পিটিয়ে গুলি করে গাদ্দাফিকে হত্যা : এনটিসির দাবি ক্রসফায়ারে মারা গেছেন

শ্চিমা বিশ্বে স্বস্তি; তবু দেশে দেশে কোটি মানুষের ব্যাপক কৌতূহল—কীভাবে হত্যা করা হয়েছে গাদ্দাফিকে। জীবিত আটক করা হয়েছিল এই আরব মরু ঈগলকে। জানা যায়, আটক অবস্থায় প্রাণভিক্ষা চেয়েছিলেন ৪ দশকজুড়ে বিশ্বব্যাপী আলোচিত এ লৌহহৃদয় বেদুইন বাদশা।কিন্তু তখন কি তার প্রতি দেখানো হয়েছে যুদ্ধবন্দির প্রাপ্য সহানুভূতি! এ নিয়ে এখন নানা প্রশ্ন।নিজ জন্মশহর সির্ত থেকে বৃহস্পতিবার সকালে পালানোর চেষ্টা করেন গাদ্দাফি। এ সময় তার গাড়িবহরে বিমান হামলা চালায় ন্যাটো। এতে অংশ নেয় মার্কিন প্রিডেটর ড্রোন।


অংশ নেয় ফরাসি একটি ফাইটার জেট, আক্রান্ত হয় গাদ্দাফির গাড়িবহর। লিবিয়ার এক সময়ের লৌহশাসক তখন অনুচরদের নিয়ে পালানোর চেষ্টা করেন। ঠিক সে সময় এনটিসির যোদ্ধারা ঘিরে ফেলে তাকে।
সম্মুখযুদ্ধে প্রতিরক্ষামন্ত্রী আবুবকর ইউনুস নিহত হন। কিন্তু গাদ্দাফি ও তার ছেলে মুতাসসিম আটক হন আহত অবস্থায়। তারপর শুরু হত্যার মিশন।
বিভিন্ন টিভি মিডিয়ার ফুটেজে পরিষ্কার দেখা যায়—গাদ্দাফির চুল ধরে টেনে উপর্যুপরি ঘুষি, লাথি মারা হচ্ছে, নিষ্ঠুরভাবে মারধর করা হচ্ছে তাকে। টানাহেঁচড়া করা হয় আহত আরব সিংহকে। এ সংঘবদ্ধ আক্রমণে তিনি রক্তাক্ত হন। তার মুখ দিয়ে রক্ত ঝরছে, চোখে-মুখে বাঁচার আকুতি। জানা যায়, একপর্যায়ে তিনি প্রাণভিক্ষা চান।
আরব দুনিয়ার কিংবদন্তি লড়াকু, রাষ্ট্রনায়ক গাদ্দাফির সেই করুণ আবেদনে সাড়া দেয়নি এনটিসি সেনারা। গাদ্দাফির ওপর চলতে থাকে মারপিট লাথি ও ঘুষি। তারপর খুব কাছ থেকে তার মাথায় গুলি করা হয়। যুদ্ধবন্দির সকরুণ আবেদনে কর্ণপাত করেনি প্রতিপক্ষ সেনারা। গুলিতে বিকৃত হয় গাদ্দাফির মুখ। থেঁতলানো শরীর নিয়ে তিনি লুটিয়ে পড়েন। মৃত্যু ঘটে একসময়ের দোর্দণ্ড প্রতাপশালী লিবীয় বাদশার। এনটিসির সেনারা তখন উল্লাসে মত্ত। তারা সহাস্যে ব্যস্ত লাশের সঙ্গে ছবি তোলায়।
দীর্ঘ ৪০ বছরের বেশি সময় যার আঙ্গুলি হেলনে একচ্ছত্র আধিপত্যে শাসিত হয়েছে লিবিয়া; একদল এনটিসি সেনার উন্মত্ত হামলায় সকরুণ যবনিকা ঘটে তার। গাদ্দাফির ছেলে মুতাসসিমকেও যখন আটক করা হয় তখন তিনি আহত। তিনিও এনটিসি সেনাদের হাতে মারপিটের শিকার হন। তার শরীর রক্তে ভিজে যায়। মৃত্যুর আগে তিনি পানি পান করতে চাইলে তাকে পানি দেয়া হয়। অতঃপর হত্যা করা হয় মুতামসিমকে। আলজাজিরা, রয়টার্স, বিবিসিসহ সংবাদ মাধ্যমগুলো জানাচ্ছে—যেভাবে তিনি নিহত হয়েছেন তাতে খোদ জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশন থেকেই প্রশ্ন উঠেছে সম্ভাব্য মানবাধিকার লঙ্ঘনের। ভেনিজুয়েলার প্রেসিডেন্ট হুগো শ্যাভেজেরও দাবি, গাদ্দাফিকে চরম নিষ্ঠুরভাবে খুন করা হয়েছে। লিবিয়ার অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, তদন্ত শেষ হওয়া পর্যন্ত মিসরাতার হিমাগারে রাখা হবে গাদ্দাফির মরদেহ।
বিবিসি জানায়, জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনার বলেছেন, কর্নেল গাদ্দাফির কীভাবে মৃত্যু হয়েছে, তার পূর্ণ তদন্ত হওয়া উচিত। হাইকমিশনার নাভি পিল্লাইয়ের একজন মুখপাত্র বলেছেন, সাবেক লিবীয় নেতাকে প্রথম জীবিত অবস্থায় আটক এবং পরে তার মৃত্যুর যেসব ছবি মোবাইল ফোনে তোলা হয়েছে, তা খুবই অস্বস্তিকর এবং বিচলিত হওয়ার মতো।
এনটিসির দাবি ক্রসফায়ারে মারা গেছেন গাদ্দাফি : লিবিয়ার অন্তর্বর্তী সরকার কর্নেল গাদ্দাফিকে হত্যা করার কথা অস্বীকার করেছে। তারা বলছে, সির্তে কর্নেল গাদ্দাফিকে ধরার পর গাদ্দাফি সমর্থক এবং সরকারি বাহিনীর মধ্যে লড়াইয়ের সময় ক্রসফায়ারে তার মাথায় গুলি লেগেছে।
কর্নেল গাদ্দাফির মরদেহ কয়েক দিন হিমঘরে রাখা হবে যাতে সবাই নিশ্চিত হতে পারে, আসলেই তিনি মারা গেছেন। কর্মকর্তারা বলছেন, সম্ভবত কোনো এক গোপন স্থানে তাকে দাফন করা হবে।
লিবিয়ার অন্তর্বর্তী সরকার বলছে, কর্নেল মুয়াম্মার গাদ্দাফির মরদেহ মিসরাতার এক মসজিদে রক্ষিত আছে।
লিবিয়ার তেলমন্ত্রী আলী তারহুনি রয়টার্স বার্তা সংস্থাকে বলেন, কর্নেল গাদ্দাফির মরদেহ এখনই দাফনের জন্য দেয়া হবে না। কর্নেল গাদ্দাফির মরদেহ কয়েক দিন হিমঘরে রাখা হবে যাতে সবাই নিশ্চিত হতে পারে, আসলেই তিনি মারা গেছেন। একটি সূত্র জানায়, গাদ্দাফির লাশ একটি শপিং সেন্টারের বাণিজ্যিক হিমঘরে রাখা হয়েছে।
দাফনের বিষয়ে এখনও কোনো সিদ্ধান্ত নেয়া হয়নি বলে তিনি জানান।
তবে ত্রিপোলি থেকে বিবিসির সংবাদদাতা ক্যারোলাইন হলি জানান, এরকম আঁচ-অনুমান করা হচ্ছে, আল কায়দা নেতা ওসামা বিন লাদেনের মতো কর্নেল গাদ্দাফির মরদেহও সাগরে দাফন করা হতে পারে, যাতে তার কবর তার অনুগতদের জন্য কোনো স্মৃতিসৌধে পরিণত না হয়।
সাইফ আল ইসলামকে কর্নেল গাদ্দাফির মূল উত্তরসূরি বলে মনে করা হয়। রয়টার্স বার্তা সংস্থা কোনো কর্মকর্তার নাম উল্লেখ না করে শুধু তাকে উদ্ধৃত করে খবর দিয়েছে, সাবেক নেতার মরদেহ নিয়ে কী করা হবে তা নিয়ে এনটিসি বা অন্তর্বর্তী পরিষদের মধ্যে মতৈক্য সৃষ্টি হয়েছে।
মুয়াম্মার গাদ্দাফির ছেলে সাইফ আল ইসলাম গাদ্দাফি কোথায় আছেন, তা এখনও অজ্ঞাত। ব্যাপকভাবে ধারণা করা হয়, তিনিই তার বাবার প্রধান উত্তরসূরি। লিবিয়ার অন্তর্বর্তী প্রশাসন এনটিসির যোদ্ধারা যখন সির্ত শহরের নিয়ন্ত্রণ নেয়ার জন্য লড়াই করছিল, তখন বৃহস্পতিবার সাইফ আল ইসলাম শহর থেকে পালিয়ে গেছেন বলে ধারণা করা হচ্ছে। অন্তর্বর্তী পরিষদের কোনো কোনো সদস্য বলছেন, বিদ্রোহী যোদ্ধারা তাকে আটক করেছে এবং তিনি আহত। কিন্তু এখনও তাকে আটক করার কোনো ছবি দেখা যায়নি।
এনটিসির কর্মকর্তারা বৃহস্পতিবার জানান, সির্ত শহরে যে হামলার সময় কর্নেল গাদ্দাফি মারা গেছেন সেই একই হামলায় কর্নেল গাদ্দাফির আরেক ছেলে মুতাসসিম নিহত হন। ১৯৬৯ সালে এক সামরিক অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে কর্নেল গাদ্দাফি লিবিয়ার ক্ষমতায় আসেন।
কিন্তু চলতি বছর ফেব্রুয়ারি মাসে এক গণঅভ্যুত্থানের জেরে তিনি ক্ষমতাচ্যুত হন। আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত বিচারের জন্য কর্নেল গাদ্দাফির বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেছিল।
এদিকে ত্রিপোলীর ডেপুটি মেয়র বলেছেন, লিবিয়ার সাধারণ মানুষ এখন মূলধারায় ফিরে আসবে। রোববার আনুষ্ঠানিকভাবে লিবিয়াকে মুক্ত ঘোষণা করা হবে। সরকার আশা করছে—গাদ্দাফি সমর্থকরা বাস্তবতা মেনে নেবেন। তারা সমাজের মূলধারায় যোগ দেবেন। তিনি বলেন, লিবিয়ার বেশিরভাগ মানুষ ইসলামী রাষ্ট্র চাইলে তাই-ই হবে। যদি তারা উদারপন্থী দেশ চান, তবে তাই হবে।
ওদিকে ন্যাটো জোটের এক শীর্ষ সামরিক কর্মকর্তা জানান, গাদ্দাফির মৃত্যুর পর লিবিয়ায় সামরিক তত্পরতা শেষ করার পরামর্শ দেয়া হয়েছে। ব্রাসেলস ন্যাটো জোটের বৈঠকে ওই কর্মকর্তা জানান, গত ৭ মাসে লিবিয়ার আকাশে ন্যাটো ২৬,০০০ বার যুদ্ধ বিমানের বহর পাঠিয়েছে।

No comments

Powered by Blogger.