রঙ্গব্যঙ্গ-আড়িয়াল বিলের গল্প by মোস্তফা কামাল
শুক্কুর মিয়া, ও শুক্কুর মিয়া!ফরিদ আলীর কণ্ঠস্বর শুনে শুক্কুর মিয়া তার কাছে এগিয়ে গিয়ে বলল, কী ব্যাপার ভাইজান? কিছু বলবেন? খবর শুনছ? কী খবর? আমাগো আড়িয়াল বিল ভরাট হইব। এখানে নাকি বিমানবন্দর হইব! কী বলেন ভাইজান! আরে হ! আমাদের নাকি উচ্ছেদ করব।
কেন, উচ্ছেদ করব কেন?
আমরা খাস জমি দখল করে আছি না!
কত মানুষই তো খাস জমি দখল কইরা আছে! এত মানুষ যাইব কই?
কেমনে বলব! অন্য কোথাও গিয়া নতুন কইরা ঘর বাঁধব।
সেখানে কি জলা থাকব?
কে জানে!
ভাইজান, প্রতিদিন এই জলাতে মাছ ধরি। পানি কমলে কিছু ধান-পানও চাষ করতে পারি। তা দিয়া সংসারটা কোনোমতে চইলা যায়। এখানে বিমানবন্দর হইলে আমরা যামু কই, খামু কী? ভাইজান, আপনে না দল করেন?
করি তো!
আপনি একটা ব্যবস্থা করেন। আপনার দলের লোকজন নিয়া আমাগো ব্যাপারে কিছু কথাবার্তা বলেন।
কথাবার্তা বলতে পারি। আমারে সাপোর্ট দিবা তো? তোমরা সাপোর্ট দিলে আমি আগাইতে পারি।
কী বলেন? আমাদের জীবন-মরণ সমস্যা নিয়া আপনে কথা বলবেন, আর আমরা সাপোর্ট দিব না? এইডা আপনে কী বললেন ভাইজান? দরকার হয়, আমি এলাকার সবাইকে বলব। আপনি যা বলবেন আমরা তা করব।
আমি ডাক দিলে তোমরা সাড়া দিবা তো!
অবশ্যই দিব ভাইজান। আচ্ছা এই বিলের মধ্যে বিমানবন্দর কেন হইব ভাইজান?
জানি না। সরকারের বোধ হয় মাথা খারাপ হয়েছে। তাহলে এত দূর বিমানবন্দর কী জন্য?
ভাইজান, আমার মনে হয়, আমাগোরে উচ্ছেদ করার জন্য সরকার এসব উল্টাপাল্টা বলতেছে।
আরে না না! তুমি জানো না। পত্রপত্রিকায় রিপোর্ট হইছে। সরকার নাকি সিদ্ধান্ত পাকা করছে।
না না ভাইজান! এইটা কিছুতেই হইব না। এই মাটি আমি ছাড়ব না। এই মাটিতে মা-বাবার গন্ধ আছে। এই মাটিতে আমি বড় হইছি।
নিজের জমি না হইলেও বাবার রেখে যাওয়া জমি তো! আমার বাপের মতো এই বিলে মাছ ধরে আমি সংসার চালাই। আমার মতো আরো অনেকের সংসার এই বিলের ওপর নির্ভরশীল।
তাহলে তুমি একটা কাজ কর। তুমি তোমার এলাকার সবাইকে বল, আমি ডাক দিলে যেন সবাই আসে।
এক শ বার আসব। আমরা সবাই দা-খুন্তি নিয়া প্রতিরোধ করব। প্রয়োজনে রক্ত দিব, তবুও এই জমি ছাড়ব না।
ঠিক আছে আমি গেলাম। কথা যেন ঠিক থাকে।
ফরিদ আলী চলে গেলেন। শুক্কুর মিয়া ফরিদ আলীর কথাগুলো নিয়ে ভাবে। তারপর সে বেরিয়ে পড়ে। এলাকার লোকদের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে কথা বলল। কথা প্রসঙ্গে নিয়ামত ব্যাপারী বলল, বিমানবন্দর হইলে এলাকার উন্নয়ন হইব। আমাগো ভাগ্য ফিরব!
আরে মিয়া! ভাগ্য ফেরার আগেই তো উচ্ছেদ হইয়া যাইবা। থাকার জায়গা আছে? তা তো নাই।
তাহলে এখন কী করতে হইব?
প্রতিরোধ করতে হইব। আমাদের পেটে লাত্থি দিয়া এখানে বিমানবন্দর করা যাইব না।
কী জানি। কোনটা ভালো হইব বুঝতে পারতেছি না। সারা জীবন মাছ মাইরা জীবন চালামু!
বিমানবন্দর হইলে কি বিমান চালাইয়া খাইবা?
এ সময় কোথা থেকে যেন হন হন করে হেঁটে আসেন ফরিদ আলী। তিনি হাঁপাতে হাঁপাতে বলেন, শুক্কুর মিয়া, খবর তো ভালো না!
কেন, কী হইছে?
দু-একদিনের মধ্যেই আড়িয়াল বিল এলাকার খাস জমিতে বসবাসকারীদের উচ্ছেদ করা হবে। পুরো এলাকায় খবর রটে গেছে। এবার আর বসে থাকলে চলবে না। বুঝতে পারছ?
আপনের দল কী বলে?
আমার দলের সাপোর্ট আছে।
যদি পয়সাপাতি লাগে?
দিব। কোনো অসুবিধা নাই।
সত্য বলতেছেন?
অবশ্যই সত্য ্বলতেছি। চিন্তা কইরো না। সব আমরা দেখব। আর শোন, কাল আমাদের লাঠি মিছিল। তোমরা লোকজন নিয়া চইলা আসবা।
আপনে নিয়ামত ব্যাপারীরে একটু বইলা দেন।
নিয়ামত, তোমার আবার কী হলো?
না না, কিছু হয় নাই।
কালকে আসবা তো?
কালকে মাছ না ধরলে না খাইয়া থাকতে হইব।
এই ধরো, এখানে ৫০০ টাকা আছে। শুক্কুর মিয়া, তুমিও নাও ৫০০। এটা আমার পকেট থেকে দিলাম। আন্দোলন চাঙ্গা হইলে টাকা-পয়সা কোনো সমস্যা না, বুঝতে পারছ?
জে, বুঝতে পারছি।
এখন যাই?
যাও। আর শোন, লাঠিসোটা নিয়া আসবা কিন্তু!
পরের দিন লাঠিসোঁটা নিয়ে হাজির হয় শুক্কুর মিয়া, নিয়ামত ব্যাপারীসহ অনেকে। তারপর শুরু হলো উত্তাপ-উত্তেজনা। পুলিশের সঙ্গে গ্রামবাসীর মুখোমুখি সংঘর্ষ হলো। তাতে প্রাণ গেল এক পুলিশ অফিসারের। আহারে! কে জানতো, ডিউটিতে গিয়ে তিনি প্রাণ হারাবেন। আর তাতে গ্রাম ছাড়তে হলো শুক্কুর আলীদের। শেষ পর্যন্ত আড়িয়াল বিলে বিমানবন্দর প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত সরকার প্রত্যাহার করলো সবার বাহবাও সরকার পেল। কিন্তু পুলিশের মামলা কিছুতেই শুক্কুর আলীর পিছু ছাড়েনি। পিছু ছাড়েনি পুলিশ!
লেখক : কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক
mkamalbd@hotmail.com
আমরা খাস জমি দখল করে আছি না!
কত মানুষই তো খাস জমি দখল কইরা আছে! এত মানুষ যাইব কই?
কেমনে বলব! অন্য কোথাও গিয়া নতুন কইরা ঘর বাঁধব।
সেখানে কি জলা থাকব?
কে জানে!
ভাইজান, প্রতিদিন এই জলাতে মাছ ধরি। পানি কমলে কিছু ধান-পানও চাষ করতে পারি। তা দিয়া সংসারটা কোনোমতে চইলা যায়। এখানে বিমানবন্দর হইলে আমরা যামু কই, খামু কী? ভাইজান, আপনে না দল করেন?
করি তো!
আপনি একটা ব্যবস্থা করেন। আপনার দলের লোকজন নিয়া আমাগো ব্যাপারে কিছু কথাবার্তা বলেন।
কথাবার্তা বলতে পারি। আমারে সাপোর্ট দিবা তো? তোমরা সাপোর্ট দিলে আমি আগাইতে পারি।
কী বলেন? আমাদের জীবন-মরণ সমস্যা নিয়া আপনে কথা বলবেন, আর আমরা সাপোর্ট দিব না? এইডা আপনে কী বললেন ভাইজান? দরকার হয়, আমি এলাকার সবাইকে বলব। আপনি যা বলবেন আমরা তা করব।
আমি ডাক দিলে তোমরা সাড়া দিবা তো!
অবশ্যই দিব ভাইজান। আচ্ছা এই বিলের মধ্যে বিমানবন্দর কেন হইব ভাইজান?
জানি না। সরকারের বোধ হয় মাথা খারাপ হয়েছে। তাহলে এত দূর বিমানবন্দর কী জন্য?
ভাইজান, আমার মনে হয়, আমাগোরে উচ্ছেদ করার জন্য সরকার এসব উল্টাপাল্টা বলতেছে।
আরে না না! তুমি জানো না। পত্রপত্রিকায় রিপোর্ট হইছে। সরকার নাকি সিদ্ধান্ত পাকা করছে।
না না ভাইজান! এইটা কিছুতেই হইব না। এই মাটি আমি ছাড়ব না। এই মাটিতে মা-বাবার গন্ধ আছে। এই মাটিতে আমি বড় হইছি।
নিজের জমি না হইলেও বাবার রেখে যাওয়া জমি তো! আমার বাপের মতো এই বিলে মাছ ধরে আমি সংসার চালাই। আমার মতো আরো অনেকের সংসার এই বিলের ওপর নির্ভরশীল।
তাহলে তুমি একটা কাজ কর। তুমি তোমার এলাকার সবাইকে বল, আমি ডাক দিলে যেন সবাই আসে।
এক শ বার আসব। আমরা সবাই দা-খুন্তি নিয়া প্রতিরোধ করব। প্রয়োজনে রক্ত দিব, তবুও এই জমি ছাড়ব না।
ঠিক আছে আমি গেলাম। কথা যেন ঠিক থাকে।
ফরিদ আলী চলে গেলেন। শুক্কুর মিয়া ফরিদ আলীর কথাগুলো নিয়ে ভাবে। তারপর সে বেরিয়ে পড়ে। এলাকার লোকদের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে কথা বলল। কথা প্রসঙ্গে নিয়ামত ব্যাপারী বলল, বিমানবন্দর হইলে এলাকার উন্নয়ন হইব। আমাগো ভাগ্য ফিরব!
আরে মিয়া! ভাগ্য ফেরার আগেই তো উচ্ছেদ হইয়া যাইবা। থাকার জায়গা আছে? তা তো নাই।
তাহলে এখন কী করতে হইব?
প্রতিরোধ করতে হইব। আমাদের পেটে লাত্থি দিয়া এখানে বিমানবন্দর করা যাইব না।
কী জানি। কোনটা ভালো হইব বুঝতে পারতেছি না। সারা জীবন মাছ মাইরা জীবন চালামু!
বিমানবন্দর হইলে কি বিমান চালাইয়া খাইবা?
এ সময় কোথা থেকে যেন হন হন করে হেঁটে আসেন ফরিদ আলী। তিনি হাঁপাতে হাঁপাতে বলেন, শুক্কুর মিয়া, খবর তো ভালো না!
কেন, কী হইছে?
দু-একদিনের মধ্যেই আড়িয়াল বিল এলাকার খাস জমিতে বসবাসকারীদের উচ্ছেদ করা হবে। পুরো এলাকায় খবর রটে গেছে। এবার আর বসে থাকলে চলবে না। বুঝতে পারছ?
আপনের দল কী বলে?
আমার দলের সাপোর্ট আছে।
যদি পয়সাপাতি লাগে?
দিব। কোনো অসুবিধা নাই।
সত্য বলতেছেন?
অবশ্যই সত্য ্বলতেছি। চিন্তা কইরো না। সব আমরা দেখব। আর শোন, কাল আমাদের লাঠি মিছিল। তোমরা লোকজন নিয়া চইলা আসবা।
আপনে নিয়ামত ব্যাপারীরে একটু বইলা দেন।
নিয়ামত, তোমার আবার কী হলো?
না না, কিছু হয় নাই।
কালকে আসবা তো?
কালকে মাছ না ধরলে না খাইয়া থাকতে হইব।
এই ধরো, এখানে ৫০০ টাকা আছে। শুক্কুর মিয়া, তুমিও নাও ৫০০। এটা আমার পকেট থেকে দিলাম। আন্দোলন চাঙ্গা হইলে টাকা-পয়সা কোনো সমস্যা না, বুঝতে পারছ?
জে, বুঝতে পারছি।
এখন যাই?
যাও। আর শোন, লাঠিসোটা নিয়া আসবা কিন্তু!
পরের দিন লাঠিসোঁটা নিয়ে হাজির হয় শুক্কুর মিয়া, নিয়ামত ব্যাপারীসহ অনেকে। তারপর শুরু হলো উত্তাপ-উত্তেজনা। পুলিশের সঙ্গে গ্রামবাসীর মুখোমুখি সংঘর্ষ হলো। তাতে প্রাণ গেল এক পুলিশ অফিসারের। আহারে! কে জানতো, ডিউটিতে গিয়ে তিনি প্রাণ হারাবেন। আর তাতে গ্রাম ছাড়তে হলো শুক্কুর আলীদের। শেষ পর্যন্ত আড়িয়াল বিলে বিমানবন্দর প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত সরকার প্রত্যাহার করলো সবার বাহবাও সরকার পেল। কিন্তু পুলিশের মামলা কিছুতেই শুক্কুর আলীর পিছু ছাড়েনি। পিছু ছাড়েনি পুলিশ!
লেখক : কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক
mkamalbd@hotmail.com
No comments