সময় বাড়ল না, ৩৫৬ পরিচালকের পদ শূন্য
ন্যূনতম শেয়ার ধারণে ব্যর্থ পরিচালকদের পদ কার্যত শূন্য ঘোষণা করেছে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (এসইসি)। একই সঙ্গে কমিশন যেসব পরিচালকের পদ শূন্য হয়েছে, তাঁদের পূর্ণাঙ্গ তালিকা পাঠানোর জন্য কোম্পানিগুলোকে নির্দেশ দিয়েছে। গতকাল মঙ্গলবার কমিশনের সভায় এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
সভাশেষে এসইসির এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে আগামী ১৫ জুলাইয়ের মধ্যে কমিশনের কাছে এই তালিকা পাঠাতে বলা হয়।
গত বছরের ২২ নভেম্বর এসইসির দেওয়া নির্দেশনা অনুযায়ী, যেসব কোম্পানির পরিচালকেরা নিজ নিজ কোম্পানির ন্যূনতম ২ শতাংশ শেয়ার ধারণে ব্যর্থ হয়েছে কার্যত তাঁদের পদই শূন্য হয়ে গেল। তবে স্বতন্ত্র ও মনোনীত পরিচালকদের এ নির্দেশনার বাইরে রাখা হয়। এসইসির ওই নির্দেশনায় আরও বলা হয়েছিল, এখন থেকে কোম্পানির উদ্যোক্তা-পরিচালকদের সম্মিলিতভাবে সব সময় কোম্পানির ৩০ শতাংশ শেয়ার ধারণ করতে হবে।
ওই নির্দেশনা পরিপালনের জন্য এসইসি ছয় মাস সময় বেঁধে দেয়, যা গত ২১ মে শেষ হয়েছে। কিন্তু বিষয়টি নিয়ে কোম্পানির পরিচালকেরা দুই দফা আদালতে রিট করেন। ফলে নির্ধারিত সময় পেরিয়ে গেলেও এত দিন এসইসি নির্দেশনাটি বাস্তবায়নের বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত নেয়নি। আইনি জটিলতার আপাতত সমাধানের পর গতকাল এসইসি ন্যূনতম শেয়ার ধারণসংক্রান্ত নির্দেশনা পরিপালনের সিদ্ধান্ত নেয়।
সর্বশেষ ২১ জুন উচ্চ আদালত এসইসির ২সিসি ক্ষমতা চ্যালেঞ্জ করে দায়ের করা পাঁচটি রিট আবেদন খারিজ করে দেন। এর আগে গত ২১ মে ন্যূনতম শেয়ার ধারণসংক্রান্ত এসইসির নির্দেশনার বিরুদ্ধে দায়ের করা একাধিক রিট আদালত খারিজ করে দেন।
এদিকে গত ২১ মের পর দেশের প্রধান শেয়ারবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই) কর্তৃপক্ষ তালিকাভুক্ত ২৩১ কোম্পানির কাছ থেকে প্রাথমিকভাবে সংগ্রহ করা তথ্য অনুযায়ী, এসব কোম্পানির প্রায় ৩৫৬ জন পরিচালককে পদ হারাতে হবে। তবে প্রাথমিকভাবে সংগ্রহ করা ডিএসইর এ তথ্যে কিছুটা হেরফের হতে পারে বলে সংস্থাটির সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান।
ন্যূনতম শেয়ার ধারণসংক্রান্ত নির্দেশনার কারণে কতজন পরিচালককে পদ ছাড়তে হবে তার চূড়ান্ত সংখ্যা জানতে আরও কিছুদিন সময় লাগবে। কারণ এ তথ্য চেয়ে এসইসি কোম্পানিগুলোর কাছে চিঠি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। পাশাপাশি দুই স্টক এক্সচেঞ্জকেও বিস্তারিত তথ্য কমিশনের কাছে জমা দিতে বলা হয়েছে। আগামী ১৫ জুলাইয়ের মধ্যে এসব তথ্য এসইসির হাতে আসবে। তারপরই চূড়ান্ত সংখ্যা জানা যাবে।
এ ছাড়া ন্যূনতম শেয়ার ধারণে ব্যর্থ পরিচালকদের পদ শূন্য হওয়া এবং এ সংক্রান্ত নির্দেশনা পরিপালনে তালিকাভুক্ত কোম্পানির উদ্যোক্তাদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব পাবলিকলি লিস্টেড কোম্পানিজের (বিএপিএলসি) সহযোগিতা চেয়েছে এসইসি। গতকালের সভায় এ সহযোগিতা চেয়ে বিএপিএলসিকে চিঠি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। একই সঙ্গে যেসব উদ্যোক্তা পরিচালক ন্যূনতম শেয়ার ধারণের সময় বাড়ানোর জন্য এসইসির কাছে আবেদন করেছিলেন, তাঁদের আবেদনও নাকচ করে দিয়েছে সংস্থাটি। ফলে যেসব কোম্পানির পরিচালকদের হাতে নিজ নিজ কোম্পানির ২ শতাংশের কম শেয়ার রয়েছে, তাঁদের পদ ছাড়তেই হচ্ছে।
ডিএসইর প্রাথমিক তথ্য অনুযায়ী, ২৩১ কোম্পানির মোট পরিচালকের সংখ্যা ছিল দুই হাজার ৩০৭ জন। এর মধ্যে স্বতন্ত্র বা স্বাধীন পরিচালকের সংখ্যা ৯৭৭ জন। এই ৯৭৭ জনকে বাদ দিলে মোট এক হাজার ৩৩০ জন পরিচালকের জন্য ২ শতাংশ শেয়ার কেনার বাধ্যবাধকতাটি প্রযোজ্য ছিল। কিন্তু এদের মধ্যে বেঁধে দেওয়া সময়সীমার মধ্যে নির্দিষ্ট পরিমাণ শেয়ার কিনেছেন ৯৭৪ জন পরিচালক। বাকি ৩৫৬ জন পরিচালক ২ শতাংশ শেয়ার ধারণের শর্ত পরিপালনে ব্যর্থ হন।
অভিমত: পুঁজিবাজার বিশেষজ্ঞ ও এসইসির সাবেক চেয়ারম্যান ফারুক আহমেদ সিদ্দিকী প্রথম আলোকে বলেন, দেশের ইতিহাসে এ ধরনের ঘটনা বিরল। একসঙ্গে এতজন পরিচালকের পদ হারানোর বিষয়টি নিঃসন্দেহে অনেক বড় একটি ঘটনা। যেহেতু উচ্চ আদালতও এসইসির পক্ষে রায় দিয়েছেন, সেহেতু এখন পরিচালকদের পদ থেকে সরে যাওয়া ছাড়া আর কোনো বিকল্প নেই। তবে এ কারণে কোম্পানিগুলোর মধ্যে কী ধরনের প্রভাব পড়বে, তা জানতে অপেক্ষা করতে হবে।
ফারুক আহমেদ সিদ্দিকী আরও বলেন, সাময়িকভাবে কিছু কোম্পানিতে অস্থিরতা তৈরি হতে পারে। কিন্তু দীর্ঘ মেয়াদে এই অস্থিরতা থাকার কোনো কারণ নেই।
ডিএসইর তথ্য: ব্যাংকিং খাতের কোম্পানিগুলোর মধ্যে সোস্যাল ইসলামী ব্যাংকের ১৮ জন পরিচালকের মধ্যে ১৫ জনেরই হাতে ২ শতাংশের কম শেয়ার রয়েছে। সেই হিসাবে কার্যত এই ১৫ জন পরিচালকের পদ শূন্য হয়ে গেছে। এ ছাড়া ব্যাংকিং খাতের অন্যান্য কোম্পানির মধ্যে উত্তরা ব্যাংকের সাতজন, ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংকের ১১ জন, স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকের তিনজন, সাউথইস্ট ব্যাংকের সাতজন, মার্কেন্টাইল ব্যাংকের ১১ জন, মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের তিনজন, এনসিসি ব্যাংকের ছয়জন, ন্যাশনাল ব্যাংকের দুজন, যমুনা ব্যাংকের তিনজন, আইএফআইসি ব্যাংকের দুজন, ইসলামী ব্যাংকের পাঁচজন, এক্সিম ব্যাংকের আটজন, ঢাকা ব্যাংকের তিনজন পরিচালকের পদ ইতিমধ্যে শূন্য হয়ে গেছে।
একাধিক ব্যাংকের শীর্ষস্থানীয় নির্বাহীদের সঙ্গে যোগাযোগ করে জানা গেছে, ইতিমধ্যে বেশকিছু ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ নতুনভাবে গঠন করা হয়েছে। যাঁদের ২ শতাংশের কম শেয়ার ছিল, তাঁদের পরিচালক পদ থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে। আবার কোনো কোনো ব্যাংক বিভিন্ন ক্যাটাগরির পরিচালক মনোনয়নের মাধ্যমে বিষয়টির সমাধান করেছে।
যোগাযোগ করা হলে মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আনিস এ খান প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের ব্যাংকের যেসব পরিচালকের ২ শতাংশের কম শেয়ার ছিল, ইতিমধ্যে তাঁদের বাদ দিয়ে নতুনভাবে পরিচালনা পর্ষদ গঠন করা হয়েছে।’
ব্যাংকিং খাতের বাইরে বারাকাতউল্লাহ ইলেকট্রো ডায়নামিকের ১৪ জন, বে লিজিংয়ের পাঁচজন, গ্লোবাল ইনস্যুরেন্সের ছয়জন, ইসলামী ও জনতা ইনস্যুরেন্সের নয়জন করে মোট ১৮ জন, কর্ণফুলী ইনস্যুরেন্সের পাঁচজন, কেয়া কসমেটিকসের তিনজন, ন্যাশনাল লাইফ ইনস্যুরেন্সের নয়জন, পিপলস ইনস্যুরেন্সের নয়জন, পপুলার লাইফ ইনস্যুরেন্সের আটজন, প্রগতি লাইফ ইনস্যুরেন্সের পাঁচজন, প্রাইম ইসলামী লাইফের চারজন, প্রাইম টেক্সটাইলের চারজন, প্রভাতী ইনস্যুরেন্সের পাঁচজন, পূরবী জেনারেল ইনস্যুরেন্সের তিনজন, আরএন স্পিনিংয়ের তিনজন, রংপুর ডেইরি ফুডের চারজন, রূপালী লাইফ ইনস্যুরেন্সের পাঁচজন, সালভো কেমিক্যালের পাঁচজন, ইউনাইটেড এয়ারের ১৪ জন, তাকাফুল ইনস্যুরেন্সের ছয়জন, ইউনিয়ন ক্যাপিটালের পাঁচজন, স্কয়ার টেক্সটাইলের তিনজন এবং জাহিন টেক্সটাইলের তিনজন পরিচালকের পদ কার্যত শূন্য হয়ে গেছে।
যোগাযোগ করা হলে ইউনাইটেড এয়ারের শেয়ার বিভাগের ম্যানেজার অলিউর রহমান বলেন, ‘আমাদের ১৭ জন পরিচালকের মধ্যে ১৪ জন পরিচালকের শেয়ার ২ শতাংশের কম।’ সেই হিসাবে কোম্পানিটির ১৪ পরিচালকের পদ ইতিমধ্যে শূন্য হয়ে গেছে। ফলে কোম্পানির পরিচালক এখন তিনজন। যদিও ২ শতাংশের কম শেয়ারধারী পরিচালককে বাদ দেওয়া হয়নি।
No comments