আন্তর্জাতিক-ক্ষমতার চূড়া থেকে কারাকক্ষের অভ্যন্তরে by এম আবদুল হাফিজ

দুঃশাসন, অন্তর্দ্বন্দ্ব বা মতবিরোধের কারণে ক্ষমতার চূড়া থেকে কলঙ্ককর পতন কোনো বিরল ঘটনা নয়। অতীতে আমরা মার্কোস, ডুভেলিয়র বা ইদি আমিনের বেলায় তা ঘটতে দেখেছি। তবে তাদের জন্য পদমর্যাদার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ ব্যবস্থাও গ্রহণ করা হয়েছে অধিকাংশ ক্ষেত্রে তাদেরই ক্ষমতাসীন থাকাকালীন পৃষ্ঠপোষকদের বদান্যতায়।


মার্কোস তার দীর্ঘ শাসনকালে যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থক ছিলেন। মার্কিনিরাই তাকে ফিলিপাইনের সঙ্গে আপস-নিষ্পত্তির মাধ্যমে হাওয়াই অঙ্গরাজ্যে ঠাঁই দিয়েছে। তার দেশে কিছু মসজিদ নির্মাণ করে ইদি আমিন সৌদি আরবের কৃপাদৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন। নির্বাসনের পর তাকেও আশ্রয় দিয়েছিল সৌদিরাই। হাইতির স্বৈরশাসক ডুভেলিয়রও সাবেক ফরাসি কলোনিতে ফরাসি স্বার্থরক্ষার মাশুল হিসেবে ফ্রান্সে আশ্রয় পেয়েছিলেন।
এমন অসংখ্য নজির আছে, যেখানে কোনো আফ্রিকীয় দেশই বিতাড়িত কোনো আফ্রিকীয় দেশের নেতাকে শর্তসাপেক্ষে আশ্রয় দিয়েছে। ব্যতিক্রম শুধু আইভরি কোস্টের কারাগারে আবদ্ধ সাবেক প্রেসিডেন্ট বাগবো। চার মাসব্যাপী দলাদলিজনিত সহিংসতার পর প্রেসিডেন্ট লরেন্ট বাগবো অবশেষে আত্মসমর্পণ করেছেন। রাজধানী আবিদজানের প্রেসিডেন্ট প্রাসাদের এক বাঙ্কার থেকে ফরাসি অস্ত্র ও নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ওয়াত্তারার সমর্থক সৈন্যদের যৌথ প্রচেষ্টায় বাগবোকে শুধু তার বাঙ্কার থেকে উদ্ধারই নয়, নির্বাচনী ফলাফল, যাতে তিনি হেরেছেন, তা অমান্যকারী বাগবোকে গ্রেফতার করাও সম্ভব হয়েছে।
এটি স্পষ্টতই সাবেক এই ফরাসি কলোনিতে গণতন্ত্রের বিজয়। বাগবো তার অনির্বাচিত পূর্বসূরির কাছ থেকে ২০০০ সালে পশ্চিম আফ্রিকার এই কোকোসমৃদ্ধ দেশটিকে জোরপূর্বক দখল করেন এবং গত বছর পর্যন্ত তার বৈধতা যাচাইয়ে নির্বাচন এড়িয়ে যান। অবশেষে যখন একটি নির্বাচন গত বছরে অনুষ্ঠিত হয় এবং যাতে তিনি তার প্রতিদ্বন্দ্বী ওয়াত্তারার কাছে সর্বজনস্বীকৃতভাবে হেরে যান, তিনি নির্বাচনী ফলাফল মেনে নিতে অস্বীকৃতি জানান; যদিও ওয়াত্তারার পক্ষে ভোট ছিল শতকরা ৫৪ ভাগ। ওয়াত্তারা কোনো ল্যান্ড স্লাইডের অধিকারী না হলেও বিজয়ী তো বটেই।
পশ্চিম আফ্রিকার দেশগুলোর ইকোনমিক কমিউনিটি, আইভরি কোস্ট যার সদস্য এবং জাতিসংঘ নির্বাচনী ফলাফল মেনে নিতে চাপ প্রয়োগ করতে থাকল। আমেরিকা এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন আরোপ করল বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞা। কিন্তু বাগবো ক্ষমতা আঁকড়েই থাকলেন; এবং গত মাস থেকে বাগবো তার নির্বাচনী সদর দফতর, যা তিনি আবিদজানের হোটেল দ্য গলফে স্থাপন করেছিলেন, সেটাকেই তিনি শক্ত ঘাঁটিতে রূপান্তরিত করলেন। প্রহরায় থাকল তার বিশ্বস্ত অনুগত সমর্থকরা।
এদিকে ওয়াত্তারাও ভাবলেন যে, এটাই সময় তার বিশ্বস্ত সমর্থকদের মুখাপেক্ষী হওয়া। ওয়াত্তারার এ সিদ্ধান্ত বা কৌশল ইতিবাচক ফল দিল। রিপাবলিক ফোর্স নামধারী ওয়াত্তারার দেশের উত্তর থেকে তার কট্টর সমর্থকদের আবিদজানে এসে একত্র হতে কোনো বাধারই সম্মুখীন না হওয়ায় এই ফোর্স বাগবোকে অবরুদ্ধ অবস্থায় রাখল এই আশাবাদ নিয়ে যে, বাগবো সমর্থকরা অচিরেই আত্মসমর্পণ করবে।
কিন্তু সে আশাবাদকে বিচূর্ণ করে বাগবো তার দুর্গ ধরে রাখলেন। ইত্যবসরে তার প্রায় সব অনুগত সৈন্য পালিয়ে গেলে এবং ৫ এপ্রিলে তার জেনারেলরাও ইস্তফা দিলে, আর মাত্র ছয়দিন যুদ্ধ ও রক্তপাত অব্যাহত থাকে। অতঃপর শুধু একটি গেঞ্জি পরিহিত অবস্থায় ছোট এক ডিঙিতে রাজধানী শহর বেষ্টনকারী লেগুন অতিক্রমকালে বাগবো গ্রেফতার হন। বাগবোর অবদমনে শুধু তার প্রতিদ্বন্দ্বী ওয়াত্তারাই নন, জাতিসংঘ নিয়োজিত ৯ হাজার শান্তিরক্ষী সৈনিক, ফরাসিরা স্বয়ং এবং ওয়াত্তারার রিপাবলিকান ফোর্স গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় ছিল।
ওয়াত্তারা একসময় আইভরি কোস্টের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। সে সময়ে ফরাসি প্রেসিডেন্ট সারকোজির সঙ্গে তার প্রগাঢ় বল্পুব্দত্ব হয়। বাগবোর লোকেরা রটনা করেছে যে, ফ্রান্সই বাগবোকে হটাতে তার সাবেক কলোনির নিয়ন্ত্রণ নিতে এবং সেখানে তাদের অনুগত শাসক নিয়োগে আইভরি কোস্টে এক প্রকার ক্যু ঘটিয়েছে। তবে যেভাবে সেখানে ক্ষমতার হস্তান্তর হলো এবং দুই প্রতিদ্বন্দ্বীর মধ্যে সহিংসতা ঘটল, তা কোনো সুলক্ষণ নয়। তা ছাড়া উভয়ের মধ্যে নৃশংসতার ঘটনাও ঘটেছে। বিশেষ করে ওয়াত্তারার লোকেরা দেশের পশ্চিমাংশে অনেক নিষ্ঠুরতা করেছে। যদিও নতুন প্রেসিডেন্ট একটি তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন এবং দক্ষিণ আফ্রিকার অনুসরণে একটি শান্তি ও সমঝোতা কমিশনও গঠন করেছেন। একই সঙ্গে প্রেসিডেন্ট ওয়াত্তারা চাইছেন যে, অবৈধভাবে ক্ষমতা ধারণ করে থাকার জন্য অতিসত্বর আইভরির আদালতে বাগবোর বিচার হোক। কিন্তু 'বিজয়ীর' বিচার প্রশ্নবিদ্ধ থাকে বলে আন্তর্জাতিক ফৌজদারি আদালত আভাস দিয়েছেন যে, বাগবোর বিরুদ্ধে কোনো যুদ্ধাপরাধ থাকলে তার বিচার তাদেরই এখতিয়ারভুক্ত। তবে সর্বোপরি একটি অনাকাঙ্ক্ষিত সংঘাতে কাঙ্ক্ষিত সমাধান এলেই তার জন্য অনেক মূল্য দিতে হয়েছে। কারারুদ্ধ ভাগ্যে এখনও কী অপেক্ষা করছে, সেটাই এখন দেখার বিষয়।

ব্রিগেডিয়ার (অব.) এম আবদুল হাফিজ :সাবেক মহাপরিচালক বিআইআইএসএস ও কলাম লেখক
 

No comments

Powered by Blogger.