আইন পাস by একরামুল হক শামীম

চার মাস আগে পাস হওয়া একটি আইনে ভুল থাকায় আইন পাস নিয়ে নতুন সমালোচনা তৈরি হয়েছে। সাংসদরা কতটা সচেতনভাবে আইন পাস করেন সে প্রশ্নও উঠেছে সংসদে। স্বতন্ত্র সাংসদ ফজলুল আজিম এ ব্যাপারে মন্ত্রণালয়, মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ, সংসদীয় কমিটি এবং সাংসদদের সমালোচনা করেছেন।


এই সমালোচনার ক্ষেত্র তৈরি হয় গত ৮ ফেব্রুয়ারি সংসদে পাস হওয়া 'ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষ আইন ২০১২' নিয়ে। সংসদে আনা বিলটি সেদিন পাস হলেও বিল থেকে ঢাকা যানবাহন সমন্বয় বোর্ড বিলোপ এবং যানবাহন সমন্বয় বোর্ড আইন, ২০০১ রহিতকরণ ও হেফাজত সম্পর্কিত দুটি দফা বাদ পড়ে যায়। এ দুটি দফা অন্তর্ভুক্ত করতেই নতুন করে সংসদে ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষ (সংশোধন) বিল ২০১২ জাতীয় সংসদ থেকে সম্প্রতি কণ্ঠভোটে পাস করা হয়। কিন্তু এমন একটি ভুল হয় কী করে? সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের জানান, বিজি প্রেসের ভুলের কারণে ত্রুটিপূর্ণভাবে বিলটি সংসদে উত্থাপিত হয়েছিল। কিন্তু এই ব্যাখ্যায় সাধারণ মানুষ কীভাবে সন্তুষ্ট হবে, যেখানে একজন সাংসদই এর বিরুদ্ধে পাল্টা প্রশ্ন হাজির করেছেন। স্বতন্ত্র সাংসদ ফজলুল আজিম বলেছেন, ছাপার ভুলের কারণে বানান ভুল হতে পারে কিন্তু পুরো একটি প্যারা বাদ পড়ে যেতে পারে না।
সংবিধানের ৮০ অনুচ্ছেদে আইন প্রণয়ন পদ্ধতির উল্লেখ হয়েছে। সেই অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, আইন প্রণয়নের উদ্দেশ্যে সংসদে আনীত প্রত্যেকটি প্রস্তাব বিল আকারে উত্থাপিত হবে। সংসদে বিলটি গৃহীত হলে সম্মতির জন্য রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠানো হয়। সংসদ কর্তৃক গৃহীত বিলে রাষ্ট্রপতি সম্মতিদান করলে তা আইনে পরিণত হয়। সংসদে বিল আকারে উত্থাপিত হওয়ার আগে বেশকিছু ধাপ পার করতে হয়। একটি বিল সংসদে উত্থাপনের আগে মন্ত্রণালয়, মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ এবং সংসদীয় কমিটিতে যাচাই-বাছাই করা হয়। সবচেয়ে বড় কথা দেশের মানুষ সংসদ সদস্যদের নির্বাচিত করেছেন ভোটের মাধ্যমে। আইন প্রণেতা হিসেবে তাদের সংসদে পাঠিয়েছেন তারা। কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, আইন প্রণেতাদের সময় দেওয়ার অভাবে ভুল আইন পাস হচ্ছে সংসদ থেকে।
এমনিতেই অভিযোগ রয়েছে সংসদে আইন পাসের জন্য পর্যাপ্ত সময় দেওয়া হয় না। অনেক বিলের ওপর সংসদে তেমন আলোচনা হয়নি। বিলের ব্যাপারে নোটিশ দেওয়ার নিয়ম হয়েছে; কিন্তু অনেক সময় দেখা গেছে নোটিশদাতাই সংসদে উপস্থিত নেই। ফলে সেই নোটিশ নিয়ে আলোচনা হয় না। বর্তমান নবম সংসদের প্রথম ১১টি অধিবেশন থেকে ১৫৩টি বিল আইনে পরিণত হয়েছে। এর মধ্যে প্রথম অধিবেশনে ৩২টি, দ্বিতীয় অধিবেশনে ২৩টি, তৃতীয় অধিবেশনে ১১টি, চতুর্থ অধিবেশনে ২৩টি, পঞ্চম অধিবেশনে ২৪টি, ষষ্ঠ অধিবেশনে ১৩টি, সপ্তম অধিবেশনে ৪টি, অষ্টম অধিবেশনে ৬টি, নবম অধিবেশনে ৮টি, দশম অধিবেশনে ২টি এবং একাদশ অধিবেশনে ৭টি বিল পাস হয়েছে। এসব বিলের ওপর বিএনপি নেতৃত্বাধীন বিরোধীদলীয় জোটের সদস্যরা এক হাজারের বেশি নোটিশ দিয়েছেন। অন্যদিকে স্বতন্ত্র সদস্য ফজলুল আজিম একাই দুই শতাধিক নোটিশ দিয়েছেন। অথচ সরকারি দলের সাংসদরা মাত্র একশ'র মতো নোটিশ দিয়েছেন। সংসদে সরকারি দলের সদস্য সংখ্যা এত বেশি হওয়া সত্ত্বেও নোটিশদাতার সংখ্যা এত কম কেন? জানা গেছে, সংসদে বিরোধী দলের অনুপস্থিতি ও বিল সম্পর্কিত নোটিশ না থাকায় বর্তমান নবম সংসদের ৫০টিরও বেশি বিল সংসদীয় বিতর্ক ছাড়াই পাস হয়েছে। প্রতিটি বিল পাস করতে ১০ মিনিটেরও কম সময় লেগেছে। রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ আইন প্রণয়ন নিয়ে সংসদীয় বিতর্ক হলে বিলের ভুলত্রুটিগুলো ধরা পড়ত, বিলটি আইনে পরিণত হলে জনগণের জন্য তা কতটুকু উপকারের হবে, কীভাবে উপকারের হবে তা নিয়ে আলোচনা হতো। কিন্তু দুর্ভাগ্য এদেশের মানুষের। তাদের জন্য আইন পাস হচ্ছে সংসদীয় বিতর্ক ছাড়াই। অথচ আইন প্রণেতা হিসেবে প্রত্যেক সংসদ সদস্যের উচিত আইন বিষয়ে মতামত দেওয়া। কেবল সংসদীয় কমিটির সভাতেই বিল নিয়ে আলোচনা করা যথেষ্ট নয়। সম্প্রতি স্বতন্ত্র সাংসদ ফজলুল আজিম সংসদে বলেছেন, করণিকরা আইন করেন, আমরা সাংসদরা তা হ্যাঁ-না বলে পাস করে দিই। এ রকম পরিস্থিতি কাম্য নয়। আমরা তাদের আইন প্রণয়নের জন্য ভোট দিয়ে সংসদে পাঠাই, তাদের দায়িত্বশীলভাবেই কাজটি সম্পাদন
করা উচিত।
 

No comments

Powered by Blogger.