শনিবারের সুসংবাদ-'রক্ষাগোলা'য় স্বনির্ভর ২২ সাঁওতাল গ্রাম by বিপ্লব রহমান,
কয়েক বছর আগেও নিত্য অভাব লেগে থাকত গ্রামের ঘরে ঘরে। অভাবের তাড়নায় মহাজনদের কাছ থেকে চড়া সুদে ঋণ নিত ভূমিহীন সাঁওয়াল ক্ষেতমজুররা। কিন্তু এখন রক্ষাগোলা তৈরি করে ভালো আছে সবাই। পরিবার-পরিজন নিয়ে দুই বেলা পেট ভরে খেতে পারছে। ছেলেমেয়েরাও লেখাপড়া করতে পারছে। সবাই এখন ঋণের ছোবল থেকে মুক্ত। এভাবেই নিজেদেরসাফল্যগাথার বর্ণনা দেন রাজশাহীর দেওপাড়া ইউনিয়নের ডাইংপাড়া গ্রামের প্রধান (মোড়ল) দেবেন বাস্কে (৪৬)।
জেলা সদর থেকে ১৪ কিলোমিটার পশ্চিমে পশ্চাৎপদ এই জনপদ ঘুরে জানা যায়, প্রাচীনকাল থেকেই বরেন্দ্র অঞ্চলটিতে উল্লেখযোগ্য সংখ্যায় ভাষাগত সংখ্যালঘু সাঁওতাল জাতির বাস। কালের করালগ্রাসে মামলা-মোকদ্দমা ও ভূমিদস্যুদের খপ্পরে একসময়ের সচ্ছল কৃষকদের অধিকাংশেরই এখন চাষবাসের জমি নেই। নিত্য হাহাকার কিছুতেই যেন তাদের পিছু ছাড়ছিল না। আশ্বিন-কার্তিক মাসে যখন জমি-জিরাতের কাজ একেবারেই থাকে না, তখন অনাহার মোকাবিলায় তারা বাধ্য হয়ে হাত পাতত মহাজনদের কাছে। এক বস্তা (৫০ কেজি) ধান ঋণ নেওয়ার বিনিময়ে তাদের শোধ করতে হতো দেড় থেকে দুই বস্তা ধান। এভাবে সুদের কঠিন চক্রে প্রতিটি পরিবার ছিল জর্জরিত।
দেবেন বাস্কে জানান, একপর্যায়ে তাঁরা গ্রামের কয়েকজন মিলে শলাপরামর্শ করে ঠিক করেন, আশপাশের সাঁওতাল গ্রামের মতো তাঁদের গ্রামেও সমবায় ভিত্তিতে ধান-চালের মুষ্টি সঞ্চয় বা রক্ষাগোলা গড়ে তোলার। অভাবের দিনে এই ধান-চালের গোলা থেকেই দুস্থ পরিবারকে খাদ্য সাহায্য করা হবে। গ্রামের সবার সম্মতিতে দুই বছর আগে তাঁরা এই গ্রামে রক্ষাগোলা প্রতিষ্ঠা করেন। ধীরে ধীরে অভাব কাটিয়ে ওঠেন। হাঁস-মুরগি, গরু-ছাগল পালন করে অনেকে বাড়তি দুই পয়সা আয়ও করছেন। কোনো পরিবারেই এখন আর অভাব নেই। গ্রামে শান্তি-সৌহার্দ্য এখন আগের চেয়ে অনেক বেশি।
গ্রামে প্রবেশের পথেই বিশাল একটি টিন শেডের মাটির ঘর দেখিয়ে রক্ষাগোলার নেত্রী সেলিনা টুডু (২৫) খানিকটা গর্ব করেই বললেন, 'এই আমাদের রক্ষাগোলা। ঘরটিকে দুই ভাগে ভাগ করে এক অংশে বানানো হয়েছে ধান-চালের গোলা। অন্য অংশ ফাঁকা রাখা হয়েছে আমাদের গ্রাম বৈঠক করার জন্য। সেখানে বসে আমরা হিসাব-কিতাব করি। প্রতি সপ্তাহে কে কত ধান বা চাল জমা দিল, অভাব মেটাতে সঞ্চিত গোলা থেকে কোন পরিবারকে কত ধান-চাল সাহায্য করা হয়েছে_ইত্যাদি। বাড়তি ধান-চাল বিক্রির টাকা দিয়ে গ্রামের জন্য কী কী করা যেতে পারে, তাও ঠিক করা হয় এসব গ্রাম বৈঠকে। বিয়ে-শাদি বা পরবের সময় প্রয়োজনে আমরা রক্ষাগোলা থেকেই দুস্থ পরিবারকে আর্থিক সাহায্যও দিয়ে থাকি। আমাদের এখানে কোনো সুদের কারবার নেই।'
পরে দেওপাড়া রক্ষাগোলা ঘরে বসেই কথা হয় আরো কয়েকজন গ্রামবাসীর সঙ্গে। তাঁরা জানান, রক্ষাগোলা নামক জাদুর ছোঁয়ায় বদলে গেছে গ্রামের ৩০টি পরিবারের জীবনচিত্র। কিষানি পিরিনা মুরমু (৩০) একজন নৃত্যশিল্পীও বটে। তিনি বলেন, 'আগে শুধু বিয়ে বা পরবের সময় আমরা কয়েকজন গ্রামের মেয়ে ঐতিহ্যবাহী সাঁওতালি নাচ করতাম। এখন অভাব মিটে যাওয়ার পর আমরা ১০-১২ জনের একটি নাচের দল করেছি। কিছুদিন আগে আমরা রাজশাহীতে একটি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে প্রতিযোগিতা করে পুরস্কারও পেয়েছি।'
সরেজমিন অনুসন্ধানে জানা গেছে, শুধু ডাইংপাড়া গ্রামটিই নয়, গত ছয় বছরে একই রকমভাবে রক্ষাগোলা তৈরি করে দেওপাড়া ও গোগ্রাম ইউনিয়নের ২২টি গ্রামের প্রায় সাড়ে চার হাজার মানুষ খাদ্যে স্বনির্ভর হয়েছে। তাদের মধ্যে অধিকাংশই ভাষাগত সংখ্যালঘু সাঁওতাল হলেও অল্প কয়েকঘর উঁরাও, পাহাড়িয়া, রাজুয়ার, রায়, শিং ও হাজরা জাতিও রয়েছে। গ্রামগুলো হচ্ছে চৈতন্যপুর, শাহানাপাড়া, ঈদলপুর, কান্তাপাশা, নিমকুড়ি, পাথরঘাটা, বেলডাঙ্গা, গোলাই, জিওলমারী, গড়ডাইং, মূলকী ডাইং, ডাইংপাড়া, নিমঘুটু, শ্রীরামপুর বিড়ইল, বাগানপাড়া, গণকের ডাইং, ফারসাপাড়া, দাদৌড়, গুণীগ্রাম রাজাপাড়া, আগলপুর, উদপুর ও নড়সিংগড় আদর্শগ্রাম।
পরিসংখ্যান মতে, বর্তমানে এই ২২টি গ্রামে ৯৬৩টি পরিবারে এক হাজার ৩৬২ জন নারী, এক হাজার ৩১৯ জন পুরুষ, ৯৬২টি মেয়ে শিশু এবং ৯৯৩টি ছেলে শিশু মিলে মোট চার হাজার ৬৩৬ জনের বাস। রক্ষগোলা প্রকল্পের অধীনে গ্রামগুলোকে খাদ্যে স্বনির্ভর হওয়ার পথ দেখিয়েছে বেসরকারি সংস্থা সেন্টার ফর ক্যাপাসিটি বিল্ডিং অব ভলেন্টারি অর্গানাইজেশন (সিভো)। এই কাজে সিভোকে আর্থিক সহায়তা দিচ্ছে অপর বেসরকারি সংস্থা বাংলাদেশ ফ্রিডম ফাউন্ডেশন (বিএফএফ)।
এদিকে পাথরঘাটা গ্রামের আরেকটি মাটির ঘরের রক্ষাগোলাকে দেখিয়ে সিভোর গ্রাম সংগঠক এবং উঁরাও জনজাতির যুবক মানিক এক্কা (২২) বলেন, 'এই রক্ষাগোলার কারণে আমরা এখন দুই বেলা খেয়ে-পরে বাঁচতে পারছি।'
একই গ্রামের কিষানি ঝাড়িয়া উঁরাও (৬০) জানান, রক্ষাগোলা তাদের জীবন বদলে দিয়েছে। জামলা বারোয়ার (৩৫) নামের আরেক কিষানি জানান, তাঁদের রক্ষাগোলার দেখাদেখি আশপাশের গ্রামের মানুষও একই রকমভাবে মুষ্টি সঞ্চয়ে আগ্রহী হয়ে উঠছে।
ডাইংপাড়া গ্রামে রক্ষাগোলার ঘর নির্মাণের জন্য নিজের প্রায় দেড়কাঠা জমি দান করেছেন ক্ষেতমজুর মরকুস পাহাড়িয়া (৬৫)। তিনি জানান, এই ধান-চালের গোলা গ্রামবাসী সবার উপকারে লাগবে। এ জন্য ঘর তোলার জমি দিয়েছেন তিনি। গ্রামের অন্যরা চাঁদা তুলে, বেগার খেটে ঘর তুলেছে। এখন সবাই এতে খুব খুশি। একই জনজাতির অলিভিয়া বিশ্বাস (২৫) জানান, তাঁরা পরিকল্পনা নিয়েছেন বেশ কিছু সঞ্চিত ধান-চাল বিক্রি করে কাছের কোনো সরকারি ব্যাংকে রক্ষাগোলার নামে টাকা জমানোর। দুর্দিনে এই টাকা গ্রামের উন্নয়নে কাজে লাগানো হবে।
রক্ষাগোলার ধারণাটি নতুন কিছু নয়_এ কথা জানিয়ে সিভোর নির্বাহী প্রধান সারওয়ার-ই-কামাল কালের কণ্ঠকে বলেন, "সাঁওতাল, উঁরাও, পাহাড়িয়া ইত্যাদি জনজাতি সমাজে ঐতিহ্যবাহী রীতিনীতি, সুশৃঙ্খল সামাজিক কাঠামো ও সংস্কৃতিতে প্রাচীনকাল থেকেই 'সামাজিক ধর্মগোলা'র ধারণা ছিল। এই সর্বজনীন গোলা থেকে গ্রামবাসী দুর্দিনে ধান-চালের সাহায্য পেত। আমরা সিভো' পক্ষ থেকে এই ধারণাটিকে আরো সুসংগঠিত করে বাস্তবে রূপ দিতে পেরেছি মাত্র। রক্ষাগোলা নির্মাণ ও পরিচালনার পুরো কাজটি গ্রামবাসী নিজেরাই স্বেচ্ছাশ্রমের ভিত্তিতে করে। আমরা তাদের কোনো রকম আর্থিক সাহায্য বা ঋণ দেই না। তাই রক্ষাগোলা পুরোপুরি গ্রামবাসীরই অর্জন।"
সারওয়ার-ই-কামাল জানান, বিএফএফের আর্থিক সহায়তায় সিভো ২০০৫ সালের ৬ জুলাই প্রথমে পরীক্ষামূলকভাবে চৈতন্যপুর, নিমকুড়ি, কান্তপাশা-ঈদলপুর, শাহানাপাড়া ও পাথরঘাটা_এই পাঁচটি গ্রামে তিন বছরের জন্য পরীক্ষামূলকভাবে রক্ষাগোলা, তথা স্থায়ীত্বশীল উন্নয়ন প্রকল্প চালায়। অভাবনীয় সাফল্য পাওয়া যায় একেবারে হাতেনাতে। প্রকল্পটি সম্প্রসারণ করে এখন তাঁরা ২০০৯ সাল থেকে তিন বছর মেয়াদে ওই ২২টি গ্রামে রক্ষাগোলাভিত্তিক স্থায়ীত্বশীল খাদ্য নিরাপত্তা কর্মসূচি চালাচ্ছেন।
সিভোর স্বেচ্ছাসেবী আরিফ ইথার কালের কণ্ঠকে বলেন, 'রক্ষাগোলা গ্রামীণ জনপদের এমন একটি উন্নয়ন পরিকল্পনা, যার সঙ্গে পুরো গ্রামবাসীর সম্পৃক্ততা ঘটে। গ্রাম পর্যায়ে এ ধরনের উন্নয়ন কর্মসূচি বৃহত্তর উত্তরবঙ্গে তো বটেই, এমন কি সারা বাংলাদেশেও নজিরবিহীন।'
দেবেন বাস্কে জানান, একপর্যায়ে তাঁরা গ্রামের কয়েকজন মিলে শলাপরামর্শ করে ঠিক করেন, আশপাশের সাঁওতাল গ্রামের মতো তাঁদের গ্রামেও সমবায় ভিত্তিতে ধান-চালের মুষ্টি সঞ্চয় বা রক্ষাগোলা গড়ে তোলার। অভাবের দিনে এই ধান-চালের গোলা থেকেই দুস্থ পরিবারকে খাদ্য সাহায্য করা হবে। গ্রামের সবার সম্মতিতে দুই বছর আগে তাঁরা এই গ্রামে রক্ষাগোলা প্রতিষ্ঠা করেন। ধীরে ধীরে অভাব কাটিয়ে ওঠেন। হাঁস-মুরগি, গরু-ছাগল পালন করে অনেকে বাড়তি দুই পয়সা আয়ও করছেন। কোনো পরিবারেই এখন আর অভাব নেই। গ্রামে শান্তি-সৌহার্দ্য এখন আগের চেয়ে অনেক বেশি।
গ্রামে প্রবেশের পথেই বিশাল একটি টিন শেডের মাটির ঘর দেখিয়ে রক্ষাগোলার নেত্রী সেলিনা টুডু (২৫) খানিকটা গর্ব করেই বললেন, 'এই আমাদের রক্ষাগোলা। ঘরটিকে দুই ভাগে ভাগ করে এক অংশে বানানো হয়েছে ধান-চালের গোলা। অন্য অংশ ফাঁকা রাখা হয়েছে আমাদের গ্রাম বৈঠক করার জন্য। সেখানে বসে আমরা হিসাব-কিতাব করি। প্রতি সপ্তাহে কে কত ধান বা চাল জমা দিল, অভাব মেটাতে সঞ্চিত গোলা থেকে কোন পরিবারকে কত ধান-চাল সাহায্য করা হয়েছে_ইত্যাদি। বাড়তি ধান-চাল বিক্রির টাকা দিয়ে গ্রামের জন্য কী কী করা যেতে পারে, তাও ঠিক করা হয় এসব গ্রাম বৈঠকে। বিয়ে-শাদি বা পরবের সময় প্রয়োজনে আমরা রক্ষাগোলা থেকেই দুস্থ পরিবারকে আর্থিক সাহায্যও দিয়ে থাকি। আমাদের এখানে কোনো সুদের কারবার নেই।'
পরে দেওপাড়া রক্ষাগোলা ঘরে বসেই কথা হয় আরো কয়েকজন গ্রামবাসীর সঙ্গে। তাঁরা জানান, রক্ষাগোলা নামক জাদুর ছোঁয়ায় বদলে গেছে গ্রামের ৩০টি পরিবারের জীবনচিত্র। কিষানি পিরিনা মুরমু (৩০) একজন নৃত্যশিল্পীও বটে। তিনি বলেন, 'আগে শুধু বিয়ে বা পরবের সময় আমরা কয়েকজন গ্রামের মেয়ে ঐতিহ্যবাহী সাঁওতালি নাচ করতাম। এখন অভাব মিটে যাওয়ার পর আমরা ১০-১২ জনের একটি নাচের দল করেছি। কিছুদিন আগে আমরা রাজশাহীতে একটি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে প্রতিযোগিতা করে পুরস্কারও পেয়েছি।'
সরেজমিন অনুসন্ধানে জানা গেছে, শুধু ডাইংপাড়া গ্রামটিই নয়, গত ছয় বছরে একই রকমভাবে রক্ষাগোলা তৈরি করে দেওপাড়া ও গোগ্রাম ইউনিয়নের ২২টি গ্রামের প্রায় সাড়ে চার হাজার মানুষ খাদ্যে স্বনির্ভর হয়েছে। তাদের মধ্যে অধিকাংশই ভাষাগত সংখ্যালঘু সাঁওতাল হলেও অল্প কয়েকঘর উঁরাও, পাহাড়িয়া, রাজুয়ার, রায়, শিং ও হাজরা জাতিও রয়েছে। গ্রামগুলো হচ্ছে চৈতন্যপুর, শাহানাপাড়া, ঈদলপুর, কান্তাপাশা, নিমকুড়ি, পাথরঘাটা, বেলডাঙ্গা, গোলাই, জিওলমারী, গড়ডাইং, মূলকী ডাইং, ডাইংপাড়া, নিমঘুটু, শ্রীরামপুর বিড়ইল, বাগানপাড়া, গণকের ডাইং, ফারসাপাড়া, দাদৌড়, গুণীগ্রাম রাজাপাড়া, আগলপুর, উদপুর ও নড়সিংগড় আদর্শগ্রাম।
পরিসংখ্যান মতে, বর্তমানে এই ২২টি গ্রামে ৯৬৩টি পরিবারে এক হাজার ৩৬২ জন নারী, এক হাজার ৩১৯ জন পুরুষ, ৯৬২টি মেয়ে শিশু এবং ৯৯৩টি ছেলে শিশু মিলে মোট চার হাজার ৬৩৬ জনের বাস। রক্ষগোলা প্রকল্পের অধীনে গ্রামগুলোকে খাদ্যে স্বনির্ভর হওয়ার পথ দেখিয়েছে বেসরকারি সংস্থা সেন্টার ফর ক্যাপাসিটি বিল্ডিং অব ভলেন্টারি অর্গানাইজেশন (সিভো)। এই কাজে সিভোকে আর্থিক সহায়তা দিচ্ছে অপর বেসরকারি সংস্থা বাংলাদেশ ফ্রিডম ফাউন্ডেশন (বিএফএফ)।
এদিকে পাথরঘাটা গ্রামের আরেকটি মাটির ঘরের রক্ষাগোলাকে দেখিয়ে সিভোর গ্রাম সংগঠক এবং উঁরাও জনজাতির যুবক মানিক এক্কা (২২) বলেন, 'এই রক্ষাগোলার কারণে আমরা এখন দুই বেলা খেয়ে-পরে বাঁচতে পারছি।'
একই গ্রামের কিষানি ঝাড়িয়া উঁরাও (৬০) জানান, রক্ষাগোলা তাদের জীবন বদলে দিয়েছে। জামলা বারোয়ার (৩৫) নামের আরেক কিষানি জানান, তাঁদের রক্ষাগোলার দেখাদেখি আশপাশের গ্রামের মানুষও একই রকমভাবে মুষ্টি সঞ্চয়ে আগ্রহী হয়ে উঠছে।
ডাইংপাড়া গ্রামে রক্ষাগোলার ঘর নির্মাণের জন্য নিজের প্রায় দেড়কাঠা জমি দান করেছেন ক্ষেতমজুর মরকুস পাহাড়িয়া (৬৫)। তিনি জানান, এই ধান-চালের গোলা গ্রামবাসী সবার উপকারে লাগবে। এ জন্য ঘর তোলার জমি দিয়েছেন তিনি। গ্রামের অন্যরা চাঁদা তুলে, বেগার খেটে ঘর তুলেছে। এখন সবাই এতে খুব খুশি। একই জনজাতির অলিভিয়া বিশ্বাস (২৫) জানান, তাঁরা পরিকল্পনা নিয়েছেন বেশ কিছু সঞ্চিত ধান-চাল বিক্রি করে কাছের কোনো সরকারি ব্যাংকে রক্ষাগোলার নামে টাকা জমানোর। দুর্দিনে এই টাকা গ্রামের উন্নয়নে কাজে লাগানো হবে।
রক্ষাগোলার ধারণাটি নতুন কিছু নয়_এ কথা জানিয়ে সিভোর নির্বাহী প্রধান সারওয়ার-ই-কামাল কালের কণ্ঠকে বলেন, "সাঁওতাল, উঁরাও, পাহাড়িয়া ইত্যাদি জনজাতি সমাজে ঐতিহ্যবাহী রীতিনীতি, সুশৃঙ্খল সামাজিক কাঠামো ও সংস্কৃতিতে প্রাচীনকাল থেকেই 'সামাজিক ধর্মগোলা'র ধারণা ছিল। এই সর্বজনীন গোলা থেকে গ্রামবাসী দুর্দিনে ধান-চালের সাহায্য পেত। আমরা সিভো' পক্ষ থেকে এই ধারণাটিকে আরো সুসংগঠিত করে বাস্তবে রূপ দিতে পেরেছি মাত্র। রক্ষাগোলা নির্মাণ ও পরিচালনার পুরো কাজটি গ্রামবাসী নিজেরাই স্বেচ্ছাশ্রমের ভিত্তিতে করে। আমরা তাদের কোনো রকম আর্থিক সাহায্য বা ঋণ দেই না। তাই রক্ষাগোলা পুরোপুরি গ্রামবাসীরই অর্জন।"
সারওয়ার-ই-কামাল জানান, বিএফএফের আর্থিক সহায়তায় সিভো ২০০৫ সালের ৬ জুলাই প্রথমে পরীক্ষামূলকভাবে চৈতন্যপুর, নিমকুড়ি, কান্তপাশা-ঈদলপুর, শাহানাপাড়া ও পাথরঘাটা_এই পাঁচটি গ্রামে তিন বছরের জন্য পরীক্ষামূলকভাবে রক্ষাগোলা, তথা স্থায়ীত্বশীল উন্নয়ন প্রকল্প চালায়। অভাবনীয় সাফল্য পাওয়া যায় একেবারে হাতেনাতে। প্রকল্পটি সম্প্রসারণ করে এখন তাঁরা ২০০৯ সাল থেকে তিন বছর মেয়াদে ওই ২২টি গ্রামে রক্ষাগোলাভিত্তিক স্থায়ীত্বশীল খাদ্য নিরাপত্তা কর্মসূচি চালাচ্ছেন।
সিভোর স্বেচ্ছাসেবী আরিফ ইথার কালের কণ্ঠকে বলেন, 'রক্ষাগোলা গ্রামীণ জনপদের এমন একটি উন্নয়ন পরিকল্পনা, যার সঙ্গে পুরো গ্রামবাসীর সম্পৃক্ততা ঘটে। গ্রাম পর্যায়ে এ ধরনের উন্নয়ন কর্মসূচি বৃহত্তর উত্তরবঙ্গে তো বটেই, এমন কি সারা বাংলাদেশেও নজিরবিহীন।'
No comments