গাদ্দাফির দাফন নিয়ে বিভক্ত লিবিয়া-মাংসের ফ্রিজে মরদেহ

লিবিয়ার নেতা মুয়াম্মার গাদ্দাফিকে ধরার পর যতটা সহজে তাঁকে মারার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল ন্যাশনাল ট্রানজিশনাল কাউন্সিল (এনটিসি) যোদ্ধারা, তাঁর শেষযাত্রা নিয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়াটা ততটাই কঠিন মনে হচ্ছে এনটিসির কাছে। সাবেক এই প্রতাপশালী শাসকের মরদেহ কোথায়, কিভাবে সমাহিত করা হবে, তা নিয়ে বিভক্ত হয়ে পড়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। এ কারণে গাদ্দাফির দাফন বিলম্বিত হচ্ছে। মরদেহ রাখা হয়েছে পুরনো একটি মাংসের দোকানের ফ্রিজে। আবার গাদ্দাফির মরদেহ গোপনে দাফন করা হতে পারে বলেও গুঞ্জন শুরু হয়েছে।


এদিকে কিভাবে গাদ্দাফির মৃত্যু হলো, তা নিয়ে পূর্ণাঙ্গ তদন্তের আহ্বান জানিয়েছেন জাতিসংঘ মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনার নাভি পিল্লাই। গতকাল শুক্রবার জেনেভায় তাঁর মুখপাত্র রুপার্ট কলভিল্লে সাংবাদিকদের বলেন, 'তিনি (গাদ্দাফি) কিভাবে মারা গেলেন, তা নিয়ে ধোঁয়াশা সৃষ্টি হয়েছে। এ
ব্যাপারে তদন্ত হওয়া প্রয়োজন।' এর পরিপ্রেক্ষিতে এনটিসির সিনিয়র সদস্য মোহাম্মেদ সাইয়ে বলেন, গাদ্দাফির মৃত্যুসংক্রান্ত নথি তৈরির জন্য লিবিয়ার বাইরে থেকে এসে তৃতীয় কোনো পক্ষ কাজ করবে।
গাদ্দাফি মারা যাওয়ার পর যুক্তরাজ্য থেকে চীন পর্যন্ত অনেকেই তৃপ্তির ঢেঁকুর গিলে বলেছে, লিবিয়ার সামনে এখন নতুন দিন। তারা দেশটির অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনার জন্য এনটিসি সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে।
নাম প্রকাশ না করে এক লিবীয় কর্মকর্তা জানান, গাদ্দাফির লাশ সমাহিত করা নিয়ে একমত হতে পারছেন না এনটিসির শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তারা। কেউ বলছেন, সবার কাছে গাদ্দাফির মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত করতে দাফন বিলম্বিত করা প্রয়োজন। আবার মুসলিম রীতি অনুযায়ী পরিপূর্ণ মর্যাদায় দ্রুতই সমাহিত করার কথা বলছেন কেউ কেউ। কিন্তু গাদ্দাফির জন্মশহর সার্ত না যেখানে এখন মরদেহ রাখা হয়েছে সেই মিসরাতায় দাফন করা হবে, এ নিয়েই মতভেদ রয়েছে।
লিবিয়ার তেলমন্ত্রী আলী তারহুনি গতকাল বলেন, গাদ্দাফির লাশ মিসরাতায়ই রাখা আছে। এ মুহূর্তে দাফনের জন্য সেখান থেকে সরিয়ে নেওয়ার সম্ভাবনা নেই। গাদ্দাফিকে দাফনের কী ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে_এ প্রশ্নে তারহুনি বলেন, 'এখনো কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি।'
অবশ্য গতকালই কোনো একসময় গোপনে গাদ্দাফিকে দাফন করা হতে পারে বলে গুঞ্জন শোনা গেছে। সেখানে কর্মরত সাংবাদিকরা বলছেন, গাদ্দাফিকে গোপনে সমাহিত করা হতে পারে। আল-কায়েদা নেতা ওসামা বিন লাদেনের লাশ যেভাবে সাগরে সমাহিত করার কথা বলা হয়েছিল গাদ্দাফির ক্ষেত্রেও তেমন কিছু ঘটতে পারে বলে গুঞ্জন উঠেছে। লাদেনের মরদেহ সাগরে সমাহিত করার পর মার্কিন কর্মকর্তারা বলেছিলেন, তাঁর কবর উগ্রবাদীদের তীর্থস্থল হয়ে উঠতে পারে_এমন আশঙ্কা থেকেই সাগরকে বেছে নিয়েছিলেন তাঁরা।
গত বৃহস্পতিবার জন্মশহর সার্তের কাছ থেকে গাদ্দাফিকে আটক করেন এনটিসি যোদ্ধারা। পরে তাঁকে হত্যা করা হয়। তাঁর দুই পা, পেট ও মাথায় গুলি লেগেছিল। গাদ্দাফি ধরা পড়ার মুহূর্তে আসলে কী ঘটেছিল তা নিয়েও জল্পনা বাড়ছে। তাঁকে হত্যা করার কথা অস্বীকার করেছে লিবিয়ার অন্তর্বর্তী সরকার। প্রধানমন্ত্রী মাহমুদ জিবরিল বলছেন, সার্তে ক্রসফায়ারে পড়ে মাথায় গুলিবিদ্ধ হয়ে গাদ্দাফি নিহত হয়েছেন। আবার এনটিসি যোদ্ধারা বলছেন, একটি সুড়ঙ্গে গাদ্দাফিকে খুঁজে পাওয়া যায়। পরে যোদ্ধারা তাঁকে গুলি করে হত্যা করেন। বিভিন্ন টেলিভিশন চ্যানেলে প্রচারিত ভিডিওচিত্রে গাদ্দাফির লাশ রাস্তা দিয়ে টেনে-হিঁচড়ে নিয়ে যেতে দেখা গেছে।
গাদ্দাফিকে অবৈধভাবে মেরে ফেলা হতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছে জাতিসংঘ। সংস্থাটির মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনারের মুখপাত্র বলেন, দুটি ভিডিওচিত্র প্রকাশ পেয়েছে। একটিতে তাঁকে জীবিত এবং অন্যটিতে মৃত দেখা গেছে। মোবাইল ফোনে ধারণ করা ওই ভিডিওচিত্র নিয়ে চার থেকে পাঁচ ধরনের বক্তব্য পাওয়া গেছে। সে কারণেই বড় ধরনের প্রশ্ন উঠেছে। তিনি বলেন, যুুদ্ধে মানুষ মারা যাওয়ার বিষয়টি আন্তর্জাতিক আইনে স্বীকৃত। কিন্তু সংক্ষিপ্ত বিচার, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড অবৈধ।
যুক্তরাজ্য ভিত্তিক আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালও গাদ্দাফির মৃত্যু নিয়ে পূর্ণাঙ্গ, স্বাধীন ও নিরপেক্ষ তদন্ত দাবি করেছে।
গাদ্দাফির বন্ধু ভেনিজুয়েলার প্রেসিডেন্ট হুগো শাভেজ সাংবাদিকদের বলেন, 'তারা (এনটিসি) তাঁকে (গাদ্দাফি) হত্যা করেছে।'
পাকিস্তান সফরকালে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন বলেছেন, কর্নেল গাদ্দাফির মৃত্যুর মধ্য দিয়ে লিবিয়ার জনগণের জন্য নতুন যুগের সূচনা হলো।
ন্যাটো মহাসচিব অ্যান্ডারস ফগ রাসমুসেন বলেন, গাদ্দাফি নিহত হওয়ার মধ্য দিয়ে লিবিয়ায় ন্যাটো জোটের অভিযান শেষ হওয়ার পথে। ফরাসি প্রেসিডেন্ট নিকোলা সারকোজি বলেছেন, স্পষ্টতই ওই অভিযান শেষ হয়ে আসছে। ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী উইলিয়াম হাগ বলেন, গাদ্দাফির মৃত্যুতে অভিযান শেষের পথ অনেক কাছাকাছি চলে এসেছে।
এনটিসি আজ শনিবার বেনগাজি শহর থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে গাদ্দাফির কবল থেকে লিবিয়া মুক্ত হওয়ার ঘোষণা দিতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
গত ২৩ আগস্টে রাজধানী ত্রিপোলির পতনের মধ্য দিয়ে ক্ষমতাচ্যুত হন ৪২ বছর ধরে ক্ষমতায় থাকা গাদ্দাফি। এর পর থেকে তাঁর অবস্থান সম্পর্কে নিশ্চিত কিছু জানা যাচ্ছিল না। আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত তাঁর বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানাও জারি করেছিল। সূত্র : এএফপি, বিবিসি, রয়টার্স, টেলিগ্রাফ, সিএনএন ও আল-জাজিরা অনলাইন।

No comments

Powered by Blogger.