সবুজ সুইডেনে by জাহীদ রেজা নূর

যাত্রার আগে ভেবেছিলাম, ও, সুইডেন, মানে ইউরোপ? তাহলে তো ছয়-সাত ঘণ্টার বিমান-ভ্রমণ। কিন্তু ই-টিকিটের দিকে তাকিয়ে চক্ষু চড়কগাছ! ঢাকা থেকে কাতারের রাজধানী দোহা পাঁচ ঘণ্টা; দুই ঘণ্টা দোহা বিমানবন্দরে ট্রানজিট যাত্রী হিসেবে বসে থাকা, তারপর আবার ছয় ঘণ্টার বিমান-ভ্রমণ আমাকে সুইডেনের আরলান্ডা বিমানবন্দরে পৌঁছে দেবে।


আর যাত্রার সময়টায় ঘড়ি যে বাঁদরামি করবে, তা-ও নিশ্চিত হলাম, অর্থাৎ দোহায় গেলেই বাংলাদেশ সময় থেকে বিয়োগ হবে দুই ঘণ্টা, স্টকহোমে সেটা গিয়ে দাঁড়াবে চার ঘণ্টায়। ঢাকায় যখন সকাল ১০টা, স্টকহোমে তখন ভোর ছয়টা।
সুইডিশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আমন্ত্রণে আট দেশ থেকে আটজন সাংবাদিক স্টকহোমে এসেছেন পরিবেশসচেতনতা নিয়ে হাতে-কলমে কিছু শিখতে। তালিকা দেখেই বুঝেছি তুরস্ককে ইউরেশিয়ার দেশ ধরে নিলে এশিয়া থেকে শুধু আমিই। বাকিরা কানাডা, হাঙ্গেরি, লাতভিয়া, পোল্যান্ড, গ্রিস আর মেক্সিকোর অধিবাসী।
ঢাকা থেকে দোহারপথে বাঙালি যাত্রীদেরই আধিক্য, কিন্তু দোহা থেকে স্টকহোমের বেশির ভাগ যাত্রীই ইউরোপীয়। কাতার এয়ারওয়েজের সুপরিসর এয়ারবাসে তিনটি সারিতে আটটি করে আসন। দুই, চার, দুই—এই হলো আসনবিন্যাস। যাওয়া-আসার চার ভ্রমণেই আমি জানালা থেকে এক আসন ডানে।

২.
কীভাবে কোথায় যেতে হবে, তার দিক-নির্দেশনা দেওয়াই ছিল। আরলান্ডা বিমানবন্দরে নেমে ইমিগ্রেশন অফিসারের সামনে যেতেই শুনি, পাশের অফিসার একজন যাত্রীকে প্রশ্ন করছেন রুশ ভাষায়। অবাক হলাম। আমার সামনের তরুণী অফিসারকে ইংরেজিতেই জিজ্ঞাসা করলাম, ‘এখানে রুশ ভাষায়ও কথা বলা হয় দেখছি! রুশে কথা বললে আমারও সুবিধা হয়।’
নিখুঁত রুশ উচ্চারণে তরুণী বললেন, ‘আমিও মস্কোতে পড়াশোনা করেছি।’
পরবর্তী কথোপকথন সহজ হয়ে গেল। পাসপোর্টে সিল পড়তে সময় লাগল না।
এখান থেকে ট্রেনে করে যেতে হবে স্টকহোম। মাত্র ২০ মিনিটের যাত্রা। কিছুক্ষণ পরপরই ট্রেন আছে। ভিড় নেই বললেই চলে। সুইডেনে নেমেই বিভিন্ন বিলবোর্ডে ‘গ্রিন’ শব্দটি বারবার চোখে পড়ছিল। পরিবেশ রক্ষার জন্য কী কী করছে ওরা, তার যেন একটা প্রদর্শনীই চলছে গোটা স্টকহোমে।
হোটেল রেইজেন পর্যন্ত যে সবুজ ট্যাক্সিতে (সবুজ মানে হলো প্রাকৃতিক গ্যাস বা ইথানলে যে গাড়ি চলে) আমার যাত্রা, এটার চালক একজন ইরাকি। এখন যদিও সুইডেনের নাগরিক। আমার চামড়ার রং দেখে আলাপ জমালেন। জানিয়ে দিলেন, নিজ দেশে অস্থিরতা থাকায় ৩৫ বছর ধরে এ দেশে থাকছেন। দেশের অবস্থা ভালো হলে আর এখানে থাকবেন না।
‘এই দেশ ভালো লাগে না?’
‘দেশটা ভালো। কিন্তু এখানে বয়স্কদের ভুলে যায় তরুণেরা। বয়স্কদের কষ্ট দেখে আমার সহ্য হয় না।’ তারপর বিড়বিড় করে বলেন, ‘আমিও তো বৃদ্ধ হব? নিজের দেশে যে সম্মান পাওয়া যাবে, সেটা এখানে পাওয়া যাবে না।’
হোটেল রেইজেনে একটি খাম, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে ইয়ান রেখে গেছেন। সঙ্গে একটি চিরকুট, প্রিয় জাহীদ, কাল সকাল আটটায় হোটেল লবিতে দেখা হবে। শুভ হোক সুইডেন-ভ্রমণ।

৩.
খেতে হবে কিছু। পকেটে সুইডিশ ক্রোনার নেই। ডলার ভাঙাতে হবে। হোটেলের অভ্যর্থনাকারী মেয়েটাই হাতে ধরিয়ে দিলেন একটি ম্যাপ আর বুঝিয়ে দিলেন, কোথায় গেলে মিলবে ক্রোনারের সন্ধান।

৪.
রাস্তাগুলো দেখলে মন ভরে যায়। ট্রাফিক ব্যবস্থায় কোনো খুঁত নেই। লাল বাতি জ্বললেই থেমে যাচ্ছে গাড়ি। পথচারীরা নির্বিঘ্নে রাস্তা পার হচ্ছেন। অসংখ্য সাইকেল চলছে একেবারে ডানদিকের লেইন ঘেঁষে। হাঁটছেও অসংখ্য মানুষ। কিছু যদি ফেলতে হয়, তবে ফেলছে নির্দিষ্ট স্থানে। রাস্তায় কোনো ময়লা ফেলতে দেখিনি কাউকে। হোটেলের সামনেই নদী। জেটি থেকে ছোট-বড় জাহাজ যাচ্ছে গন্তব্যে। এক ঘণ্টা, দুই ঘণ্টার জন্য ক্রুইজও আছে এক ঘণ্টা পর পর।
আমরা আট সাংবাদিক আর সুইডিশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধি ইয়ান সফরের পাঁচ দিন একসঙ্গে থাকতে থাকতে বড় আপন হয়ে গেলাম। স্টকহোম আর মালমো শহরে কাটানো এ সময়টাতে বর্জ্যব্যবস্থাপনা, যোগাযোগব্যবস্থা, পরিবেশবান্ধব বাড়ি, রেস্তোরাঁ ইত্যাদি দেখলাম। ২০৩০ ও ২০৫০ সাল দুটিকে লক্ষ্য হিসেবে নিয়ে পরিবেশ বাঁচানোর আন্দোলনে কীভাবে সংযুক্ত হচ্ছে সুইডেন, তা জানাল।
মালমোতে একটা ঘটনার কথা মনে করে এখনো হাসি পায়। যোগাযোগব্যবস্থা উন্নত করার জন্য আরও কী কী পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে, সেটা বলছিলেন মালমো নগর উন্নয়ন বোর্ডের রুসলান নিলসন। পোল্যান্ডের সিজারো রুশ ভাষায় বললেন, ‘কারও টাকা থাকলে কীভাবে খরচ করবে, তা ভেবে পায় না। আমাদের দেশের মতো দেশ হলে বুঝত, টাকা খরচ করার কত জায়গা আছে।’
নিলসন কথা বলতে বলতেই বললেন, ‘আমি রুশ ভাষা বুঝি!’
সিজারোর মুখ চুন।
যে দোকানগুলোয় যাওয়ার সুযোগ ঘটেছিল, তাতে পরিবেশবান্ধব পণ্য ও খাদ্যের সমাহার দেখা গেল। সুইডিশ নারী-পুরুষের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে দেখেছি, তাঁরা আগ্রহ নিয়েই সহযোগিতা করেন।

৫.
মালমো শহরের পাশেই বাল্টিক সাগর। সেই সাগরের ওপরে সেতু। মালমো থেকে প্রতি ২০ মিনিট পর পর ট্রেন যায় সাগর পেরিয়ে ডেনমার্কের রাজধানী কোপেনহেগেনে। পৌঁছুতে লাগে ঘড়ি ধরে ২০ মিনিট। আমরা সবাই সাগরের পাড়ে দাঁড়িয়ে একটু কি অন্যরকম হয়ে যাই? আমরা কি যে যার দেশের সমুদ্রের কথা মনে করি? মনে করি, সাগরের মতো উদার হতে পারলে পরিবেশ নষ্টকারীদের হাত থেকে রক্ষা পাওয়া যেত?

No comments

Powered by Blogger.