রোহিঙ্গা-রাখাইন দাঙ্গা এবং বাংলাদেশের নিরাপত্তা কৌশল by মুহাম্মদ রুহুল আমীন
প্রায় তিন দশকের পুরনো সমস্যা বাংলাদেশে রোহিঙ্গা শরণার্থী ইস্যুটি সম্প্রতি বেশ জটিল, স্পর্শকাতর ও কূটনৈতিক বিশৃঙ্খলা নিয়ে বাংলাদেশের নিরাপত্তার প্রতি গুরুত্বপূর্ণ হুমকি হিসেবে আবির্ভূত হতে যাচ্ছে বলে অনুমিত হচ্ছে। জুনের প্রথম সপ্তাহব্যাপী মিয়ানমারের আরাকানের মুসলিম রোহিঙ্গা ও বৌদ্ধ রাখাইন সম্প্রদায়ের মধ্যকার রক্তাক্ত
সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা দমনে মিয়ানমার সরকার আরাকান প্রদেশে সেনা মোতায়েন, সান্ধ্য আইন জারি ও অন্যান্য প্রাদেশিক আইন-কানুন চালু করলেও প্রতিদিন অসংখ্য রোহিঙ্গা শরণার্থী নাফ নদী পার হয়ে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করছে। জুনের প্রথম সপ্তাহেই মংডু শহরের ডা. নাজিমুদ্দীন ও ডা. নূরুল হক নামের দুজন জনপ্রিয় রোহিঙ্গা নেতাসহ অর্ধশতাধিক মুসলিমকে হত্যা করা হয়েছে। প্রাণভয়ে রাত-দিন রোহিঙ্গারা পালানোর নিরাপদ স্থান হিসেবে বাংলাদেশকে বেছে নিয়েছে। কিন্তু তাদের অনুপ্রবেশে বাঁধা দিচ্ছে বাংলাদেশ। তবে রোহিঙ্গাদের আশ্রয়দানে কূটনৈতিক চাপ বাংলাদেশের নিরাপত্তার বিষয়টিকে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনার বিষয়ে পরিণত করছে।
রোহিঙ্গা রাখাইন বিরোধ মিয়ানমারের নতুন ইস্যু নয়, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় এবং নব্বই দশকের শুরুতে এদের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় বহু হতাহতের ঘটনা ঘটেছে। আরাকানের প্রায় সাত লাখ রোহিঙ্গা চরম অবহেলার শিকার তিনটি কারণে। প্রথমত, তারা ধর্মগতভাবে মুসলিম হওয়ায় সংখ্যাগুরু বৌদ্ধদের ধর্মীয় নির্যাতনের শিকার হয়ে আসছে। দ্বিতীয়ত, বাংলা উপ-ভাষায় কথা বলার কারণে তাদের বাংলাদেশি উদ্বাস্তু হিসেবে বিবেচিত করা হয়, ফলে ভাষাগত বৈষম্যের শিকারও তারা। তৃতীয়ত, রোহিঙ্গা মুসলিমদের নাগরিকত্ব ও সাংবিধানিক স্বীকৃতিতে স্পষ্ট হয়নি। ১৯৮২ সালে চালু হওয়া একটি আইনে বলা হয়েছে, নাগরিকত্বের স্বীকৃতির জন্য রোহিঙ্গাদের প্রমাণ করতে হবে যে, তারা ১৮২৩ সালের ইংরেজ বর্মী যুদ্ধের আগে মিয়ানমারে বসবাস করত। চতুর্থত, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা ও সরকারি-বেসরকারি চাকরি ক্ষেত্রে সংখ্যালঘুতার অভিশাপে রোহিঙ্গারা সীমাহীন বঞ্চনা ভোগ করছে। পঞ্চমত, সংখ্যালঘু মুসলিম হওয়ার কারণে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন অজুহাতে তাদের মিয়ানমার ত্যাগে বাধ্য করা হয়। যাতে সমূলে রোহিঙ্গা নিধনযজ্ঞ (ethnic cleansing) সম্পন্ন করা যায়। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, আরাকানের মোট ২০ লাখ রোহিঙ্গা মুসলিমের দুই-তৃতীয়াংশই বিদেশে অবস্থান করছে। এদের মধ্যে তিন লাখ বাংলাদেশে, ১০ লাখ মধ্যপ্রাচ্যে এবং বাকি সাড়ে ৭ লাখ আরাকানে বসবাস করছে।
সাম্প্রতিককালে সৃষ্ট রোহিঙ্গা ইস্যুটি মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি এবং অত্রাঞ্চলের দাতাগোষ্ঠীসহ কূটনৈতিক মহলের নানা হিসাব-নিকাশের ফল, যার খেসারত দিতে হচ্ছে কেবল বাংলাদেশকে। প্রথমত, গণতান্ত্রিক সংস্কারের স্বীকৃতিস্বরূপ মিয়ানমারের ওপর থেকে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় বিধিনিষেধ ও অবরোধ তুলে নিচ্ছে। ফলে মিয়ানমারের গণতন্ত্রায়নের গতি বেগবান হচ্ছে, যার ফলে কায়েমি স্বার্থবাদী গোষ্ঠী হুমকি হিসেবে বিবেচনা করছে। মিয়ানমারবিষয়ক বিশেষজ্ঞ এবং 'গ্রেড গেইম ইস্ট' বইয়ের লেখক বার্টিল লিন্টার বলেন, সু চির নেতৃত্বে যে পরিবর্তন এসেছে সরকার সে ব্যাপারে খুবই উদ্বিগ্ন। রোহিঙ্গাদের সমর্থন দিয়ে বৌদ্ধদের সমর্থন হারাবেন এমন একটি বিব্রতকর পরিস্থিতিতে সু চিকে ঠেলে দিতে চায় সরকার। তিনি যদি নীরব থাকেন, তাহলে মানবাধিকার প্রশ্নে সু চির ভূমিকা হবে প্রশ্নবিদ্ধ। এ দ্বিমুখী সিদ্ধান্ত সংকটে সু চিকে নিক্ষিপ্ত করার কৌশল হিসেবে রোহিঙ্গা ইস্যুটি বেগবান করা হচ্ছে। দ্বিতীয়ত, মিয়ানমারের অন্যান্য নৃতাত্তি্বক গোষ্ঠীগুলোর ওপর সেনাবাহিনীর নিপীড়নের যে করুণ চিত্র ফুটে উঠেছে, তা চাপা দিতে রোহিঙ্গা রাখাইন অস্থিতিশীলতার সৃষ্টি করা হচ্ছে। লন্ডন স্কুল অব ইকনোমিক্সের ভিজিটিং ফেলো মং জার্নি মনে করেন, রাখাইনে দাঙ্গার কারণে সরকার বিভিন্নভাবে লাভবান হচ্ছে। তৃতীয়ত, গত ৮ জুন শুক্রবার সু চির ইউরোপ সফর ও তাঁর নোবেল পুরস্কার গ্রহণ করার কথা। মিয়ানমারের জান্তা সরকার তাঁর সফর ব্যর্থ করতে অভ্যন্তরীণ অস্থিতিশীলতা সৃষ্টির চেষ্টা করছে। চতুর্থত, অত্রাঞ্চলের বিভিন্ন দাতাগোষ্ঠী এবং মানবাধিকার প্রতিষ্ঠান বিশেষত যারা বাংলাদেশ সীমান্তে কাজ করছে, তাদের অস্তিত্বের স্বার্থে, চাকরি ও আয়-রোজগারের স্বার্থে এবং বিশ্ব মিডিয়ায় নিজেদের খবরের শীর্ষস্থানে জায়গা করে নেওয়ার স্বার্থে মিয়ানমারের জাতিগত দাঙ্গা জিইয়ে রাখছে।
নিরাপত্তাহীনতার আধুনিক ধারা (non-traditional) নানাভাবে বাংলাদেশে হুমকি সৃষ্টি করছে। প্রথমত, বাংলাদেশের মতো জনসমুদ্রের একটি দেশে বাড়তি শরণার্থীর মাথা গোঁজার কোনো ঠাঁই নেই। উপচেপড়া শরণার্থীর মূল জনস্রোতে মিলিত হয়ে বিস্ফোরণোন্মুখ নিরাপত্তাহীনতা তৈরি করতে যাচ্ছে, যা অচিরেই বাংলাদেশে মৌলিক মানবিক বিপর্যয় ঘটাবে। দ্বিতীয়ত, পত্রিকার খবরে জানা যায়, রোহিঙ্গা শরণার্থীদের কাছে ইয়াবাসহ মারণাস্ত্র পাওয়া যাচ্ছে, যা সীমান্ত হয়ে শিগগিরই নদীমাতৃক বাংলাদেশের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়তে পারে, এবং বাংলাদেশে ভয়াবহ আইন-শৃঙ্খলার অবনতি হতে পারে। তৃতীয়ত, শরণার্থীদের জায়গা করে দেওয়ার জন্য পাহাড় কেটে আশ্রয়স্থল নির্মাণ করা হচ্ছে, যা ভয়াবহ পরিবেশ বিপর্যয় ডেকে আনবে এবং উপকূলের নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগ ঘটাতে সাহায্য করবে। চতুর্থত, রোহিঙ্গারা সহজেই মূল জনগোষ্ঠীর সঙ্গে মিশ্রিত হচ্ছে এবং বিভিন্ন পেশায় তারা কর্মরত হচ্ছে। এতে বেকারত্বের অভিশাপ ধেয়ে আসছে বাংলাদেশি নাগরিকদের জীবনে। পঞ্চমত, বিভিন্ন দাতাগোষ্ঠী এবং কূটনৈতিক মহল রোহিঙ্গা শরণার্থীদের আশ্রয়দানের জন্য বাংলাদেশের ওপর চাপ প্রয়োগ করছে। ফলে বাংলাদেশের সীমানায় নিয়োজিত প্রহরা শিথিল করতে কখনো কখনো বাংলাদেশ বাধ্য হচ্ছে। এতে সীমানা অরক্ষিত থাকছে যার ফলে অরক্ষিত সীমানায় নানা বিপর্যয়ের মুখে পড়ছে বাংলাদেশ।
এমতাবস্থায় বাংলাদেশের সরকার ও জনগণকে দেশের স্বার্থে একতাবদ্ধ হয়ে আশু সমস্যার সমাধান করতে হবে। প্রথমত, রোহিঙ্গা শরণার্থীরা মুসলমান হওয়ায় বাংলাদেশের সরকার ও জনগণের সহমর্মিতা পাচ্ছে, কিন্তু মনে রাখতে হবে এ সহযোগিতা যেন সীমানা এলাকার অসমাধানযোগ্য সমস্যা তৈরি না করে।
দ্বিতীয়ত, বিজিবিকে অত্যন্ত ধৈর্য ও বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে ইমান ও দেশাত্মবোধের চেতনায় প্রহরা পরিচালিত করতে হবে যেন কোনোভাবেই সীমানা সংঘর্ষের মতো ঘটনা না ঘটে। তৃতীয়ত, কূটনৈতিক পর্যায়ে বাংলাদেশকে অত্যন্ত সজাগ, সুচতুর ও দক্ষ নীতির প্রয়োগ করতে হবে। দাতাগোষ্ঠীর সঙ্গে ঘন ঘন মিটিং করে বাংলাদেশের নিরাপত্তা প্রেক্ষিত বিশ্লেষণ করা দরকার। মানবাধিকারকর্মী ও সংস্থা তথা দাতাগোষ্ঠীকে নিশ্চিত করতে হবে, রোহিঙ্গা-রাখাইন সংঘর্ষ মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ সমস্যা, বাংলাদেশের নয়। এ সমস্যা নিরসনে তারা যাতে মিয়ানমারের ওপরই কার্যকর চাপ অব্যাহত রাখে সে ব্যাপারে বাংলাদেশের কূটনৈতিক তৎপরতা জোরদার করতে হবে। এ ব্যাপারে বিভিন্ন বিখ্যাত ব্যক্তিবর্গকে শুভেচ্ছা দূত হিসেবে মিয়ানমারে পাঠানো যেতে পারে। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থায় বাংলাদেশের দাতা গোষ্ঠীর সঙ্গে ঘন ঘন আলাপ-আলোচনার আয়োজন করা দরকার।
লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
রোহিঙ্গা রাখাইন বিরোধ মিয়ানমারের নতুন ইস্যু নয়, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় এবং নব্বই দশকের শুরুতে এদের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় বহু হতাহতের ঘটনা ঘটেছে। আরাকানের প্রায় সাত লাখ রোহিঙ্গা চরম অবহেলার শিকার তিনটি কারণে। প্রথমত, তারা ধর্মগতভাবে মুসলিম হওয়ায় সংখ্যাগুরু বৌদ্ধদের ধর্মীয় নির্যাতনের শিকার হয়ে আসছে। দ্বিতীয়ত, বাংলা উপ-ভাষায় কথা বলার কারণে তাদের বাংলাদেশি উদ্বাস্তু হিসেবে বিবেচিত করা হয়, ফলে ভাষাগত বৈষম্যের শিকারও তারা। তৃতীয়ত, রোহিঙ্গা মুসলিমদের নাগরিকত্ব ও সাংবিধানিক স্বীকৃতিতে স্পষ্ট হয়নি। ১৯৮২ সালে চালু হওয়া একটি আইনে বলা হয়েছে, নাগরিকত্বের স্বীকৃতির জন্য রোহিঙ্গাদের প্রমাণ করতে হবে যে, তারা ১৮২৩ সালের ইংরেজ বর্মী যুদ্ধের আগে মিয়ানমারে বসবাস করত। চতুর্থত, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা ও সরকারি-বেসরকারি চাকরি ক্ষেত্রে সংখ্যালঘুতার অভিশাপে রোহিঙ্গারা সীমাহীন বঞ্চনা ভোগ করছে। পঞ্চমত, সংখ্যালঘু মুসলিম হওয়ার কারণে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন অজুহাতে তাদের মিয়ানমার ত্যাগে বাধ্য করা হয়। যাতে সমূলে রোহিঙ্গা নিধনযজ্ঞ (ethnic cleansing) সম্পন্ন করা যায়। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, আরাকানের মোট ২০ লাখ রোহিঙ্গা মুসলিমের দুই-তৃতীয়াংশই বিদেশে অবস্থান করছে। এদের মধ্যে তিন লাখ বাংলাদেশে, ১০ লাখ মধ্যপ্রাচ্যে এবং বাকি সাড়ে ৭ লাখ আরাকানে বসবাস করছে।
সাম্প্রতিককালে সৃষ্ট রোহিঙ্গা ইস্যুটি মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি এবং অত্রাঞ্চলের দাতাগোষ্ঠীসহ কূটনৈতিক মহলের নানা হিসাব-নিকাশের ফল, যার খেসারত দিতে হচ্ছে কেবল বাংলাদেশকে। প্রথমত, গণতান্ত্রিক সংস্কারের স্বীকৃতিস্বরূপ মিয়ানমারের ওপর থেকে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় বিধিনিষেধ ও অবরোধ তুলে নিচ্ছে। ফলে মিয়ানমারের গণতন্ত্রায়নের গতি বেগবান হচ্ছে, যার ফলে কায়েমি স্বার্থবাদী গোষ্ঠী হুমকি হিসেবে বিবেচনা করছে। মিয়ানমারবিষয়ক বিশেষজ্ঞ এবং 'গ্রেড গেইম ইস্ট' বইয়ের লেখক বার্টিল লিন্টার বলেন, সু চির নেতৃত্বে যে পরিবর্তন এসেছে সরকার সে ব্যাপারে খুবই উদ্বিগ্ন। রোহিঙ্গাদের সমর্থন দিয়ে বৌদ্ধদের সমর্থন হারাবেন এমন একটি বিব্রতকর পরিস্থিতিতে সু চিকে ঠেলে দিতে চায় সরকার। তিনি যদি নীরব থাকেন, তাহলে মানবাধিকার প্রশ্নে সু চির ভূমিকা হবে প্রশ্নবিদ্ধ। এ দ্বিমুখী সিদ্ধান্ত সংকটে সু চিকে নিক্ষিপ্ত করার কৌশল হিসেবে রোহিঙ্গা ইস্যুটি বেগবান করা হচ্ছে। দ্বিতীয়ত, মিয়ানমারের অন্যান্য নৃতাত্তি্বক গোষ্ঠীগুলোর ওপর সেনাবাহিনীর নিপীড়নের যে করুণ চিত্র ফুটে উঠেছে, তা চাপা দিতে রোহিঙ্গা রাখাইন অস্থিতিশীলতার সৃষ্টি করা হচ্ছে। লন্ডন স্কুল অব ইকনোমিক্সের ভিজিটিং ফেলো মং জার্নি মনে করেন, রাখাইনে দাঙ্গার কারণে সরকার বিভিন্নভাবে লাভবান হচ্ছে। তৃতীয়ত, গত ৮ জুন শুক্রবার সু চির ইউরোপ সফর ও তাঁর নোবেল পুরস্কার গ্রহণ করার কথা। মিয়ানমারের জান্তা সরকার তাঁর সফর ব্যর্থ করতে অভ্যন্তরীণ অস্থিতিশীলতা সৃষ্টির চেষ্টা করছে। চতুর্থত, অত্রাঞ্চলের বিভিন্ন দাতাগোষ্ঠী এবং মানবাধিকার প্রতিষ্ঠান বিশেষত যারা বাংলাদেশ সীমান্তে কাজ করছে, তাদের অস্তিত্বের স্বার্থে, চাকরি ও আয়-রোজগারের স্বার্থে এবং বিশ্ব মিডিয়ায় নিজেদের খবরের শীর্ষস্থানে জায়গা করে নেওয়ার স্বার্থে মিয়ানমারের জাতিগত দাঙ্গা জিইয়ে রাখছে।
নিরাপত্তাহীনতার আধুনিক ধারা (non-traditional) নানাভাবে বাংলাদেশে হুমকি সৃষ্টি করছে। প্রথমত, বাংলাদেশের মতো জনসমুদ্রের একটি দেশে বাড়তি শরণার্থীর মাথা গোঁজার কোনো ঠাঁই নেই। উপচেপড়া শরণার্থীর মূল জনস্রোতে মিলিত হয়ে বিস্ফোরণোন্মুখ নিরাপত্তাহীনতা তৈরি করতে যাচ্ছে, যা অচিরেই বাংলাদেশে মৌলিক মানবিক বিপর্যয় ঘটাবে। দ্বিতীয়ত, পত্রিকার খবরে জানা যায়, রোহিঙ্গা শরণার্থীদের কাছে ইয়াবাসহ মারণাস্ত্র পাওয়া যাচ্ছে, যা সীমান্ত হয়ে শিগগিরই নদীমাতৃক বাংলাদেশের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়তে পারে, এবং বাংলাদেশে ভয়াবহ আইন-শৃঙ্খলার অবনতি হতে পারে। তৃতীয়ত, শরণার্থীদের জায়গা করে দেওয়ার জন্য পাহাড় কেটে আশ্রয়স্থল নির্মাণ করা হচ্ছে, যা ভয়াবহ পরিবেশ বিপর্যয় ডেকে আনবে এবং উপকূলের নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগ ঘটাতে সাহায্য করবে। চতুর্থত, রোহিঙ্গারা সহজেই মূল জনগোষ্ঠীর সঙ্গে মিশ্রিত হচ্ছে এবং বিভিন্ন পেশায় তারা কর্মরত হচ্ছে। এতে বেকারত্বের অভিশাপ ধেয়ে আসছে বাংলাদেশি নাগরিকদের জীবনে। পঞ্চমত, বিভিন্ন দাতাগোষ্ঠী এবং কূটনৈতিক মহল রোহিঙ্গা শরণার্থীদের আশ্রয়দানের জন্য বাংলাদেশের ওপর চাপ প্রয়োগ করছে। ফলে বাংলাদেশের সীমানায় নিয়োজিত প্রহরা শিথিল করতে কখনো কখনো বাংলাদেশ বাধ্য হচ্ছে। এতে সীমানা অরক্ষিত থাকছে যার ফলে অরক্ষিত সীমানায় নানা বিপর্যয়ের মুখে পড়ছে বাংলাদেশ।
এমতাবস্থায় বাংলাদেশের সরকার ও জনগণকে দেশের স্বার্থে একতাবদ্ধ হয়ে আশু সমস্যার সমাধান করতে হবে। প্রথমত, রোহিঙ্গা শরণার্থীরা মুসলমান হওয়ায় বাংলাদেশের সরকার ও জনগণের সহমর্মিতা পাচ্ছে, কিন্তু মনে রাখতে হবে এ সহযোগিতা যেন সীমানা এলাকার অসমাধানযোগ্য সমস্যা তৈরি না করে।
দ্বিতীয়ত, বিজিবিকে অত্যন্ত ধৈর্য ও বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে ইমান ও দেশাত্মবোধের চেতনায় প্রহরা পরিচালিত করতে হবে যেন কোনোভাবেই সীমানা সংঘর্ষের মতো ঘটনা না ঘটে। তৃতীয়ত, কূটনৈতিক পর্যায়ে বাংলাদেশকে অত্যন্ত সজাগ, সুচতুর ও দক্ষ নীতির প্রয়োগ করতে হবে। দাতাগোষ্ঠীর সঙ্গে ঘন ঘন মিটিং করে বাংলাদেশের নিরাপত্তা প্রেক্ষিত বিশ্লেষণ করা দরকার। মানবাধিকারকর্মী ও সংস্থা তথা দাতাগোষ্ঠীকে নিশ্চিত করতে হবে, রোহিঙ্গা-রাখাইন সংঘর্ষ মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ সমস্যা, বাংলাদেশের নয়। এ সমস্যা নিরসনে তারা যাতে মিয়ানমারের ওপরই কার্যকর চাপ অব্যাহত রাখে সে ব্যাপারে বাংলাদেশের কূটনৈতিক তৎপরতা জোরদার করতে হবে। এ ব্যাপারে বিভিন্ন বিখ্যাত ব্যক্তিবর্গকে শুভেচ্ছা দূত হিসেবে মিয়ানমারে পাঠানো যেতে পারে। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থায় বাংলাদেশের দাতা গোষ্ঠীর সঙ্গে ঘন ঘন আলাপ-আলোচনার আয়োজন করা দরকার।
লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
No comments