পর্যটন-পরিবেশ নষ্ট হচ্ছে তাতে আমার কী? by উপমা মাহবুব
পরিবেশ রক্ষার জন্য অনেক বড় কোনো উদ্যোগ গ্রহণের কোনো প্রয়োজন নেই। 'পরিবেশ নষ্ট হচ্ছে তাতে আমার কী'_ এই জাতীয় মানসিকতা থেকে আমাদের বের হয়ে আসতে হবে। কোথাও বেড়াতে গিয়ে ময়লা ফেলে সেখানকার পরিবেশ নষ্ট না করার বিষয়ে হতে হবে সচেতন।
নিজেদের জাতীয় সম্পদকে আমরা যদি ভালো না বাসি, এর রক্ষণাবেক্ষণে যদি নজর না রাখি তাহলে সরকারের একার পক্ষে এগুলোর পরিবেশকে রক্ষা
করা সম্ভব নয়
দেশে পর্যটন শিল্পের উন্নয়ন নিয়ে বর্তমানে বিভিন্ন ধরনের উদ্যোগ গ্রহণ করা হচ্ছে। গণমাধ্যমে পর্যটনের ওপর চমৎকার বিজ্ঞাপন প্রচারিত হচ্ছে। বহু ধরনের পর্যটন প্যাকেজ চালু হয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ অনেক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পর্যটন শিল্পের ওপর পড়ালেখার জন্য আলাদা বিভাগ খোলা হয়েছে। এগুলো অত্যন্ত ভালো উদ্যোগ। পর্যটন শিল্প সারাবিশ্বে বর্তমানে একটি অন্যতম বৈদেশিক অর্থ উপার্জনকারী শিল্প। আমাদের খুব কাছের থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়াসহ বিভিন্ন দেশ এর ওপর নির্ভর করে তাদের অর্থনীতির ভাগ্য বদলে দিয়েছে। বাংলাদেশ কোনো অর্থেই এসব দেশের চেয়ে কম প্রাকৃতিক সৌন্দর্য সম্পন্ন নয়। এখানেও পর্যটন শিল্প বিকাশ এবং এর মাধ্যমে বিপুল বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের সম্ভাবনা রয়েছে।
কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক এবং একই সঙ্গে অত্যন্ত হাস্যকর সত্য হলো, আমাদের দেশে পর্যটন শিল্প বিকাশে আমরাই সবচেয়ে বড় বাধা। কেননা আমাদের রয়েছে এক বিশেষ জাতিগত বৈশিষ্ট্য আর সেটি হলো আমরা পরিবেশ নোংরা করাকে অত্যন্ত স্বাভাবিক একটি ঘটনা বলে মনে করি। আমরা যেভাবে বিভিন্ন দর্শনীয় স্থানগুলোতে বেড়াতে গিয়ে সেখানে খাবারের উচ্ছিষ্ট থেকে শুরু করে বিভিন্ন ধরনের ময়লা-আবর্জনা নিয়মিত ফেলে স্থানগুলোর পরিবেশ নষ্ট করছি, তাতে স্থানগুলো বিদেশিদের কাছে আকর্ষণ হারাচ্ছে। বাইরের দেশ থেকে কেউ পয়সা খরচ করে নিশ্চয়ই কোনো নোংরা স্থান দেখতে আসবে না। সারাবিশ্বেই বিভিন্ন দেশ পর্যটকদের আকর্ষণ করতে তাদের দর্শনীয় স্থানগুলোকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন, ঝকঝকে করে রাখে এবং অবশ্যই সেসব দেশের সরকার একা এ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখার কাজটি করে না। বরং সেই দেশের প্রতিটি নাগরিক, যারা এসব স্থানে বেড়াতে যায় এবং যারা ওই এলাকার স্থায়ী বাসিন্দা, তারা প্রত্যেকেই এসব স্থান নোংরামুক্ত রাখার বিষয়ে অত্যন্ত সচেতন ভূমিকা পালন করে।
কিন্তু আমাদের দেশে দৃশ্যটি পুরোপুরি উল্টো। কক্সবাজারের উদাহরণ দেওয়ার কোনো মানেই হয় না, আমরা প্রত্যেকেই কমবেশি কক্সবাজারে গিয়েছি এবং সেখানকার সমুদ্রের পানি ও পরিবেশ বর্তমানে কী পরিমাণ নোংরা-আবর্জনায় ভরে গেছে সেটি আমাদের জানা। মজার ব্যাপার হলো, আমরা যারা সেখানে বেড়াতে গেছি তাদের সম্ভবত নিরানব্বই ভাগই খাবারের ঠোঙ্গা, চিপসের প্যাকেট, কোকের ক্যানসহ বহু ধরনের ময়লা ফেলে এ নোংরাকরণ কর্মসূচিতে অবদান রেখেছি। আমি ময়লা ফেলব আর সমুদ্র সংরক্ষণ কমিটি টাইপের কোনো একটি কমিটি সরকারি উদ্যোগে সারাক্ষণ সমুদ্রসৈকত পরিষ্কার রাখবে এ মানসিকতা থেকে বের হতে না পারলে আর কিছু দিন পর বিদেশিরা কেন দেশের মানুষই আগ্রহ হারিয়ে ফেলবে বিশ্বের সবচেয়ে দীর্ঘ অপূর্ব সুন্দর এ সমুদ্রসৈকতের প্রতি। অন্যদিকে নিয়মিত ময়লা পরিষ্কার করার জন্য আলাদা লোক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে, এ ধরনের পর্যটন এলাকাও বাংলাদেশে আছে। যেমন_ সুন্দরবন। জাহাজে করে সুন্দরবন ভ্রমণের সময় নদীর পানিতে বিভিন্ন ধরনের খাবারের প্যাকেট ভাসতে দেখেছি; কিন্তু তার পরিমাণ ছিল অত্যন্ত কম। তাই একটা ধারণা জন্মেছিল যে, সুন্দরবন ভ্রমণ যথেষ্ট ব্যয়বহুল হওয়ায় এখানে যারা আসেন তারা হয়তো অনেক বেশি রুচিবান এবং সচেতন, তাই তারা ময়লা ফেলে পানি নষ্ট করেননি। কিন্তু সুন্দরবনের অন্যতম আকর্ষণ কটকা সৈকতের কাছাকাছি পেঁৗছে দেখলাম ভয়াবহ দৃশ্য। সমন্ত নদীর পানি খাবারের প্যাকেট, পলিব্যাগসহ বিভিন্ন ধরনের বর্জ্যে সয়লাব হয়ে আছে। সুন্দরবনের প্রতিটি ট্যুরিস্ট জাহাজে একজন কর্মচারীকে দায়িত্ব দেওয়া আছে মানুষের ফেলে যাওয়া ময়লা পরিষ্কার করার। দেখলাম, যেহেতু এখানে নদীতে কুমিরের বাস তাই তারা জাহাজের ওপর থেকেই লাঠি দিয়ে নদীর পানিতে ভেসে থাকা ময়লা তুলতে আপ্রাণ চেষ্টা করছে। কিন্তু তা তেমন কোনো কাজেই আসছে না। কটকা সৈকতে একটি জাহাজের পর্যটকরা যতক্ষণ থাকেন ততক্ষণ পর্যন্ত ওই জাহাজের একজন কর্মচারী বস্তা কাঁধে করে পুরো সৈকত চক্কর মারে আর পর্যটকদের ফেলা ময়লা পরিষ্কার করে। বিশ্বের সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ বন দেখতে এসে সবাই নির্বিকারভাবে এর পরিবেশ নষ্ট করছে। এভাবে করে কখনোই পর্যটন শিল্পের বিকাশ সম্ভব নয়।
বাংলাদেশে আরেকটি অসাধারণ অঞ্চল আছে যা এ দেশের অন্যতম পর্যটনের কেন্দ্রে পরিণত হতে পারে। সেটি হলো হাওরাঞ্চল। এখন পর্যন্ত আমাদের দেশীয় পর্যটকদেরও খুব একটা পদধূলি পড়েনি এই অসাধারণ সুন্দর অঞ্চলে, সে কারণেই পরিবেশও এখানে মনোরম। হাইল হাওরে দেখেছি প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত নৌকার মাঝিরা পর্যটকদের বিলে ফুটে থাকা পদ্ম ফুল তুলতে দেন না। কেননা এ ফুলগুলোর লোভেই হাজার হাজার মাইল পথ পাড়ি দিয়ে অতিথি পাখিরা এই হাওরে আসে। সেখানে তারা কোনো ময়লা ফেলতে দেন না। কিছু মানুষ অবৈধভাবে অতিথি পাখি শিকার করে থাকলেও এলাকার অধিকাংশ মানুষই এই পাখিগুলোকে ভালোবাসে এবং সেগুলো যাতে কেউ শিকার না করতে পারে সেদিকে নজর রাখে। এতে করে এটাই বোঝা যায়, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এ ধরনের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যমণ্ডিত এলাকাগুলোর পরিবেশ নোংরা হওয়ার পেছনে স্থানীয় বাসিন্দারা নয় বরং যারা এখানে বেড়াতে যান তারাই মূলত দায়ী। আমার আশঙ্কা, হাওরে পর্যটন শিল্পের বিকাশ ঘটলে এখানকার পানি পর্যটকদের ফেলা বর্জ্যে ভরে যাবে। ফলে কমে যাবে অতিথি পাখির সংখ্যা, বিপন্ন হবে এখানকার স্থলজ ও জলজ জীববৈচিত্র্য।
অথচ এসব এলাকার পরিবেশ রক্ষার জন্য অনেক বড় কোনো উদ্যোগ গ্রহণের কোনো প্রয়োজন নেই। 'পরিবেশ নষ্ট হচ্ছে তাতে আমার কী'_ এই জাতীয় মানসিকতা থেকে আমাদের বের হয়ে আসতে হবে। কোথাও বেড়াতে গিয়ে ময়লা ফেলে সেখানকার পরিবেশ নষ্ট না করার বিষয়ে হতে হবে সচেতন। নিজেদের জাতীয় সম্পদকে আমরা যদি ভালো না বাসি, এর রক্ষণাবেক্ষণে যদি নজর না রাখি তাহলে সরকারের একার পক্ষে এগুলোর পরিবেশকে রক্ষা করা সম্ভব নয়। তাই এগুলোর রক্ষণাবেক্ষণে প্রত্যেকেই তার নিজ নিজ জায়গা থেকে ভূমিকা রাখতে হবে। অন্যান্য সুযোগ-সুবিধার পরিমাণ কম থাকার পরও শুধু পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখতে পারলেও বিদেশি পর্যটকদের একটি বড় অংশকে আকর্ষণ করা সম্ভব। এতে করে দেশের পর্যটন শিল্পের বিকাশ ঘটবে। দেশের অর্থনীতির চাকা আরও গতি পাবে। বাড়বে কর্মসংস্থানের সুযোগ। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মানুষ বাংলাদেশের নাম জানবে। এখানে বেড়াতে আসবে। ঘটবে সংস্কৃতির মেলবন্ধন। এর মাধ্যমে সার্বিকভাবে আমরা প্রত্যেকেই লাভবান হবো। তাই অতিরিক্ত দূষণের ফলে পরিবেশ বিপর্যয় ঘটে দেশের প্রাকৃতিক সম্পদগুলোর সৌন্দর্য নষ্ট হওয়ার আগেই এখনই সময় নিজেদের বহুল চর্চিত এই খারাপ অভ্যাসটি বদলে নেওয়ার। পরিবেশকে একটু ভালোবাসার।
উপমা মাহবুব :গবেষক
m_upoma@yahoo.com
No comments