মা দিবস-‘ভালো’ মা হতে কি অধিকার হারাতে হয়? by নাসরিন খন্দকার
বেশ কয়েক বছর ধরে আমাদের দেশে ‘মা দিবস’টি বেশ শোনা যাচ্ছে, একটু-আধটু উদ্যাপিতও হচ্ছে। মাকে উপহার কিনে দিচ্ছেন বিত্তশালী সন্তানেরা। এই দিবস উপলক্ষে আর্চিস বা হলমার্কে কার্ডের বিক্রিবাটাও বেশ ভালো হচ্ছে। বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন দিনে মা দিবস পালিত হলেও ‘পথিকৃৎ’ যুক্তরাষ্ট্রসহ বেশ কিছু দেশে পালিত হয় মে মাসের দ্বিতীয়
রোববার। অগত্যা বাংলাদেশেও তাই। সে হিসাবে এবার ৮ মে বাংলাদেশে মা দিবস পালিতও হলো। এ উপলক্ষে মায়ের জন্য কেনাকাটা বেড়েছে, আর বেড়েছে ত্যাগী মাতৃত্বের গুণকীর্তন। এই পরিস্থিতিতে মা হিসেবে আমার অবস্থা কিছুটা কিংকর্তব্যবিমূঢ়। কেননা, মায়ের জন্য উপহার আর পত্রিকার বয়ানে মাতৃত্বের গুণগান—দুটোর কোনোটাই আমাকে খুশি করতে পারছে না। কেননা, আমি এমন একজন নারী, যিনি মা হওয়ার পর থেকে প্রতিটি দিন যথার্থ মা হওয়ার পরীক্ষণ-প্রক্রিয়ায় বাস করেন এবং এই পরীক্ষায় পাস করলেও অভিভাবকত্বের অধিকার পান না, মেলে না সন্তানের বিষয়ে অগ্রাধিকার।
‘মায়ের উপস্থিতিতে কীভাবে বাচ্চা পড়ে, ব্যথা পায়?’ ধমকের স্বরে বললেন বাবা। বাচ্চাটি ব্যথা পেয়েছে, কাঁদছে। মা অপরাধীর মতো সন্তানের ব্যথায় কুঁকড়ে যান। মা ভাবতে থাকেন, তিনি যথার্থ মা হতে পারছেন না, তাই তাঁর সন্তান ব্যথা পায়। বাসে চলতে গিয়ে এক বয়স্ক ব্যক্তির কথা কানে এল, ‘আমাদের মা আমাদের সন্তানের জন্য নিজের কিছুই কোনো দিন লক্ষ করেননি। আর আজকালকার মায়েদের দেখুন—কত কী দাবি তাঁদের।’ নিজের দিকে তাকানো মা তবে যথার্থ মা নন? বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক মা তাঁর ক্লাসের সময়সূচিকে বাচ্চার স্কুলের সময়সূচি অনুযায়ী ঠিক করে নেন, কেননা তাঁকেই এই দায়িত্ব পালন করতে হয়। বাচ্চাকে স্কুলে দেওয়ার সময় বাচ্চা কাঁদে, কেন কাঁদে তার উত্তরও আছে পাশে বসে থাকা এক মায়ের কাছে, যিনি ‘সন্তানের জন্য নিজের ক্যারিয়ার বিসর্জন’ দিয়ে বসে থাকেন স্কুলের সামনে। তিনি বলেন, ‘আপনি চাকরি করেন, তাই আপনার বাচ্চা কাঁদে, স্কুল ছুটির পর বাচ্চা অনেকক্ষণ অপেক্ষা করে, তাই আপনার বাচ্চা কাঁদে।’ সমীকরণের ফলাফল: চাকরিজীবী মা একজন যথার্থ মা নন। এই সমীকরণের আরেকটি দিক হচ্ছে, পেশাজীবী মা যথেষ্ট ভালো বা দায়িত্বশীল পেশাজীবী নন। এক প্রবীণ শিক্ষিকা বললেন, ‘আমরা কিছুই হতে পারলাম না, না ঘরকা না ঘাটকা।’ ঘর আর ঘাট দুটোই যে তাঁর অনুকূলে নয়, দুটোই যে তাঁর জন্য নিরন্তর সংগ্রামের স্থান।
তো, এ-ই হলো মাতৃত্ব, আর এই মা দিবস হলো সেই মাতৃত্বেরই উদ্যাপন। তা-ও কীভাবে? যে মা নিজের অধিক করে সন্তানকে তিলে তিলে বড় করে তোলেন, তাঁর ঋণ শোধ করার নৈতিক চাপ তৈরি করা কি এই দিবসের লক্ষ্য? তবে কি এটা দান-প্রতিদানের বিষয়? সন্তান যখন ছোট, তখন তিনি তাঁর সবটা দিয়ে সন্তানকে বড় করে তুলবেন আর সন্তান বড় হয়ে মায়ের দেখভাল করবে? তাহলে মা দিবসের মর্ম এই: ১. মাকে উপহার দিন, ২. বৃদ্ধ মাকে তাঁর মাতৃত্বের মমতার প্রতিদান দিন। আমি নিশ্চিত, এই দুটি প্রাপ্তিই মায়ের মুখে একটি বিষণ্ন হাসি ছাড়া আর কিছু দিতে না পারলেও করপোরেট আগ্রহকে অনেক কিছু দিতে পারে। দিতে পারে বিজ্ঞাপনের নতুন আইডিয়া, বেচাকেনার নতুন নতুন সুযোগ।
মা দিবসে মা যে কত কত মহান, তার অজস্র বয়ান চারপাশে শুনি। প্রশ্ন আসে, এই আদর্শায়ন কি কাজে আসে? যদি বলি, এগুলোর মাধ্যমে মাকে দেবীর আসনে বসিয়ে তাঁর মানবাধিকার হরণ করা হয়? যদি বলি, এগুলোর মাধ্যমে মাতৃত্ব বিচারের মানদণ্ড তৈরি করা হয়? মাতৃত্বের মহত্ত্বকে এভাবে উদ্যাপন করে মা কী পান? মানুষ হিসেবে একজন ব্যক্তির মৌলিক চাওয়াগুলোও মাতৃত্বের দোহাই দিয়ে তাঁর কাছ থেকে নিয়ে নেওয়া হয়। আমার প্রশ্ন, মাতৃত্বের মহত্ত্ব নিয়ে নয়, বরং এই মহত্ত্বকে ‘স্বাভাবিক’ ও একমাত্র কাঙ্ক্ষিত আদর্শ করে তোলা নিয়ে; যার মাধ্যমে মা আর মানুষ হিসেবে বিবেচিত হন না, হন কোনো উচ্চমার্গীয় প্রাণী হিসেবে। মানুষের অধিকার চাইতে গেলে যাঁর ‘মাতৃত্বের’ উঁচু আসন থেকে নামতে হয়। পরিণতিতে অসম্মানিত হন; মা হিসেবে শ্রদ্ধা, অর্ঘ্য পাওয়ার যোগ্যতা হারান। মাতৃত্বের এই শোষণ একজন মায়ের ‘নিজ’ সত্তাটুকুকেও মাতৃত্বের মধ্যে গ্রাস করে। একই রকম কি পিতৃত্বের ক্ষেত্রেও হতে দেখি আমরা? পিতৃত্বের মানদণ্ড—পিতার ‘নিজ’কে ঢেকে দেয় না, দেয় অধিকার, আর মায়ের জন্য রাখে শুধুই দায়িত্ব।
দশ মাস গর্ভে নিজ শরীরের পুষ্টি দিয়ে, রক্ত-মাংস দিয়ে একটু একটু করে বড় করা মা, জন্মের পর বুকের দুধ দিয়ে বাঁচিয়ে রাখা মা, বুকের মধ্যে আগলে রাখা মা কি সন্তানের অভিভাবকত্ব পান? পান সন্তান ধারণে সিদ্ধান্ত নেওয়ার অগ্রাধিকার? উপহার আর মাতৃত্বের গুণগানের প্রহসনে ঢেকে যাওয়া মা দিবসে তাই আসুন, ফিরে তাকাই মায়ের অধিকারের দিকে, যে অধিকার তাঁকে মানুষ হিসেবে বিবেচনা করে, মা হিসেবে যে অধিকার তাঁর প্রাপ্য।
নাসরিন খন্দকার: শিক্ষক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।
‘মায়ের উপস্থিতিতে কীভাবে বাচ্চা পড়ে, ব্যথা পায়?’ ধমকের স্বরে বললেন বাবা। বাচ্চাটি ব্যথা পেয়েছে, কাঁদছে। মা অপরাধীর মতো সন্তানের ব্যথায় কুঁকড়ে যান। মা ভাবতে থাকেন, তিনি যথার্থ মা হতে পারছেন না, তাই তাঁর সন্তান ব্যথা পায়। বাসে চলতে গিয়ে এক বয়স্ক ব্যক্তির কথা কানে এল, ‘আমাদের মা আমাদের সন্তানের জন্য নিজের কিছুই কোনো দিন লক্ষ করেননি। আর আজকালকার মায়েদের দেখুন—কত কী দাবি তাঁদের।’ নিজের দিকে তাকানো মা তবে যথার্থ মা নন? বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক মা তাঁর ক্লাসের সময়সূচিকে বাচ্চার স্কুলের সময়সূচি অনুযায়ী ঠিক করে নেন, কেননা তাঁকেই এই দায়িত্ব পালন করতে হয়। বাচ্চাকে স্কুলে দেওয়ার সময় বাচ্চা কাঁদে, কেন কাঁদে তার উত্তরও আছে পাশে বসে থাকা এক মায়ের কাছে, যিনি ‘সন্তানের জন্য নিজের ক্যারিয়ার বিসর্জন’ দিয়ে বসে থাকেন স্কুলের সামনে। তিনি বলেন, ‘আপনি চাকরি করেন, তাই আপনার বাচ্চা কাঁদে, স্কুল ছুটির পর বাচ্চা অনেকক্ষণ অপেক্ষা করে, তাই আপনার বাচ্চা কাঁদে।’ সমীকরণের ফলাফল: চাকরিজীবী মা একজন যথার্থ মা নন। এই সমীকরণের আরেকটি দিক হচ্ছে, পেশাজীবী মা যথেষ্ট ভালো বা দায়িত্বশীল পেশাজীবী নন। এক প্রবীণ শিক্ষিকা বললেন, ‘আমরা কিছুই হতে পারলাম না, না ঘরকা না ঘাটকা।’ ঘর আর ঘাট দুটোই যে তাঁর অনুকূলে নয়, দুটোই যে তাঁর জন্য নিরন্তর সংগ্রামের স্থান।
তো, এ-ই হলো মাতৃত্ব, আর এই মা দিবস হলো সেই মাতৃত্বেরই উদ্যাপন। তা-ও কীভাবে? যে মা নিজের অধিক করে সন্তানকে তিলে তিলে বড় করে তোলেন, তাঁর ঋণ শোধ করার নৈতিক চাপ তৈরি করা কি এই দিবসের লক্ষ্য? তবে কি এটা দান-প্রতিদানের বিষয়? সন্তান যখন ছোট, তখন তিনি তাঁর সবটা দিয়ে সন্তানকে বড় করে তুলবেন আর সন্তান বড় হয়ে মায়ের দেখভাল করবে? তাহলে মা দিবসের মর্ম এই: ১. মাকে উপহার দিন, ২. বৃদ্ধ মাকে তাঁর মাতৃত্বের মমতার প্রতিদান দিন। আমি নিশ্চিত, এই দুটি প্রাপ্তিই মায়ের মুখে একটি বিষণ্ন হাসি ছাড়া আর কিছু দিতে না পারলেও করপোরেট আগ্রহকে অনেক কিছু দিতে পারে। দিতে পারে বিজ্ঞাপনের নতুন আইডিয়া, বেচাকেনার নতুন নতুন সুযোগ।
মা দিবসে মা যে কত কত মহান, তার অজস্র বয়ান চারপাশে শুনি। প্রশ্ন আসে, এই আদর্শায়ন কি কাজে আসে? যদি বলি, এগুলোর মাধ্যমে মাকে দেবীর আসনে বসিয়ে তাঁর মানবাধিকার হরণ করা হয়? যদি বলি, এগুলোর মাধ্যমে মাতৃত্ব বিচারের মানদণ্ড তৈরি করা হয়? মাতৃত্বের মহত্ত্বকে এভাবে উদ্যাপন করে মা কী পান? মানুষ হিসেবে একজন ব্যক্তির মৌলিক চাওয়াগুলোও মাতৃত্বের দোহাই দিয়ে তাঁর কাছ থেকে নিয়ে নেওয়া হয়। আমার প্রশ্ন, মাতৃত্বের মহত্ত্ব নিয়ে নয়, বরং এই মহত্ত্বকে ‘স্বাভাবিক’ ও একমাত্র কাঙ্ক্ষিত আদর্শ করে তোলা নিয়ে; যার মাধ্যমে মা আর মানুষ হিসেবে বিবেচিত হন না, হন কোনো উচ্চমার্গীয় প্রাণী হিসেবে। মানুষের অধিকার চাইতে গেলে যাঁর ‘মাতৃত্বের’ উঁচু আসন থেকে নামতে হয়। পরিণতিতে অসম্মানিত হন; মা হিসেবে শ্রদ্ধা, অর্ঘ্য পাওয়ার যোগ্যতা হারান। মাতৃত্বের এই শোষণ একজন মায়ের ‘নিজ’ সত্তাটুকুকেও মাতৃত্বের মধ্যে গ্রাস করে। একই রকম কি পিতৃত্বের ক্ষেত্রেও হতে দেখি আমরা? পিতৃত্বের মানদণ্ড—পিতার ‘নিজ’কে ঢেকে দেয় না, দেয় অধিকার, আর মায়ের জন্য রাখে শুধুই দায়িত্ব।
দশ মাস গর্ভে নিজ শরীরের পুষ্টি দিয়ে, রক্ত-মাংস দিয়ে একটু একটু করে বড় করা মা, জন্মের পর বুকের দুধ দিয়ে বাঁচিয়ে রাখা মা, বুকের মধ্যে আগলে রাখা মা কি সন্তানের অভিভাবকত্ব পান? পান সন্তান ধারণে সিদ্ধান্ত নেওয়ার অগ্রাধিকার? উপহার আর মাতৃত্বের গুণগানের প্রহসনে ঢেকে যাওয়া মা দিবসে তাই আসুন, ফিরে তাকাই মায়ের অধিকারের দিকে, যে অধিকার তাঁকে মানুষ হিসেবে বিবেচনা করে, মা হিসেবে যে অধিকার তাঁর প্রাপ্য।
নাসরিন খন্দকার: শিক্ষক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।
No comments