সামাজিক যোগাযোগ-তারুণ্যের নতুন জানালা by আলতাফ শাহনেওয়াজ

‘আমার এক বন্ধু আছে, সে কেবলই উদ্দীপনা খোঁজে এবং সে যুবসমাজের প্রতিনিধি’—নিজের ফেসবুকে তানিয়া (ছদ্মনাম) কৌতুকপূর্ণ এই স্ট্যাটাস লেখামাত্রই তাঁর এক বন্ধু কমেন্ট লিখলেন, ‘তাঁকে নিজের দিকে ভালো করে তাকাতে বলো, যুবসমাজের প্রতিনিধি হলে এর মধ্যেই তার উদ্দীপনা পেয়ে যাওয়ার কথা।’


আবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থীর ফেসবুকে দেখা গেল, নিজের একটি ছবি আপলোড করেছেন তিনি। পাশে লেখা, ‘বাসার ছাদে এই নিমগাছটা আমার খুব পছন্দের। ডালগুলোর কয়েকটা ছাদেই থাকে এভাবে। কাছে গিয়ে দাঁড়ালেই কেমন যেন মিশে যাই।’ ছবির নিচে বন্ধুদের অনেক কমেন্ট রয়েছে। তার মধ্যে একজনের কমেন্টটি এমন, ‘নিমগাছের ভেতরেই থাক। অসুখ হবে না।’ এগুলো সামাজিক যোগাযোগের ওয়েবসাইট ফেসবুকের দৈনন্দিন গল্পের খণ্ডচিত্র মাত্র। এভাবে প্রতিদিন অসংখ্য তরুণের হাতে ফেসবুক, গুগল প্লাস, টুইটার, লিঙ্কড-ইন—সামাজিক যোগাযোগের সাইটগুলোতে জন্ম নিচ্ছে এমন আরও অজস্র গল্প। আর সেই গল্পে গল্পে খুলে গেছে বন্ধুত্ব ও দিনযাপনের নতুন জানালা।
ছোট হয়ে আসা দুনিয়ায় ফেসবুক, টুইটার ও লিঙ্কড-ইন এখন তারুণ্যের জীবনযাপনের অনিবার্য অংশ। এগুলো ব্যবহার করে প্রতিদিন তাঁরা নিজেকে ছড়িয়ে দিচ্ছেন দূরে, একই সঙ্গে দূরকেও টেনে আনছেন কাছের বন্ধনে।
সামাজিক যোগাযোগ—তথ্যপ্রযুক্তির এই নতুন মাধ্যমে প্রতিদিন কী কী কাজ করেন তরুণেরা?
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষার্থীকে প্রশ্নটি করতেই তাঁদের কাছ থেকে ফিরে এল পাল্টা প্রশ্ন। মনোবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী কৌশিক সাহা বললেন, ‘কী না করি—টুইটারে তারকাদের সঙ্গে নিমেষেই যোগাযোগ করতে পারছি, নিজের মতামত জানাতে পারছি। অমিতাভ বচ্চন, শাহরুখ খান—এঁদের অনুভূতির সঙ্গে একাত্ম হতে পারছি মুহূর্তেই। মন চাইলে ইউটিউবে দিতে পারছি নিজেদের নতুন নতুন ভিডিও। আবার অন্যের ভিডিও দেখার মধ্য দিয়ে তাঁদের সঙ্গে একরকম যোগাযোগও ঘটছে। ফেসবুকের ব্যবহার তো মোটামুটি সবার জানা। এ বিষয়ে আর কী বলব...।’
ফেসবুক নিয়ে কৌশিক কিছু না বললেও তাঁর পাশে বসে থাকা নাট্যকলা বিভাগের শিক্ষার্থী কৃপার কথায় জানা গেল কার্যকারণ—‘ফেসবুকের মাধ্যমে মুহূর্তেই আমার অনুভূতি অন্যের সঙ্গে শেয়ার করতে পারছি আমি। ফেসবুকে বন্ধুরা আমার কথা শুনছে, আমার অনুভবকে বোঝার চেষ্টা করছে—আমার ভালো লাগা, মন্দ লাগা তাঁদের জানাতে পারছি। সবচেয়ে বড় কথা, ফেসবুকে সব সময় আমি বন্ধুত্বের উত্তাপ পাচ্ছি, খোলা পৃথিবীর হাওয়া পাচ্ছি। তা ছাড়া ফেসবুকের মাধ্যমে ব্যবসা ও চাকরির সুযোগও পাচ্ছেন অনেকে।’
একই বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী রোখসানা নাসরিনের গল্পটি একটু ভিন্ন। শখের আলোকচিত্রী তিনি। যখন যা ভালো লাগত ধরে রাখতেন ক্যামেরার স্থিরচিত্রে। তাঁর ছবি প্রকাশিত হবে, এমন ভাবনা মাথায় ছিল না কখনো। এক বন্ধুর পরামর্শে কয়েকটি ছবি ফেসবুকে দিলেন। এরপরই ঘটল ঘটনা—অসংখ্য লাইক, কমেন্ট। সে সময় বেশ মজাই পেয়েছিলেন রোখসানা। তিনি বলেন, ‘ওই ঘটনা আমাকে দারুণভাবে অনুপ্রাণিত করল। তারপর থেকে নিয়মিতই ফেসবুকে নিজের তোলা ছবি দিই। বন্ধুরা আমার ছবি দেখে, কমেন্ট করে। ফেসবুকের মাধ্যমে নতুন বন্ধু এবং নতুন ফটোগ্রাফারদের সঙ্গে পরিচয় ঘটেছে আমার।’
আবার জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগের শিক্ষার্থী সুশান্ত হালদার জানালেন, ‘অনেকটা খেয়ালের বশেই একবার নিজের কবিতা দিয়েছিলাম ফেসবুকে। তারপর অপরিচিত একজন সেখানে লিখলেন, “দারুণ লাগল... জোশ্।” এরপর থেকে ফেসবুকে নিজের লেখা রাখি। এই সূত্রেই পরবর্তীকালে কয়েকটি ম্যাগাজিনে লেখা ছাপা হয়েছে আমার। এর মাধ্যমে কবি নির্মলেন্দু গুণের সঙ্গেও আমার যোগাযোগ হয়েছে। চাইলেই আমি এখন মঈনুল আহসান সাবের, আনিসুল হক—এসব লেখকের প্রোফাইলে গিয়ে তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারছি।’
কেবল নিজের অনুভূতি, ছবি, লেখা—সৃজনশীলতা প্রকাশের এই ক্ষেত্রগুলোর জন্য নয়, ফেসবুকে বন্ধুর সঙ্গে সরাসরি কথা বলতে পারার কারণে এ মাধ্যমটির জনপ্রিয়তা দিনকে দিন বাড়ছে তরুণদের কাছে। তবে ফেসবুকের আরেকটি সুবিধার কথা বেরিয়ে এল স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থী মেহেদি হাসানের কাছ থেকে, ‘সাহিত্য, বিজ্ঞান, সংগীত, নাটকসহ বিভিন্ন বিষয়ভিত্তিক একাধিক পেজ ও গ্রুপ রয়েছে ফেসবুকে। এগুলোর সঙ্গে যুক্ত হয়ে আমরা প্রতিনিয়ত নিজেদের সমৃদ্ধ করতে পারছি, সাম্প্রতিক থাকতে পারছি। তা ছাড়া ফেসবুক তো এখন মুঠোফোনেই ব্যবহার করা যায়। ফলে পুরো পৃথিবীই এখন আমার হাতের মুঠোয়।’ মেহেদি যখন কথা বলছিলেন, তখন তিনি বন্ধুর সঙ্গে চ্যাটিংয়ে ব্যস্ত। এক ফাঁকে আরেক বন্ধুর স্ট্যাটাসে কমেন্টও করলেন।
অন্যদিকে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের মাসুদ পারভেজ শোনালেন, ‘ফেসবুকে হারানো বন্ধুকে খুঁজে পেয়েছি।’ এভাবে শুরু করে তিনি বললেন তাঁর স্কুলজীবনের হারিয়ে যাওয়া সহপাঠীর সঙ্গে ফেসবুকের মাধ্যমে আবার নতুন করে যোগাযোগের কাহিনি।
প্রতিদিন এমন অগুনতি গল্পে ভরপুর হয়ে সামাজিক যোগাযোগের এসব মাধ্যম তারুণ্যের স্বপ্ন ও বাস্তবতায়, তাঁদের চারপাশে তৈরি হয়েছে অন্যরকম এক জগৎ। এই জগতে একা হয়েও সবাই অনেককে সঙ্গে নিয়ে বাঁচেন। ইনডিপেন্ডেন্ট ইউনিভার্সিটি, বাংলাদেশের শিক্ষার্থী ফয়সাল রহমানও যেন বা সে কথাটিই বললেন, ‘প্রযুক্তিনির্ভর এই ভার্চুয়াল জগতে আমরা নতুন একটি ভাষা পেয়েছি, নতুন অনেক মানুষ পেয়েছি। নিজস্ব অনুভূতি ও অস্তিত্ব জানান দেওয়ার ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে। তাই ফেসবুক, টুইটার, গুগল প্লাস, লিঙ্কড-ইন—সামাজিক নেটওয়ার্কের এ জগৎটি এখন আমাদের কাছে রক্ত-মাংসের মতোই জীবন্ত।’
তার পরও কথা থাকে। ফেসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলোর অপব্যবহারও কম হচ্ছে না। তাই নির্মল বন্ধুত্ব বা কেজো যোগাযোগ—যে কারণই হোক; এসব সাইটের ব্যবহার ভালোভাবে জেনে রাখা দরকার, যাতে অনাকাঙ্ক্ষিত কোনো কিছু না ঘটে।

No comments

Powered by Blogger.