পক্ষপাতিত্বের অভিযোগে তিন ওসিসহ প্রশাসনে রদবদল চান আইভী-তৈমূর by আবু সাউদ মাসুদ
নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ এনে তিন থানার ওসিসহ স্থানীয় প্রশাসনে রদবদল চান মেয়র প্রার্থী আইভী ও তৈমূর। নানা অজুহাতে নেতাকর্মীদের নাজেহাল ও পোস্টার-ফেস্টুন ছিঁড়ে ফেলার বিরুদ্ধে পদক্ষেপ না নেয়ায় শামীম ওসমান সমর্থকদের পক্ষে পুলিশের সহযোগিতার অভিযোগ তুলেছেন হেভিওয়েট এই দুই প্রার্থী। পোস্টার ও ফেস্টুন ছেঁড়া এবং পোড়ানোকে নিয়ে হুমকি পাল্টা হুমকিতে পরিস্থিতি উত্তপ্ত করে তুলেছেন আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থী শামীম ওসমান ও সমর্থনবঞ্চিত আইভী। একে অপরের প্রতি আক্রমণাত্মক বক্তব্য দেয়ায় উভয় শিবিরের নেতাকর্মীদের মাঝে দেখা দিয়েছে উত্তেজনা। সাধারণ ভোটাদের মাঝে দেখা দিয়েছে শঙ্কা।
শামীম দলীয় সমর্থন পাওয়ায় তার পক্ষে কেন্দ্রীয় নেতারা নারায়ণগঞ্জ আসছেন প্রতিদিন। প্রচারণায়ও অংশ নিচ্ছেন। জনগণের প্রার্থী দাবিদার সেলিনা হায়াত্ আইভীর পক্ষে আনুষ্ঠানিকভাবে গণসংযোগে নেমেছেন জেলা আওয়ামী লীগের আহ্বায়ক ও সাবেক এমপি এসএম আকরাম। কার্যত নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে স্থানীয় আওয়ামী লীগ বনাম কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের লড়াই এখন প্রকাশ্যে।
শামীম ওসমান সাংবাদিকদের বলেন, আইভী শেষ পর্যন্ত তার পক্ষেই আসবেন। তিনি বলেন, আমার কাছে অনেক ফাইল আছে। চাইলেই আমি এগুলো প্রকাশ করে দিতে পারি। দলের স্বার্থে তা করছি না। আমার বিশ্বাস আইভী শেষ পর্যন্ত বুঝতে পারবে। শামীম ওসমান বলেন, তার এ অবস্থানের কারণে স্বাধীনতাবিরোধীরা সুযোগ পাবে। তিনি বলেন, আমি যতটুকু জানি আইভী বসে যেতে চায়। কিন্তু কিছু লোক তাকে বসতে দিচ্ছে না। সো-কলড সুশীল নামের কিছু লোক তাকে নির্বাচনে থাকার পরামর্শ দিচ্ছে। যারা এক-এগারোর সময় মাঠে ছিল তারাই আইভীর পক্ষে। এদিকে শামীম ওসমানের ভাই সংসদ সদস্য নাসিম ওসমান গতকাল আবারও বলেন, শামীম ওসমানই নির্বাচনে বিজয়ী হবে। তিনি কীভাবে নিশ্চিত হলেন জানতে চাইলে নাসিম বলেন, স্থানীয় সংসদ সদস্য হিসেবে তিনি অনুমান করেই বলেছেন। তিনি বলেন, ভাই হিসেবে নয়, নারায়ণগঞ্জের যোগ্য প্রার্থী হিসেবে তিনি শামীম ওসমানকে সমর্থন করেন।
শামীম ওসমানের বক্তব্যের পাল্টা বক্তব্যে আইভী বলেন, নাসিম ওসমান একজন দায়িত্বশীল সংসদ সদস্য হয়ে কীভাবে বলতে পারেন আইভী ৫ হাজার ভোটও পাবে না এবং ৭টা মধ্যে শামীম ওসমানকে বিজয়ী ঘোষণা করা হবে। তার ভাইয়ের পক্ষ হয়ে উনি যদি আগেই ফলাফল বলে দেন তাহলে কি আমরা বলতে পারি ভোটে নারায়ণগঞ্জের জনগণের কাঙ্ক্ষিত ফলাফল পাওয়া যাবে না। এব্যাপারে নির্বাচন কমিশনকে অনুরোধ করব প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে। এত হুমকি-ধমকির মধ্যেও নারায়ণগঞ্জের মানুষ বেরিয়ে পড়েছে। যে গণজোয়ারের সৃষ্টি হয়েছে তাতে কোনো সন্ত্রাসী, কোন চাঁদাবাজের দখলদারিত্ব এখানে টিকবে না ইনশাল্লা। আমি বসে যাচ্ছি বলে অপপ্রচার চালানো হচ্ছে। শামীম ওসমানের এই বক্তব্য পুরনো কৌশল। ভোট ছিনতাই করা, মানুষকে ভয় দেখানোই হচ্ছে তার কাজ। ৩০ তারিখে দোয়াত-কলমে ভোট দেয়াই হবে দীর্ঘদিনের ওসমান ফ্যামিলির কবল থেকে নারায়ণগঞ্জকে মুক্ত করার ম্যান্ডেট। নারায়ণগঞ্জের মানুুষ সন্ত্রাস ও চাঁদাবাজি থেকে মুক্তি চায়। ওসমান পরিবারের শাসন থেকে মুক্তি চায়। আমার পক্ষে গণজোয়ার সৃষ্টি হয়েছে। নারায়ণগঞ্জের লক্ষ জনতা আমার সঙ্গে আছে। গণজোয়ার দেখে শেষ পর্যন্ত শামীম ওসমান আমার পক্ষেই কাজ করবেন।
এদিকে বিএনপি সমর্থিত প্রার্থী অ্যাডভোকেট তৈমূর আলম খন্দকারেরও অভিযোগ, নারায়ণগঞ্জের প্রশাসন নিরপেক্ষ নয়। এদের দিয়ে নির্বাচন নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু করা সম্ভব নয়। তিনি ৩ থানার ওসিসহ স্থানীয় প্রশাসনে রদবদল চান। তৈমূর নির্বাচন প্রক্রিয়ার শুরু থেকেই প্রশাসনের রদবদলের দাবি জানিয়ে আসছিলেন। কিন্তু নির্বাচন কমিশন তা আমলে নেননি। তৈমূর সমর্থকরা বলছেন, লিফলেট বিলি করতে গেলে নানা অজুহাতে পুলিশ তাদের হয়রানি করছে। ফলে নেতাকর্মীদের মাঝে ভীতির সৃষ্টি হয়েছে।
এদিকে সাধারণ ভোটারদেরও বক্তব্য বর্তমান প্রশাসন একটি পরিবারের অনুগত। ফলে একটি পক্ষের সঙ্গে এই প্রশাসনের আত্মিক সম্পর্ক রয়েছে। এদের যত চাপ কিংবা আদর-সোহাগ করা হোক না কেন দীর্ঘদিনের সখ্য থেকে এরা বেরুতে পারবে না। ফলে এদের নিরপেক্ষ থাকার কোনো সুযোগ নেই। সুবিধাভোগ করার কারণে এদের পক্ষে নিরপেক্ষ থাকা কঠিন হয়ে পড়বে। স্থানীয় প্রশাসনে রদবদল অবশ্যই এখন জনতার দাবি।
প্রশাসনের পক্ষপাতমূলক আচরণের অভিযোগ আইভীর
মেয়র প্রার্থী আইভী প্রশাসনের পক্ষপাতমূলক আচরণের লিখিত অভিযোগ জেলা রিটার্নিং অফিসারের কাছে দায়ের করেছেন। গতকাল দুপুরে দায়ের করা এ অভিযোগে তিনি উল্লেখ করেন, নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে কার্যক্রম চালাতে গিয়ে প্রশাসন নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করছে না। বিভিন্ন স্থানে আমাদের প্রচার কার্যক্রমে বিধি-বহির্ভূতভাবে বাধা প্রদান করছে। ২০ অক্টোবর বিকালে ১৭ নং ওয়ার্ডের পাইকপাড়ার শাহসূজা রোডে আমাদের ১০/১২ কর্মী লিফলেট বিতরণ করতে থাকলে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মোহাম্মদ মামুন মিয়ার নেতৃত্বে এসআই জহিরুলসহ মোবাইল টিম এসে বাধা দেয়। এ সময় তারা ১০ হাজার টাকা জরিমানা ও অনাদায়ে ৪ দিনের বিনাশ্রম কারাদণ্ড প্রদানের নোটিশ জারি করে। নোটিশে নির্বাচন আচরণবিধি ২০১০-এর ৬/৪(খ) ভঙ্গ করা হয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়। আচরণবিধি ৬/৪ (খ) বিধিতে উল্লেখ রয়েছে যে, ‘যানবাহন সহকারে মিছিল কিংবা মিছিল বাহির করা যাইবে না বা কোনোরূপ শোডাউন করা যাইবে না।’ ১০/১২ জনের প্রচারপত্র বিলিতে ওই ধারা ভঙ্গের কোনো কারণ নেই। এটি সম্পূর্ণ বিধিবহির্ভূতভাবে করা হয়েছে বলে আমরা মনে করি। সেদিনই বিকালে ১নং ওয়ার্ডের মিজমিজি এলাকায় লিফলেট বিতরণকালে ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে পুলিশ এসে লিফলেট ছিনিয়ে নেয়। উল্লেখ করা হয়, লিফলেট মুদ্রণকারী প্রতিষ্ঠানের নাম ও তারিখ না থাকাতে এ লিফলেট বিলি করা যাবে না। অথচ সিটি করপোরেশন নির্বাচন বিধিমালার কোথাও এমন ধারা নেই যে লিফলেটে মুদ্রণকারী প্রতিষ্ঠানের নাম, ঠিকানা ও তারিখ উল্লেখ করতে হবে। ২০ অক্টোবর বিকালে ৭নং ওয়ার্ডের কদমতলী হাইস্কুলের সামনে থেকে কর্তব্যরত ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে আমাদের একটি ফেস্টুন খুলে নিয়ে যাওয়া হয়। ফেস্টুনটি ৩ মিটারের চেয়েও বড় উল্লেখ করে নিয়ে যাওয়া হয়। আমরা দৃঢ়তার সঙ্গে বলতে চাই কোথাও আমাদের কোনো ফেস্টুনই ৩ মিটারের চেয়ে বড় নেই। প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী শামীম ওসমানের তিন মিটাররের চেয়েও বড় আকারের ফেস্টুনগুলো বিভিন্ন জায়গায় প্রদর্শিত হলেও তা খুলে নেয়ার কোনো উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না। আমরা আগে থেকেই বর্তমান প্রশাসনের পক্ষপাতমূলক অবস্থানের কারণে তাদের রদবদল দাবি করে আসছি। অথচ নারায়ণগঞ্জের বির্তকিত জেলা প্রশাসকের সহকর্মী ও সহযোগীদের দিয়ে নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু নির্বাচন কতটা করা যাবে আমরা তাতে শঙ্কা প্রকাশ করছি। আমরা অনতিবিলম্বে এ বিষয়ে জরুরি পদক্ষেপ নেয়ার জন্য আবেদন জানাচ্ছি।
হেভিওয়েট তিন প্রার্থীর গণসংযোগ
নির্বাচন ঘনিয়ে আসায় ঘুম হারাম হয়ে গেছে মেয়র ও কাউন্সিলর প্রার্থীদের। গতকাল ছুটির দিনে জমজমাট প্রচারণা চালিয়েছেন তারা। দিনভর তারা ভোটারদের শুনিয়েছেন উন্নয়নের নানা প্রতিশ্রুতি। আলোচিত ৩ মেয়র প্রার্থী আওয়ামী লীগের শামীম ওসমান, ডা. সেলিনা হায়াত্ আইভী, বিএনপির তৈমূর আলম খন্দকার ছুটির এই দিনটিকে পুরোপুরি কাজে লাগিয়েছেন। তবে পিছিয়ে থাকেননি চরমোনাই সমর্থিত প্রার্থী আলহাজ আতিকুর রহমান নান্নু মুন্সি। এরমধ্যে আলোচিত তিন মেয়র প্রার্থীর মধ্যে ডা. সেলিনা হায়াত্ আইভী সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত ১৩ নং ওয়ার্ডের জামতলা, কলেজ রোড, গলাচিপা, মাসদাইর বাজার এলাকায় গণসংযোগ করেন। এরপর বিকাল ৩টা থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত বন্দরের ২৪ নং ওয়ার্ডের মদনগঞ্জ এলাকায় বাড়ি বাড়ি গিয়ে ভোট চান আইভী। অতীতের মতোই উন্নয়নমূলক কাজ করে যাওয়ার প্রতিশ্রুতি দেন তিনি। এ সময় আইভীর কাছে ছুটে আসে বৃদ্ধ-নারী-শিশুসহ সর্বস্তরের মানুষ। দুই এলাকার গণসংযোগে তার সঙ্গে ছিলেন জেলা আওয়ামী লীগের আহ্বায়ক সাবেক এমপি এসএম আকরাম, শহর আওয়ামী লীগের সভাপতি আনোয়ার হোসেন, সহ-সভাপতি হায়দার আলী পুতুল, জেলা যুবলীগের সভাপতি আবদুল কাদির, জেলা আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবক লীগের আহ্বায়ক নিজাম উদ্দিন, জেলা কৃষক লীগের সাধারণ সম্পাদক রোকন উদ্দিন আহেমদ, কেন্দ্রীয় ছাত্রীলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক জিএম আরাফাতসহ স্থানীয় আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীরা।
সকাল থেকে শামীম ওসমান প্রচারণা চালান সিদ্ধিরগঞ্জের ১নং ওয়ার্ডের মিজমিজি ক্যানেলপাড়, পাগলাবাড়ি, তালতলা, পাইনাদী, ধনুহাজী রোড ও হিরাঝিল এলাকায়। শামীম ওসমান ১৯৯৬ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত এমপি থাকা অবস্থায় তার উন্নয়নের চিত্র তুলে ধরে ভোট চান ভোটারদের কাছে। জমার নামাজের আগ পর্যন্ত তিনি ওইসব এলাকায় গণসংযোগ করে নারায়ণগঞ্জে ফিরে আসেন। ওই সময় তার সঙ্গে ছিলেন স্থানীয় এমপি কায়সার হাসনাত, নজরুম্নল ইসলাম বাবু এমপি, সিদ্ধিরগঞ্জ থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি মজিবুর রহমান, সাধারণ সম্পাদক হাজী ইয়াছিন মিয়া প্রমুখ। বিকালে শামীম ওসমান নতুন পালপাড়ায় বৈঠক করে মিন্নত আলী শাহ’র মাজার জিয়ারত করে ১৬ নং ওয়ার্ডের দেওভোগ বাবুরাইল, বেপারীপাড়া, দেওভোগ পাক্কা রোড, পশ্চিম দেওভোগ এলাকায় গণসংযোগ এবং উঠান বৈঠক করেন।
বিএনপি সমর্থিত মেয়র প্রার্থী তৈমূর আলম খন্দকার সকালে ১২নং ওয়ার্ডের খানপুর এলাকায় গণসংযোগ করেছেন। পরে তিনি খেলাফত মজলিসের নেতাকর্মীদের সঙ্গে বৈঠক করেন। সেখানে খেলাফত মজলিসের নেতাকর্মীরা তাকে সমর্থন জানান। দুপুরে সিদ্ধিরগঞ্জপুল, মিজমিজি, মজিববাগসহ বিভিন্ন এলাকায় গণসংযোগ করেন তিনি। এসময় তার সঙ্গে ছিলেন নারায়ণগঞ্জ-৫ (শহর-বন্দর) আসনের সাবেক এমপি আবুল কালাম, নারায়ণগঞ্জ-৪ (ফতুল্লা) আসনের সাবেক এমপি গিয়াসউদ্দিন, বিএনপি নেতা আবদুল হাই রাজু প্রমুখ।
অপরদিকে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় নেতা চরমোনাই পীর সমর্থিত মেয়র প্রার্থী আলহাজ আতিকুর রহমান নান্নু মুন্সি দিনভর বন্দরের ১৯, ২০ ও ২১ নং ওয়ার্ডে গণসংযোগ ও উঠান বৈঠক করেন। সাধারণ ভোটার ছাড়াও বিপুলসংখ্যক চরমোনাই পীরের অনুসারীরা তার সঙ্গে গণসংযোগ ও উঠান বৈঠকে অংশ নেন। নির্বাচনী প্রচারণার সময় নান্নু মুন্সির সঙ্গে ছিলেন নির্বাচন পরিচালনা কমিটির আহ্বায়ক মাওলানা সৈয়দ আহাম্মদ, সদস্য সচিব মাওলানা দ্বীন ইসলাম, মাওলানা আকতার হোসেন, মাওলানা নছরুল্লাহ প্রমুখ। অপর দুই মেয়র প্রার্থীর প্রচারণা তেমন একটা চোখে পড়েনি।
শামীম ওসমান সাংবাদিকদের বলেন, আইভী শেষ পর্যন্ত তার পক্ষেই আসবেন। তিনি বলেন, আমার কাছে অনেক ফাইল আছে। চাইলেই আমি এগুলো প্রকাশ করে দিতে পারি। দলের স্বার্থে তা করছি না। আমার বিশ্বাস আইভী শেষ পর্যন্ত বুঝতে পারবে। শামীম ওসমান বলেন, তার এ অবস্থানের কারণে স্বাধীনতাবিরোধীরা সুযোগ পাবে। তিনি বলেন, আমি যতটুকু জানি আইভী বসে যেতে চায়। কিন্তু কিছু লোক তাকে বসতে দিচ্ছে না। সো-কলড সুশীল নামের কিছু লোক তাকে নির্বাচনে থাকার পরামর্শ দিচ্ছে। যারা এক-এগারোর সময় মাঠে ছিল তারাই আইভীর পক্ষে। এদিকে শামীম ওসমানের ভাই সংসদ সদস্য নাসিম ওসমান গতকাল আবারও বলেন, শামীম ওসমানই নির্বাচনে বিজয়ী হবে। তিনি কীভাবে নিশ্চিত হলেন জানতে চাইলে নাসিম বলেন, স্থানীয় সংসদ সদস্য হিসেবে তিনি অনুমান করেই বলেছেন। তিনি বলেন, ভাই হিসেবে নয়, নারায়ণগঞ্জের যোগ্য প্রার্থী হিসেবে তিনি শামীম ওসমানকে সমর্থন করেন।
শামীম ওসমানের বক্তব্যের পাল্টা বক্তব্যে আইভী বলেন, নাসিম ওসমান একজন দায়িত্বশীল সংসদ সদস্য হয়ে কীভাবে বলতে পারেন আইভী ৫ হাজার ভোটও পাবে না এবং ৭টা মধ্যে শামীম ওসমানকে বিজয়ী ঘোষণা করা হবে। তার ভাইয়ের পক্ষ হয়ে উনি যদি আগেই ফলাফল বলে দেন তাহলে কি আমরা বলতে পারি ভোটে নারায়ণগঞ্জের জনগণের কাঙ্ক্ষিত ফলাফল পাওয়া যাবে না। এব্যাপারে নির্বাচন কমিশনকে অনুরোধ করব প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে। এত হুমকি-ধমকির মধ্যেও নারায়ণগঞ্জের মানুষ বেরিয়ে পড়েছে। যে গণজোয়ারের সৃষ্টি হয়েছে তাতে কোনো সন্ত্রাসী, কোন চাঁদাবাজের দখলদারিত্ব এখানে টিকবে না ইনশাল্লা। আমি বসে যাচ্ছি বলে অপপ্রচার চালানো হচ্ছে। শামীম ওসমানের এই বক্তব্য পুরনো কৌশল। ভোট ছিনতাই করা, মানুষকে ভয় দেখানোই হচ্ছে তার কাজ। ৩০ তারিখে দোয়াত-কলমে ভোট দেয়াই হবে দীর্ঘদিনের ওসমান ফ্যামিলির কবল থেকে নারায়ণগঞ্জকে মুক্ত করার ম্যান্ডেট। নারায়ণগঞ্জের মানুুষ সন্ত্রাস ও চাঁদাবাজি থেকে মুক্তি চায়। ওসমান পরিবারের শাসন থেকে মুক্তি চায়। আমার পক্ষে গণজোয়ার সৃষ্টি হয়েছে। নারায়ণগঞ্জের লক্ষ জনতা আমার সঙ্গে আছে। গণজোয়ার দেখে শেষ পর্যন্ত শামীম ওসমান আমার পক্ষেই কাজ করবেন।
এদিকে বিএনপি সমর্থিত প্রার্থী অ্যাডভোকেট তৈমূর আলম খন্দকারেরও অভিযোগ, নারায়ণগঞ্জের প্রশাসন নিরপেক্ষ নয়। এদের দিয়ে নির্বাচন নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু করা সম্ভব নয়। তিনি ৩ থানার ওসিসহ স্থানীয় প্রশাসনে রদবদল চান। তৈমূর নির্বাচন প্রক্রিয়ার শুরু থেকেই প্রশাসনের রদবদলের দাবি জানিয়ে আসছিলেন। কিন্তু নির্বাচন কমিশন তা আমলে নেননি। তৈমূর সমর্থকরা বলছেন, লিফলেট বিলি করতে গেলে নানা অজুহাতে পুলিশ তাদের হয়রানি করছে। ফলে নেতাকর্মীদের মাঝে ভীতির সৃষ্টি হয়েছে।
এদিকে সাধারণ ভোটারদেরও বক্তব্য বর্তমান প্রশাসন একটি পরিবারের অনুগত। ফলে একটি পক্ষের সঙ্গে এই প্রশাসনের আত্মিক সম্পর্ক রয়েছে। এদের যত চাপ কিংবা আদর-সোহাগ করা হোক না কেন দীর্ঘদিনের সখ্য থেকে এরা বেরুতে পারবে না। ফলে এদের নিরপেক্ষ থাকার কোনো সুযোগ নেই। সুবিধাভোগ করার কারণে এদের পক্ষে নিরপেক্ষ থাকা কঠিন হয়ে পড়বে। স্থানীয় প্রশাসনে রদবদল অবশ্যই এখন জনতার দাবি।
প্রশাসনের পক্ষপাতমূলক আচরণের অভিযোগ আইভীর
মেয়র প্রার্থী আইভী প্রশাসনের পক্ষপাতমূলক আচরণের লিখিত অভিযোগ জেলা রিটার্নিং অফিসারের কাছে দায়ের করেছেন। গতকাল দুপুরে দায়ের করা এ অভিযোগে তিনি উল্লেখ করেন, নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে কার্যক্রম চালাতে গিয়ে প্রশাসন নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করছে না। বিভিন্ন স্থানে আমাদের প্রচার কার্যক্রমে বিধি-বহির্ভূতভাবে বাধা প্রদান করছে। ২০ অক্টোবর বিকালে ১৭ নং ওয়ার্ডের পাইকপাড়ার শাহসূজা রোডে আমাদের ১০/১২ কর্মী লিফলেট বিতরণ করতে থাকলে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মোহাম্মদ মামুন মিয়ার নেতৃত্বে এসআই জহিরুলসহ মোবাইল টিম এসে বাধা দেয়। এ সময় তারা ১০ হাজার টাকা জরিমানা ও অনাদায়ে ৪ দিনের বিনাশ্রম কারাদণ্ড প্রদানের নোটিশ জারি করে। নোটিশে নির্বাচন আচরণবিধি ২০১০-এর ৬/৪(খ) ভঙ্গ করা হয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়। আচরণবিধি ৬/৪ (খ) বিধিতে উল্লেখ রয়েছে যে, ‘যানবাহন সহকারে মিছিল কিংবা মিছিল বাহির করা যাইবে না বা কোনোরূপ শোডাউন করা যাইবে না।’ ১০/১২ জনের প্রচারপত্র বিলিতে ওই ধারা ভঙ্গের কোনো কারণ নেই। এটি সম্পূর্ণ বিধিবহির্ভূতভাবে করা হয়েছে বলে আমরা মনে করি। সেদিনই বিকালে ১নং ওয়ার্ডের মিজমিজি এলাকায় লিফলেট বিতরণকালে ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে পুলিশ এসে লিফলেট ছিনিয়ে নেয়। উল্লেখ করা হয়, লিফলেট মুদ্রণকারী প্রতিষ্ঠানের নাম ও তারিখ না থাকাতে এ লিফলেট বিলি করা যাবে না। অথচ সিটি করপোরেশন নির্বাচন বিধিমালার কোথাও এমন ধারা নেই যে লিফলেটে মুদ্রণকারী প্রতিষ্ঠানের নাম, ঠিকানা ও তারিখ উল্লেখ করতে হবে। ২০ অক্টোবর বিকালে ৭নং ওয়ার্ডের কদমতলী হাইস্কুলের সামনে থেকে কর্তব্যরত ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে আমাদের একটি ফেস্টুন খুলে নিয়ে যাওয়া হয়। ফেস্টুনটি ৩ মিটারের চেয়েও বড় উল্লেখ করে নিয়ে যাওয়া হয়। আমরা দৃঢ়তার সঙ্গে বলতে চাই কোথাও আমাদের কোনো ফেস্টুনই ৩ মিটারের চেয়ে বড় নেই। প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী শামীম ওসমানের তিন মিটাররের চেয়েও বড় আকারের ফেস্টুনগুলো বিভিন্ন জায়গায় প্রদর্শিত হলেও তা খুলে নেয়ার কোনো উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না। আমরা আগে থেকেই বর্তমান প্রশাসনের পক্ষপাতমূলক অবস্থানের কারণে তাদের রদবদল দাবি করে আসছি। অথচ নারায়ণগঞ্জের বির্তকিত জেলা প্রশাসকের সহকর্মী ও সহযোগীদের দিয়ে নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু নির্বাচন কতটা করা যাবে আমরা তাতে শঙ্কা প্রকাশ করছি। আমরা অনতিবিলম্বে এ বিষয়ে জরুরি পদক্ষেপ নেয়ার জন্য আবেদন জানাচ্ছি।
হেভিওয়েট তিন প্রার্থীর গণসংযোগ
নির্বাচন ঘনিয়ে আসায় ঘুম হারাম হয়ে গেছে মেয়র ও কাউন্সিলর প্রার্থীদের। গতকাল ছুটির দিনে জমজমাট প্রচারণা চালিয়েছেন তারা। দিনভর তারা ভোটারদের শুনিয়েছেন উন্নয়নের নানা প্রতিশ্রুতি। আলোচিত ৩ মেয়র প্রার্থী আওয়ামী লীগের শামীম ওসমান, ডা. সেলিনা হায়াত্ আইভী, বিএনপির তৈমূর আলম খন্দকার ছুটির এই দিনটিকে পুরোপুরি কাজে লাগিয়েছেন। তবে পিছিয়ে থাকেননি চরমোনাই সমর্থিত প্রার্থী আলহাজ আতিকুর রহমান নান্নু মুন্সি। এরমধ্যে আলোচিত তিন মেয়র প্রার্থীর মধ্যে ডা. সেলিনা হায়াত্ আইভী সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত ১৩ নং ওয়ার্ডের জামতলা, কলেজ রোড, গলাচিপা, মাসদাইর বাজার এলাকায় গণসংযোগ করেন। এরপর বিকাল ৩টা থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত বন্দরের ২৪ নং ওয়ার্ডের মদনগঞ্জ এলাকায় বাড়ি বাড়ি গিয়ে ভোট চান আইভী। অতীতের মতোই উন্নয়নমূলক কাজ করে যাওয়ার প্রতিশ্রুতি দেন তিনি। এ সময় আইভীর কাছে ছুটে আসে বৃদ্ধ-নারী-শিশুসহ সর্বস্তরের মানুষ। দুই এলাকার গণসংযোগে তার সঙ্গে ছিলেন জেলা আওয়ামী লীগের আহ্বায়ক সাবেক এমপি এসএম আকরাম, শহর আওয়ামী লীগের সভাপতি আনোয়ার হোসেন, সহ-সভাপতি হায়দার আলী পুতুল, জেলা যুবলীগের সভাপতি আবদুল কাদির, জেলা আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবক লীগের আহ্বায়ক নিজাম উদ্দিন, জেলা কৃষক লীগের সাধারণ সম্পাদক রোকন উদ্দিন আহেমদ, কেন্দ্রীয় ছাত্রীলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক জিএম আরাফাতসহ স্থানীয় আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীরা।
সকাল থেকে শামীম ওসমান প্রচারণা চালান সিদ্ধিরগঞ্জের ১নং ওয়ার্ডের মিজমিজি ক্যানেলপাড়, পাগলাবাড়ি, তালতলা, পাইনাদী, ধনুহাজী রোড ও হিরাঝিল এলাকায়। শামীম ওসমান ১৯৯৬ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত এমপি থাকা অবস্থায় তার উন্নয়নের চিত্র তুলে ধরে ভোট চান ভোটারদের কাছে। জমার নামাজের আগ পর্যন্ত তিনি ওইসব এলাকায় গণসংযোগ করে নারায়ণগঞ্জে ফিরে আসেন। ওই সময় তার সঙ্গে ছিলেন স্থানীয় এমপি কায়সার হাসনাত, নজরুম্নল ইসলাম বাবু এমপি, সিদ্ধিরগঞ্জ থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি মজিবুর রহমান, সাধারণ সম্পাদক হাজী ইয়াছিন মিয়া প্রমুখ। বিকালে শামীম ওসমান নতুন পালপাড়ায় বৈঠক করে মিন্নত আলী শাহ’র মাজার জিয়ারত করে ১৬ নং ওয়ার্ডের দেওভোগ বাবুরাইল, বেপারীপাড়া, দেওভোগ পাক্কা রোড, পশ্চিম দেওভোগ এলাকায় গণসংযোগ এবং উঠান বৈঠক করেন।
বিএনপি সমর্থিত মেয়র প্রার্থী তৈমূর আলম খন্দকার সকালে ১২নং ওয়ার্ডের খানপুর এলাকায় গণসংযোগ করেছেন। পরে তিনি খেলাফত মজলিসের নেতাকর্মীদের সঙ্গে বৈঠক করেন। সেখানে খেলাফত মজলিসের নেতাকর্মীরা তাকে সমর্থন জানান। দুপুরে সিদ্ধিরগঞ্জপুল, মিজমিজি, মজিববাগসহ বিভিন্ন এলাকায় গণসংযোগ করেন তিনি। এসময় তার সঙ্গে ছিলেন নারায়ণগঞ্জ-৫ (শহর-বন্দর) আসনের সাবেক এমপি আবুল কালাম, নারায়ণগঞ্জ-৪ (ফতুল্লা) আসনের সাবেক এমপি গিয়াসউদ্দিন, বিএনপি নেতা আবদুল হাই রাজু প্রমুখ।
অপরদিকে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় নেতা চরমোনাই পীর সমর্থিত মেয়র প্রার্থী আলহাজ আতিকুর রহমান নান্নু মুন্সি দিনভর বন্দরের ১৯, ২০ ও ২১ নং ওয়ার্ডে গণসংযোগ ও উঠান বৈঠক করেন। সাধারণ ভোটার ছাড়াও বিপুলসংখ্যক চরমোনাই পীরের অনুসারীরা তার সঙ্গে গণসংযোগ ও উঠান বৈঠকে অংশ নেন। নির্বাচনী প্রচারণার সময় নান্নু মুন্সির সঙ্গে ছিলেন নির্বাচন পরিচালনা কমিটির আহ্বায়ক মাওলানা সৈয়দ আহাম্মদ, সদস্য সচিব মাওলানা দ্বীন ইসলাম, মাওলানা আকতার হোসেন, মাওলানা নছরুল্লাহ প্রমুখ। অপর দুই মেয়র প্রার্থীর প্রচারণা তেমন একটা চোখে পড়েনি।
No comments