গতকাল সমকাল-মুরসি—মিসরের প্রথম নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি by ফারুক চৌধুরী
২০১২ সালের ২৪ জুন মিসরের সুপ্রাচীন এবং সুদীর্ঘ ইতিহাসের একটি বিশেষ দিন হয়ে রইবে। এই দিনে মিসরের জনগণ তাদের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো ‘মুসলিম ব্রাদারহুডের’ রাজনৈতিক বাহু ‘ফ্রিডম অ্যান্ড জাস্টিস পার্টির’ মোহাম্মদ মুরসিকে ৫১ দশমিক ৭৩ শতাংশ ভোটে রাষ্ট্রপতি হিসেবে নির্বাচন করল।
মিসরের ইতিহাসে তিনিই প্রথম নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি। তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী আহমেদ শফিক পেয়েছেন ৪৮ দশমিক ২৭ শতাংশ ভোট। আহমেদ শফিক অপসারিত রাষ্ট্রপতি হোসনি মোবারকের সর্বশেষ প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। মিসরে দুই কিস্তিতে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলো। ২০১২ সালের মে মাসে অনুষ্ঠিত রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের প্রথম রাউন্ডে ১০ জন প্রার্থী ছিলেন। নির্বাচনের নিয়ম অনুযায়ী তাঁদের মধ্যে অধিকতর ভোট পাওয়া দুজন প্রার্থী মোহাম্মদ মুরসি আর আহমেদ শফিক জুন ২০১২ সালের প্রথম সপ্তাহের নির্বাচনের দ্বিতীয় রাউন্ড লড়লেন। তাতে বিজয়ী হলেন মোহাম্মদ মুরসি।
মিসরের অনেক ভোটদাতাই এই দুজন প্রার্থী নিয়ে অনিশ্চয়তার মধ্যে ছিলেন। আহমেদ শফিক অতীতে হোসনি মোবারকের বেসামরিক বিমান চলাচলমন্ত্রী হিসেবে যথেষ্ট দক্ষতার পরিচয় দিয়েছিলেন। কিন্তু অসাম্প্রদায়িক ও উদারপন্থী হিসেবে পরিচিত এই সাবেক সামরিক কর্মকর্তাকে অনেকেই সামরিক শাসকের ঘরানার বলে মনে করেছিলেন। তাই দ্বিধা সত্ত্বেও তাঁরা মোহাম্মদ মুরসিকে সমর্থন জানিয়েছেন। অন্যদিকে ‘ফ্রিডম অ্যান্ড জাস্টিস পার্টি’ তথা মুসলিম ব্রাদারহুডের প্রার্থী মোহাম্মদ মুরসি রাষ্ট্রপতি হিসেবে মিসরের সংখ্যালঘু কপটিক খ্রিষ্টান সম্প্রদায় (মিসরের জনসংখ্যার ১০ শতাংশ), নারীসমাজ ও অসাম্প্রদায়িক জনগোষ্ঠীর মধ্যে কতটুকু গ্রহণযোগ্য হবেন, তা নিয়ে সন্দেহ ছিল। সেই কারণে সামরিক ঘরানার বিরোধী অনেক উদারপন্থীই আহমেদ শফিককে ভোট দিয়েছেন। তবে শেষ কথা হলো এই যে, বিপুল সংখ্যাধিক্যে না হলেও ভোটের ফলাফল মোহাম্মদ মুরসির অনুকূলে গিয়েছে।
তাঁর বিজয় ঘোষিত হওয়ার অব্যবহিত পরই মোহাম্মদ মুরসি ‘মুসলিম ব্রাদারহুড’ এবং ‘ফ্রিডম অ্যান্ড জাস্টিস পার্টি’র সঙ্গে সব ধরনের সম্পর্ক ছেদ করেছেন এবং বলেছেন যে জাতমত ভেদে তিনি মিসরীয় সব নাগরিকের রাষ্ট্রপতি। মিসরে আরব বসন্তের এমনই নির্মম পরিহাস, যখন তাহরির স্কয়ারে গণজাগরণ সৃষ্টি হয়েছিল তখন মুসরি ছিলেন মোবারকের জেলে, আর তিনি যখন রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব নিতে যাচ্ছেন তখন সেই মোবারকই যাবজ্জীবন কারাদণ্ড ভোগ করছেন।
কায়রোর তাহরির স্কয়ারেই মিসরের মোবারকবিরোধী আন্দোলন শুরু হয়েছিল মাত্র দেড় বছরেরও সামান্য বেশি সময় আগে। ২০১২ সালের ২৪ জুন মোহাম্মদ মুরসির বিজয় ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে তাহরির স্কয়ার আবার ফেটে পড়ল আনন্দের বিস্ফোরণে। নবনির্বাচিত রাষ্ট্রপতিকে ‘আন্তরিক অভিনন্দন’ জানালেন তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী আহমেদ শফিক। মিসরের সামরিক জান্তার নেতা জেনারেল তানতাওয়িও সেই অভিনন্দন জানানোর পালায় যোগ দিলেন। প্রেসিডেন্ট ওবামা টেলিফোনে নবনির্বাচিত রাষ্ট্রপতি মুরসিকে জানালেন যে তিনি তাঁর সঙ্গে সহযোগিতা করতে প্রস্তুত। ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু নির্বাচনের ফলাফলকে সম্মান (Respect) জানালেন। মিসরের খ্রিষ্টান সম্প্রদায়ের বিশপ পাচোমিনও তাঁর রাষ্ট্রপতিকে অভিনন্দন জানিয়েছেন। এককথায়, দেশে-বিদেশে নির্বাচন-উত্তর আনুষ্ঠানিকতা নবনির্বাচিত রাষ্ট্রপতির জন্য সম্পন্নই হয়েছে, নির্বাচনের ঘণ্টা খানেকের মধ্যেই। আরব বিশ্বে এই নির্বাচনের বিশেষ প্রভাব পড়বে, প্রধানত এই কারণে যে প্রায় প্রতিটি আরব দেশেই মিসরে ১৯২৮ সালে প্রতিষ্ঠিত ইসলামিক ব্রাদারহুডের শাখা গত শতাব্দীর বিভিন্ন বছরে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। তিউনিসিয়ায় যে আরব-বসন্তের সূচনা হয়েছিল, সেখানে আজ ক্ষমতায় রয়েছে অতীতে নিষিদ্ধ, উদারপন্থী ইসলামিক পার্টি ইন্নাহদা। সেই ‘ইন্নাহদা’ দলের মুনসেফ মারজুকি আজ তিউনিসিয়ার রাষ্ট্রপতি। তবে মিসর হচ্ছে আরব বিশ্বের বৃহত্তম এবং সবচেয়ে প্রভাবশালী দেশ। অতএব, মিসরের বিবর্তন আরব বিশ্বকে নাড়া দেবেই। মোদ্দা কথা হলো, আরব বিশ্বে এখন সাধারণ জনগণের কণ্ঠধ্বনি সেই অঞ্চলের শাসকদের মধ্যে আগের চেয়েও অনেক জোরে ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হবে।
তবে মিসরে একটি সুষ্ঠু রাষ্ট্রপতি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে, সেই কথা যেমন সত্যি, তেমনি সত্যি এই কথাটিও যে সেই দেশ এখনো গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা থেকে অনেক দূরেই রয়েছে। সে ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতি মুরসির সামনে রয়েছে বিরাট দুটি চ্যালেঞ্জ। তার প্রথমটি অবশ্যই হলো মিসরের সব সম্প্রদায় ও গোষ্ঠীর কাছে তাঁর গ্রহণযোগ্যতা নিশ্চিত করা। দ্বিতীয় এবং বোধ করি তার চেয়েও দুরূহ কাজ হবে সামরিক জান্তা, যা SCAF (Supreme Command of the Armed Forces) বলে পরিচিত, তাদের ক্ষমতা খর্ব করে দেশকে গণতন্ত্রের পথে পরিচালনা করা। বর্তমানে দেশের সংবিধান রচনা এবং সংসদ নির্বাচন থেকে শুরু করে বেসামরিক প্রশাসনের অনেক কিছুই SCAF-এর হাতে রয়েছে। তার জন্য প্রয়োজন হবে অপরিসীম ধৈর্য আর সুদীর্ঘ আলোচনার প্রক্রিয়া। তবে এই ক্ষেত্রে প্রেসিডেন্ট মুরসিকে দেশের জনগণের সমর্থন সুচিন্তিতভাবে আদায় করে নিতে হবে। মিসরে যে সংবিধান রচিত হতে যাচ্ছে, একমাত্র তা-ই জনগণের সার্বভৌমত্বের নিশ্চয়তা দিতে পারে। প্রতিটি প্রশ্নে তাহরির স্কয়ারের গণ-আন্দোলন তার বিকল্প ব্যবস্থা হতে পারে না। ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক মোহাম্মদ মুরসির জন্য বিরাট একটি চ্যালেঞ্জ হয়ে রইবে। প্রেসিডেন্ট মুরসি অবশ্য ঘোষণা করেছেন যে তাঁর সরকার সব আন্তর্জাতিক ঘোষণা মেনে চলবে, যার মধ্যে ১৯৭৯ সালের ক্যাম্প ডেভিড চুক্তি অবশ্যই অন্তর্ভুক্ত।
এটা বলা যায় যে মিসরে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন আমাদের সমসাময়িক ইতিহাসে বার্লিন দেয়াল ভাঙা অথবা নেলসন ম্যান্ডেলার মুক্তির মতোই তাৎপর্যপূর্ণ একটি ঘোষণা। যদি মিসর নিজেকে মূলত একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র বলে প্রতিষ্ঠিত করতে পারে, তাহলে তা একদিন স্বৈরশাসিত আরব দেশগুলোর আদল বদলে দেবেই। নানাভাবে তার বহিঃপ্রকাশ ঘটতে পারে সেই সব দেশের আর্থসামাজিক আর রাজনৈতিক অবস্থার ওপর। তা নাড়িয়ে তুলতে পারে সেই সব সমাজের ঘুণে ধরা সব ভিত্তি। আর এই আরব সুনামির পরিণতিও হতে পারে কল্পনাতীত ও সুদূরপ্রসারী। হয়তো বা তা ফিলিস্তিন সমস্যার স্থায়ী সমাধানে সহায়ক হবে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৯৩০ সালে জুইস স্ট্যান্ডার্ড নামের একটি পত্রিকার সাংবাদিকদের কাছে অত্যন্ত স্পষ্ট ভাষায় ফিলিস্তিন সমস্যা সমাধানে তাঁর চিন্তা ব্যক্ত করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ‘ফিলিস্তিন সমস্যার স্থায়ী সমাধান লন্ডনে বসে হবে না, তা ফিলিস্তিনেই অর্জন করতে হবে।’ রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, ‘আরব ইহুদি সহযোগিতা ও সহমর্মিতা ছাড়া ইহুদিদের আবাসভূমি (শান্তিপূর্ণ) প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়। ফিলিস্তিনে এই উদ্যোগের সাফল্য আসতে পারে শুধু আরব ও ইহুদিদের মধ্যে প্রত্যক্ষ যোগাযোগ ও সহযোগিতার ভিত্তিতে।’ কয়েকটি দশক ধরে সাম্রাজ্যবাদসৃষ্ট স্বৈরাচারী আরব সরকারগুলো পাশ্চাত্যের আজ্ঞাবাহী রয়েছে। একটি গণতান্ত্রিক আরব বিশ্ব এবং ইসরায়েল তাদের পারস্পরিক স্বার্থেই ভবিষ্যতে সেই অঞ্চলে শান্তি প্রতিষ্ঠায় ব্রতী হতে পারে। তা অবশ্যই সময়সাপেক্ষ। তবে একটি গণতান্ত্রিক মিসর তার সনাতন ঐতিহ্য নিয়ে মধ্যপ্রাচ্যে একটি ইতিবাচক ভূমিকা অবশ্যই পালন করতে পারবে; সেই অঞ্চলে শান্তি প্রতিষ্ঠায় রাখতে পারবে গুরুত্বপূর্ণ অবদান।
ফারুক চৌধুরী: সাবেক পররাষ্ট্রসচিব। কলাম লেখক।
zaaf@bdmail.net
মিসরের অনেক ভোটদাতাই এই দুজন প্রার্থী নিয়ে অনিশ্চয়তার মধ্যে ছিলেন। আহমেদ শফিক অতীতে হোসনি মোবারকের বেসামরিক বিমান চলাচলমন্ত্রী হিসেবে যথেষ্ট দক্ষতার পরিচয় দিয়েছিলেন। কিন্তু অসাম্প্রদায়িক ও উদারপন্থী হিসেবে পরিচিত এই সাবেক সামরিক কর্মকর্তাকে অনেকেই সামরিক শাসকের ঘরানার বলে মনে করেছিলেন। তাই দ্বিধা সত্ত্বেও তাঁরা মোহাম্মদ মুরসিকে সমর্থন জানিয়েছেন। অন্যদিকে ‘ফ্রিডম অ্যান্ড জাস্টিস পার্টি’ তথা মুসলিম ব্রাদারহুডের প্রার্থী মোহাম্মদ মুরসি রাষ্ট্রপতি হিসেবে মিসরের সংখ্যালঘু কপটিক খ্রিষ্টান সম্প্রদায় (মিসরের জনসংখ্যার ১০ শতাংশ), নারীসমাজ ও অসাম্প্রদায়িক জনগোষ্ঠীর মধ্যে কতটুকু গ্রহণযোগ্য হবেন, তা নিয়ে সন্দেহ ছিল। সেই কারণে সামরিক ঘরানার বিরোধী অনেক উদারপন্থীই আহমেদ শফিককে ভোট দিয়েছেন। তবে শেষ কথা হলো এই যে, বিপুল সংখ্যাধিক্যে না হলেও ভোটের ফলাফল মোহাম্মদ মুরসির অনুকূলে গিয়েছে।
তাঁর বিজয় ঘোষিত হওয়ার অব্যবহিত পরই মোহাম্মদ মুরসি ‘মুসলিম ব্রাদারহুড’ এবং ‘ফ্রিডম অ্যান্ড জাস্টিস পার্টি’র সঙ্গে সব ধরনের সম্পর্ক ছেদ করেছেন এবং বলেছেন যে জাতমত ভেদে তিনি মিসরীয় সব নাগরিকের রাষ্ট্রপতি। মিসরে আরব বসন্তের এমনই নির্মম পরিহাস, যখন তাহরির স্কয়ারে গণজাগরণ সৃষ্টি হয়েছিল তখন মুসরি ছিলেন মোবারকের জেলে, আর তিনি যখন রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব নিতে যাচ্ছেন তখন সেই মোবারকই যাবজ্জীবন কারাদণ্ড ভোগ করছেন।
কায়রোর তাহরির স্কয়ারেই মিসরের মোবারকবিরোধী আন্দোলন শুরু হয়েছিল মাত্র দেড় বছরেরও সামান্য বেশি সময় আগে। ২০১২ সালের ২৪ জুন মোহাম্মদ মুরসির বিজয় ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে তাহরির স্কয়ার আবার ফেটে পড়ল আনন্দের বিস্ফোরণে। নবনির্বাচিত রাষ্ট্রপতিকে ‘আন্তরিক অভিনন্দন’ জানালেন তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী আহমেদ শফিক। মিসরের সামরিক জান্তার নেতা জেনারেল তানতাওয়িও সেই অভিনন্দন জানানোর পালায় যোগ দিলেন। প্রেসিডেন্ট ওবামা টেলিফোনে নবনির্বাচিত রাষ্ট্রপতি মুরসিকে জানালেন যে তিনি তাঁর সঙ্গে সহযোগিতা করতে প্রস্তুত। ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু নির্বাচনের ফলাফলকে সম্মান (Respect) জানালেন। মিসরের খ্রিষ্টান সম্প্রদায়ের বিশপ পাচোমিনও তাঁর রাষ্ট্রপতিকে অভিনন্দন জানিয়েছেন। এককথায়, দেশে-বিদেশে নির্বাচন-উত্তর আনুষ্ঠানিকতা নবনির্বাচিত রাষ্ট্রপতির জন্য সম্পন্নই হয়েছে, নির্বাচনের ঘণ্টা খানেকের মধ্যেই। আরব বিশ্বে এই নির্বাচনের বিশেষ প্রভাব পড়বে, প্রধানত এই কারণে যে প্রায় প্রতিটি আরব দেশেই মিসরে ১৯২৮ সালে প্রতিষ্ঠিত ইসলামিক ব্রাদারহুডের শাখা গত শতাব্দীর বিভিন্ন বছরে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। তিউনিসিয়ায় যে আরব-বসন্তের সূচনা হয়েছিল, সেখানে আজ ক্ষমতায় রয়েছে অতীতে নিষিদ্ধ, উদারপন্থী ইসলামিক পার্টি ইন্নাহদা। সেই ‘ইন্নাহদা’ দলের মুনসেফ মারজুকি আজ তিউনিসিয়ার রাষ্ট্রপতি। তবে মিসর হচ্ছে আরব বিশ্বের বৃহত্তম এবং সবচেয়ে প্রভাবশালী দেশ। অতএব, মিসরের বিবর্তন আরব বিশ্বকে নাড়া দেবেই। মোদ্দা কথা হলো, আরব বিশ্বে এখন সাধারণ জনগণের কণ্ঠধ্বনি সেই অঞ্চলের শাসকদের মধ্যে আগের চেয়েও অনেক জোরে ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হবে।
তবে মিসরে একটি সুষ্ঠু রাষ্ট্রপতি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে, সেই কথা যেমন সত্যি, তেমনি সত্যি এই কথাটিও যে সেই দেশ এখনো গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা থেকে অনেক দূরেই রয়েছে। সে ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতি মুরসির সামনে রয়েছে বিরাট দুটি চ্যালেঞ্জ। তার প্রথমটি অবশ্যই হলো মিসরের সব সম্প্রদায় ও গোষ্ঠীর কাছে তাঁর গ্রহণযোগ্যতা নিশ্চিত করা। দ্বিতীয় এবং বোধ করি তার চেয়েও দুরূহ কাজ হবে সামরিক জান্তা, যা SCAF (Supreme Command of the Armed Forces) বলে পরিচিত, তাদের ক্ষমতা খর্ব করে দেশকে গণতন্ত্রের পথে পরিচালনা করা। বর্তমানে দেশের সংবিধান রচনা এবং সংসদ নির্বাচন থেকে শুরু করে বেসামরিক প্রশাসনের অনেক কিছুই SCAF-এর হাতে রয়েছে। তার জন্য প্রয়োজন হবে অপরিসীম ধৈর্য আর সুদীর্ঘ আলোচনার প্রক্রিয়া। তবে এই ক্ষেত্রে প্রেসিডেন্ট মুরসিকে দেশের জনগণের সমর্থন সুচিন্তিতভাবে আদায় করে নিতে হবে। মিসরে যে সংবিধান রচিত হতে যাচ্ছে, একমাত্র তা-ই জনগণের সার্বভৌমত্বের নিশ্চয়তা দিতে পারে। প্রতিটি প্রশ্নে তাহরির স্কয়ারের গণ-আন্দোলন তার বিকল্প ব্যবস্থা হতে পারে না। ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক মোহাম্মদ মুরসির জন্য বিরাট একটি চ্যালেঞ্জ হয়ে রইবে। প্রেসিডেন্ট মুরসি অবশ্য ঘোষণা করেছেন যে তাঁর সরকার সব আন্তর্জাতিক ঘোষণা মেনে চলবে, যার মধ্যে ১৯৭৯ সালের ক্যাম্প ডেভিড চুক্তি অবশ্যই অন্তর্ভুক্ত।
এটা বলা যায় যে মিসরে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন আমাদের সমসাময়িক ইতিহাসে বার্লিন দেয়াল ভাঙা অথবা নেলসন ম্যান্ডেলার মুক্তির মতোই তাৎপর্যপূর্ণ একটি ঘোষণা। যদি মিসর নিজেকে মূলত একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র বলে প্রতিষ্ঠিত করতে পারে, তাহলে তা একদিন স্বৈরশাসিত আরব দেশগুলোর আদল বদলে দেবেই। নানাভাবে তার বহিঃপ্রকাশ ঘটতে পারে সেই সব দেশের আর্থসামাজিক আর রাজনৈতিক অবস্থার ওপর। তা নাড়িয়ে তুলতে পারে সেই সব সমাজের ঘুণে ধরা সব ভিত্তি। আর এই আরব সুনামির পরিণতিও হতে পারে কল্পনাতীত ও সুদূরপ্রসারী। হয়তো বা তা ফিলিস্তিন সমস্যার স্থায়ী সমাধানে সহায়ক হবে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৯৩০ সালে জুইস স্ট্যান্ডার্ড নামের একটি পত্রিকার সাংবাদিকদের কাছে অত্যন্ত স্পষ্ট ভাষায় ফিলিস্তিন সমস্যা সমাধানে তাঁর চিন্তা ব্যক্ত করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ‘ফিলিস্তিন সমস্যার স্থায়ী সমাধান লন্ডনে বসে হবে না, তা ফিলিস্তিনেই অর্জন করতে হবে।’ রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, ‘আরব ইহুদি সহযোগিতা ও সহমর্মিতা ছাড়া ইহুদিদের আবাসভূমি (শান্তিপূর্ণ) প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়। ফিলিস্তিনে এই উদ্যোগের সাফল্য আসতে পারে শুধু আরব ও ইহুদিদের মধ্যে প্রত্যক্ষ যোগাযোগ ও সহযোগিতার ভিত্তিতে।’ কয়েকটি দশক ধরে সাম্রাজ্যবাদসৃষ্ট স্বৈরাচারী আরব সরকারগুলো পাশ্চাত্যের আজ্ঞাবাহী রয়েছে। একটি গণতান্ত্রিক আরব বিশ্ব এবং ইসরায়েল তাদের পারস্পরিক স্বার্থেই ভবিষ্যতে সেই অঞ্চলে শান্তি প্রতিষ্ঠায় ব্রতী হতে পারে। তা অবশ্যই সময়সাপেক্ষ। তবে একটি গণতান্ত্রিক মিসর তার সনাতন ঐতিহ্য নিয়ে মধ্যপ্রাচ্যে একটি ইতিবাচক ভূমিকা অবশ্যই পালন করতে পারবে; সেই অঞ্চলে শান্তি প্রতিষ্ঠায় রাখতে পারবে গুরুত্বপূর্ণ অবদান।
ফারুক চৌধুরী: সাবেক পররাষ্ট্রসচিব। কলাম লেখক।
zaaf@bdmail.net
No comments