বৃত্তের ভেতর বৃত্ত-নূরজাহান থেকে হেনা : আর কত বর্বরতা? by দেবব্রত চক্রবর্তী বিষ্ণু
আবার ফতোয়া! আবার দোররা! আবার প্রাণ কেড়ে নেওয়ার প্রকাশ্য উন্মাদনা! এবার ঘটনাস্থল শরীয়তপুরের নড়িয়া উপজেলার চামটা গ্রাম। এবার দংশিত হলো হেনা নামের ১৪ বছরের কিশোরী। হেনা ৩০ জানুয়ারি ২০১১ প্রকৃতির ডাকে ঘরের বাইরে গিয়ে তারই এক আত্মীয়ের দ্বারা ধর্ষণের শিকার হয়।
মেয়েটির আর্তচিৎকারে যারা ছুটে আসে তারা তাকে শাস্তি দিতে ঝাঁপিয়ে পড়ে তারই ওপর! শেষ পর্যন্ত হেনাকে উদ্ধার করা হয় বিপন্ন-বিপর্যস্ত অবস্থায়। পশুশক্তির ছোবলে যে মেয়েটির সর্বস্ব গেল, সে একটু সেরে ওঠার সময় পর্যন্ত পেল না! পরদিন সকালে স্থানীয় ইউপি সদস্য আরেক দানব ইদ্রিস ফকিরের নেতৃত্বে বসে তথাকথিত সালিস বৈঠক। সালিসে উপস্থিত হয় আরো কিছু মানবরূপী দানব। তারপর যা হওয়ার তা-ই হলো। তথাকথিত বিচারে হেনার শরীরে পড়তে থাকল দোররার ছোবল। ৭০-৮০টির মতো দোররা সইতে পারলেও এর পর আর পারেনি। তার জন্য নির্ধারিত ১০০ দোররা নির্দেশ জারি করেছিল যে ফতোয়াবাজরা, তাদের সামনেই মাটিতে লুটিয়ে পড়ে হেনা। নিথর শরীর! নিয়ে যাওয়া হয় নড়িয়া উপজেলা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে। সেখানে মৃত্যুর সঙ্গে লড়তে লড়তে ওই দিন রাতেই হেনার জীবনাবসান ঘটে। এর পরের ঘটনা আর বর্ণনা করা বোধ করি নিষ্প্রয়োজন। হেনারা এভাবেই ঝরে যাচ্ছে সমাজের একশ্রেণীর স্বেচ্ছাচারী, চরম ঘৃণ্য ও অন্যায়কারী, অন্ধকারের কীটদের দংশনে। মনে পড়ে মৌলভীবাজারের ছাতকছড়া গ্রামের সেই নূরজাহানের কথা, যার জীবনাবসানও ঘটেছিল ফতোয়াবাজদের দোররার কারণেই। নূরজাহান জীবন দিয়েও তার উত্তরসূরি নূরজাহানদের রক্ষা করতে পারছে না! আর কত বর্বরতা, নিষ্ঠুরতা, পৈশাচিকতা, আইন ও ন্যায়বিচারের বদলে স্বেচ্ছাচারীদের আস্ফালন সইবে নিরীহ মানুষ_এ প্রশ্নের জবাব মেলে না!
গত ২ ফেব্রুয়ারি হাইকোর্ট একটি রুল জারি করেছেন। দোররা মারার ঘটনা এবং তা প্রতিরোধে আগে দেওয়া হাইকোর্টের এক রায়ের আলোকে কী পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছিল, তা জানতে চেয়েছেন আদালত। অপর আরেকটি বেঞ্চ ফতোয়াবিরোধী হাইকোর্টের রায় গণমাধ্যমে প্রচারের ব্যবস্থা গ্রহণে তথ্য মন্ত্রণালয়কে নির্দেশ দিয়েছেন। দুটি বেঞ্চই স্বপ্রণোদিত হয়ে এই আদেশ দিয়েছেন।
হেনারা দুঃসময়ের, সামাজিক দুঃশাসনের, কালো অধ্যায়ের দুঃসহ স্মারক। হেনারা পশুশক্তির দ্বারা আক্রান্ত হয়, আবার এই সমাজের তথাকথিত মোড়লরা তাদের জীবনও কাড়ে! কে দিয়েছে তাদের সে অধিকার? কি তাদের এখতিয়ার? আইন হাতে তুলে নেওয়ার এই শক্তি অন্ধকারের কীটরা পায় কোথায়? ফতোয়ার মতো আদিম বর্বরতার নৃশংস ছোবল কেন রাষ্ট্রশক্তি আজও বন্ধ করতে পারেনি? কেন ইদ্রিস ফকির, সাইফুল, মফিজউদ্দিন, ইয়াসিন, লতিফ, আক্কাস, জয়নালদের মতো দানবদের আইনের কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে তাদের বর্বরোচিত কর্মকাণ্ডের যথাবিহিত করতে পারে না? এই সমাজ, রাষ্ট্র, প্রশাসন যন্ত্রের সবকিছু কি তবে তাদেরই করতলগত? ধর্মের নামে তথাকথিত ধার্মিকরা আর কত উন্মাদনা চালাবে রাষ্ট্রশক্তির সবকিছুর প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন করে? দরিদ্র পরিবারের চিরতরে ঝরে যাওয়া হেনা আর তার বাবা দরবেশ খাঁ ও অন্য স্বজনদের বেঁচে থাকাটা ওই একই পর্যায়ের। হেনা চলে গেছে; কিন্তু তার স্বজন যাঁরা বেঁচে আছেন তাঁদের বেঁচে থাকার পথটিও তো এখন ক্রমেই হবে অধিকতর কণ্টকাকীর্ণ। আমাদের অতীত অভিজ্ঞতা সে কথাই বলে। আর কত হেনাদের জীবন গেলে তবে ওদের রক্তপিপাসা মিটবে? ধিক্ তথাকথিত মানুষ নামধারী পশুদের, দানবদের। আমরা আবার পত্রপত্রিকায় পড়ব, টেলিভিশন চ্যানেলগুলোতে শুনব, আর যেন কোনো হেনার জীবন এভাবে ঝরে না যায় রাষ্ট্রশক্তি তা নিশ্চিত করার সর্বতো প্রয়াস নেবে। কিছুদিন হৈচৈ হবে এবং একপর্যায়ে সব থেমেও যাবে! তারপর আবার মাথা চাড়া দিয়ে উঠবে ফতোয়াবাজ নামক চক্রটি, আবার হয়তো জন্ম নেবে অন্য কোনো হেনার উপাখ্যান। এভাবেই তো চলছে! সমাজদেহ থরথর করে কাঁপছে আর সমাজে বসবাসকারীরা তা সয়ে চলেছে অসহায়ত্ব প্রদর্শন করে! যারা হেনাদের জীবন ধসিয়ে দিচ্ছে তাদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রশক্তি দৃষ্টান্তযোগ্য কিছু রাখতে পারছে না বলেই গ্রাম্য মোড়ল-মেম্বারদের দাপট সব তছনছ করে দিচ্ছে। এবার হেনা আবারও বিবেকের কড়া নেড়ে দিয়ে গেল।
মৌলভীবাজার-রাজশাহী-নাটোর-ব্রাহ্মণবাড়িয়া-ঠাকুরগাঁওসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে এবং সর্বশেষ শরীয়তপুরের নড়িয়ায় যে ঘটনাটি ঘটল এর কোনোটিই কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। বিচারপতি মোহাম্মদ গোলাম রাব্বানী ও বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানার সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্টের একটি ডিভিশন বেঞ্চ ফতোয়াবাজির বিরুদ্ধে সুয়োমোটো রুল জারি করেছিলেন ২০০১ সালের ২ জানুয়ারি। এর বিপরীতে মৌলবাদী গোষ্ঠীর কিছু লোক আপিল করায় বিষয়টি অনিষ্পন্ন অবস্থায় ঝুলে আছে। সংবিধানের ২৭, ২৮, ৩১ ও ৩৫ অনুচ্ছেদে বর্ণিত নাগরিকের মৌলিক অধিকারের প্রতি ফতোয়া মারাত্মক চ্যালেঞ্জ। ফতোয়াবাজরা আইনের সব বিধান উপেক্ষা-অবজ্ঞা করে ধর্মের নামে একের পর এক মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন ঘটিয়ে চলেছে। এই অন্ধত্বের অভিশাপ সমাজকে পেছনে ঠেলে দেয়। কিন্তু যার ওপর ভর করে এমন হচ্ছে, সেই ফতোয়ার আভিধানিক অর্থ হলো, কোনো বিষয়ের ওপর মতামত। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক এ দেশে তা এনমভাবেই কার্যকর হয়ে চলেছে, যা সম্পূর্ণ আইন ও সংবিধানবিরুদ্ধ। রাষ্ট্রের বিধান অনুযায়ী আদালত ব্যতিরেকে কারো কোনো শাস্তি ঘোষণা করার এখতিয়ার নেই। ১৮০৯ সালের দেওয়ানি কার্যবিধির ৮৯ (ক) ও ৮৯ (খ) ধারায় কিছু সাধারণ বিচার সালিসের মাধ্যমে মীমাংসা করার সুযোগ আইনি ব্যবস্থায়ও রয়েছে; কিন্তু তাদেরও সীমাবদ্ধতার বিষয়টি স্পষ্ট। সেখানে কোনো শাস্তি প্রদানের এখতিয়ার দেওয়া হয়নি। সরকারের উচিত, যে আপিলটি অনিষ্পন্ন অবস্থায় রয়েছে এ জন্য দ্রুত আদালতের শরণাপন্ন হওয়া। আদালতের রায় সংবিধানের বিপক্ষে যাবে না_এমন আশা খুবই সংগত। ফতোয়াবাজি বন্ধে যেমন দরকার দ্রুত কার্যকর রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ, তেমনি দরকার সুনির্দিষ্ট আইন।
ফতোয়া-সন্ত্রাসের একটা সামাজিক-অর্থনৈতিক মাত্রাও আছে। এতে অবধারিতভাবে জড়িত থাকে গ্রামের প্রভাবশালী গোষ্ঠী। আর ভুক্তভোগীরা গরিব-নিরীহ এবং সিংহভাগই নারী। ইমাম শাফি (রহ.) ফতোয়ার সংজ্ঞায় বলেছেন, 'ফতোয়া হইল ইসলামী আইনের বিশেষজ্ঞ মতামত।' ইমাম শাফির (রহ.) শরিয়াহ কেতাব 'উদমাত আল সালিক' পৃষ্ঠা ১১৮৪তে এর বর্ণনা আছে যে কিতাবটি অনুবাদ করেছেন, নুহ হা মিম কেলার। বইটিকে মিসরের আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয় স্ট্যাম্প দিয়ে সত্যায়িত করেছে। কিন্তু অভিমত দেওয়ার অধিকার কার? জবাব দিয়েছেন ইমাম শাফি (রহ.), 'শুধু কোনো বৈধ কর্তৃপক্ষই ইহা (ফতোয়া) দিতে পারেন।' তবে এই বৈধ কর্তৃপক্ষ কে বা কারা তা নিয়ে ইসলামী বিশেষজ্ঞদের মাঝে প্রবল মতবিরোধ আছে। ইসলামী বিষয়ে পড়াশোনা করে ডিগ্রি নিলেই ফতোয়ার অধিকার থাকবে_এ তত্ত্ব অচল। কারণ, এ রকম বহু তথাকথিত বিশেষজ্ঞের ফতোয়ায় অতীতে মুসলিম বিশ্বের ভয়াবহ ক্ষতি হয়েছে। স্মরণ করা যেতে পারে, এজিদের প্রাসাদের ইমামরা ফতোয়া দিয়েছিলেন, ইমাম হোসেন (রা.) কাফের। তাঁর হত্যাকারী সীমার সেই ফতোয়া সব সময় পাগড়ির ভেতর রাখত। এমনকি বড় পীর আবদুল কাদের জিলানীকেও ইমাম হৌজ (বলা হয়ে থাকে তখন তিনি ছিলেন খুব খ্যাতিমান) এক হাজার ইমামকে সঙ্গে নিয়ে কাফের বলে ফতোয়া দিয়েছিলেন (ভূমিকা : বড় পীর সাহেবের বই 'ফতহল গায়েব')। আমরা স্মরণ করতে পারি, ইতিহাস বিজ্ঞানের অন্যতম শ্রেষ্ঠজন ইবনে খালদুনের কথাও; যিনি দেশে দেশে পালিয়ে বেড়িয়েছেন ফতোয়ার কারণে। একটি কথা স্পষ্ট করেই বলা যায়, আধুনিক রাষ্ট্রে আইন হাতে তুলে নেওয়ার ক্ষমতা কারো নেই। এর পক্ষে মত দিয়েছেন শরিয়াহ তত্ত্ববিদ শাহ আবদুল হান্নানও।
সংবিধানকে সমুন্নত রাখতে হলে ফতোয়াকে পরিহার করতেই হবে। কারণ সংবিধান নিশ্চিত করে দিয়েছে, বিচারিক কাজ করার দায়িত্ব একমাত্র আদালতের। এর পাশাপাশি একটি স্বাধীন-সার্বভৌম গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে নাগরিকের ইচ্ছা-অনিচ্ছাকে মূল্য দেওয়া প্রত্যেকের সাংবিধানিক দায়িত্ব। শিক্ষা-সভ্যতায় পিছিয়ে থাকা সমাজব্যবস্থা এবং অর্থনৈতিক-সামাজিকভাবে নারীর দুর্বল অবস্থান এমন মর্মন্তুদ ঘটনার জন্য বহুলাংশে দায়ী। বৈষম্য, অশিক্ষা, লোভ, অসচেতনতা দূর করে সুশাসন প্রতিষ্ঠিত করতে পারলে এসব ঘটনার পরিসমাপ্তি ঘটতে পারে। তবে সব কিছুতেই সর্বাগ্রে রাষ্ট্রশক্তিকে বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করতে হবে। সঙ্গে সঙ্গে সমাজের সচেতন প্রগতিশীল জনগোষ্ঠীকে দৃঢ়ভাবে দাঁড়াতে হবে এসবের বিরুদ্ধে। হেনাদের পিষে মারে যে দানব শক্তি, এই শক্তি শুধু সভ্যতা-মানবতারই কলঙ্ক নয়, এরা সুস্থ-সুন্দর-প্রগতিবাদী সমাজব্যবস্থারও চরম শত্রু। আমরা জানি না শরীয়তপুরের হেনার প্রাণ হরণকারীদের দৃষ্টান্তমূলক দণ্ড নিশ্চিত করা যাবে কি না; তবে এটুকু জানি, হেনাদের এমন বিদায় আমাদের অপরাধী করে দেয়। মনুষ্যসমাজের জন্য ক্রমাগত যে ক্ষত সৃষ্টি করে চলেছে বকধার্মিক তথাকথিত সমাজপতিরা, তাদের মূলোৎপাটনে আর কোনো উদাসীনতা যেন প্রদর্শন না করে রাষ্ট্রশক্তি_এটিই দাবি।
লেখক : সাংবাদিক
deba_bishnu@yahoo.com
গত ২ ফেব্রুয়ারি হাইকোর্ট একটি রুল জারি করেছেন। দোররা মারার ঘটনা এবং তা প্রতিরোধে আগে দেওয়া হাইকোর্টের এক রায়ের আলোকে কী পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছিল, তা জানতে চেয়েছেন আদালত। অপর আরেকটি বেঞ্চ ফতোয়াবিরোধী হাইকোর্টের রায় গণমাধ্যমে প্রচারের ব্যবস্থা গ্রহণে তথ্য মন্ত্রণালয়কে নির্দেশ দিয়েছেন। দুটি বেঞ্চই স্বপ্রণোদিত হয়ে এই আদেশ দিয়েছেন।
হেনারা দুঃসময়ের, সামাজিক দুঃশাসনের, কালো অধ্যায়ের দুঃসহ স্মারক। হেনারা পশুশক্তির দ্বারা আক্রান্ত হয়, আবার এই সমাজের তথাকথিত মোড়লরা তাদের জীবনও কাড়ে! কে দিয়েছে তাদের সে অধিকার? কি তাদের এখতিয়ার? আইন হাতে তুলে নেওয়ার এই শক্তি অন্ধকারের কীটরা পায় কোথায়? ফতোয়ার মতো আদিম বর্বরতার নৃশংস ছোবল কেন রাষ্ট্রশক্তি আজও বন্ধ করতে পারেনি? কেন ইদ্রিস ফকির, সাইফুল, মফিজউদ্দিন, ইয়াসিন, লতিফ, আক্কাস, জয়নালদের মতো দানবদের আইনের কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে তাদের বর্বরোচিত কর্মকাণ্ডের যথাবিহিত করতে পারে না? এই সমাজ, রাষ্ট্র, প্রশাসন যন্ত্রের সবকিছু কি তবে তাদেরই করতলগত? ধর্মের নামে তথাকথিত ধার্মিকরা আর কত উন্মাদনা চালাবে রাষ্ট্রশক্তির সবকিছুর প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন করে? দরিদ্র পরিবারের চিরতরে ঝরে যাওয়া হেনা আর তার বাবা দরবেশ খাঁ ও অন্য স্বজনদের বেঁচে থাকাটা ওই একই পর্যায়ের। হেনা চলে গেছে; কিন্তু তার স্বজন যাঁরা বেঁচে আছেন তাঁদের বেঁচে থাকার পথটিও তো এখন ক্রমেই হবে অধিকতর কণ্টকাকীর্ণ। আমাদের অতীত অভিজ্ঞতা সে কথাই বলে। আর কত হেনাদের জীবন গেলে তবে ওদের রক্তপিপাসা মিটবে? ধিক্ তথাকথিত মানুষ নামধারী পশুদের, দানবদের। আমরা আবার পত্রপত্রিকায় পড়ব, টেলিভিশন চ্যানেলগুলোতে শুনব, আর যেন কোনো হেনার জীবন এভাবে ঝরে না যায় রাষ্ট্রশক্তি তা নিশ্চিত করার সর্বতো প্রয়াস নেবে। কিছুদিন হৈচৈ হবে এবং একপর্যায়ে সব থেমেও যাবে! তারপর আবার মাথা চাড়া দিয়ে উঠবে ফতোয়াবাজ নামক চক্রটি, আবার হয়তো জন্ম নেবে অন্য কোনো হেনার উপাখ্যান। এভাবেই তো চলছে! সমাজদেহ থরথর করে কাঁপছে আর সমাজে বসবাসকারীরা তা সয়ে চলেছে অসহায়ত্ব প্রদর্শন করে! যারা হেনাদের জীবন ধসিয়ে দিচ্ছে তাদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রশক্তি দৃষ্টান্তযোগ্য কিছু রাখতে পারছে না বলেই গ্রাম্য মোড়ল-মেম্বারদের দাপট সব তছনছ করে দিচ্ছে। এবার হেনা আবারও বিবেকের কড়া নেড়ে দিয়ে গেল।
মৌলভীবাজার-রাজশাহী-নাটোর-ব্রাহ্মণবাড়িয়া-ঠাকুরগাঁওসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে এবং সর্বশেষ শরীয়তপুরের নড়িয়ায় যে ঘটনাটি ঘটল এর কোনোটিই কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। বিচারপতি মোহাম্মদ গোলাম রাব্বানী ও বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানার সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্টের একটি ডিভিশন বেঞ্চ ফতোয়াবাজির বিরুদ্ধে সুয়োমোটো রুল জারি করেছিলেন ২০০১ সালের ২ জানুয়ারি। এর বিপরীতে মৌলবাদী গোষ্ঠীর কিছু লোক আপিল করায় বিষয়টি অনিষ্পন্ন অবস্থায় ঝুলে আছে। সংবিধানের ২৭, ২৮, ৩১ ও ৩৫ অনুচ্ছেদে বর্ণিত নাগরিকের মৌলিক অধিকারের প্রতি ফতোয়া মারাত্মক চ্যালেঞ্জ। ফতোয়াবাজরা আইনের সব বিধান উপেক্ষা-অবজ্ঞা করে ধর্মের নামে একের পর এক মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন ঘটিয়ে চলেছে। এই অন্ধত্বের অভিশাপ সমাজকে পেছনে ঠেলে দেয়। কিন্তু যার ওপর ভর করে এমন হচ্ছে, সেই ফতোয়ার আভিধানিক অর্থ হলো, কোনো বিষয়ের ওপর মতামত। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক এ দেশে তা এনমভাবেই কার্যকর হয়ে চলেছে, যা সম্পূর্ণ আইন ও সংবিধানবিরুদ্ধ। রাষ্ট্রের বিধান অনুযায়ী আদালত ব্যতিরেকে কারো কোনো শাস্তি ঘোষণা করার এখতিয়ার নেই। ১৮০৯ সালের দেওয়ানি কার্যবিধির ৮৯ (ক) ও ৮৯ (খ) ধারায় কিছু সাধারণ বিচার সালিসের মাধ্যমে মীমাংসা করার সুযোগ আইনি ব্যবস্থায়ও রয়েছে; কিন্তু তাদেরও সীমাবদ্ধতার বিষয়টি স্পষ্ট। সেখানে কোনো শাস্তি প্রদানের এখতিয়ার দেওয়া হয়নি। সরকারের উচিত, যে আপিলটি অনিষ্পন্ন অবস্থায় রয়েছে এ জন্য দ্রুত আদালতের শরণাপন্ন হওয়া। আদালতের রায় সংবিধানের বিপক্ষে যাবে না_এমন আশা খুবই সংগত। ফতোয়াবাজি বন্ধে যেমন দরকার দ্রুত কার্যকর রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ, তেমনি দরকার সুনির্দিষ্ট আইন।
ফতোয়া-সন্ত্রাসের একটা সামাজিক-অর্থনৈতিক মাত্রাও আছে। এতে অবধারিতভাবে জড়িত থাকে গ্রামের প্রভাবশালী গোষ্ঠী। আর ভুক্তভোগীরা গরিব-নিরীহ এবং সিংহভাগই নারী। ইমাম শাফি (রহ.) ফতোয়ার সংজ্ঞায় বলেছেন, 'ফতোয়া হইল ইসলামী আইনের বিশেষজ্ঞ মতামত।' ইমাম শাফির (রহ.) শরিয়াহ কেতাব 'উদমাত আল সালিক' পৃষ্ঠা ১১৮৪তে এর বর্ণনা আছে যে কিতাবটি অনুবাদ করেছেন, নুহ হা মিম কেলার। বইটিকে মিসরের আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয় স্ট্যাম্প দিয়ে সত্যায়িত করেছে। কিন্তু অভিমত দেওয়ার অধিকার কার? জবাব দিয়েছেন ইমাম শাফি (রহ.), 'শুধু কোনো বৈধ কর্তৃপক্ষই ইহা (ফতোয়া) দিতে পারেন।' তবে এই বৈধ কর্তৃপক্ষ কে বা কারা তা নিয়ে ইসলামী বিশেষজ্ঞদের মাঝে প্রবল মতবিরোধ আছে। ইসলামী বিষয়ে পড়াশোনা করে ডিগ্রি নিলেই ফতোয়ার অধিকার থাকবে_এ তত্ত্ব অচল। কারণ, এ রকম বহু তথাকথিত বিশেষজ্ঞের ফতোয়ায় অতীতে মুসলিম বিশ্বের ভয়াবহ ক্ষতি হয়েছে। স্মরণ করা যেতে পারে, এজিদের প্রাসাদের ইমামরা ফতোয়া দিয়েছিলেন, ইমাম হোসেন (রা.) কাফের। তাঁর হত্যাকারী সীমার সেই ফতোয়া সব সময় পাগড়ির ভেতর রাখত। এমনকি বড় পীর আবদুল কাদের জিলানীকেও ইমাম হৌজ (বলা হয়ে থাকে তখন তিনি ছিলেন খুব খ্যাতিমান) এক হাজার ইমামকে সঙ্গে নিয়ে কাফের বলে ফতোয়া দিয়েছিলেন (ভূমিকা : বড় পীর সাহেবের বই 'ফতহল গায়েব')। আমরা স্মরণ করতে পারি, ইতিহাস বিজ্ঞানের অন্যতম শ্রেষ্ঠজন ইবনে খালদুনের কথাও; যিনি দেশে দেশে পালিয়ে বেড়িয়েছেন ফতোয়ার কারণে। একটি কথা স্পষ্ট করেই বলা যায়, আধুনিক রাষ্ট্রে আইন হাতে তুলে নেওয়ার ক্ষমতা কারো নেই। এর পক্ষে মত দিয়েছেন শরিয়াহ তত্ত্ববিদ শাহ আবদুল হান্নানও।
সংবিধানকে সমুন্নত রাখতে হলে ফতোয়াকে পরিহার করতেই হবে। কারণ সংবিধান নিশ্চিত করে দিয়েছে, বিচারিক কাজ করার দায়িত্ব একমাত্র আদালতের। এর পাশাপাশি একটি স্বাধীন-সার্বভৌম গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে নাগরিকের ইচ্ছা-অনিচ্ছাকে মূল্য দেওয়া প্রত্যেকের সাংবিধানিক দায়িত্ব। শিক্ষা-সভ্যতায় পিছিয়ে থাকা সমাজব্যবস্থা এবং অর্থনৈতিক-সামাজিকভাবে নারীর দুর্বল অবস্থান এমন মর্মন্তুদ ঘটনার জন্য বহুলাংশে দায়ী। বৈষম্য, অশিক্ষা, লোভ, অসচেতনতা দূর করে সুশাসন প্রতিষ্ঠিত করতে পারলে এসব ঘটনার পরিসমাপ্তি ঘটতে পারে। তবে সব কিছুতেই সর্বাগ্রে রাষ্ট্রশক্তিকে বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করতে হবে। সঙ্গে সঙ্গে সমাজের সচেতন প্রগতিশীল জনগোষ্ঠীকে দৃঢ়ভাবে দাঁড়াতে হবে এসবের বিরুদ্ধে। হেনাদের পিষে মারে যে দানব শক্তি, এই শক্তি শুধু সভ্যতা-মানবতারই কলঙ্ক নয়, এরা সুস্থ-সুন্দর-প্রগতিবাদী সমাজব্যবস্থারও চরম শত্রু। আমরা জানি না শরীয়তপুরের হেনার প্রাণ হরণকারীদের দৃষ্টান্তমূলক দণ্ড নিশ্চিত করা যাবে কি না; তবে এটুকু জানি, হেনাদের এমন বিদায় আমাদের অপরাধী করে দেয়। মনুষ্যসমাজের জন্য ক্রমাগত যে ক্ষত সৃষ্টি করে চলেছে বকধার্মিক তথাকথিত সমাজপতিরা, তাদের মূলোৎপাটনে আর কোনো উদাসীনতা যেন প্রদর্শন না করে রাষ্ট্রশক্তি_এটিই দাবি।
লেখক : সাংবাদিক
deba_bishnu@yahoo.com
No comments