স্বস্তি ফিরছে বাজারে by রাজীব আহমেদ

বজির দাম আরো কমেছে। কমেছে চাল, ভোজ্য তেল, চিনি ও ডালের দাম। ব্রয়লার মুরগি ও মাছের দামও আগের চেয়ে কিছুটা কম। ফলে প্রায় তিন মাসের অস্থিরতার পর বাজার এখন নিম্নমুখী।ব্যবসায়ীরা বলছেন, আন্তর্জাতিক বাজারে দাম কমার কারণে বিভিন্ন আমদানি পণ্যের দাম কমছে। পাশাপাশি শীত এসে যাওয়ায় কমছে সবজির দাম। বাজারে আগামী কয়েক মাস এমন স্বস্তির ভাব থাকবে বলে আশা করছেন তাঁরা।জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (ফাও) এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চলতি বছর বিশ্বে খাদ্য উৎপাদন বাড়বে।


ফলে দামও আগের বছরের তুলনায় কম থাকবে। ফাও মনে করে, চলতি অর্থবছরে বিশ্বব্যাপী ২৩১ কোটি টন খাদ্য উৎপাদন হবে, যা বিগত বছরের তুলনায় প্রায় সাত কোটি টন বেশিগত ৬ অক্টোবর প্রকাশিত ফাও'র ত্রৈমাসিক এই প্রতিবেদনে বলা হয়, চিনি, ভোজ্য তেল, চালসহ আন্তর্জাতিক বাজারে সব ধরনের নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম কমেছে।
আন্তর্জাতিক বাজারে দাম কমার প্রভাব দ্রুত বাংলাদেশের বাজারে পড়েছে ভারত রপ্তানির অনুমতি দেওয়ায়। ভারত থেকে চাল ও চিনি আমদানি হওয়ায় দ্রুত এ দুটি পণ্যের দাম কমে গেছে। পাশাপাশি বন্ধ ঘোষণার পর আবার রপ্তানির অনুমতি দেওয়ায় দেশের পেঁয়াজের বাজারেও স্থিতিশীলতা ফিরেছে।
সবজি, মাছ ও মাংসের দাম আন্তর্জাতিক বাজারের ওপর খুব বেশি নির্ভরশীল নয়। দেশের বাজারে এসব পণ্যের দাম কমেছে নানা কারণে।
রাজধানীর মৌলভীবাজারকেন্দ্রিক ভোজ্য তেল ও চিনির পাইকারি ব্যবসায়ী হাজি আবুল হাশেম কালের কণ্ঠকে বলেন, উৎপাদন ভালো হলে আন্তর্জাতিক বাজারে দাম কম থাকবে। এতে দেশের বাজারেও কম দামে পণ্য মিলবে। উৎপাদন ভালো হওয়ায় ভারত চিনি রপ্তানি করছে। ফলে দামও কমে গেছে। উৎপাদন আরো ভালো হলে তারা আরো কম দামে রপ্তানি করতে পারবে।
হাজি আবুল হাশেম বলেন, সরবরাহ ঠিক থাকলে পণ্যের দাম স্থিতিশীল থাকে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আতিউর রহমান আগামী মাসগুলোতে মূল্যস্ফীতি কমে যাওয়ার ব্যাপারে আশা প্রকাশ করেছেন। সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেছেন, মূল্যস্ফীতি হয়তো কোনো ক্ষেত্রে কয়েক মাস ধরে সহ্যসীমার বাইরে আছে। আগামী বছরের প্রথম মাসগুলোতে মূল্যস্ফীতি কমে আসবে।
গত সেপ্টেম্বর মাসে দেশে মাসওয়ারি মূল্যস্ফীতির হার ছিল গত এক দশকের মধ্যে সর্বোচ্চ। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্যানুযায়ী, ওই মাসে সার্বিক মূল্যস্ফীতি ১১.৯৭ শতাংশে উঠে যায়। পয়েন্ট টু পয়েন্ট ভিত্তিতে সেপ্টেম্বর মাসে খাদ্য মূল্যস্ফীতি বেড়ে দাঁড়ায় ১৩.৭৫ শতাংশ। আগস্টে এ হার ছিল ১২.৭০ শতাংশ।
সেপ্টেম্বর মাসে যখন খাদ্য মূল্যস্ফীতির হার বেড়ে যায় তখন বাজারে প্রতি কেজি সবজির দাম ছিল ৬০ থেকে ৭০ টাকা। গত রোজার আগ থেকে মানুষের ভোগান্তির বড় কারণ হয়ে দাঁড়ায় সবজির দাম। এখন এই দাম কমে দাঁড়িয়েছে ৩০ থেকে ৪০ টাকায়। রোজার ১৫ দিন আগে প্রকারভেদে সবজির দাম কেজিপ্রতি ২৫ থেকে ৩৫ টাকায় ওঠা-নামা করে। এখন বাজারে সরবরাহ বাড়ায় এবং শীতের সবজি আসতে শুরু করায় দাম কমছে বলে জানান বিক্রেতারা।
রাজধানীর খুচরা বাজারগুলোতে বেশির ভাগ সবজি যায় কারওয়ান বাজারের আড়ত থেকে। গতকাল শুক্রবার কারওয়ান বাজারের খুচরা সবজি বাজারে বেশির ভাগ সবজি ৩০ থেকে ৪০ টাকা কেজি দরে বিক্রি করতে দেখা যায়। ওই বাজারে প্রতি কেজি বেগুন ৩০ টাকা, পটোল ৩০ টাকা, চিচিঙ্গা ৩৫ টাকা, শশা ৩০ টাকা, করলা ৩০ টাকা, ঢেঁড়স ৪০ টাকা, বরবটি ৩০ টাকা, পেঁপে ১৮ টাকা দরে বিক্রি করছিলেন বিক্রেতারা।
শীতের সবজির মধ্যে ছোট বাঁধাকপি প্রতি পিস ২৫ টাকা, ফুলকপি ৩৫ থেকে ৪০ টাকা এবং বগুড়ার নতুন লাল আলু ২৬ টাকা কেজি দরে বিক্রি করতে দেখা গেছে। সাধারণত কারওয়ান বাজারের আড়তগুলোতে সবজি বিক্রি হয় খুচরা বাজারের অর্ধেক দামে।
গত এক সপ্তাহ আগের তুলনায় খুচরা বাজারে সব ধরনের সবজির দাম কেজিতে ২০ টাকা পর্যন্ত কমেছে বলে দাবি করেন বিক্রেতারা।
কোরবানির ঈদের আগে বাজারে সাধারণত ব্রয়লার মুরগির দাম কম থাকে। এবারও ঈদ ঘনিয়ে আসায় দাম কমছে। গত সপ্তাহের ১৩০ টাকার ব্রয়লার মুরগি এখন বিক্রি হচ্ছে ১২০ টাকা দরে। সরবরাহ বেড়ে যাওয়ায় ইলিশ মাছের দামও আগের চেয়ে কম। বাজারে বড় আকারের প্রতিটি ইলিশ ৩৫০ থেকে ৫০০ টাকার মধ্যে মিলছে। ছোট আকারের ইলিশ প্রতিকেজি ২৫০ থেকে ৩৫০ টাকা দরে বিক্রি করছেন কারওয়ান বাজারের বিক্রেতারা।
মসুর ডালের দাম কেজিতে কমেছে অন্তত পাঁচ টাকা। রসুন বিক্রি হচ্ছে কেজিপ্রতি ৫০ টাকার মধ্যে। তবে আদার দাম কিছুটা বাড়তি। তবু এখনো কেজিপ্রতি ৬০-৭০ টাকার মধ্যে আছে দেশি ও চীন থেকে আমদানি করা আদা।
নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মধ্যে বেশি দাম বেড়েছে আটা ও ময়দার। কেজিতে ১০ টাকা বেড়ে খোলা ময়দা এখন বিক্রি হচ্ছে ৪৫ টাকা দরে। আটার দাম সপ্তাহখানেক আগে বেড়ে এখন প্রতি দুই কেজির প্যাকেট ৬৪-৬৫ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। এর আগে মাসখানেক দুই কেজির আটার প্যাকেট ৬০ টাকায় কিনতে পেরেছিলেন ক্রেতারা।
খুচরা বাজারেও কমছে চালের দাম : দেশের মোকাম ও ঢাকার আড়তে বেশ কিছুদিন ধরেই চালের দাম কমতির দিকে। এখন খুচরা বাজারেও কমেছে বলে দাবি করেছেন বিক্রেতারা।
কারওয়ান বাজারের বরিশাল রাইস এজেন্সি ও মতলব ট্রেডার্সের কর্মীরা জানান, খুচরা দোকানে চালের দাম কেজিতে এক থেকে দুই টাকা কমেছে। নতুন আমন মৌসুম ঘনিয়ে আসায় এবং ভারত থেকে আমদানির কারণে চালের দাম কমেছে বলে দাবি করেন তাঁরা।
কারওয়ান বাজারে মোটা জাতের বিআর-২৮ চাল কেজিপ্রতি ৩৫ টাকা, স্বর্ণা ৩৪ থেকে ৩৫ টাকা, সরু জাতের মধ্যে মিনিকেট ৪০-৪২ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। একেবারে মোটা মানের চালের কদর নেই বলে বিক্রেতারা সেটা দোকানে রাখেন না।
ভালো ফলনের সম্ভাবনা দেখা দেওয়ায় ভারত গত ১৯ জুলাই ১০ লাখ টন চাল রপ্তানির অনুমতি দেয়। তবে দেশটি টনপ্রতি চালের দাম ৪০০ ডলারে নির্ধারণ করে দেয়। ভারত থেকে আমদানি করা চাল দেশের পাইকারি বাজারে ২৮ থেকে ২৯ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে বলে জানা গেছে।
ভালো আবহাওয়া ও সুষম বৃষ্টিপাতের কারণে আসন্ন আমন মৌসুমে ভালো ফলন হবে বলে আশা করছে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর। আমন বাংলাদেশের ধানের দ্বিতীয় প্রধান মৌসুম। দেশের মোট উৎপাদনের প্রায় ৪০ ভাগ চাল এ মৌসুমে উৎপাদিত হয়। মাসখানেক পরই আমন ধান বাজারে আসতে শুরু করবে।
কমেছে চিনির দাম : বাজারে এখন খোলা চিনি বিক্রি হচ্ছে কেজিপ্রতি ৬০ টাকা দরে। অথচ এই চিনির দাম সরকারিভাবে নির্ধারণ করা হয়েছিল ৬৫ টাকা। ভারত থেকে বেসরকারিভাবে আমদানি হওয়া চিনিতে বাজার সয়লাব হয়ে যাওয়ায় মিল মালিকরাও চিনির দাম কমাতে বাধ্য হয়েছেন। গত সপ্তাহে কারওয়ান বাজারে মেসার্স সোহেল জেনারেল স্টোর চিনি বিক্রি করেছে ৬৫ টাকা দরে। গতকাল ওই বিক্রেতা চিনির দাম চেয়েছেন কেজিপ্রতি ৬০ টাকা। তবে প্যাকেটজাত চিনির দাম কমেনি, এখনো ৬৭ থেকে ৭০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে।
আন্তর্জাতিক বাজারেও চিনির দাম কমছে। কয়েক মাস আগেও আন্তর্জাতিক বাজারে টনপ্রতি চিনির দাম ছিল ৭০০ ডলারের কাছাকাছি। এখন তা ৬২০ থেকে ৬৪০ ডলারে ওঠানামা করছে। ভারতে এ বছর ২৫ দশমিক ৮৩ মিলিয়ন টন চিনি উৎপাদিত হবে বলে আশা করা হচ্ছে, যা গত চার বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। ফলে ভারত ১০ লাখ টন চিনি রপ্তানির সুযোগ দিয়েছে সে দেশের ব্যবসায়ীদের। মাসখানেক ধরে সেই চিনি বাংলাদেশে আসছে।
এ ছাড়া ইউরোপ ও অস্ট্রেলিয়ায় চিনির উৎপাদন ভালো হবে বলে আশা করা হচ্ছে। ইউরোপে ২০০৫-০৬ সালের পর এ বছরই সর্বোচ্চ ৩০ মিলিয়ন টন চিনি উৎপাদনের পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে। সব মিলিয়ে ব্রাজিলে উৎপাদন কম হওয়ার ধাক্কা সামলে উঠছে বিশ্ববাজার।
কমতির দিকে ভোজ্য তেলের দাম : বাজারে খোলা ভোজ্য তেলের দাম কমেছে। পাশাপাশি একটি কম্পানি কমিয়েছে বোতলজাত ভোজ্য তেলের দাম। কারওয়ান বাজারে খোলা সয়াবিন বিক্রি হচ্ছে কেজিপ্রতি ১১৫ টাকা দরে। এতে লিটারপ্রতি (১ লিটার = ৯২৫ গ্রাম) দাম দাঁড়াচ্ছে প্রায় ১০৬ টাকা। এক সপ্তাহ আগেও প্রতিকেজি সয়াবিন তেলের দাম ১২০ টাকা ছিল বলে জানান কারওয়ান বাজারের বিক্রেতারা। পাম সুপার তেলের দামও কমেছে। ১০৫ থেকে ১০৬ টাকা কেজির খোলা পাম সুপার তেল এখন বিক্রি হচ্ছে ১০২ থেকে ১০৩ টাকা দরে। এতে লিটারপ্রতি দাম দাঁড়াচ্ছে প্রায় ৯৪ টাকা।
কারওয়ান বাজারের মুদি দোকানের মালিক মিজানুর রহমান জানান, সিটি গ্রুপ তাদের সয়াবিন তেলের দাম লিটারে দুই টাকা কমিয়েছে। বিক্রেতাদের দুই টাকা কমে দিলেও তারা বোতলের গায়ের দাম আগের মতোই রেখেছে। বিক্রেতারা এখন প্রতি পাঁচ লিটারের তীর ব্র্যান্ডের তেলের বোতল কিনছেন ৫৭৫ টাকা দরে। বিক্রি করছেন ৫৮০ টাকায়। আগে কেনা দাম ছিল ৫৮৫ টাকা। বিক্রি করতেন ৫৯০ টাকা দরে। বোতলের গায়ের মুদ্রিত দাম ৫৯৫ টাকা।

No comments

Powered by Blogger.