এরশাদের বিরুদ্ধে একাধিক দুর্নীতির মামলা সচল হচ্ছে-জাতীয় পার্টির মতে এই উদ্যোগ রাজনৈতিক অপকৌশল by এম বদি-উজ-জামান ও মোশতাক আহমদ

ক্ষমতাসীন মহাজোট সরকারের প্রধান শরিক জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান সাবেক রাষ্ট্রপতি এইচ এম এরশাদের বিরুদ্ধে আগে দায়ের হওয়া একাধিক দুর্নীতির মামলা সচল করার উদ্যোগ নিয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। হাইকোর্টের স্থগিতাদেশের সুবাদে মামলাগুলো বছরের পর বছর ধরে ঝুলে আছে।


ইতিমধ্যেই রাষ্ট্রপতি হিসেবে পাওয়া উপহার সামগ্রী আত্মসাৎসংক্রান্ত দুর্নীতি মামলায় দুদক পক্ষভুক্ত হওয়ার জন্য উচ্চ আদালতে আবেদন করেছে। হাইকোর্ট গতকাল মঙ্গলবার এক আদেশে দুদকের আবেদন মঞ্জুর করেছেন। এ ছাড়া শাহবাগে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) পাশেই রাজউকের জমি বরাদ্দ দেওয়ার ক্ষেত্রে দুর্নীতির অভিযোগের মামলায়ও দুদক পক্ষভুক্ত হওয়ার আবেদন করেছে।
এ বিষয়ে দুদক চেয়ারম্যান গোলাম রহমান কালের কণ্ঠকে বলেন, কোনো ব্যক্তি বিশেষকে উদ্দেশ্য করে নয়, দীর্ঘদিন যেসব মামলা পড়ে আছে তা নিষ্পত্তির জন্য দুদক সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তিনি বলেন, ব্যুরো আমলে করা অনেক দুর্নীতি মামলা এখনো ঝুলে আছে। তিনি বলেন, দুর্নীতি দমন ব্যুরো বিলুপ্ত হয়ে যাওয়ায় ব্যুরো আমলের কয়েক হাজার মামলা দুদকের কাঁধে পড়েছে। বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে করা এসব মামলা নিষ্পত্তির জন্যই (দুদক) এ কাজ করছে।
দুদকের আইনজীবী অ্যাডভোকেট খুরশীদ আলম খান বলেন, নিম্ন আদালতের দেওয়া রায়ের বিরুদ্ধে এরশাদ আপিল করলেও তাতে দুদককে বিবাদী করেননি। আপিলে পক্ষভুক্ত হওয়ার জন্যই আমরা এই আবেদন করেছি।' হাইকোর্ট আবেদন মঞ্জুর করায় এরশাদের করা আপিল দ্রুত শুনানির জন্য হাইকোর্টে আবেদন জানানো হবে বলে জানান দুদকের আইনজীবী।
দুদকের এ উদ্যোগকে সরকারের রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত হিসেবে দেখছেন এরশাদের নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য সাবেক মন্ত্রী কাজী ফিরোজ রশিদ। তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, এই মহাজোট সরকারের আমলে মামলা থেকে এরশাদের মুক্তি পাওয়ার কথা। সরকার ইতিমধ্যেই রাজনৈতিক বিবেচনায় কয়েক হাজার মামলা প্রত্যাহার করেও নিয়েছে। সেখানে নতুন করে এরশাদের মামলায় দুদকের পক্ষভুক্ত হওয়া রাজনৈতিক চাপ ছাড়া কিছু নয়। তিনি বলেন, মামলার ভয় দেখিয়ে এরশাদকে চাপে রাখার চেষ্টা করেছিল। এ চেষ্টা রাজনৈতিক অপকৌশল।
আরেক প্রেসিডিয়াম সদস্য অধ্যাপক দেলোয়ার হোসেন বলেন, এরশাদের মামলা নিয়ে বাড়াবাড়ি হলে মহাজোটের সঙ্গে জাতীয় পার্টির তিক্ততা বাড়বে।
এরশাদের আইনজীবী শেখ সিরাজুল ইসলাম কালের কণ্ঠকে বলেন, এরশাদের বিরুদ্ধে সব মিলে ৪৩টি মামলা হয়। এর প্রায় সব মামলাই নিষ্পত্তি হয়ে গেছে। কয়েকটি মামলা এখন বিচারাধীন। তিনি বলেন, 'যে মামলা দুদক সচল করার উদ্যোগ নিয়েছে, অর্থাৎ দুদক পক্ষভুক্ত হওয়ার আবেদন করেছে, সে বিষয়ে আমাদের কোনো নোটিশ দেওয়া হয়নি।' তিনি বলেন, এ মামলায় এরশাদ তিন বছরের সাজা খেটে ফেলেছেন। তাই এ মামলা সচল করার কারণ বোধগোম্য নয়। তিনি আরো বলেন, 'দুদক আবেদন করায় আমরাও আইনগত পদক্ষেপ নেব।'
১৯৯০ সালে গণ-আন্দোলনের মুখে এরশাদের পতন হলে তাঁর নামে মোট ২৭টি মামলা দায়ের করা হয়। পরবর্তী সময়ে তাঁর সাবেক স্ত্রী বিদিশা কয়েকটি মামলা করেন। তাঁর বিরুদ্ধে অবৈধভাবে ক্ষমতা দখলের অভিযোগে জাসদ নেতা হাসানুল হক ইনুও একটি মামলা করেন। সব মিলে এরশাদের বিরুদ্ধে ৪৩টি মামলা হয়। ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বরের জাতীয় সংসদ নির্বাচন উপলক্ষে এরশাদ রংপুর-৩ আসনের প্রার্থী হিসেবে তাঁর নির্বাচনী হলফনামায় ৪০টি মামলার কথা উল্লেখ করেন।
এসব মামলার মধ্যে ১৯৯২ সালের মধ্যে জনতা টাওয়ার দুর্নীতি মামলা, রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে পাওয়া উপহার সামগ্রী আত্মসাতসংক্রান্ত দুর্নীতির মামলাসহ তিনটি মামলায় এরশাদের সাজা হয়। এ ছাড়া রাজউকে প্লট বরাদ্দসংক্রান্ত দুর্নীতি মামলা, স্বর্ণ চোরাচালানসংক্রান্ত মামলা, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে ক্ষমতার অব্যবহার করে একজনকে চাকরি দেওয়াসংক্রান্ত মামলাসহ বেশ কয়েকটি মামলায় নিম্ন আদালত থেকে এরশাদ খালাস পেয়েছেন। এখনো তাঁর বিরুদ্ধে মেজর জেনারেল (অব.) মঞ্জুর হত্যা মামলাসহ বেশ কয়েকটি মামলা বিচারাধীন। এ ছাড়া বিটুমিন ক্রয় দুর্নীতি মামলা ও বিদেশে অর্থ পাচারসংক্রান্ত মামলা তদন্ত পর্যায়েই নিষ্পত্তি হয়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, মহাজোট ক্ষমতায় আসার পর ২০০৯ সালের ১৭ মে প্রথম দফায় মামলা প্রত্যাহারের জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আবেদন করেন এরশাদ। ওই আবেদনে এরশাদ রাডার ক্রয়, মঞ্জুর হত্যা মামলা, বিটিভির ক্যাবল ক্রয় দুর্নীতি মামলাসহ পাঁচটি মামলা প্রত্যাহারের আবেদন করেন। আবেদনের পরও অগ্রগতি না হলে গত বছরের ২০ এপ্রিল দ্বিতীয় দফায় স্বরাষ্ট্র সচিব বরাবর মামলা প্রত্যাহারের আবেদন করেন এরশাদ। এর পর সরকারের পক্ষ থেকে এরশাদ ছাড়াও আওয়ামী লীগের একাধিক নেতার বিরুদ্ধে করা শতাধিক মামলার একটি তালিকা দুদকে পাঠানো হয়। দুদক কোনো মামলা প্রত্যাহার না করার পক্ষে মত দেয়। এদিকে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের কয়েকজন নেতার মামলা উচ্চ আদালতে নিষ্পত্তি হয় এবং সংশ্লিষ্টরা মামলায় খালাস পান।
উপহার সামগ্রী আত্মসাত মামলা
এইচ এম এরশাদ ১৯৮৩ সালের ১১ ডিসেম্বর থেকে ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর ক্ষমতায় থাকাকালে রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে বিভিন্ন উপহার সামগ্রী পান। এসব সামগ্রী রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা না দেওয়ার অভিযোগে ১৯৯১ সালের ৮ জানুয়ারি তৎকালীন দুর্নীতি দমন ব্যুরোর উপপরিচালক সালেহউদ্দিন আহমেদ ক্যান্টনমেন্ট থানায় এরশাদের বিরুদ্ধে অসদাচরণ ও জ্ঞাত আয় বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগ এনে দুর্নীতির মামলা দায়ের করেন। মামলায় তাঁর বিরুদ্ধে এক কোটি ৯০ লাখ ৮১ হাজার ৫৬৫ টাকা আর্থিক অনিয়মেরও অভিযোগ আনা হয়। এ মামলায় ১৯৯২ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিভাগীয় বিশেষ জজ আদালত এরশাদকে তিন বছরের সশ্রম কারাদণ্ডাদেশ দেন এবং এক কোটি ৯০ লাখ ৮১ হাজার ৫৬৫ টাকা জরিমানা ও একটি টয়োটা ল্যান্ডক্রুজার গাড়ি বাজেয়াপ্ত করার নির্দেশ দেন। ওই রায়ের বিরুদ্ধে ১৯৯২ সালে হাইকোর্টে আপিল করেন এরশাদ। হাইকোর্ট জরিমানার আদেশ স্থগিত করে বিচারিক আদালতের নথি তলব করেন। কিন্তু গত ২০ বছরেও এই আপিলের ওপর শুনানি অনুষ্ঠিত হয়নি। এদিকে এরশাদের দায়ের করা আপিলে দুর্নীতি দমন ব্যুরোকে পক্ষভুক্ত না করে সরকারকে পক্ষভুক্ত করা হয়। গত ১১ জুন আপিলে পক্ষভুক্ত হতে দুদক তাদের আইনজীবীকে একটি চিঠি দেয়। এ চিঠি অনুযায়ী দুদকের আইনজীবী খুরশীদ আলম খান গত ১৩ জুন হাইকোর্টে পক্ষভুক্তির আবেদন করেন। শুনানি শেষে হাইকোর্টের সংশ্লিষ্ট বেঞ্চ দুদকের পক্ষভুক্তির আবেদন মঞ্জুর করে আদেশ দেন।
এ ছাড়া রাজধানীর শাহবাগে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের (সাবেক পিজি হাসপাতাল) পাশে একটি পাঁচতারা হোটেল করার জন্য ব্যবসায়ী আবুল খায়ের লিটুর মালিকানাধীন ইন্টারন্যাশনাল হোটেল হোল্ডিংস লিমিটেডকে ১১ বিঘার বেশি জমি বরাদ্দ দেয় ঢাকা উন্নয়ন ট্রাস্ট (বর্তমানে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ-রাজউক)। ১৯৮৭ সালে প্রতি বিঘা জমির মূল্য ধরা হয় ৫০ লাখ টাকা। এ জমি বরাদ্দ দেওয়ার সময় পরস্পর যোগসাজশে রাষ্ট্রের ১৩ কোটি ৪০ লাখ টাকা আত্মসাত করার অভিযোগ এনে তখনকার দুর্নীতি দমন ব্যুরো (বর্তমানে বিলুপ্ত) ১৯৯১ সালের ৯ মে তখনকার রাষ্ট্রপতি এরশাদ, মওদুদ আহমদ, সাবেক মন্ত্রী শফিকুল গানি স্বপন, ঢাকা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের সাবেক চেয়ারম্যান আবুল বাশার ও ব্যবসায়ী আবুল খায়ের লিটুর বিরুদ্ধে মামলা করে। এ মামলায় আবুল বাশার ছাড়া অন্য চারজনের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করা হয়। পরে হাইকোর্ট ১৯৯৫ সালে মামলাটির কার্যক্রম স্থগিত করে দেন। মামলাটি এখনো স্থগিত রয়েছে। 'হোটেল হলিডে ইন' দুর্নীতি মামলা বলে পরিচিত এ মামলায়ও দুদক পক্ষভুক্ত হওয়ার আবেদন করেছে বলে জানা গেছে।

No comments

Powered by Blogger.