নারায়ণগঞ্জ সিটি নির্বাচন-ছুটির দিনে জোর গণসংযোগ by অমিতোষ পাল ও দিলীপ কুমার মণ্ডল,

৯৮১ সালের কথা। বর্তমান মেয়র পদপ্রার্থী ডা. সেলিনা হায়াত আইভীর বাবা আলী আহমেদ চুনকা তখন নারায়ণগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি। অন্য মেয়র পদপ্রার্থী এ কে এম শামীম ওসমানের বাবা এ কে এম শামসুজ্জোহা তখন কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের সদস্য। নভেম্বর মাসে নারায়ণগঞ্জের বালুর মাঠের জনসভায় প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন সদ্য দেশে ফেরা আওয়ামী লীগ সভানেত্রী ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তাঁর উপস্থিতিতেই শুরু হয় দুই নেতার মধ্যে বচসা। পাঞ্জাবি ছিঁড়ে যায় শামসুজ্জোহার।


সেই থেকে উভয় পরিবারের মধ্যে তৈরি হয় দূরত্ব। ১৯৮৪ সালে আলী আহমেদ চুনকার মৃত্যুর পর নারায়ণগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের পুরোটার নিয়ন্ত্রক হয়ে ওঠে ওসমান পরিবার। ২০০৩ সালে আইভী পৌর চেয়ারম্যান
নির্বাচিত হওয়ার পর চুনকা পরিবার আবার ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করে।
নারায়ণগঞ্জের বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, শহরের মাঝ দিয়ে চলে যাওয়া ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ রেললাইনের মতোই এখানে দুই শিবিরে ভাগ হয়ে আছে আওয়ামী লীগ। রেললাইনের উত্তরে শামীম ওসমান আর দক্ষিণে আইভীর প্রভাব। স্থানীয় লোকজন জানায়, চুনকা-শামসুজ্জোহার মধ্যে সত্তরের দশক থেকেই স্নায়ুযুদ্ধ চলছিল। বালুর মাঠের বিরোধকে কেন্দ্র করে বিভাজন স্পষ্ট হয়ে ওঠে। তখন থেকে দুজনের সমর্থকদের মধ্যে গণ্ডগোল শুরু হয়। চুনকার মৃত্যুর পর সেটার অবসান হয়। ১৯৮৪ সালে শামসুজ্জোহার মৃত্যুর পর আওয়ামী লীগের নিয়ন্ত্রণ চলে আসে শামীম ওসমানের ওপর। বিগত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সারাহ বেগম কবরী সংসদ সদস্য হওয়ার পর থেকে কয়েক বছর ধরেই চলছে কবরী-আইভী সমর্থকদের সঙ্গে ওসমান সমর্থকদের বিরোধ। এমনকি নিজেরাও একজন আরেকজনের বিরুদ্ধে তেড়ে যাওয়ার দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। নির্বাচনী প্রচারণায়ও সমর্থকরা একজন আরেকজনের বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করে চলেছেন।
নারায়ণগঞ্জ জেলা যুবলীগের সভাপতি ও আইভীর সমর্থক আবদুল কাদির কালের কণ্ঠকে বলেন, 'ওসমান পরিবার সব কিছু দখলে রাখতে চায়। অথচ পঁচাত্তরে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর চুনকা সাহেবই এখানে আওয়ামী লীগকে ধরে রেখেছিলেন। আবার ২০০১ সালের নির্বাচনের পর ওসমান পরিবারের কাউকে পাওয়া যায়নি। তখন নারায়ণগঞ্জে আওয়ামী লীগকে বাঁচিয়ে রেখেছেন আইভী। তবে দুই পরিবারের বিরোধ রাজনৈতিক।'
অন্যদিকে শামীম ওসমানের সমর্থক হিসেবে পরিচিত জেলা আওয়ামী লীগ নেতা গোপীনাথ দাস কালের কণ্ঠকে বলেন, '৩৩ বছর আগে শহরের দেওভোগে লক্ষ্মীনারায়ণের মন্দিরের সাড়ে চার একর জায়গা দখল করাকে কেন্দ্র করে দুই পরিবারের মধ্যে বিরোধ তৈরি হয়। তখন চুনকা সাহেব ওই জায়গা দখল করে নেন। এখনো সেটা চুনকা পরিবারের দখলে আছে। আসলে আইভী হলেন সংস্কারবাদী মহিলা। জামায়াত-বিএনপির এজেন্ট হয়ে তিনি আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে কাজ করছেন।'
জানা গেছে, এখানে আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গসংগঠনের নেতা-কর্মীদের মধ্যে শহরের জামতলা, উত্তর চাষাঢ়া, গোদনাইল, হাজীগঞ্জসহ কয়েকটি এলাকায় শামীম ওসমানের ব্যাপক প্রভাব রয়েছে। অন্যদিকে আইভীর প্রভাব রয়েছে দেওভোগ, বাবুরাইল, নিতাইগঞ্জসহ কয়েকটি এলাকায়। জেলা আওয়ামী লীগের আহ্বায়ক ও নারায়ণগঞ্জ সদর আসনের সাবেক সংসদ সদস্য এস এম আকরাম আইভীর পক্ষে প্রকাশ্যে প্রচারণা চালাচ্ছেন। বন্দর এলাকায় তাঁর বাড়ি। সেখানে তাঁর একটি বড় ভোটব্যাংক রয়েছে। এ ছাড়া শহর আওয়ামী লীগের সভাপতি আনোয়ার হোসেন, জেলা যুবলীগের সভাপতি আবদুল কাদির, জেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের আহ্বায়ক নিজামউদ্দিন, শহর যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক আহমদ শাহ রেজা উজ্জ্বল, জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য মো. শহীদুল্লাহ, জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক জি এম আরাফাতসহ দলের অনেকেই আইভীর পক্ষে কাজ করছেন। তাঁরা বলছেন, এটা দলীয় নির্বাচন নয়। আইভীর পক্ষে কাজ করলেও তাঁরা আওয়ামী লীগের সঙ্গেই আছেন। ভবিষ্যতেও আওয়ামী লীগেই থাকবেন।
অন্যদিকে শামীম ওসমানের পক্ষে আছেন জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম আহ্বায়ক মফিজুল ইসলাম, সদস্য আনিসুর রহমান দীপু, চন্দন শীল, শহর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট খোকন সাহা, জেলা যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক আবু হাসনাত মোহাম্মদ বাদল, জেলা কৃষক লীগের সভাপতি নাজিম উদ্দিনসহ অঙ্গসংগঠনের বেশির ভাগ নেতা। তাঁরা বলছেন, আইভী দলের প্রতি শ্রদ্ধা না দেখিয়ে একগুঁয়েমির আশ্রয় নিয়েছেন। এটা দলীয় শৃঙ্খলা লঙ্ঘনের শামিল। এ জন্য তাঁর বিরুদ্ধে দলের পক্ষ থেকে ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।
ছুটির দিনে জমজমাট প্রচার : নির্বাচনের দিন ৩০ অক্টোবর যতই ঘনিয়ে আসছে, ততই বেগবান হচ্ছে প্রধান প্রার্থীদের গণসংযোগ। গতকাল শুক্রবার ছিল ছুটির দিন। তাই এ কে এম শামীম ওসমান, সেলিনা হায়াত আইভী ও অ্যাডভোকেট তৈমূর আলম খন্দকার ও তাঁদের কর্মীরা ভোটারদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে সমর্থন চান।
শামীম ওসমানের গণসংযোগ : আওয়ামী লীগ সমর্থিত মেয়র পদপ্রার্থী এ কে এম শামীম ওসমান গতকাল সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত সিদ্ধিরগঞ্জের ১ নম্বর ওয়ার্ডের পশ্চিম মিজমিজি, পাইনাদি ও হীরাঝিল এলাকায় গণসংযোগ, উঠোন বৈঠক ও পথসভা করেছেন। এ সময় তাঁর সঙ্গে ছিলেন নজরুল ইসলাম বাবু এমপি, আবদুল্লাহ আল কায়সার এমপি, সিদ্ধিরগঞ্জ থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি মুজিবর রহমান, সাধারণ সম্পাদক হাজি ইয়াছিন মিয়া প্রমুখ। বিকেলে তিনি শহরের নতুন পালপাড়ায় উঠোন বৈঠক করে মিন্নত আলী শাহর মাজার জিয়ারত করেন। পরে ১৬ নম্বর ওয়ার্ডের দেওভোগ বাবুরাইল, ব্যাপারীপাড়া ও পাক্কা রোড এলাকায় গণসংযোগ করেন। এ ছাড়া সিদ্ধিরগঞ্জের বিভিন্ন ওয়ার্ডে গণসংযোগে রয়েছেন ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া।
এদিকে বন্দরের বৃন্দাবন আখড়ায় এক উঠোন বৈঠকে কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের উপপ্রচার সম্পাদক অসীম কুমার উকিল, উপদপ্তর সম্পাদক মৃণাল কান্তি দাস, সদস্য সুজিত রায় নন্দী, স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাধারণ সম্পাদক পঙ্কজ দেবনাথ, উপজেলা চেয়ারম্যান বিশ্বনাথ সরকার বিটু, আওয়ামী লীগ নেতা লিটন সাহা বক্তব্য দেন।
অধ্যাপিকা অপু উকিল এমপির নেতৃত্বে যুব মহিলা লীগের কয়েকটি দল শহরের গোয়ালপাড়া, পালপাড়া, নিতাইগঞ্জ, শীতলক্ষ্যা এলাকায় গণসংযোগ করেন। এ সময় উপস্থিত ছিলেন ঢাকা মহানগর মহিলা যুবলীগের (দক্ষিণ) সাধারণ সম্পাদক সাবিনা আক্তার তুহিন, নুরুন্নাহার লাভলী প্রমুখ।
আইভীর গণসংযোগ : ডা. সেলিনা হায়াত আইভী গতকাল সকালে শহরের জামতলা, কলেজ রোড, গলাচিপা ও মাসদাইর এলাকায় গণসংযোগ করেন। বিকেলে তিনি বন্দরের মদনগঞ্জ এলাকায় গণসংযোগ করেন। এ সময় তাঁর সঙ্গে শহর আওয়ামী লীগের সভাপতি আনোয়ার হোসেন, সহসভাপতি হায়দার আলী পুতুল, কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক জি এম আরাফাত প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন। এ ছাড়া জেলা আওয়ামী লীগের আহ্বায়ক এস এম আকরাম বিভিন্ন এলাকায় আইভীর পক্ষে ভোট চান।
আইভী গণসংযোগকালে বলেন, 'আমি নারায়ণগঞ্জের কী উন্নয়ন করেছি, তা নারায়ণগঞ্জবাসী ভালো করেই জানেন।' নারায়ণগঞ্জকে শান্তির শহর গড়ার লক্ষ্যে তিনি দোয়াত-কলম প্রতীকে সবাইকে ভোট দেওয়ার আহ্বান জানান।
তৈমূরের গণসংযোগ : বিএনপি সমর্থিত মেয়র পদপ্রার্থী অ্যাডভোকেট তৈমূর আলম খন্দকার ১২ নম্বর ওয়ার্ডের খানপুর এলাকায় গণসংযোগ করেন। পরে তিনি খেলাফত মজলিসের নেতা-কর্মীদের সঙ্গে বৈঠক করেন। সেখানে খেলাফত মজলিসের নেতা-কর্মীরা তাঁকে সমর্থন জানান। দুপুরে সিদ্ধিরগঞ্জ পুল, মিজমিজি, মজিববাগসহ বিভিন্ন এলাকায় গণসংযোগ করেন তিনি। এ সময় তাঁর সঙ্গে সাবেক সংসদ সদস্য আবুল কালাম, সাবেক সংসদ সদস্য গিয়াসউদ্দিনসহ বিএনপি নেতা-কর্মীরা উপস্থিত ছিলেন।

No comments

Powered by Blogger.