অনন্তকালব্যাপী বিদ্যুৎ

৯৮৭ সালে আমেরিকান ফিজিক্যাল সোসাইটির বার্ষিক সম্মেলন বিখ্যাত হয়ে আছে 'উডস্টক অব ফিজিক্স' নামে। পদার্থবিদ্যার গবেষকদের কাছে ১৯৮৭ সাল দুটি ঘটনার জন্য স্মরণীয়। প্রথমটি হলো_ ২৩ ফেব্রুয়ারি রাতের আকাশে এক তারার বিস্ফোরণ বা সুপারনোভার দেখা মেলা। ওই বিস্ফোরণের আলো বিশ্লেষণ করে জ্যোতির্পদার্থবিদ্যার জ্ঞানভাণ্ডার বাড়ানো সম্ভব হয়েছিল। ১৯৮৭ সালের দ্বিতীয় বড় ঘটনা ১৮-১৯ মার্চের সেই 'উডস্টক অব ফিজিক্স'। ঘটনাটি মিডিয়ায় এমন ফলাও করে প্রচার পেল যে, তারপর ক'দিন সম্মেলনে যোগদানকারী গবেষকরা নিউইয়র্ক শহরে ভিআইপি খাতির পেলেন।


বুকে সম্মেলনের ব্যাজসমেত বিজ্ঞানীরা ব্যস্ত রেস্তোরাঁয় ঢুকেও দেখতে পেলেন তাদের জন্য চেয়ার খালি করে দেওয়া হচ্ছে। রাজকীয় অভ্যর্থনা! কী কারণে এমন পরিস্থিতি? কী এমন উঠে এলো বিজ্ঞানীদের অধিবেশনে যে তা ঘিরে এত উন্মাদনা?
এসব প্রশ্নের উত্তর একটিই_ সুপারকন্ডাক্টিভিটি। পদার্থবিদ্যায় যা ভীষণ মূল্যবান জিনিস। সে কারণে দারুণ লোভনীয়। 'সুপার' উপসর্গটির অর্থ 'মহা' বা 'বিশাল'। যেমন সুপারস্টার, সুপার পাওয়ার, সুপার কম্পিউটার কিংবা সুপার মার্কেট। কন্ডাক্টিভিটি হলো পরিবাহিতা বা পরিবহন ক্ষমতা। বিজ্ঞানে এটি তাপ বা বিদ্যুৎ পরিবহন। কোনো পদার্থের তড়িৎ পরিবহন ক্ষমতা কতটা, সে বিচারে তাদের নানা শ্রেণীতে ভাগ করা হয়। বিজ্ঞানীরা বহুকাল আগে জেনে গেছেন, বিদ্যুৎ পরিবহনের কৌশলটি। পরমাণুর কণা ইলেকট্রনের দৌড় হলো তড়িৎ প্রবাহ। তামা বা লোহার মতো ধাতুর মধ্যে
ইলেকট্রন কণাগুলো বেশ ভালোভাবে ছুটতে পারে। ফলে তারা বিদ্যুতের সুপরিবাহী। অধিকাংশ প্লাস্টিক বা রবারের মধ্যে ইলেকট্রনগুলো কুপরিবাহী। এ রকম গুণের জন্যই বিদ্যুতের তার মোড়া থাকে প্লাস্টিকের আস্তরণে। যাতে হাত দিলেও শক না লাগে। এই সুপরিবাহী আর কুপরিবাহীর মাঝখানে রয়েছে আর এক ধরনের পদার্থ। সেমিকন্ডাক্টর বা আধা-পরিবাহী। উদাহরণ সিলিকন বা জারমেনিয়াম। এসব পদার্থ সাধারণ অবস্থায় কুপরিবাহী। কিন্তু একটু-আধটু অন্য জিনিসের সংমিশ্রণে বনে যায় পরিবাহী। এহেন ধর্মের জন্য ট্রানজিস্টর বা কম্পিউটার চিপ বানানো হয় সেমিকন্ডাক্টর দিয়ে।
সুপারকন্ডাক্টর বা সুপারকন্ডাক্টিভিটি জিনিসটা ওই তিন জাতের পদার্থ থেকে একেবারে আলাদা। কোনো পরিবাহী তার যখন বিদ্যুৎ বহন করে তখন তা গরম হয়ে ওঠে। তড়িৎ প্রবাহের ফলে তার কেন গরম হয়? তড়িৎ প্রবাহ মানে ইলেকট্রনের দৌড়। একটা-আধটা নয়, লাখো কোটি ইলেকট্রনের স্রোত। কিন্তু এই প্রবাহ নির্বিঘ্ন নয়। ইলেকট্রনরা তো দৌড়াচ্ছে না ফাঁকা মাঠে, তাদের ছুটতে হচ্ছে ধাতুর উপাদান অসংখ্য পরমাণুর ভিড় ঠেলে। এই ধাক্কায় কিছুটা পরিমাণে নষ্ট হচ্ছে ইলেকট্রনগুলোর শক্তি বা এনার্জি। ওই এনার্জি প্রকট হচ্ছে তাপ হিসেবে। তড়িৎ পরিবাহী তার হচ্ছে গরম। টোস্টারে যে তার লাল হয়ে প্রচুর তাপ জোগায় কিংবা ইলেকট্রিক বাল্বের বেলায় যে তার আলো ছড়ায়_ তা ওই জুল হিটিংয়ের কারণেই।
সুপারকন্ডাক্টিভিটি মানে ইলেকট্রনের বাধাবিঘ্নহীন দৌড়। এমনিতে ওই বাধার কারণে উৎস থেকে ব্যবহারের জায়গায় পাওয়ার স্টেশন থেকে আমাদের বাড়িঘরে পেঁৗছতে বিদ্যুতের কিছুটা হারিয়ে যায়। সুপারকন্ডাক্টিভিটিতে ইলেকট্রনের স্রোত বাধামুক্ত, তাই এতে বিদ্যুৎ একটু হারায় না। তড়িৎ উৎসে থাকে যতটা, তার পুরোটাই পেঁৗছায় ব্যবহারের জায়গায়। যে পদার্থ বা তার এভাবে বিনা বাধায় বিদ্যুতের পুরোটা পরিবহন করবে তাকে বলা যাবে সুপারকন্ডাক্টর বা অতিপরিবাহী। অতিপরিবাহী তার দিয়ে একটি কয়েল বা চক্র বানানো হলো। এবার এই তারের মধ্যে কোনোভাবে বিদ্যুৎ পাঠানো শুরু হলো। তারটি যেহেতু অতিপরিবাহী, সেটি তড়িৎ পরিবহন করবে। একটুও নষ্ট না করে। সেহেতু দেখা যাবে চক্রের মধ্যে দিয়ে বিদ্যুৎ ঘুরপাক খাচ্ছে, খেয়েই চলেছে। বাইরে থেকে আর কখনও বিদ্যুতের জোগান না দিলেও কারেন্ট চালু থাকবে অনন্তকাল। সুপারকন্ডাক্টিং কয়েলের মধ্য দিয়ে অনন্তকালব্যাপী বিদ্যুৎ পরিবহন কিন্তু অবাস্তব ব্যাপার নয়।
বিদ্যুৎ পরিবহন যদি সম্ভব হয় বিনা ক্ষয়ে, তাহলে প্রযুক্তিতে আসতে পারে বিপ্লব। একদা যেমন এসেছিল লাইট বাল্ব কিংবা ট্রানজিস্টর আবিষ্কারে। সুপারকন্ডাক্টিভিটি বিপ্লবে মিলতে পারে এমন ট্রেন, যা ছুটবে ঘণ্টায় দুই-তিনশ' কিলোমিটার, সহজলভ্য হতে পারে বিদ্যুৎচালিত গাড়ি, আসতে পারে আজকের তুলনায় বহুগুণ ক্ষমতাবান কম্পিউটার, তৈরি হতে পারে এমন পরমাণু বিদ্যুৎচুলি্ল যা তেজস্ক্রিয়তা ছড়াবে না। সুপারকন্ডাক্টিভিটি গবেষণা কত মূল্যবান, তা বোঝাতে একটি তথ্যই যথেষ্ট। এ বিষয়ে কাজ করে এ পর্যন্ত নোবেল পেয়েছেন ১০ জন। সূত্র : দেশ।

No comments

Powered by Blogger.