বাংলাদেশ টেস্ট খেলল টেস্ট দলের মতোই-বাংলাদেশ : ৯১ ওভারে ২৫৫/৪ by মোস্তফা মামুন,

টেস্ট খেলল বাংলাদেশ! -তথ্য হিসাবে বিভ্রান্তিকর, চট্টগ্রামে তো টেস্ট খেলাই হচ্ছে, তাহলে আবার চর্বিত-চর্বণ কেন? এ জন্য যে বাংলাদেশ সাধারণত টেস্টটা টেস্টের মতো খেলে না। টেস্ট হয়ে যায় ওয়ানডে। ওয়ানডেকে বানিয়ে দেয় টোয়েন্টি টোয়েন্টি। তার তুলনায় কালকের চট্টগ্রাম এমন জ্বলজ্বলে ব্যতিক্রম যে কিছু ফাঁকফোকর থাকা সত্ত্বেও দিনশেষে লিখতে গিয়ে মনে হচ্ছে, এ যেন 'একদিন স্বপ্নের দিন'।টেস্ট ক্রিকেট পবিত্রতার প্রতীক, শুদ্ধতা তার অলংকার, ধৈর্য তার চারিত্রিক দাবি। সেই দাবিগুলো একসময় ধর্মাচরণের মতো করে পালন করতেন ব্র্যাডম্যান-গাভাস্কাররা।


গত দেড়-দুই দশকে পেছনের দরজা দিয়ে ঢুকে গেল বেশ কিছু ভেজাল। বাণিজ্যিক চরিত্রের কারণে ওয়ানডে হয় অনেক বেশি, তাল মেলাতে গিয়ে খেলার ধরনে বদল এসেছে অনেক এবং সেই বদলের সুবাদে টেস্ট ক্রিকেটও তার ধ্রুপদী চরিত্র হারিয়েছে অনেক। আজকাল তাই আর বৃষ্টি ছাড়া ড্র টেস্ট দেখা হয় না। বিঘ্নহীন পুরো দিনের ৯১ ওভারে ২৫৫ রানও বিরলপ্রায়। আর ঘটনাটা যখন ঘটায় নাবালক বাংলাদেশ, তখন শুধু কৃতিত্বে সীমিত না থেকে সেটা স্বপ্নের কাতারে

পেঁৗছায়। আমাদের চেনা যে বাংলাদেশ, তার ব্যাটসম্যানরা তো সব ছাড়ার বল মারতে গিয়ে উইকেট দেন। অধৈর্য তাঁরা। সঠিক ব্যাটিং প্রতিরক্ষাবূ্যহ না থাকায় মাঝেমধ্যেই আসা-যাওয়ার মিছিল শুরু হয়ে যায়। তার তুলনায় ২১ অক্টোবরের চট্টগ্রাম আনন্দদায়ী ব্যতিক্রম। পুরো দিনে ৫৪৮টি বল খেলতে হয়েছে বাংলাদেশকে, দিনের শেষে খুব ভেবে দেখছি এর মধ্যে ৪৮ বলও বাংলাদেশ ব্যাটসম্যানরা ভুল খেলেননি। রান যা-ই হোক, বলের পেছনে যাওয়া, আত্মরক্ষা, বোলার এবং বলকে বোঝা_টেস্টের ভেতরে এসব যে ছোট ছোট পরীক্ষা তার সিংহ ভাগেই বাংলাদেশের ব্যাটিং লেটার মার্ক পাওয়ার দাবিদার।
ক্রিকেট অধিনায়কের খাতায় তাঁর নাম অবশ্যই সোনার অক্ষরে লেখা থাকবে। ক্রিকেট বিজ্ঞানে, ক্রিকেটের সংস্কারেও তাঁর চিন্তার ভূমিকা কম নয়। ভদ্রলোকের নাম স্টিভেন রজার্স ওয়াহ। যতই টেস্টের গায়ে ক্লাসিক্যালের ব্যানার থাকুক, মানুষ না দেখলে তো তার কোনো মানে থাকে না। তিনি তাই নব্বই দশকের মাঝামাঝি একটা ফর্মুলা বের করলেন। টেস্টে প্রতি ওভারে ৪ রান হওয়া উচিত আদর্শ। তাঁর মানে দিনের নূ্যনতম ৯০ ওভারে ৩৬০ রান এবং তাতে ৫ সেশন ব্যাট করলেই সাড়ে চার শ'র কাছাকাছি চলে যাওয়া যাচ্ছে। বিপক্ষকে অল আউট করার জন্য সময় পাওয়া যাচ্ছে অনেক বেশি। দারুণ কার্যকর চিন্তা। ওয়ানডের সুবাদে ব্যাটসম্যানরা অনেক বেশি শটপ্রবণ এবং বোলাররা লাইন-লেন্থের চর্চা করতে করতে অনেক কম আক্রমণাত্মক। কাজেই স্টিভ সফল। তাঁর দল তাদের জয়ের ঘোড়দৌড় শুরু করল অনন্তের দিকে। স্টিভ ওয়াহ সফল, এটাই এখন মডেল, কিন্তু এই মডেলে ঠিক সেই শুদ্ধতার চর্চা নেই। রান হয়, সে তো ওয়ানডেতে ছয়-সাত শ রানও হয়। ঢাল আর তলোয়ার একসঙ্গে চালিয়ে শুদ্ধতার ভেতরে থেকে যে আদি টেস্ট ক্রিকেট, তাঁর চর্চা আজকাল আর খুব দেখা যায় না। কালকের বাংলাদেশ, দুয়েকটি ভুলভাল বাদ দিলে সেটা দেখিয়েছে। এ যেন ফুরিয়ে যাওয়া খনি থেকে হারিয়ে যাওয়া মুক্তার ধ্বংসাবশেষের প্রদর্শনী।
স্টিভ ওয়াহর মতো আরেকজন কিংবদন্তি ছিলেন। ইমরান খান নিয়াজি। সাদা ট্রাউজার-টি-শার্ট ছেড়ে এখন চোস্ত কাবুলি পরেন, পাকিস্তান আর আমেরিকার শাসকদের বিরুদ্ধে কণ্ঠ কামান দাগেন মাঝেমধ্যে আর বলেন, ক্রিকেটে এখন আর তাঁর মন নেই। একসময় মন ছিল। শরীর ছিল। ছিল শারীরিক অপ্রতিরোধ্য উপস্থিতি। নিজের পাকিস্তান দলকে অনিশ্চয়তার ঐশ্বর্য দিয়ে এমন রাঙিয়েছিলেন যে পাকিস্তান সম্পর্কে একটা কথাও আগেভাগে বলা যেত না। এখনকার বাংলাদেশ, আমাদের বাংলাদেশ, ক্ষুদ্র পরিসরে সেই চরিত্রটা যেন ধারণ করে ফেলেছে। নইলে আইসিএল গোলমালে একগাদা খেলোয়াড় হারানোর পরের ম্যাচেই কী করে জেতে! কিংবা বিশ্বকাপে ৫৮-তে অল আউট হওয়ার পর কিংবা এখানে সিরিজ হারার পর ৬১ কী করে ঘটায়! কাল ম্যাচ জেতেনি কিন্তু আমাদের চোখে ধাঁধা লাগাল দলের টেস্ট দলের রূপ ধারণ! ভাবা যায়, এই দলটি গত ১০ দিনের মধ্যে টোয়েন্টি টোয়েন্টি-ওয়ানডে এবং তারপর টেস্ট খেলছে। প্রায় অভিন্ন দল, দেশের মাটিতে টেস্ট খেলছে দুই বছর পর, সব মিলিয়ে গত দেড় বছরের মধ্যে মাত্র দ্বিতীয় টেস্ট, অথচ কালকের ব্যাটিং দেখে মনেই হলো না এরা টেস্টে অনভ্যস্ত। আর তাই বহু দিন পর টেস্টের প্রথম দিন শেষে বাংলাদেশ ড্রেসিংরুমে ফিরল তৃপ্তি নিয়ে। কেউ কেউ বলবেন, উইকেটে এমন কিছু ছিল না। মুভমেন্ট নেই, নেই টার্নের বিষাক্ততা। কাজেই এ আর এমন কী! তাঁদের জন্য বলা, বাংলাদেশের টেস্টে ব্যর্থ হতে উইকেট-মুভমেন্ট এসব লেগেছে কবে! একেবারে নিজস্ব ক্ষমতায় (অক্ষমতায়) বাংলাদেশ লুটিয়ে পড়ার সামর্থ্য রাখে প্রায় সময়।
তিনি তামিম ইকবাল, এই চট্টগ্রামের সন্তান। ভাগ্য বাংলাদেশ ক্রিকেটকে আশীর্বাদ দিতে এক পায়ে খাড়া থাকে এখানে কিন্তু তামিমের দিকে কেন যেন হাত বাড়ায় না। নিজের শহরে তাঁর কোনো সেঞ্চুরি নেই। কাল হয়ে যেতে পারত। শেষপর্যন্ত যে হয়নি সেটা নিজেরই দোষ। ধৈর্যের পরীক্ষায় পাস করে, শটের থলিতে লাগাম পরিয়ে ১৪১ বলে ৫২ রান করার পর স্লগ সুইপ করতে গেলেন। সময়ের হেরফেরে বল আকাশে। মিডউইকেটে ফিল্ডিং করছিলেন ব্র্যাথওয়েইট। বল তাঁরই হাতে। তামিমের আফসোস নেই, কারণ ওটা ছিল মারার বল। ঠিক আছে। ভুল তো এক-আধটা হবেই, না হলে তো আর কোনো ব্যাটসম্যান কখনো আউট হতো না। তামিম শটের ঝুলিটা প্রায় সময়ই উপুড় করে মেলে ধরেন, আর উপুড় করে মেলে ধরা জিনিস যেমন লুট হওয়ার আশঙ্কা থাকে, তেমনি তামিমের উইকেটও সাধারণত লুট হয় খুব তাড়াতাড়ি। কাল যে অনেক দেরিতে হলো, তার কারণ তো নিজের এই ধৈর্যশীলতা। তামিম আর সাকিব ব্যক্তিগত জীবনে যেমন অভিন্নহৃদয়, তেমনি মাঠের কাণ্ড এবং কীর্তি দুটোতেই একীভূত থাকার চেষ্টা করেন যেন। সাকিব অত ধৈর্যশীল নন, ৮৩ বলে ৪০ কিন্তু প্রথম রানের জন্য যে ১০ বল পর্যন্ত অপেক্ষা করেছেন সেটাও তো টেস্টের চরিত্র-চাহিদার সঙ্গে মানানসই। কিন্তু আউটটা আবার তামিমের মতো। নিজেকে বিলিয়ে দেওয়া। এমন কিছু বল নয়, নিরীহ অফস্পিন, সাকিব কাট করতে গেলেন। কাট করার জন্য যতটা জায়গা দরকার অতটা ছিল না বলেই বলটা কিপারের হাতে। তাঁদের তুলনায় রকিবুল অনেক বেশি টেস্ট ম্যাচের জন্য তৈরি, প্রায় পড়ে পাওয়া চৌদ্দ আনার মতো পাওয়া সুযোগটাকে কাজে লাগালেন প্রয়োগক্ষমতার পুরোটা ঢেলে দিয়ে। ১৩৫ মিনিটে তিল তিল করে খেলা ৯২ বলে ৪১ রানের ইনিংসটি শেষ হওয়াতে নিজের চেয়ে আম্পায়ারের দোষ বেশি। বলটা খুব সম্ভব লেগস্টাম্প মিস করছিল। টিভি সে রকম দেখালেও আম্পায়ার অন্য রকম দেখলেন। এসব মিলেই পুরো দিনে ঘন ঘন দুই উইকেট পড়ার সমস্যা নেই, ব্রেকের আগে বা পরে তাড়াহুড়ার রোগও নেই। তাই কালকের দিনের একমাত্র বেমানান ইমরুলের (১০) সঙ্গে তামিমের ২৬ রানের ওপেনিং জুটিটা বাদ দিলে আর সবই বলার মতো জুটি। দ্বিতীয় উইকেটে ৮৪, তৃতীয় উইকেটে ৪৯, চতুর্থ উইকেটে ৬৯। এ-ও বিরল দৃশ্য। পরপর তিনটা বড় জুটি। ধ্রুপদী টেস্টের আরেকটা ছবিও আছে। ফিদেল এডওয়ার্ডসের একটা বাউন্সার ছাড়তে গিয়ে সময়মতো সরতে পারলেন না নাফীস, বল প্রটেক্টিং গ্রিল ভেদ করে লাগল নাকে। রক্তপাত। এটাও পুরনো আমলের টেস্টে খুব হতো। তখন অত আত্মরক্ষার সরঞ্জাম ছিল না, বডিলাইনের মতো না হলেও শরীরে-শরীরে একটা লড়াই ছিল, তাতে রক্তপাতও নিত্যদিনের ঘটনা। সেটাও হয়ে গেল কালকের চট্টগ্রামে। সব মিলিয়ে টেস্টের ক্লাসিক প্রথম দিন।
সেই ক্লাসিক দিনে সবচেয়ে ক্লাসিক যিনি তাঁর কথাটা এখনো আনিনি। ইচ্ছা করেই। লেখাটা তাঁকে দিয়ে শেষ করার ইচ্ছা যে! মুশফিকুর রহিম নামের কিশোর-দর্শন তরুণটি বাংলাদেশ ক্রিকেটের নিখুঁত ব্যাটিংয়ের নিপুণতম ছবি। সেটা সব সময়ের ঘটনা। আর অধিনায়ক হওয়ার পরের ঘটনা হলো, তাঁর শরীরে যেন ভর করেছে জাদুর জোয়ার। যাতে হাত দিচ্ছেন তা-ই সোনা হয়ে যাচ্ছে। ভাবা যায়, এখন পর্যন্ত অংশ নেওয়া পাঁচটি টসই জিতেছেন! ব্যাটে প্রতি ইনিংসে রান এবং প্রতিদিনই যেন নিজেকে ছাড়িয়ে যাওয়ার লড়াইয়ে। কালও ব্যাট হাতে যথারীতি দুর্ভেদ্য, শট খেলায় পরিমিত, শারীরিক উপস্থিতিতে প্রকৃত অবয়ব ছাড়িয়ে এক মহীরুহ যেন। ব্যাট দিয়ে, ছায়া দিয়ে, প্রতিজ্ঞা দিয়ে নিজেকে আর দলকে টেনে নিচ্ছেন সাফল্যের মিনারের দিকে। প্রায় সোয়া তিন ঘণ্টা ব্যাট করে ১৪৪ বলে ৬৮ রানে অপরাজিত। এখন সঙ্গী নাঈম, এখনো রয়ে গেছেন নাসির। তারপর আরো তিনজন। মুশফিকের সম্ভাব্য সেঞ্চুরি, দলের চার শ ছাড়ানো স্কোর_সবই এখন প্রত্যাশার বৃত্তের মধ্যে। লেখাটা যখন এই পর্যায়ে তখনই এক পরিচিতের ফোন। ব্যক্তিগত ব্যস্ততায় সারা দিন খোঁজ রাখতে না পারা বন্ধুটি মনে করিয়ে দিলেন, বাংলাদেশের সেই চরিত্রকে। অধারাবাহিকতার চরিত্র। অনিশ্চয়তার চরিত্র। একদিন যা করে পরদিন তাকে ডুবিয়ে দেয়। সেই নীতি তো প্রায় প্রমাণিত সত্য। মানতেই হচ্ছে।
আর তাই আশঙ্কা করছি আজকের বাংলাদেশ হতাশ করবে। আবার আশা করছি হতাশ করবে না।

No comments

Powered by Blogger.