উন্নয়ন-প্রলয়ঙ্করী সুনামি নিরিখে উন্নয়ন দর্শন by হিলাল ফয়েজী
কৃত্রিম উপগ্রহ এমন দৃশ্য দেখাবে, এমন অকৃত্রিম ভয়ঙ্করতা দেখার জন্য প্রস্তুত ছিলাম না। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপান ছাই হয়ে গিয়েছিল। কল্পকথার ফিনিক্স পাখি হয়ে গেল জাপান। পরিশ্রমে, মেধায়, বুদ্ধিতে, ধৈর্যে এবং অসীম সাহসে পুঁজিবাদী উন্নয়ন দর্শনে প্রবাহিত হয়ে জাপান অর্থনৈতিক দ্বিতীয় পরাশক্তিতে পরিণত হলো মাত্র কয়েক দশকে।
একপর্যায়ে খোদ মার্কিনি পণ্য পর্যন্ত জাপানি জনগণের কাছে মানসম্মত হিসেবে গ্রহণযোগ্য ছিল না। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অন্তিম সময়ে সামরিক দিক থেকে অপ্রয়োজনীয়ভাবে জাপানের ওপর দুটো আণবিক বোমা ফেলে নৃশংস ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, সে দেশের তদানীন্তন প্রেসিডেন্ট ট্রুম্যান বুঝি ওই বোমা ফাটিয়ে পৃথিবীকে এই 'ট্রুথ'টুকুই জানাতে চেয়েছিলেন, পৃথিবীর এক নম্বর পরাশক্তি হিসেবে 'ওহে আমরা এসেছি'। সে আণবিক বোমার তেজস্ক্রিয়তার প্রভাব এই ৬৫ বছর পরও সে অঞ্চলে বিদ্যমান। আজকের অত্যুন্নত জাপান এই ২০১১ সালের ১১ মার্চ মহাপ্রলয়ের পর ফের পারমাণবিক তেজস্ক্রিয়তার শিকার। সুনামির মহাপ্রলয়ের জেরে বিপর্যস্ত পারমাণবিক বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র থেকে এখন নিঃসরিত হচ্ছে মহাবিপদ।
পুঁজিবাদী বিশ্বের দ্বিতীয় শক্তিতে পরিণত হতে জাপান বলা যায় 'উন্নয়ন-উন্মাদ' হয়ে পড়েছিল। প্রয়োজন হয়েছিল তাদের বিপুল জ্বালানি, বিপুল বিদ্যুৎ; পারমাণবিক বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র হচ্ছে তার ব্যয়বহুল কিন্তু অপেক্ষাকৃত সহজ উৎস। ভূমিকম্পের প্রতিরোধ নকশা ওই পারমাণবিক কেন্দ্রগুলোতে নাকি যথেষ্ট ছিল। কিন্তু সমুদ্র উপকূলের ওই কেন্দ্রগুলো এমন ভয়াবহ সুনামির জন্য প্রস্তুত ছিল না। এমন উঁচু ঢেউ, এমন শক্তিশালী, ক্ষিপ্র আর দ্রুতগতির সুনামি কী ঘটাতে পারে কৃত্রিম উপগ্রহ আমাদের তা দেখিয়েছে। পৃথিবীর সব মহাদেশে এখন পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের বিরুদ্ধে তীব্র জনমত গড়ে উঠেছে। জার্মানির বিশাল মিছিল দেখেছি। থাইল্যান্ড এরই মাঝে ঘোষণা করে দিয়েছে : আমরা পরিকল্পিত সব পারমাণবিক তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র বাতিল করে দিলাম। আমাদের বাংলাদেশে এখন উন্নয়ন প্রয়োজনে প্রবল বিদ্যুৎ ক্ষুধা। এ ক্ষুধা মেটাতে কত রকম প্রস্তাব, উদ্যোগ, আয়োজন; ক্ষুধা মেটাতে ব্যাকুল পৃথিবীর নানা দেশের নানা কোম্পানি, নানা সুকৌশলে-প্রকৌশলে। পৃথিবীতে বড় বড় কোম্পানিগুলো মূলত বোঝে এবং খোঁজে তাদের মুনাফাসর্বস্ব রণনীতি-কৌশলের সার্থকতা। পৃথিবীব্যাপী তারা 'প্রয়োজন' খুঁজে বেড়ায়, গছিয়ে দেয় উন্নয়ন দর্শন। বুঝে, না বুঝে কিংবা আঁতাত-মৌতাতে আমরা সে উন্নয়ন দর্শনের ফাঁদে পা ফেলি পরিস্থিতির 'নগদ চাহিদা' মেটানোর নামে।
উন্নয়নের এই উন্মাদনা প্রবল থেকে প্রবলতর হয়ে উঠেছে বিশেষত ইউরোপে শিল্প-বিপ্লব পর্ব থেকে। এ উন্মাদনা পৃথিবীকে উপহার দিয়েছে আশ্চর্য সব উদ্ভাবন, যা আমাদের নগদ জীবনকে শুরুতে সহজ করে দিয়েছে। এই উন্নয়ন ধারা কিন্তু কখনোই প্রকৃতির সঙ্গে বল্পুব্দত্ব বজায় রাখার প্রশ্নটিকে আমলই দেয়নি। বরং প্রকৃতিকে ধ্বংস করে দ্রুত উন্নয়নের পথ ধরতেই তা ব্যাকুল ছিল এবং আছে। এ উন্নয়ন উন্মাদনায় অর্থনৈতিক পরাশক্তিতে উন্নীত হয়েছে পৃথিবীর কয়েকটি দেশ, 'জি-৮'-এর অভিজাত পঙ্ক্তিতে আজ তারা। জাপান যার অন্যতম।
এই উন্নয়ন ভূপৃষ্ঠের জমিনে বিশাল কারখানা আর অট্টালিকা নির্মাণ করতে সক্ষম হয়েছে। চোখ ধাঁধানো উজ্জ্বলতা। মহানগরী আর মহানগরী। আলিশান কত কিছু। ভোগের মহাভাণ্ডার। কিন্তু হালে জানতে পেরেছি এসবই নাকি গড়ে তুলছে মহাভাগাড়। উন্নয়নে ফুটো হয়ে গেছে আকাশ। বিপজ্জনক রশ্মি এসে নামছে পৃথিবীতে। নিঃসরিত কার্বনে পৃথিবী ভেতর থেকে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। 'জলবায়ু বিপর্যয়' পৃথিবীকে ক্রমেই একশেষ করে দিচ্ছে। উষ্ণতা বাড়ছে, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতাও বাড়ছে। বরফ গলছে। ফলে পৃথিবীতে প্রধান 'জলবায়ু বিপন্ন' দেশ হিসেবে আমাদের বাংলাদেশ শীর্ষে। জলবায়ু বিপর্যয় অবশেষে পৃথিবী আর প্রকৃতিকে কোথায় নেবে কে জানে! ভয়ঙ্কর ঘূর্ণিঝড়গুলো এখন সংখ্যায় এবং ভয়ঙ্করতায় বেড়েই চলেছে, ঘূর্ণিঝড়ের আঘাতও তীব্রতর হচ্ছে। রিটা, ক্যাটরিনা, নার্গিস, কী মিষ্টি মিষ্টি নাম! তা যত মিষ্টি নামেই ডাকুন, ওসব ডাকাবুকো ঘূর্ণিঝড়-দানব যে জনপদ-সভ্যতার সব লণ্ডভণ্ড করে দেয়।
একবিংশ শতাব্দীর প্রথম দশকে বাংলাদেশে টিপাইমুখ বাঁধ নিয়ে বেশ তর্ক-বিতর্ক-উত্তাপ সৃষ্টি হয়। এ বিষয়ে 'অঙ্গীকার বাংলাদেশ' সংগঠনের মধ্য দিয়ে কাজ করার সুযোগ হয়। দৃশ্যত টিপাইমুখ বাঁধ উন্নয়নের এক সৌধ স্তম্ভ হিসেবে ভারতের অত্যন্ত অনুন্নত জনপদ মনিপুরের জন্য এক বিশাল-বিস্ময় নির্মাণই হওয়ার কথা। পৃথিবীতে বড় বাঁধের মহাহুজুগ-হুল্লোড় চলছে। 'যেখানেই সুযোগ পাও, সেখানেই মেগা বাঁধ বানাও'_ হিড়িকে পৃথিবীতে এখন প্রায় ৫০ হাজারটি বড় বাঁধ নির্মিত হয়েছে। বড় বাঁধ মানে নূ্যনতম ১৫ মিটার তথা ৫০ ফুটের মতো উঁচু। পৃথিবীতে এখনি আরও ৫০ হাজার বাঁধ করার সুযোগ রয়েছে। এ বাঁধ বানানোর জন্য পৃথিবীতে রয়েছে এক মহাশক্তিশালী বাঁধ সিন্ডিকেট। গণচীন নিজের দেশে পৃথিবীর সর্ববৃহৎ বাঁধ, বৃহত্তম বাঁধ-জলাশয় তৈরি করে এক্ষেত্রে সর্বোচ্চ দক্ষতা ও কুশলতা অর্জন করেছে। তাদের হাতে আছে বিশ্বব্যাংককে চ্যালেঞ্জ জানানোর মতো পুঁজি। খবর নিয়ে দেখুন, আফ্রিকা ও ল্যাটিন আমেরিকায় কত বিশাল পুঁজি নিয়ে বাঁধসহ নানাবিধ প্রকৃতিবিধ্বংসী উন্নয়ন-যজ্ঞে ঝাঁপিয়ে পড়েছে গণচীন।
বাঁধ-টারবাইন-আয়রন-সিমেন্ট মহাজনদের এই বিশ্ব সিন্ডিকেটের নজরে উত্তর-পূর্ব ভারত এবং মনিপুরও। বিশেষত ব্রহ্মপুত্র নদকে কেন্দ্র করে এখন গণচীন আর ভারতের চলছে বাঁধ নির্মাণের তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ মহাআয়োজন। উৎস থেকে সমুদ্র পর্যন্ত ব্রহ্মপুত্রের প্রায় ২ হাজার কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের অংশ আছে গণচীনের তিব্বতে, ৯০০ কিলোমিটার ভারতে, ৩০০ কিলোমিটার বাংলাদেশে। গণচীন ব্রহ্মপুত্রের উৎসে পৃথিবীর সর্ববৃহৎ বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রের (৪০ হাজার মেগাওয়াট) বাঁধ তৈরি করছে, ব্রহ্মপুত্র থেকে বিপুল পানি সরিয়ে গণচীনের মরুভূমিকে সবুজ করার প্রকল্প তাদের হাতে অনেক দিন ধরেই। গণচীনের আগেই অরুণাচলে কয়েকটি বাঁধে ২৭ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ তৈরির প্রকল্প ভারত হাতে নিয়ে 'প্রথম ব্যবহারকারী'র সুবিধা নিতে ব্যাকুল। ভাটির আসাম এবং বাংলাদেশ ব্রহ্মপুত্র-নির্ভরশীল এক বিশাল অববাহিকা, পানি-তৃষ্ণার্ত। গণচীন ও ভারত উন্নয়ন-উন্মাদনার প্রতিযোগিতায় ভাটির আসাম এবং বাংলাদেশকে সর্বস্বান্ত করে দেবে।
টিপাইমুখ বাঁধ নিয়ে এ দেশের যেসব দক্ষিণপন্থি রণহুঙ্কার দিয়ে থাকে প্রায়ই তারা কিন্তু গণচীনের বাঁধ-অবরোধ প্রশ্নে একেবারে চুপচাপ। আবার টিপাইমুখ বাঁধ-উত্তাপের সময় একদল হঠাৎ গজানো পণ্ডিতকে দেখেছি, না, না, ও বাঁধে ক্ষতি হবে না। টিপাইমুখ বাঁধের যে নকশা করেছে, তাতে ভারত তাদের দেশের ২৭৭ কিলোমিটার বরাক নদীর দৈর্ঘ্যের অববাহিকার তথ্য-উপাত্তই ব্যবহার করছে বাকি বাংলাদেশের ৬৬৯ কিলোমিটার অভিন্ন মেঘনা নদীর তথ্য-উপাত্ত ওরা হিসাবেই নেয়নি। আমাদের ভালোমন্দের কথা ভাবাই হয়নি। ওদিকে বড় বাঁধের উজানে একরকম বিপদ, ভাটিতে অন্যরকম। বিশাল ভূমিকম্পে যদি বাঁধ-জলাশয় ভেঙে পড়ে তাহলে টিপাইমুখের নিচে অবস্থিত আসামের কাছাড় এবং বাংলাদেশের সিলেটের বিশাল অঞ্চল সুনামির মতো ভয়াবহ অবস্থার শিকার হবে। পর্দা-পণ্ডিত কথাকুশলী যেসব মহাজন বলেছেন, টিপাইমুখ বাঁধে কোনো ক্ষতি হবে না, তারা এখন নয়ন মেলে দেখুন জাপানি সুনামির পর্দার ভয়াবহ প্রকাশ। প্রতিটি বড় বাঁধের বড় জলাশয় ভূমিকম্পপ্রবণ অঞ্চলে প্রকৃতই এক একটি 'জলবোমা'... কখন কিসে যে কী হয়, কোন প্রলয় ঘটে কে জানে! তাই প্রশ্ন উঠবেই, আমরা কেমন করে নিশ্চিত হবো, না, ভূমিকম্পেও তেমন কিছু হবে না!
শুরুর কথায় আসি। পৃথিবীজুড়ে পারমাণবিক তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র বিরোধিতার শক্তি ক্রমেই জোরদার হয়ে চলেছে। আমাদের বাংলাদেশও রুশ সাহায্যে 'পারমাণবিক তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র' নির্মাণের প্রাক্-প্রস্তুতিতে অনেক দূর অগ্রসর হয়েছে। জাপানের বিপর্যয়ের পর আমাদের 'রূপপুর প্রকল্প' নিয়েও স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠবে। প্রশ্ন ওঠার আগেই আমাদের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ দেখি সবার আগে যথাদ্রুত এক সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করে বলে ফেলেছে, রূপপুর প্রকল্প চলবেই। ওখানে কখনোই 'সুনামি' হবে না, ১০ রিখটার স্কেলের ভূমিকম্প প্রতিরোধের ব্যবস্থা থাকবেই। অতএব মাভৈ! এগিয়ে যাও।
এত বড় বিপর্যয় ঘটল জাপানে, সারা পৃথিবীতে নতুন করে উন্নয়ন-দর্শন নিয়ে তর্ক-বিতর্ক উঠল। প্রকৃতি ধ্বংস করে যে উন্নয়ন, তা আখেরে আকাশ ফুটো করে সভ্যতার কপাল ফুটো করে দিচ্ছে, তবু কী 'দাঁড়াও পথিকবর' বলে 'তিষ্ঠ ক্ষণকাল' আবেদন জানানোটা বেমানান-বেসুরো হয়ে যাবে? মেগা-উন্নয়ন প্রকল্পের পশ্চাতে মেগা কোম্পানির লকলকে মুনাফা জিহ্বার বাস্তবতা বুঝে নিতে হবে আগে। সারা পৃথিবীতেই সাধারণ মানুষকে প্রকৃতিবান্ধব উন্নয়নের কথা ভাবতে হবে আগে। ভোগসর্বস্ব জীবন যেভাবে সর্বগ্রাসী কার্বন উৎপাদন করে মানবসভ্যতা তিলে তিলে ধ্বংস করে দিচ্ছে পৃথিবীজুড়েই তার বিরুদ্ধে সুচিন্তিত উদ্যোগ প্রয়োজন। এয়ারকন্ডিশন-ফ্রিজভিত্তিক জীবনের বিকল্প আচারের জন্য কি নবভাবনার নবপ্রবাহ জরুরি নয়? বড় বাঁধ না করে সৌর, বায়ুচালিত নবায়নযোগ্য জ্বালানির যুগপর্বে পা ফেলা প্রয়োজন নয়? অট্টালিকা প্রবাহের উন্নয়ন দর্শন যদি এই সুনামি ভাসিয়ে দিতে পারত! যেনতেন নগদ-উন্নয়নের জন্য আগামী পৃথিবী ধ্বংস করে দেওয়ার অধিকার আমাদের কেউ দেয়নি।
হিলাল ফয়েজী : কলাম লেখক
পুঁজিবাদী বিশ্বের দ্বিতীয় শক্তিতে পরিণত হতে জাপান বলা যায় 'উন্নয়ন-উন্মাদ' হয়ে পড়েছিল। প্রয়োজন হয়েছিল তাদের বিপুল জ্বালানি, বিপুল বিদ্যুৎ; পারমাণবিক বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র হচ্ছে তার ব্যয়বহুল কিন্তু অপেক্ষাকৃত সহজ উৎস। ভূমিকম্পের প্রতিরোধ নকশা ওই পারমাণবিক কেন্দ্রগুলোতে নাকি যথেষ্ট ছিল। কিন্তু সমুদ্র উপকূলের ওই কেন্দ্রগুলো এমন ভয়াবহ সুনামির জন্য প্রস্তুত ছিল না। এমন উঁচু ঢেউ, এমন শক্তিশালী, ক্ষিপ্র আর দ্রুতগতির সুনামি কী ঘটাতে পারে কৃত্রিম উপগ্রহ আমাদের তা দেখিয়েছে। পৃথিবীর সব মহাদেশে এখন পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের বিরুদ্ধে তীব্র জনমত গড়ে উঠেছে। জার্মানির বিশাল মিছিল দেখেছি। থাইল্যান্ড এরই মাঝে ঘোষণা করে দিয়েছে : আমরা পরিকল্পিত সব পারমাণবিক তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র বাতিল করে দিলাম। আমাদের বাংলাদেশে এখন উন্নয়ন প্রয়োজনে প্রবল বিদ্যুৎ ক্ষুধা। এ ক্ষুধা মেটাতে কত রকম প্রস্তাব, উদ্যোগ, আয়োজন; ক্ষুধা মেটাতে ব্যাকুল পৃথিবীর নানা দেশের নানা কোম্পানি, নানা সুকৌশলে-প্রকৌশলে। পৃথিবীতে বড় বড় কোম্পানিগুলো মূলত বোঝে এবং খোঁজে তাদের মুনাফাসর্বস্ব রণনীতি-কৌশলের সার্থকতা। পৃথিবীব্যাপী তারা 'প্রয়োজন' খুঁজে বেড়ায়, গছিয়ে দেয় উন্নয়ন দর্শন। বুঝে, না বুঝে কিংবা আঁতাত-মৌতাতে আমরা সে উন্নয়ন দর্শনের ফাঁদে পা ফেলি পরিস্থিতির 'নগদ চাহিদা' মেটানোর নামে।
উন্নয়নের এই উন্মাদনা প্রবল থেকে প্রবলতর হয়ে উঠেছে বিশেষত ইউরোপে শিল্প-বিপ্লব পর্ব থেকে। এ উন্মাদনা পৃথিবীকে উপহার দিয়েছে আশ্চর্য সব উদ্ভাবন, যা আমাদের নগদ জীবনকে শুরুতে সহজ করে দিয়েছে। এই উন্নয়ন ধারা কিন্তু কখনোই প্রকৃতির সঙ্গে বল্পুব্দত্ব বজায় রাখার প্রশ্নটিকে আমলই দেয়নি। বরং প্রকৃতিকে ধ্বংস করে দ্রুত উন্নয়নের পথ ধরতেই তা ব্যাকুল ছিল এবং আছে। এ উন্নয়ন উন্মাদনায় অর্থনৈতিক পরাশক্তিতে উন্নীত হয়েছে পৃথিবীর কয়েকটি দেশ, 'জি-৮'-এর অভিজাত পঙ্ক্তিতে আজ তারা। জাপান যার অন্যতম।
এই উন্নয়ন ভূপৃষ্ঠের জমিনে বিশাল কারখানা আর অট্টালিকা নির্মাণ করতে সক্ষম হয়েছে। চোখ ধাঁধানো উজ্জ্বলতা। মহানগরী আর মহানগরী। আলিশান কত কিছু। ভোগের মহাভাণ্ডার। কিন্তু হালে জানতে পেরেছি এসবই নাকি গড়ে তুলছে মহাভাগাড়। উন্নয়নে ফুটো হয়ে গেছে আকাশ। বিপজ্জনক রশ্মি এসে নামছে পৃথিবীতে। নিঃসরিত কার্বনে পৃথিবী ভেতর থেকে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। 'জলবায়ু বিপর্যয়' পৃথিবীকে ক্রমেই একশেষ করে দিচ্ছে। উষ্ণতা বাড়ছে, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতাও বাড়ছে। বরফ গলছে। ফলে পৃথিবীতে প্রধান 'জলবায়ু বিপন্ন' দেশ হিসেবে আমাদের বাংলাদেশ শীর্ষে। জলবায়ু বিপর্যয় অবশেষে পৃথিবী আর প্রকৃতিকে কোথায় নেবে কে জানে! ভয়ঙ্কর ঘূর্ণিঝড়গুলো এখন সংখ্যায় এবং ভয়ঙ্করতায় বেড়েই চলেছে, ঘূর্ণিঝড়ের আঘাতও তীব্রতর হচ্ছে। রিটা, ক্যাটরিনা, নার্গিস, কী মিষ্টি মিষ্টি নাম! তা যত মিষ্টি নামেই ডাকুন, ওসব ডাকাবুকো ঘূর্ণিঝড়-দানব যে জনপদ-সভ্যতার সব লণ্ডভণ্ড করে দেয়।
একবিংশ শতাব্দীর প্রথম দশকে বাংলাদেশে টিপাইমুখ বাঁধ নিয়ে বেশ তর্ক-বিতর্ক-উত্তাপ সৃষ্টি হয়। এ বিষয়ে 'অঙ্গীকার বাংলাদেশ' সংগঠনের মধ্য দিয়ে কাজ করার সুযোগ হয়। দৃশ্যত টিপাইমুখ বাঁধ উন্নয়নের এক সৌধ স্তম্ভ হিসেবে ভারতের অত্যন্ত অনুন্নত জনপদ মনিপুরের জন্য এক বিশাল-বিস্ময় নির্মাণই হওয়ার কথা। পৃথিবীতে বড় বাঁধের মহাহুজুগ-হুল্লোড় চলছে। 'যেখানেই সুযোগ পাও, সেখানেই মেগা বাঁধ বানাও'_ হিড়িকে পৃথিবীতে এখন প্রায় ৫০ হাজারটি বড় বাঁধ নির্মিত হয়েছে। বড় বাঁধ মানে নূ্যনতম ১৫ মিটার তথা ৫০ ফুটের মতো উঁচু। পৃথিবীতে এখনি আরও ৫০ হাজার বাঁধ করার সুযোগ রয়েছে। এ বাঁধ বানানোর জন্য পৃথিবীতে রয়েছে এক মহাশক্তিশালী বাঁধ সিন্ডিকেট। গণচীন নিজের দেশে পৃথিবীর সর্ববৃহৎ বাঁধ, বৃহত্তম বাঁধ-জলাশয় তৈরি করে এক্ষেত্রে সর্বোচ্চ দক্ষতা ও কুশলতা অর্জন করেছে। তাদের হাতে আছে বিশ্বব্যাংককে চ্যালেঞ্জ জানানোর মতো পুঁজি। খবর নিয়ে দেখুন, আফ্রিকা ও ল্যাটিন আমেরিকায় কত বিশাল পুঁজি নিয়ে বাঁধসহ নানাবিধ প্রকৃতিবিধ্বংসী উন্নয়ন-যজ্ঞে ঝাঁপিয়ে পড়েছে গণচীন।
বাঁধ-টারবাইন-আয়রন-সিমেন্ট মহাজনদের এই বিশ্ব সিন্ডিকেটের নজরে উত্তর-পূর্ব ভারত এবং মনিপুরও। বিশেষত ব্রহ্মপুত্র নদকে কেন্দ্র করে এখন গণচীন আর ভারতের চলছে বাঁধ নির্মাণের তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ মহাআয়োজন। উৎস থেকে সমুদ্র পর্যন্ত ব্রহ্মপুত্রের প্রায় ২ হাজার কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের অংশ আছে গণচীনের তিব্বতে, ৯০০ কিলোমিটার ভারতে, ৩০০ কিলোমিটার বাংলাদেশে। গণচীন ব্রহ্মপুত্রের উৎসে পৃথিবীর সর্ববৃহৎ বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রের (৪০ হাজার মেগাওয়াট) বাঁধ তৈরি করছে, ব্রহ্মপুত্র থেকে বিপুল পানি সরিয়ে গণচীনের মরুভূমিকে সবুজ করার প্রকল্প তাদের হাতে অনেক দিন ধরেই। গণচীনের আগেই অরুণাচলে কয়েকটি বাঁধে ২৭ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ তৈরির প্রকল্প ভারত হাতে নিয়ে 'প্রথম ব্যবহারকারী'র সুবিধা নিতে ব্যাকুল। ভাটির আসাম এবং বাংলাদেশ ব্রহ্মপুত্র-নির্ভরশীল এক বিশাল অববাহিকা, পানি-তৃষ্ণার্ত। গণচীন ও ভারত উন্নয়ন-উন্মাদনার প্রতিযোগিতায় ভাটির আসাম এবং বাংলাদেশকে সর্বস্বান্ত করে দেবে।
টিপাইমুখ বাঁধ নিয়ে এ দেশের যেসব দক্ষিণপন্থি রণহুঙ্কার দিয়ে থাকে প্রায়ই তারা কিন্তু গণচীনের বাঁধ-অবরোধ প্রশ্নে একেবারে চুপচাপ। আবার টিপাইমুখ বাঁধ-উত্তাপের সময় একদল হঠাৎ গজানো পণ্ডিতকে দেখেছি, না, না, ও বাঁধে ক্ষতি হবে না। টিপাইমুখ বাঁধের যে নকশা করেছে, তাতে ভারত তাদের দেশের ২৭৭ কিলোমিটার বরাক নদীর দৈর্ঘ্যের অববাহিকার তথ্য-উপাত্তই ব্যবহার করছে বাকি বাংলাদেশের ৬৬৯ কিলোমিটার অভিন্ন মেঘনা নদীর তথ্য-উপাত্ত ওরা হিসাবেই নেয়নি। আমাদের ভালোমন্দের কথা ভাবাই হয়নি। ওদিকে বড় বাঁধের উজানে একরকম বিপদ, ভাটিতে অন্যরকম। বিশাল ভূমিকম্পে যদি বাঁধ-জলাশয় ভেঙে পড়ে তাহলে টিপাইমুখের নিচে অবস্থিত আসামের কাছাড় এবং বাংলাদেশের সিলেটের বিশাল অঞ্চল সুনামির মতো ভয়াবহ অবস্থার শিকার হবে। পর্দা-পণ্ডিত কথাকুশলী যেসব মহাজন বলেছেন, টিপাইমুখ বাঁধে কোনো ক্ষতি হবে না, তারা এখন নয়ন মেলে দেখুন জাপানি সুনামির পর্দার ভয়াবহ প্রকাশ। প্রতিটি বড় বাঁধের বড় জলাশয় ভূমিকম্পপ্রবণ অঞ্চলে প্রকৃতই এক একটি 'জলবোমা'... কখন কিসে যে কী হয়, কোন প্রলয় ঘটে কে জানে! তাই প্রশ্ন উঠবেই, আমরা কেমন করে নিশ্চিত হবো, না, ভূমিকম্পেও তেমন কিছু হবে না!
শুরুর কথায় আসি। পৃথিবীজুড়ে পারমাণবিক তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র বিরোধিতার শক্তি ক্রমেই জোরদার হয়ে চলেছে। আমাদের বাংলাদেশও রুশ সাহায্যে 'পারমাণবিক তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র' নির্মাণের প্রাক্-প্রস্তুতিতে অনেক দূর অগ্রসর হয়েছে। জাপানের বিপর্যয়ের পর আমাদের 'রূপপুর প্রকল্প' নিয়েও স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠবে। প্রশ্ন ওঠার আগেই আমাদের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ দেখি সবার আগে যথাদ্রুত এক সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করে বলে ফেলেছে, রূপপুর প্রকল্প চলবেই। ওখানে কখনোই 'সুনামি' হবে না, ১০ রিখটার স্কেলের ভূমিকম্প প্রতিরোধের ব্যবস্থা থাকবেই। অতএব মাভৈ! এগিয়ে যাও।
এত বড় বিপর্যয় ঘটল জাপানে, সারা পৃথিবীতে নতুন করে উন্নয়ন-দর্শন নিয়ে তর্ক-বিতর্ক উঠল। প্রকৃতি ধ্বংস করে যে উন্নয়ন, তা আখেরে আকাশ ফুটো করে সভ্যতার কপাল ফুটো করে দিচ্ছে, তবু কী 'দাঁড়াও পথিকবর' বলে 'তিষ্ঠ ক্ষণকাল' আবেদন জানানোটা বেমানান-বেসুরো হয়ে যাবে? মেগা-উন্নয়ন প্রকল্পের পশ্চাতে মেগা কোম্পানির লকলকে মুনাফা জিহ্বার বাস্তবতা বুঝে নিতে হবে আগে। সারা পৃথিবীতেই সাধারণ মানুষকে প্রকৃতিবান্ধব উন্নয়নের কথা ভাবতে হবে আগে। ভোগসর্বস্ব জীবন যেভাবে সর্বগ্রাসী কার্বন উৎপাদন করে মানবসভ্যতা তিলে তিলে ধ্বংস করে দিচ্ছে পৃথিবীজুড়েই তার বিরুদ্ধে সুচিন্তিত উদ্যোগ প্রয়োজন। এয়ারকন্ডিশন-ফ্রিজভিত্তিক জীবনের বিকল্প আচারের জন্য কি নবভাবনার নবপ্রবাহ জরুরি নয়? বড় বাঁধ না করে সৌর, বায়ুচালিত নবায়নযোগ্য জ্বালানির যুগপর্বে পা ফেলা প্রয়োজন নয়? অট্টালিকা প্রবাহের উন্নয়ন দর্শন যদি এই সুনামি ভাসিয়ে দিতে পারত! যেনতেন নগদ-উন্নয়নের জন্য আগামী পৃথিবী ধ্বংস করে দেওয়ার অধিকার আমাদের কেউ দেয়নি।
হিলাল ফয়েজী : কলাম লেখক
No comments