ক্রিকেট মাঠে রক্তপাত by রাহেনুর ইসলাম

ফিদেল এডওয়ার্ডসের বাউন্সারে মাথায় আঘাত পেয়ে মাঠ ছেড়েছেন শাহরিয়ার নাফীস। গতকাল চট্টগ্রামে রক্ত মুছতে মুছতে মাঠ ছাড়তে হয় তাঁকে। আঘাতটা অতটা গুরুতর নয় বলে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে এ টেস্টে আবার ব্যাট হাতে নামতে পারবেন বাংলাদেশের এ ব্যাটসম্যান। ক্রিকেট মাঠে রক্তপাতের ঘটনা আছে ভূরি ভূরি। ১৯৩২-৩৩ মৌসুমের কুখ্যাত বডিলাইন সিরিজকে হিসাবের বাইরে রাখলেও এমন ঘটনা বলে শেষ করা যাবে না যেখানে বোলার হ্যারল্ড লারউডের মতো 'অপকৌশলের' আশ্রয় না নিয়েও বোলার ত্রাস ছড়িয়েছেন ব্যাটসম্যানদের মনে। মাঠ থেকে রক্তাক্ত ক্রিকেটারকে নিয়ে অ্যাম্বুলেন্স ছুটেছে হাসপাতালে। ফিরে এসে সেই ক্রিকেটারই লড়েছেন বীরের মতো।


অনেকের আবার ক্যারিয়ার, এমনকি জীবনও শেষ হয়ে গেছে মাঠে পাওয়া আঘাতে।এক বাউন্সারে ক্যারিয়ারই শেষ!
ষাট-সত্তরের দশকে হেলমেট ছাড়াই ব্যাট করতে হতো সবাইকে। চাইলে ওভারের সব কটি বলে বাউন্সারও দিতে পারতেন বোলাররা। তাই অ্যান্ডি রবার্টস, জোয়েল গার্নার, চার্লি গ্রিফিথ, মাইকেল হোল্ডিংদের তোপে ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরে যাওয়া অনেক ক্রিকেটারেরই ঠিকানা হতো হাসপাতাল। ১৯৬১-৬২ মৌসুমের ক্যারিবীয় সফরে বার্বাডোজ টেস্টে ভারতের নরি কন্ট্রাক্টর মাথায় আঘাত পেয়ে বসেন চার্লি গ্রিফিথের বাউন্সারে। নাক-কান দিয়ে গড়িয়ে পড়া রক্তে লাল হয়ে যায় উইকেট। দ্রুত হাসপাতালে নেওয়া হয় তাঁকে। মস্তিষ্কে রক্তকণা জমে যাওয়ায় করাতে হয় অস্ত্রোপচার। হাসপাতালে ছয় দিন জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে থাকা কন্ট্রাক্টরকে রক্তও দেন দলের কজন ক্রিকেটার। এরপর স্বাভাবিক জীবনে ফিরলেও আর আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলা হয়নি ৩১ টেস্টে ১ সেঞ্চুরি ও ১১ ফিফটিসহ ১৬১১ রান করা নরি কন্ট্রাক্টরের।
সুলতান সুলতানের মতোই...
টাকায় কি না হয়? বাড়ি, গাড়ি, বিলাসবহুল জীবন, ক্রিকেট...না ক্রিকেট হয় না। আরব আমিরাতের ধনকুবের সুলতান জারাওয়ানি সেটা হাড়ে হাড়েই বুঝেছিলেন ১৯৯৬ বিশ্বকাপে। অভিবাসী ক্রিকেটারদের নিয়ে গড়া দলটিতে আরব আমিরাতে জন্ম নেওয়া একমাত্র ক্রিকেটার হওয়ায় পেয়েছিলেন অধিনায়কত্ব। একে সুলতান তারপর অধিনায়ক_একটু সাহস তো থাকতেই হয়, সেটা দেখাতে সাদা বিদ্যুৎখ্যাত দক্ষিণ আফ্রিকান পেসার অ্যালান ডোনাল্ডের বিপক্ষে ব্যাট করতে নেমেছিলেন হেলমেট ছাড়া। ডোনাল্ডের প্রথম বলটাই আঘাত করে সুলতানের মাথায়! উড়ে যায় টুপি। কিন্তু মাথায় হাত বুলিয়ে 'কিছুই হয়নি' এমন একটা ভাব করে আবারও দাঁড়িয়ে যান ক্রিজে এবং যথারীতি হেলমেট ছাড়াই! এরপর আর কোনো বাউন্সারে আঘাত না পেলেও ছয় বল পর আউট হয়ে যান ম্যাকমিলানের বলে। এ নিয়ে নিজের আত্মজীবনীতে ডোনাল্ড লিখেছেন, 'তখন মনে হয়েছিল আমি খুন করেছি কোনো ব্যাটসম্যানকে। কিন্তু অবাক হয়ে যাই সুলতানকে আবারও হেলমেট ছাড়া ব্যাট করতে দেখে।' ৭ ম্যাচের ক্যারিয়ারে সুলতান জারওয়ানির উইকেট ৫টি, সেখানে শচীন টেন্ডুলকারের উইকেটটি।
গাভাস্কারের মহাকাব্য, ভারতের অসহায়ত্ব
ওয়েস্ট ইন্ডিজের দানবীয় বোলারদের দেখলেই হাঁটু কাঁপবে_এ কাতারে ছিলেন না সুনীল গাভাস্কার। বরং তাঁর সামনে উল্টো তাল কেটে গিয়েছিল ক্যারিবীয়দেরই। ১৯৭১ সালে অভিষেক সিরিজে ওয়েস্ট ইন্ডিজের মাটিতেই যে ব্যাট হাতে 'দাদাগিরি' দেখিয়েছিলেন 'লিটল মাস্টার'! সেই সিরিজে তাঁর ৮টি ইনিংস ৬৫, ৬৭*, ১১৬, ৬৪*, ১, ১১৭*, ১২৪, ২২০! গাভাস্কার অভিষেক সিরিজে ৭৭৪ রান করার রেকর্ডও গড়েন সেই সিরিজে! তাঁকে নিয়ে ক্যালিপসো রচনা করেন ওয়েস্ট ইন্ডিজের ক্রিকেটপ্রেমীরাই। অথচ সিরিজটা কিন্তু ভারতের অন্য ব্যাটসম্যানদের জন্য ছিল মহাকঠিন। হাসপাতাল ঘুরে আসতে হয়েছে দলের বেশ কয়েকজন ক্রিকেটারকে! হাসপাতালে যেতে হয়েছিল ১৯৭৬ সালের ক্যারিবীয় সফরেও। জ্যামাইকা টেস্টে তো রীতিমতো কেলেঙ্কারি অবস্থা। দ্বিতীয় ইনিংসে ৫ উইকেট হারানোর পর ব্যাট করতে যাওয়ার মতো আর কেউ ছিল না। বাকি সবাই বাউন্সারের আঘাতে হাসপাতালে! তাই ৯৭ রানেই শেষ হয়ে যায় ভারতের ইনিংস। স্কোর কার্ডে 'অল আউট' লেখা দেখে অধিনায়ক বিষেণ সিং বেদির কেমন লাগছিল তা তো অনুমানই করা যায়। ভারতের এমন হাল দেখেও অবশ্য খোঁচা মারতে ছাড়েননি ওয়েস্ট ইন্ডিজের অধিনায়ক ক্লাইভ লয়েড, 'কী করব বলুন, আমি তো হাফ ভলি বল করাতে পারি না!'
আফতাবের ক্যারিয়ারের ভয়ংকর সেই দিন
চট্টগ্রামের জহুর আহমেদ চৌধুরী স্টেডিয়াম দুই হাত ভরে দিয়েছে বাংলাদেশকে। এখানে খেলা ১২ ওয়ানডের ৭টিতেই জিতেছে স্বাগতিকরা। সেই স্টেডিয়ামেই আবার রিটায়ার্ড হার্ট হয়ে মাঠ ছাড়তে বাধ্য হয়েছিলেন চট্টগ্রামেরই ছেলে আফতাব আহমেদ। ২০০৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে টেস্টের প্রথম ইনিংসে ৪৫ বলে ২১ রানে থাকার সময় হেলমেটে আঘাত পান জ্যাক ক্যালিসের বাউন্সারে। স্ট্রেচারে করে মাঠ ছাড়তে হয় তাঁকে। এরপর আর সেই টেস্টে মাঠে নামা হয়নি আফতাবের।
রমন লাম্বার চিরবিদায়!
খেলতে খেলতে মাঠেই মৃত্যুর ঘটনা কম নেই ক্রীড়াঙ্গনে। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে এ ধরনের মর্মান্তিক কিছু না ঘটলেও ক্লাব ক্রিকেটে আছে কয়েকটা ট্র্যাজেডি। এর অন্যতম ১৯৯৮ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি ঢাকা প্রিমিয়ার লিগে আবাহনীর হয়ে খেলতে নামা ভারতীয় ক্রিকেটার রমন লাম্বার মৃত্যু। বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে মোহামেডানের বিপক্ষে ম্যাচটিতে শর্ট লেগে ফিল্ডিং করছিলেন হেলমেট ছাড়া। কিন্তু মেহরাব হোসেন অপির করা একটা পুল থেকে বল আঘাত করে লাম্বার মাথায়। ড্রেসিংরুমে প্রাথমিক চিকিৎসা নেওয়ার পর অসুস্থ বোধ করায় তাঁকে নিয়ে যাওয়া হয় হাসপাতালে। মস্তিষ্কের বাম দিকে রক্তকণিকা জমে যাওয়ায় করাতে হয় অস্ত্রোপচার। কিন্তু দিলি্ল থেকে বিশেষজ্ঞ ডাক্তার উড়িয়ে এনেও বাঁচানো যায়নি ভারতের হয়ে ৪ টেস্ট আর ৩২ ওয়ানডে খেলা লাম্বাকে। এ ছাড়া ১৯৫৮-৫৯ সালের কায়েদ-ই-আজম ট্রফির ফাইনালে করাচির উইকেটরক্ষক আবদুল আজিজ ও ১৯৯৩ সালে ইংলিশ ঘরোয়া ক্রিকেটে হোয়াইটহেভেনের হয়ে খেলার সময় পাওয়া আঘাতে পৃথিবীর ওপারের বাসিন্দা হন ইয়ান ফোলি।
দুটো সেলাই নিয়েও সেঞ্চুরি
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষে সে সময়ের অন্যতম দুই তারকা ক্রিকেটার ছিলেন ইংলিশ ব্যাটসম্যান ডেনিস কম্পটন ও অস্ট্রেলিয়ান পেসার রে লিন্ডওয়াল। ১৯৪৮ সালের অ্যাশেজে ওল্ড ট্র্যাফোর্ড টেস্টে লিন্ডওয়ালের বল সরাসরি গিয়ে লাগে কম্পটনের মাথায়। হাসপাতালে গিয়ে দুটো সেলাই নিতে হয় তাঁকে। সেলাই নিয়ে ফেরার পর কম্পটনকে প্রথম বলটাই তাঁকে বাউন্সার দেন লিন্ডওয়াল। কিন্তু দমে না গিয়ে কম্পটন শেষ পর্যন্ত অপরাজিতও থাকেন ১৪৫ রানে।
ম্যাকসকার-কুম্বলের সাহসিকতা...
১৯৭৭ সালে মেলবোর্নে টেস্ট ক্রিকেটের শতবর্ষপূর্তিতে মুখোমুখি হয়েছিল অস্ট্রেলিয়া-ইংল্যান্ড। ঐতিহাসিক ম্যাচটিতে ইংলিশ পেসার বব উইলিসের বাউন্সারে চোয়াল ভেঙে যায় অস্ট্রেলিয়ার রিক ম্যাকসকারের। মাথায় ব্যান্ডেজ থাকলেও চতুর্থ দিন তাঁকে ব্যাট করার অনুরোধ জানান অধিনায়ক গ্রেগ চ্যাপেল। অধিনায়কের অনুরোধ রেখে ১০ নম্বরে নেমে রড মার্শের সঙ্গে গড়েন ৫৪ রানের জুটি। ম্যাকসকার করেন ৬৮ বলে ২৫। এ জুটিটাই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল অস্ট্রেলিয়ার ৪৫ রানের জয়ে। ২০০২-২০০৩ মৌসুমে ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরে ৭ নম্বরে ব্যাট করতে নেমে মার্ভ ডিলনের বাউন্সারে অনিল কুম্বলেরও চোয়াল ভেঙেছিল। অস্ত্রোপচারের জন্য দেশেও ফিরতে চেয়েছিলেন তিনি। কিন্তু শচীন টেন্ডুলকার টার্ন পাচ্ছেন দেখে নিজেও নেমে পড়েন মাঠে। টানা ১৪ ওভার বল করে নেন ব্রায়ান লারার উইকেট!
রানের লোভ সামলাতে না পেরে...
২০০৩-০৪ মৌসুমে পাকিস্তানের বিপক্ষে টেস্টে শোয়েব আখতারের বাউন্সার হুক করতে গিয়েছিলেন দক্ষিণ আফ্রিকার ওপেনার গ্যারি কারস্টেন। বলটা ব্যাটে না লেগে আঘাত করে হেলমেটে। ভেঙে যায় কারস্টেনের নাকের একটা অংশ। হাসপাতাল ঘুরে এসে দ্বিতীয় ইনিংসে ৪৬ রান করেন কারস্টেন। মাঠে নামার কারণ হিসেবে বলেছিলেন, 'পিচটা ব্যাটিংয়ের জন্য এতই ভালো যে বাড়ি ফিরতে ইচ্ছে করছিল না।' টেস্টটা কিন্তু ৮ উইকেটে হেরে গিয়েছিল দক্ষিণ আফ্রিকা।
কুম্বলের স্পিনে সাবা করিমের সর্বনাশ
ফাস্ট বোলারের বাউন্সার নয়, অনিল কুম্বলের স্পিনেই ওয়ানডে ক্যারিয়ার শেষ হয়েছে সাবা করিমের! ২০০০ সালের মে মাসে ঢাকার বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে এশিয়া কাপের ম্যাচে কুম্বলের একটা লাফিয়ে ওঠা বল ছুঁয়ে যায় বাংলাদেশি ব্যাটসম্যান হাবিবুল বাশারের প্যাড। প্যাড থেকে গিয়ে বল লাগে ভারতের উইকেটরক্ষক সাবা করিমের চোখের নিচে। মাঠ ছাড়তে হয় তখনই। ফিরতে হয় দেশেও। দুর্ভাগ্যজনকভাবে করিমের ৩৪ ম্যাচের ওয়ানডে ক্যারিয়ারটা থেমে যায় সেখানেই। মাস ছয়েক পর বাংলাদেশের অভিষেক টেস্টে ভারতের হয়ে উইকেটের পেছনে গ্লাভস হাতে দাঁড়িয়েছিলেন ঠিকই। কিন্তু এরপর আর ডাক পাননি জাতীয় দলে।
অভিষেকের পর শততম টেস্টেও...
ঘরোয়া ক্রিকেট পুকুর হলে আন্তর্জাতিক অঙ্গনটা সমুদ্র। সেই সমুদ্রের ঢেউ কেমন প্রলয়ঙ্করী পুরো ক্যারিয়ারজুড়েই অনুভব করে গেছেন জাস্টিন ল্যাঙ্গার। অস্ট্রেলিয়ার এ ওপেনারের টেস্ট অভিষেক ১৯৯৩ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে। ইয়ান বিশপের বাউন্সার হেলমেটের আঘাতে শুশ্রূষা নিতে হয় মাঠেই। তার পরও ওয়ালশ, বিশপ, অ্যাম্ব্রোসদের সামলে ফিফটি করে শুরু হয়েছিল পথচলা। শততম টেস্টে অবশ্য আর পেরে ওঠেননি। ২০০৫-০৬ মৌসুমে সেঞ্চুরিয়ানে নিজের শততম টেস্টে প্রথম বলে মুখোমুখি হন দক্ষিণ আফ্রিকার পেসার মাখায়া এনটিনির। বল লাগে মাথায়! এরপর সোজা হাসপাতাল। শততম টেস্টটা মাঠের বদলে ল্যাঙ্গারকে কাটাতে হয় হাসপাতালে! এরপর আর ৫ ম্যাচ খেলেই টেস্ট ক্যারিয়ারে ইতি টানেন ১০৫ টেস্টে ৭৬৯৬ রান করা এ অস্ট্রেলিয়ান।

No comments

Powered by Blogger.