার সুবাদে সীমান্তে এই প্রতিরোধকারীদের সঙ্গে আমাদের সীমান্তরক্ষীদের গুলিবিনিময় দেখেছি। পরে ভারতে সরকার বদলের পর মোরারজি দেশাইয়ের প্রধানমন্ত্রিত্বকালে কী যেন এক প্রটোকলের অধীনে ওই সংক্ষিপ্ত সীমান্ত সংঘর্ষ থেমে যেতেও দেখেছি। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের বাংলা-ভারত সীমান্ত নিরতিকারই থেকে গেছে। এখন তো তা সীমান্তবাসীদের জন্য একপ্রকার বধ্যভূমি। এখন তা কদর্য কাঁটাতারের বেড়ায় আংশিকভাবে ভারত ঘিরে ফেলেছে। তা শুধু দৃষ্টিকটুই নয়, ভীতি সঞ্চারক।
চাকরিজীবনে বিভিন্ন কারণে বা অকারণে পৃথিবীর অনেক সীমান্ত দেখার সুযোগ হয়েছে। বার্লিন প্রাচীর দেখেছি, যেখানে স্নায়ুযুদ্ধের সময়েও দু'ধারের প্রহরীরা বাক্যবিনিময় করত। উভয় কোরিয়ার সীমান্ত রেখা পানসুনজমে গিয়েছি। সেখানকার প্রহরীরা উভয়ে উভয় দেশের খোঁজখবর নিত। কাউকে বাধা দিতে দেখিনি। সবচেয়ে কঠিন দেখেছি তোরখামে পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের মধ্যকার সীমান্ত। কিন্তু অধুনা সেই স্থলে দখল করতে যাচ্ছে সম্ভবত বাংলা-ভারত সীমান্ত, যা জলজ্যান্ত একটি মৃত্যুফাঁদ। ইংরেজিতে চৎড়ভবংংরড়হধষ ঈধসধৎধফবৎরব (পেশাগত সৌহার্দ্য) বলে একটি কথা আছে এবং সাধারণত একই পেশার লোকেরা পরস্পরকে বড় একটা ঘাঁটায় না। বাংলা-ভারত তার ব্যতিক্রম।
পেশাগত পরিচয় ও সৌহার্দ্য থাকা সত্ত্বেও গুলি করে হত্যা এখানকার সীমান্তে নিত্যদিনের বাস্তবতা। অথচ এই সীমান্ত ব্যবহারকারী বাংলা-ভারতের বন্ধুত্বের ভান কিংবদন্তিতুল্য। কত রকম ইতিবাচক অঙ্গীকারে ঢাকা পড়ে থাকে উভয়পক্ষের সীমান্ত কর্মকর্তাদের অসংখ্য ফ্লাগ মিটিং বা ঢাকা ও দিলি্লতে অনুষ্ঠিত বার্ষিক সম্মেলনের আতিথেয়তা ও আপাত বদান্যতা, যা এতদিনের অভিজ্ঞতায় মনে হয় একে অপরকে পরিমাপ করার মহড়া। এ সীমান্ত অস্তিত্বে আসার পর থেকে যতই সময় পেরিয়ে যাচ্ছে_ কোনো প্রকার সৌহার্দ্য তো দূরের কথা, বর্ডার মানেই আতঙ্ক। বর্ডার মানেই কাঁটাতারে আটকে থাকা ফেলানীর লাশ এবং বিএসএফ জওয়ানদের লক্ষ্যভেদ বাংলাদেশিদের তাক করে।
আসলেই কি শুধু আবেগ দিয়ে বন্ধুত্ব হয়? বন্ধুত্ব তো দূরের কথা, বঙ্গবন্ধুর আওয়ামী লীগের দ্বিতীয় মেয়াদে বাংলা-ভারত সীমান্তের বড়ইবাড়ী ও রৌমারীতে সীমান্ত যুদ্ধও হয়েছিল। এ নিয়ে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের অনেক তিক্ততারও সৃষ্টি হয়েছিল। এখন সীমান্তের ওপর কর্তৃত্ব প্রায় একতরফা হয়ে গেছে।
এখন বঙ্গবন্ধুর এটারনাল পিসের বর্ডারে হঠাৎ কী ঘটল যে, স্বয়ং বিএসএফের বড় কর্তারাও চোখ রাঙিয়ে 'প্রয়োজনে গুলি চালনা' অব্যাহত থাকার কথাই বলেন। অথচ আমার মনে পড়ে, কলেজে পড়ার সময় বৈচিত্র্যের সন্ধানে কতবার হিলি সীমান্তে গিয়েছি। সীমান্তের রেললাইনে দাঁড়িয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা গল্প করেছি। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মাটির পেয়ালায় চা খেয়েছি। কেউ বাধা দেয়নি। তাও আবার তখন ছিল পাকিস্তান আমল। তবু কেউ বাধা দেয়নি।
কখনও কখনও মনে হয়, শুধু আবেগ দিয়ে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের ভিত রচনা করা যায় না। আবেগের সঙ্গে আবার মাঝে মধ্যে পুরনো অবিশ্বাস উঁকিঝুঁকি দেয়, উন্মোচিত হয় অনেক দুঃখ-স্মৃতির ক্ষত। তাই নতুন সম্পর্ক, তাও আবার আবেগনির্ভর_ তার সঙ্গে অবশ্যই থাকতে হবে কিছু অনুভবক্ষম উপাদান। সেটা নেই বলেই বন্ধুত্বের ভিত জমে না, বারবার তা খসে পড়ে।
আশ্চর্য হলেও অনেক দেশের মধ্যে কোনো সীমান্তই নেই। পুরনো দিনের ইউরোপ বহুবার যুদ্ধে ক্ষতবিক্ষত হয়েছে। সেখানে হালের ইউরোপীয় ইউনিয়নের ২৭টি দেশের মধ্যে এখন কোনো সীমান্তই নেই।
ব্রিগেডিয়ার (অব.) এম আবদুল হাফিজ : সাবেক মহাপরিচালক বিআইআইএসএস এবং কলাম লেখক
No comments