নৃত্যের তালে আনন্দঘন আয়োজন by হাসান শান্তনু

তকাল নগরের বেশিরভাগ সাংস্কৃতিক আয়োজন ছিল নৃত্যকেন্দ্রিক। এসব আয়োজনে নৃত্যের তাল ভালো লাগা ও আনন্দের দোলা দেয় নগরের সংস্কৃতিপ্রেমীদের মনে। আনন্দঘন আয়োজন উপভোগের মধ্য দিয়েই তাদের গতকাল ছুটির দিনের বিকাল ও সন্ধ্যা কাটে।দশীয় ঐতিহ্য ধারণ করে সাজানো নানা মাত্রা ও তালের নৃত্য দিয়ে গতকাল থেকে শুরু হয়েছে উদীচী শিল্পীগোষ্ঠীর তিন দিনের জাতীয় সাংস্কৃতিক সম্মেলন। ছায়ানটে গত সন্ধ্যায় ছিল উপমহাদেশের চার নৃত্য মণিপুরি, ওড়িশি, ভরতনাট্যম ও কত্থক নিয়ে উত্সব। শিশু একাডেমীর মিলনায়তনে সবুজ সেনা সংগঠনের আয়োজিত অনুষ্ঠানে ছিল খুদে শিল্পীদের মনোমুগ্ধকর নৃত্য। তবে ব্যতিক্রমী আয়োজনও ছিল।


সেগুলোতেও ছুটে আসেন বৈচিত্র্যপিয়াসী বিনোদনপ্রেমীরা। এশিয়াটিক সোসাইটি মিলনায়তনে বিকালে শিশু-কিশোর সংগঠন খেলাঘরের উদ্যোগে আয়োজিত হয় মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক শিশুতোষ সিনেমা দেখানোর অনুষ্ঠান। এতে অধ্যাপক মুহম্মদ জাফর ইকবালের ‘আমার বন্ধু রাশেদ’ সিনেমাটি দেখানো হয়। অনুষ্ঠানে অধ্যাপক জাফর ইকবাল, চলচ্চিত্রকার মোরশেদুল ইসলামসহ দুইশ’র বেশি শিশু-কিশোর ও তাদের অভিভাবক মিলে সিনেমাটি উপভোগ করেন। সন্ধ্যায় শিল্পকলা একাডেমীর সঙ্গীত ও নৃত্যকলা কেন্দ্র মিলনায়তনে ছিল কবিতার বইয়ের পাঠ উন্মোচন। সাহিত্যের গুরুগম্ভীর আলোচনার এ অনুষ্ঠানেও ছিল গান ও কবিতার আবৃত্তি। এতে অংশ নেন সঙ্গীত শিল্পী ও কবিতাবোদ্ধারা।
শহীদ মিনারে লোকজ ঐতিহ্যের নৃত্য: কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে বিকাল থেকে শুরু হয় উদীচীর জাতীয় সাংস্কৃতিক
সম্মেলন। এতে উদীচীর বিভিন্ন জেলা শাখার শিল্পী ও কর্মীরা উত্সবমুখর পরিবেশে অংশ নিচ্ছেন। শুধু এ সংগঠনের শিল্পী-কর্মীরাই নন, কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে গতকাল ছিল নগরের সংস্কৃতিপ্রেমীদের উপচেপড়া ভিড়। নানা রঙের বেলুন উড়িয়ে, ঢাকঢোল বাজিয়ে সম্মেলনের উদ্বোধন করেন রাজবাড়ির লাঞ্ছিত ও নির্যাতিত বাউলেরা। তাদের মধ্যে ছিলেন মোহাম্মদ আলী ফকির, মিনু ফকির, মালেকা ফকির, লাল চাঁদ ফকির, হিচাই ফকির ও আকবর ফকির।
উদ্বোধনী দিনের আলোচনায় অংশ নেন সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব সৈয়দ হাসান ইমাম, লোকশিল্পী সাইদুর রহমান বয়াতী, উদীচীর সাধারণ সম্পাদক হাবিবুল আলম, সহ-সাধারণ সম্পাদক প্রবীর সরদার ও বাউল সংগঠক অধ্যক্ষ নজরুল ইসলাম জাহাঙ্গীর। এতে সভাপতিত্ব করেন উদীচী কেন্দ্রীয় সংসদের সভাপতি গোলাম মোহাম্মদ ইদু। স্বাগত বক্তব্য রাখেন জাতীয় সাংস্কৃতিক সম্মেলন প্রস্তুতি পরিষদের আহ্বায়ক জামসেদ আনোয়ার তপন। অনুষ্ঠান পরিচালনায় ছিলেন উদীচীর সহ-সাধারণ সম্পাদক অমিত রঞ্জন দে। অনুষ্ঠানে বাউলদের ফুল ও ক্রেস্ট প্রদান করেন উদীচী কেন্দ্রীয় সংসদের সহসভাপতিরা।
সাংস্কৃতিক পর্বে অংশ নেয় উদীচী ঢাকা মহানগর সংসদ। এছাড়াও ছিল সংগঠনটির ময়মনসিংহ, খুলনা, টাঙ্গাইল, পিরোজপুর, বরগুনা, সুনামগঞ্জ, সিরাজগঞ্জ, নেত্রকোনা, দিনাজপুর, চুয়াডাঙ্গা, যশোর, সিলেট, রাজবাড়ী ও ঠাকুরগাঁও জেলা শাখার শিল্পীদের বৈচিত্র্যময় সাংস্কৃতিক পরিবেশনা। তিন দিনের এ সম্মেলনে প্রতিদিনের সাংস্কৃতিক পরিবেশনায় থাকবে লোকনৃত্য, যাত্রাপালা, পথনাটক, গীতি আলেখ্য, গণসঙ্গীত, গম্ভীরা, বাউল, জারি, সারি, ভাটিয়ালি, ভাওয়াইয়া, মুর্শিদি, মারফতি, ঘেটুগান, বিয়ের গান, নৌকাবাইচের গান, যন্ত্রসঙ্গীত পরিবেশনা, পল্লী ও লোকগীতি।
আজ দ্বিতীয় দিন সকাল সাড়ে ১০টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি মিলনায়তনে থাকবে ‘আমাদের সংস্কৃতি ও সাংস্কৃতিক আন্দোলন : বর্তমান অবস্থা’ শিরোনামে আলোচনা সভা। বিকাল ৪টা থেকে শুরু হবে উদীচীর বিভিন্ন জেলা শাখার শিল্পী-কর্মীদের সাংস্কৃতিক পরিবেশনা। সম্মেলনের তৃতীয় ও শেষ দিন সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে বিশেষ অবদানের জন্য শিল্পী বিপুল ভট্টাচার্যকে ‘উদীচী পদক-২০১১’ দেয়া হবে। ‘মুুক্তিযুদ্ধের চেতনা, সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র না’ স্লেম্লাগানে এ সম্মেলনের আয়োজন হচ্ছে।
ছায়ানটের দু’দিনের নৃত্যোত্সব শেষ : মণিপুরি, ওড়িশি, ভরতনাট্যম ও কত্থক—উপমহাদেশের এ চার নৃত্যে গতকাল মুখর হয়ে ওঠে ছায়ানট মিলনায়তন। দেশের বিভিন্ন এলাকার আমন্ত্রিত শিল্পীরা এতে অংশ নেন। উত্সব উপভোগ করেন নানা বয়সের নৃত্যপ্রিয় মানুষ। আর এর মধ্য দিয়ে শেষ হলো ছায়ানটের আয়োজিত দু’দিনের এ উত্সব। এতে ছায়ানটসহ মোট সাতটি সংগঠন শাস্ত্রীয় নৃত্য পরিবেশন করে। দলীয় পরিবেশনার পাশাপাশি ছিল একক পরিবেশনা। বেসরকারি মুঠোফোন কোম্পানি রবির সহযোগিতায় এর আয়োজন হয়। কবিগুরুর সার্ধশত জন্মবর্ষ উপলক্ষে গত বছর রবীন্দ্র নৃত্যোত্সবের আয়োজন করে ছায়ানট। এর ধারাবাহিকতায় এ নৃত্যোত্সব আয়োজিত হয়।
শিশু একাডেমীতে খুদে শিল্পীদের নৃত্য : শিশু একাডেমীর মিলনায়তনে বিকালে সবুজ সেনা আয়োজন করে বর্ণাঢ্য নৃত্যানুষ্ঠানের। এতে সংগঠনটির শিশু শিল্পীরা নৃত্য পরিবেশন করে। তাদের নৃত্যের ছন্দ একাডেমীর মিলনায়তন ছাড়িয়ে ছড়িয়ে পড়ে আশপাশ এলাকায়। সবুজ সেনার পথচলার দশ বছর পূর্তি উপলক্ষে আয়োজিত এ অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী অ্যাডভোকেট প্রমোদ মানকিন। বিশেষ অতিথি ছিলেন সংসদ সদস্য ডা. মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন ও অ্যাডভোকেট আফজাল হোসেন। প্রধান বক্তা ছিলেন গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশনের সেক্রেটারি জেনারেল ঝুনা চৌধুরী, কথক নৃত্যগুরু সাজু আহমেদ, নৃত্যশিল্পী সংস্থার সাধারণ সম্পাদক দীপা খন্দকার ও সিসিবিএল গ্রুপের চেয়ারম্যান গোলাম নবী মোল্লা। এতে সভাপতিত্ব করেন আয়োজক সংগঠনের সভাপতি নুরুল করিম চৌধুরী জিন্নাহ। স্বাগত বক্তব্য রাখেন জাতীয় কবিতা পরিষদের সাধারণ সম্পাদক আসলাম সানী। শুভেচ্ছা বক্তব্য দেন শিশু সংগঠন ঐক্যজোটের সভাপতি শাহ আলম শিকদার জয়।
শিল্পকলায় পাঠ উন্মোচন : কথা, কবিতা আর গানের সুরে গতকাল পাঠ উন্মোচন হলো তরুণ কবি ও সাংবাদিক হাসান মাহমুদের ‘চোখের মতো চিহ্নগুলো’ কবিতার বইয়ের। সন্ধ্যায় শিল্পকলা একাডেমীর সঙ্গীত ও নৃত্যকলা কেন্দ্র মিলনায়তনে আয়োজিত অনুষ্ঠানে বইটির পাঠ উন্মোচন করেন কবি জাহিদুল হক, অনুবাদক আলী আহমদ ও কণ্ঠশিল্পী ঝর্ণা রহমান। অনুষ্ঠানে গান গেয়ে শোনান লালনকন্যা ফরিদা পারভীন, সঙ্গীতজন অনুপ ভট্টাচার্য। উল্লেখ্য, বইটি এবারের একুশে বইমেলায় প্রকাশ করে আদর্শ প্রকাশনী।
কবীর চৌধুরী শিশুসাহিত্য পুরস্কার : বাংলা একাডেমীর পরিচালিত ‘কবীর চৌধুরী শিশুসাহিত্য পুরস্কার ২০১০’ পেলেন বিশিষ্ট ছড়াকার সুকুমার বড়ুয়া। শিশুসাহিত্যে সামগ্রিক অবদানের জন্য তাকে এ পুরস্কার দেয়া হচ্ছে বলে একাডেমীর বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়। পুরস্কারের অর্থমূল্য এক লাখ টাকা। আর পুরস্কার তহবিলের জন্য প্রয়োজনীয় টাকা জাতীয় অধ্যাপক কবীর চৌধুরী উদ্যোগে প্রদান করা হবে। শিগগিরই আনুষ্ঠানিকভাবে সুকুমার বড়ুয়াকে এ পুরস্কার দেয়া হবে।
আজ শেষ হচ্ছে প্রশান্ত প্রকৃতি : প্রকৃতিবিষয়ক চিত্রকর্ম নিয়ে ধানমন্ডির বেঙ্গল শিল্পালয়ে গত ১৪ অক্টোবর থেকে আয়োজিত ছাপচিত্রের প্রদর্শনী শেষ হচ্ছে আজ। ভারতের প্রখ্যাত শিল্পী হরেন দাস আর তার ছেলে চন্দন দাসের চিত্রকর্ম নিয়ে ‘প্রশান্ত প্রকৃতি’ শিরোনামে এর আয়োজন হয়। বেঙ্গল শিল্পালয় নয় দিনের এ প্রদর্শনীর আয়োজন করে। এতে ছিল হরেন দাসের ৫১টি আর চন্দন দাসের ২৪টি চিত্রকর্ম। সব মিলিয়ে চিত্রকর্ম ছিল ৭৫টি।

No comments

Powered by Blogger.