অর্থনীতি সমিতির সেমিনার : দেশের অর্থনীতির প্রধান চ্যালেঞ্জ দুর্নীতি, বেকারত্ব ও বিনিয়োগ হ্রাস

বেকারত্ব সমস্যা, আয়বৈষম্য, দুর্নীতি এবং সরকারের ঋণের কারণে ব্যক্তিখাতে বিনিয়োগ না হওয়াকে দেশের অর্থনীতির প্রধান চ্যালেঞ্জ হিসেবে চিহ্নিত করেছে বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি। সমিতির মতে, বিদ্যুত্ সঙ্কট ও ভেঙে পড়া যোগাযোগ ব্যবস্থার কারণে দেশের উত্পাদন হ্রাস পাচ্ছে। আর দুর্বল বাজার ব্যবস্থাপনার কারণে বাড়ছে নিত্যপণ্যের দাম। এসব সঙ্কট মোকাবিলায় সরকারের ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় সমন্বিত কোনো উদ্যোগ নেই। গতকাল রাজধানীর ইনস্টিটিউট অব ইঞ্জিনিয়ার্স মিলনায়তনে ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা শীর্ষক জাতীয় সেমিনারে এসব কথা বলেন সমিতির সাবেক সভাপতি ড. কাজী খলিকুজ্জামান আহমদ।


সরকারের ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা নিয়ে দু’দিনব্যাপী সেমিনারের আয়োজন করেছে অর্থনীতি সমিতি। গতকাল উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন ড. খলিকুজ্জামান। সমিতির সভাপতি অধ্যাপক ড. আবুল বারাকাতের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য রাখেন সমিতির সাধারণ সম্পাদক ড. তৌফিক আহমদ চৌধুরী। সমিতির সদস্যরা উন্মুক্ত আলোচনায় অংশ নেন। মূল প্রবন্ধে কাজী খলিকুজ্জামান বলেন, সরকারের পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার
লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে কর্মসংস্থান সৃষ্টি সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতা হয়ে দাঁড়াবে। দেশে শতকরা চার ভাগ দরিদ্র মানুষ রয়েছে মর্মে সরকারের পক্ষ থেকে প্রচার করা হলেও প্রকৃতপক্ষে বেকারের সংখ্যা অনেক বেশি। বেকারত্ব হার নির্ধারণে সরকারি প্রতিষ্ঠান পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) প্রচলিত পদ্ধতির সমালোচনা করে তিনি বলেন, দেশে কমপক্ষে ৩৫ শতাংশ লোক বেকার রয়েছে। বেকারত্ব দূর করতে ব্যপক কর্মসংস্থান সৃষ্টির লক্ষ্যে বিনিয়োগ বাড়ানোর পরামর্শ দেন তিনি।
দেশের সঞ্চয় ও বিনিয়োগ কমে যাওয়ায় উদ্বেগ প্রকাশ করেন ড. খলিকুজ্জামান। তিনি বলেন, গত অর্থবছরে জিডিপির মোট ২৯ শতাংশ সঞ্চয় হয়েছে, আর বিনিয়োগ হয়েছে মাত্র ২৫ ভাগ। সঞ্চয় থাকা সত্ত্বেও জাতীয় উত্পাদনের শতকরা চার ভাগ অর্থ কোথায় ব্যয় হয়, এমন প্রশ্ন রাখেন তিনি। সরকারের পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় সঞ্চয় ও বিনিয়োগের হার বাড়ানোর লক্ষ্য থাকলেও তা অর্জনের সম্ভাব্যতা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেন তিনি।
সরকার কোনো লক্ষ্যমাত্রাই অর্জন করতে পারছে না বলে দাবি করেন ড. খলিকুজ্জামান। তিনি বলেন, রাজস্ব খাতে অতিরিক্ত ব্যয় মেটাতে সরকার প্রচুর ঋণ করতে বাধ্য হচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ঋণ নিলে নতুন টাকা প্রিন্ট করায় মূল্যস্ফীতি বেড়ে যায়। আবার তফসিলি ব্যাংক থেকে ঋণ গ্রহণ করলে বেসরকারি পর্যায়ে বিনিয়োগের সুযোগ কমে যায়। তাছাড়া, গ্যাস ও বিদ্যুত্ সঙ্কট, যাতায়াত ব্যবস্থার বেহাল দশার কারণেও কাঙ্ক্ষিত হারে বিনিয়োগ বাড়ছে না বলে দাবি করেন তিনি। একই কারণে শিল্পখাতে উত্পাদন কমে যাচ্ছে বলেও তিনি মন্তব্য করেন।
এসব সমস্যা মোকাবিলায় সরকারের পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় সমন্বিত কোনো কর্মপরিকল্পনা নেই বলে মন্তব্য করেন ড. খলিকুজ্জামান। তিনি বলেন, প্রতিটি খাতে পৃথকভাবে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। কিন্ু্ত সব সমস্যা বিবেচনা করে কেন্দ্রীয়ভাবে তা সমাধানের কোনো পন্থা এ পরিকল্পনায় নেই। এ অবস্থায় ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা সফল হবে না বলে তিনি মন্তব্য করেন।
দুর্নীতির কারণে পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার লক্ষ্যমাত্রা ব্যাহত হতে পারে বলেও মন্তব্য করেন ড. খলিকুজ্জামান। তিনি বলেন, দেশে ব্যাপকহারে দুর্নীতি ছড়িয়ে পড়েছে। বর্তমানে এমন কোনো খাত নেই যেখানে দুর্নীতি হচ্ছে না। সরকারি অফিসে অর্থের লেনদেন ছাড়া কোনো কাজই হয় না বলে তিনি দাবি করেন।
বিগত শতাব্দীর ’৯০ দশক থেকে দেশে দারিদ্র্যের হার উল্লেখযোগ্য হারে কমেছে বলে দাবি করেন অর্থমন্ত্রী। এ ব্যাপারে কাজী খলিকুজ্জামান বলেন, গত এক দশকে দরিদ্র মানুষের সংখ্যা ৪০ ভাগ থেকে সাড়ে ৩১ ভাগে নেমে এসেছে। তবে এ সময়ে দরিদ্র মানুষের প্রকৃত সংখ্যা সম্পর্কে সরকারের পক্ষ থেকে কোনো তথ্য দেয়া হচ্ছে না। দেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি বিবেচনা না করে মৌলিক অধিকার, বিশেষ করে সেনিটেশন, প্রাথমিক শিক্ষা ও স্বাস্থ্য সুবিধার সহজলভ্যতা বিবেচনা করে দারিদ্র্য বিবেচনা করার পরামর্শ দেন তিনি।
তিনি আরও বলেন, জাতীয় আয়ের প্রবৃদ্ধি বাড়লেও সাম্প্রতিক সময়ে দেশে ব্যাপকহারে আয়বৈষম্য বেড়ে গেছে। আর গ্রামাঞ্চলে আয়বৈষম্য বেড়েছে সবচেয়ে বেশি। রাজশাহী, খুলনা ও বরিশাল বিভাগে সবচেয়ে বেশি দরিদ্র মানুষের বসবাস। তাছাড়া প্রতিটি জেলার বিভিন্ন উপজেলা ও ইউনিয়ন অন্যান্য এলাকার তুলনায় পিছিয়ে রয়েছে।
উল্লেখ্য, চলতি বছরের জুলাই মাসে সরকার ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা চূড়ান্ত করেছে। পরিকল্পনার আওতায় সরকার উত্পাদনশীল সেক্টরে ২০১৫ সালের মধ্যে ১৬ শতাংশ কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং জিডিপি ৮ শতাংশে উন্নীত করার লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে। তাছাড়া ২০১৫ সালের মধ্যে বিদ্যুত্ উত্পাদন ১৫ হাজার ২০০ মেগাওয়াটে উন্নীত করার লক্ষ্য রয়েছে সরকারের। লক্ষ্য পূরণ হলে ৬৫ শতাংশ অঞ্চল বিদ্যুত্ সুবিধা পাবে।
ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা চূড়ান্ত করার আগে পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগ (জিইডি) দেশের ১৪টি সেক্টরের সঙ্গে আলাদাভাবে মতবিনিময় করেছে। এছাড়া বিশ্বব্যাংকসহ দাতা সংস্থাগুলোর সঙ্গেও তারা এ নিয়ে বৈঠক করেছে। লক্ষ্য অর্জনে ১৩ দশমিক ৪৭ ট্রিলিয়ন টাকা বিনিয়োগের পরিকল্পনা রয়েছে। এ সময়ের মধ্যে দেশের গড় মূল্যস্ফীতি ৬ শতাংশে নামিয়ে আনার পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের। ২০১০-১১ অর্থবছর থেকে এ পরিকল্পনা বাস্তবায়ন শুরু হয়েছে।

No comments

Powered by Blogger.