তত্ত্বাবধায়ক সরকার-সুপ্রিম কোর্টের ঐতিহাসিক রায়
সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা সংক্রান্ত ধারার বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের মঙ্গলবারের রায় ঐতিহাসিক হিসেবেই বিবেচিত হবে। সত্তর ও আশির দশকে দুই দফা সামরিক শাসনামলে বাংলাদেশের নির্বাচনব্যবস্থাকে প্রহসনে পরিণত করা হয়। সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান নির্বাচন কমিশন হয়ে পড়ে আজ্ঞাবহ প্রতিষ্ঠান।
গণতন্ত্র ও স্বৈরতান্ত্রিক ব্যবস্থার পক্ষ-বিপক্ষ শক্তি সংঘাতের অবস্থানে চলে যায় এবং রাজনৈতিক ও সামাজিক অঙ্গনেও তা ছড়িয়ে পড়তে থাকে। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে পারস্পরিক আস্থার অভাব প্রকট হয়ে ওঠে। এ প্রেক্ষাপটে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠান ছিল সময়ের দাবি। ১৯৯১ সালের ফেব্রুয়ারির নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় সে সময়ে সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতিকে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি হিসেবে নিয়োগদানের মাধ্যমে। এইচএম এরশাদের শাসনের বিরুদ্ধে প্রবল গণআন্দোলনের মুখে তিনটি রাজনৈতিক জোটের কাছে গ্রহণযোগ্য হিসেবে ছিল এই মনোনয়ন। পরবর্তী নির্বাচনেও এ ধরনের ব্যবস্থা বহাল রাখার দাবির প্রতি সে সময়ের বিএনপি সরকার অবজ্ঞা প্রদর্শন করে এবং ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টিসহ বেশিরভাগ রাজনৈতিক দলের বয়কটের মধ্যেই সংঘাতময় পরিবেশে দলীয় সরকারের অধীনে ষষ্ঠ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। মাত্র কয়েকদিন স্থায়ী এ সংসদেই সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী গৃহীত হয়েছিল, যাতে সুপ্রিম কোর্টের সর্বশেষ বিদায়ী প্রধান বিচারপতিকে প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োগদান করে নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনের বিধান করা হয়। দুর্ভাগ্যজনকভাবে এ ধরনের ব্যবস্থার পরও রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে তাৎপর্যপূর্ণ পরিবর্তন ঘটেনি। বরং এর কিছু নেতিবাচক প্রভাব সর্বোচ্চ আদালতেও পড়তে থাকে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান কে হতে পারেন সে বিষয়টি বিবেচনায় রেখে আপিল বিভাগের বিচারপতি ও প্রধান বিচারপতির নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পাদিত হয় বলে অভিযোগ উঠতে থাকে। এমন অভিযোগও ওঠে যে, বিএনপির শাসনামলে সংবিধানের চতুর্দশ সংশোধনীতে বিচারপতিদের অবসরের বয়সসীমা দুই বছর বাড়ানোর বিধান সংযুক্ত করার উদ্দেশ্য ছিল পছন্দের ব্যক্তিকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান পদে দায়িত্ব পালনের সুযোগ সৃষ্টি। এ পদক্ষেপের বিরুদ্ধে টানা দুই বছর রাজনৈতিক অঙ্গন ছিল উত্তপ্ত এবং সে কারণে নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানই শুধু দুই বছর বিলম্বিত হয়নি, অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে জরুরি আইনে শাসিত হয় দেশ। আপিল বিভাগের রায়ে এই সার্বিক প্রেক্ষাপট বিবেচনার পাশাপাশি বর্তমান রাজনৈতিক পরিবেশ এবং জনপ্রত্যাশাও বিবেচনায় রাখা হয়েছে সন্দেহ নেই। দশম ও একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠান এবং এ ক্ষেত্রে তত্ত্বাবধায়ক সরকারপ্রধান হিসেবে সাবেক প্রধান বিচারপতি ও আপিল বিভাগের বিচারপতিদের বাদ দিয়ে পদক্ষেপ গ্রহণে জাতীয় সংসদকে স্বাধীনতা প্রদানে বিচক্ষণতা ও দূরদর্শিতার ছাপ স্পষ্ট। বর্তমানে জাতীয় সংসদে সংবিধান সংশোধনের প্রক্রিয়া চলছে এবং এতে আপিল বিভাগের রায় সর্বোচ্চ গুরুত্ব পাবে, এটাই প্রত্যাশিত। এ সংক্রান্ত কমিটি সমাজের বিভিন্ন অংশের সঙ্গে এ বিষয়ে দীর্ঘ সময় ধরে আলোচনা চালাচ্ছে। গণমাধ্যমেও এ বিষয়ে মতামত প্রতিফলিত হচ্ছে। সর্বোচ্চ আদালতের রায়ের প্রেক্ষাপটে সংবিধান সংশোধনের প্রক্রিয়া দীর্ঘায়িত হতে পারে বলে ইতিমধ্যে ইঙ্গিত পাওয়া গেছে। সবকিছুর পরও গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে রাজনৈতিক সমঝোতা। রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে মৌলিক পরিবর্তন সাধন এবং বিশেষ করে সংঘাতময় অবস্থানকে চিরতরে বিদায় দিয়ে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ সমুন্নত করা না গেলে সেটা হবে দুর্ভাগ্যজনক। আমরা আশা করব, আপিল বিভাগের রায়ের আলোকে সংবিধানের প্রয়োজনীয় সংশোধনী আনয়নের প্রক্রিয়ায় প্রধান বিরোধী দল বিএনপি এবং তাদের মিত্ররা যুক্ত হবে। এটাও কাঙ্ক্ষিত যে, এটা সম্ভব করে তুলতে সরকারপক্ষ প্রয়োজনীয় সব পদক্ষেপ গ্রহণ করতে দ্বিধান্বিত হবে না।
No comments