'নারীর অগ্রযাত্রা' : কালের কণ্ঠের বর্ষপূর্তি আয়োজন by ড. নাজমুল হক
১০ জানুয়ারি ২০১১ জাতীয় দৈনিক 'কালের কণ্ঠ' পালন করল প্রথম বর্ষপূর্তি। মাত্র এক বছরের কাল-পরিক্রমায় সবার হৃদয় হরণকারী পত্রিকাটির এ উপলক্ষে প্রকাশিত বিশেষ সংখ্যাটি নিঃসন্দেহে 'বাজিমাত' করেছে। এক শ একজন (শূন্য সংখ্যা বাঙালির অপছন্দ, তাই কি এক শ এক?) লেখকের প্রবন্ধ-নিবন্ধ-ফিচারে আলোচনায় সুপরিকল্পিত ও
সুসম্পাদিত সংখ্যাটির বিশেষত্ব হচ্ছে_বাহাত্তর পৃষ্ঠার সুপরিসর অবয়বে প্রধানত বাংলাদেশের ভৌগোলিক পরিসীমায় জন্মগ্রহণকারী অথবা অভিবাসনকৃত কেবল নারী লেখকদের বিচিত্র ভাবনাসমৃদ্ধ নিবন্ধমালা। 'নারীর অগ্রযাত্রা' শিরোনামটিও দৃষ্টি আকর্ষক। সংকলিত নিবন্ধের বিষয়-বৈচিত্র্য যেমন শতমুখী, লেখকদের পেশাগত পরিচয়ও তেমনি সহস্রধারার। প্রবন্ধগুলোতে নারীবাদের উগ্রতা নেই, আছে নারী জাগরণ ও অগ্রগতির ধারাবাহিক ইতিবৃত্ত; নেই তত্ত্ব ও তথ্যের অনাবশ্যক আড়ম্বর, আছে প্রশান্ত চিন্তা, স্বপ্ন, সৌন্দর্য, প্রতিবাদ, প্রয়াস আর উদ্যোগ-উদ্যমের বিনম্র আত্মকথন। নারী জাগরণের স্বপ্নদ্রষ্টা ও অগ্রপথিক মহীয়সী নারীদের জীবনসংগ্রামের পরিচয় উদ্ঘাটন থেকে শুরু করে নারীর অগ্রযাত্রায় কৃতী ও সাধনার যে কল্লোল, তার অনেক নির্দেশক (indicator) প্রকাশ পেয়েছে সংকলিত নিবন্ধমালায়। যদি বলা হয়, এই বাহাত্তর পৃষ্ঠা পাঠ করলে যে কারো পক্ষে এ দেশের নারীবৈষম্যের চিত্র, বৈষম্য থেকে উত্তরণের জন্য তার আয়াসসাধ্য প্রয়াস ও সংগ্রাম, এরই অনুক্রমে জাতীয় উন্নয়নের ধারায় পুরুষের সমতালে নারীর এগিয়ে চলা; বর্তমান রাষ্ট্রিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটে অভিন্ন ভূমিকা পালন সম্পর্কে পরিপূর্ণ ধারণা লাভ করা সম্ভব_তাহলেও অতিকথন হয় না।
প্রকাশিত নিবন্ধগুলোকে বিষয় অনুযায়ী ১৯টি শ্রেণীতে বিন্যস্ত করা চলে। বিষয়ভিত্তিক নাম ও তার সংখ্যভিত্তিক পরিচয় এ রকম_১. নারী জাগরণের অগ্রপথিক বিষয়ে অন্তর্ভুক্ত রচনা তিনটি। ২. নারী অধিকার, জেন্ডার-বৈষম্য, আইন এবং মানবাধিকার প্রসঙ্গ আটটি। ৩. নারীর অতীত ও বর্তমান অবস্থা এবং বৈশিষ্ট্য সম্পর্কিত নিবন্ধ-চারটি। ৪. নারীর কর্মোদ্দীপনা, জীবনসংগ্রাম ও নারীকর্মীর দৃঢ় পথচলার শপথ-বিষয়ক রচনা আটটি। ৫. বর্তমান সমাজচিত্র ও যুবসমাজ প্রসঙ্গ দুটি। ৬. ইভ টিজিং এবং সামাজিক অপরাধ ও মাদকদ্রব্য প্রতিরোধ সম্পর্কিত প্রবন্ধ পাঁচটি। ৭. রাজনীতি প্রসঙ্গ চারটি। ৮. নারী নেতৃত্ব বিষয়ে লেখা চারটি। ৯. বিজ্ঞান নিবন্ধ চারটি। ১০. শিক্ষা সাতটি। ১১. নারী ব্যবসায় উদ্যোগ ও নেতৃত্ব প্রসঙ্গ চারটি। ১২. নারী ক্রীড়াবিদ-বিষয়ক একটি। ১৩. প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও রং একটি। ১৪. শিল্প-সংস্কৃতি-ভাস্কর্য-নাটক-সংগীত-নৃত্য ও সাংস্কৃতিক অঙ্গন বিষয়ে নিবন্ধ ১৪টি। ১৫. নারী পুলিশের ভূমিকা-বিষয়ক লেখা চারটি। ১৬. নৃগোষ্ঠী প্রসঙ্গ একটি। ১৭. মুক্তিযুদ্ধকেন্দ্রিক প্রবন্ধ তিনটি। ১৮. যুদ্ধাপরাধীর বিচার প্রসঙ্গে একটি এবং ১৯. সুন্দর ভবিষ্যতের জন্য স্বপ্ন ও আকাঙ্ক্ষা বিষয়ে ২৩টি নিবন্ধ এই বিশেষ আয়োজনের অন্তর্ভুক্ত। এ ছাড়া রয়েছে নবাব ফয়জুন্নেসা চৌধুরানী (১৮৩৪-১৯০৩) ও রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন (১৮৮০-১৯৩২) থেকে শহীদ সাংবাদিক সেলিনা পারভীন (১৯৩১-১৯৭১) পর্যন্ত নারী জাগরণের ১২ অগ্রপথিক মহীয়সীর সংক্ষিপ্ত জীবনকথা এবং মহান মুক্তিযুদ্ধের বিজয়িনী ১২ নারীর সংক্ষিপ্ত পরিচিতি ও আলোচনা।
যাঁরা এই এক শ একটি নিবন্ধ লিখেছেন, তাঁদের পেশাগত এবং সামাজিক মর্যাদাকেন্দ্রিক পরিচয় এ রকম_১. আইনজীবী পাঁচজন। তাঁদের মধ্যে রয়েছেন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ব্যক্তিত্বও। ২. রাজনীতিবিদ ছয়জন। তাঁদের মধ্যে রয়েছেন দুজন সংসদ সদস্য, একজন প্রবীণ কমিউনিস্ট নেত্রী এবং একজন ভাষাসৈনিক। ৩. নারী নেত্রী ১১ জন। তাঁদের মধ্যে অন্যতম বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী এবং একজন সাবেক প্রধানমন্ত্রী। ৪. শিক্ষাবিদ ১৬ জন। তাঁদের মধ্যে ১১ জন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। ৫. পত্রিকার সম্পাদক তিনজন। ৬. প্রথিতযশা সাহিত্যিক দুজন। ৭. বিজ্ঞানী একজন। ৮. ব্যবসায়ী নারী নেত্রী ও উদ্যোক্তা চারজন। ৯. মেয়র একজন, কাউন্সিলর একজন। ১০. সাংবাদিক দুজন। ১১. ভাস্কর্যশিল্পী একজন। ১২. সরকারি আমলা তিনজন। ১৩. ক্রীড়াবিদ তিনজন। ১৪. উন্নয়নকর্মী ও সমাজ সংগঠক তিনজন। ১৫. আলোকচিত্রী দুজন। ১৬. উচ্চপদস্থ পুলিশ কর্মকর্তা চারজন। ১৭. নাট্য পরিচালক ও নির্মাতা তিনজন। ১৮. কৃতী ছাত্রী ছয়জন। ১৯. ফ্যাশন ডিজাইনার, রূপবিশেষজ্ঞ ও রন্ধনবিশারদ সাতজন। ২০. সংগীত, অভিনয়শিল্পী ও সাংস্কৃতিককর্মী ১৭ জন।
উলি্লখিত ২০টি পেশা বা কর্মের সঙ্গে সম্পৃক্ত নারী লেখকের ১৯টি বিষয়ে ১০১টি নিবন্ধে বাংলাদেশের আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক (কৃষি ও শিল্প ব্যতীত) প্রায় সব নির্দেশক (Indicator) অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। বলাবাহুল্য, লেখকরা প্রধানত নারী অধিকার, নারী উন্নয়ন ও সুন্দর সমাজব্যবস্থার স্বপ্ন ও আকাঙ্ক্ষার চিত্রই তুলে এনেছেন তাঁদের সৃষ্টিতে। নারী লেখকদের পেশা-বৈচিত্র্যের প্রতি লক্ষ করলে প্রতীয়মান হয় যে নারী অগ্রগতির ধারাটি এখন পূর্ণ বিকশিত। দেশের সব ধরনের পেশায় সফল অংশগ্রহণের কৃতিত্বের ফসল হাতের মুঠোয় তুলে এনেছেন নারী।
'কালের কণ্ঠ' বিশেষ আয়োজনের প্রারম্ভে অনিবার্যভাবেই রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের প্রবন্ধ (স্ত্রীজাতির অবনতি) পত্রস্থ করেছে। নারী জাগরণ এবং নারী-ভাবনায় আত্মোপলব্ধির জন্য এ নিবন্ধ অসাধারণ ক্ষমতাধর। নারী উন্নয়নের পথে এ সূচনার পথ ধরেই একটির পর একটি নিবন্ধ-প্রবন্ধ অগ্রযাত্রার ইতিহাসকে করেছে উন্মোচিত। এর পরই আছেন বেগম রোকেয়ার প্রদীপ এগিয়ে নেওয়া আরেক মহীয়সী নারী সুফিয়া কামাল (রোকেয়ার শিক্ষা)। আছেন আলোকপ্রাপ্ত জননীতুল্য নারী জাহানারা ইমাম। প্রথম পাতায়ই বাংলাদেশের 'বৃহৎ জনগোষ্ঠীর জন্য উন্নয়ন'-এর কথা বলেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। গণতন্ত্র, নারী নেতৃত্ব ও অগ্রযাত্রার আধুনিক পুরোধা যিনি। নিজের রাজনীতি ও দল সম্পর্কে লিখেছেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী, আপসহীন নেত্রী খালেদা জিয়া।
অবশিষ্ট একাত্তর পাতাজুড়ে স্থান পেয়েছে নারী অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের কথা। এ দেশের অপার সম্ভাবনার নানা প্রসঙ্গ, নারী শিক্ষার আবশ্যকতার বিবরণ, গণতন্ত্র ও মাথা উঁচু করে বেঁচে থাকার সাহসের অঙ্গীকার, বিজ্ঞান সাধনা ও নব নব আবিষ্কারের প্রসঙ্গ, নারীবাদের (Feminism) প্রকৃত স্বরূপ, বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বের অনিবার্যতা, নারীর রাজনীতি ও সংসদ, বিচার বিভাগ ও মানবাধিকার, নারী নেতৃত্বের প্রাসঙ্গিকতা, সন্ত্রাস ও দুর্নীতিমুক্ত একটি দেশের প্রত্যাশা, নতুন প্রজন্মের জন্য স্বপ্ন ও আকাঙ্ক্ষা, মুক্তিযুদ্ধ ও নারী, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার, পাটের জিন-রহস্যের সন্ধান, এনার্জি ও প্রযুক্তি ভাবনা, ব্যবসা ও বাণিজ্যে নারীর অংশগ্রহণ, ইভ টিজিং ও সামাজিক অবক্ষয় প্রসঙ্গ, শিল্প-সাহিত্য-সংগীত-নৃত্য-নাট্যভাস্কর্যে নারীর ভূমিকা ও নেতৃত্ব, প্রতিকূল সামাজিক-রাষ্ট্রিক প্রেক্ষাপটে অন্ধকার সরিয়ে নারীর এগিয়ে চলার ইতিকথা_এসব প্রসঙ্গ প্রতিফলিত হয়েছে সংকলিত নিবন্ধমালায়।
সাম্প্রতিক সময়ে সশস্ত্রবাহিনী ও পুলিশবাহিনীতে নারী কর্মকর্তার প্রশংসনীয় ও কৃতিত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন তাঁদের অগ্রযাত্রাকে করেছে ত্বরান্বিত। বিশেষ সংখ্যার আয়োজনে চারজন সিনিয়র নারী পুলিশ অফিসারের নিবন্ধে তাঁদের দুঃসাহসিকতাপূর্ণ দায়িত্ব পালনের বিবরণ বিশেষভাবে উল্লেখের দাবি রাখে। তাঁদের কেউ কেউ জাতিসংঘের 'শান্তি মিশনে' চ্যালেঞ্জিং ভূমিকা পালন করেছেন। এ সংকলনে সেনাবাহিনী ও বিচার বিভাগের নারী কর্মকর্তাদের নিবন্ধ না থাকলেও আমাদের অজানা নেই যে এ শাখায়ও নারী ব্যক্তিত্বের উজ্জ্বল উপস্থিতি কম নয়। এখন আর নারী জেলা প্রশাসক, বিচারপতি বা সচিবকে প্রদীপ জ্বালিয়ে খোঁজার প্রয়োজন হয় না, তাঁরা নিজেরাই আলোকিত করছেন দেশের সব অঙ্গন। কেবল প্রধানমন্ত্রী নন, আরো বহু আলোকিত নারী হরহামেশা 'পলিসি মেকিং' ও বাস্তবায়নে রাখছেন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। ব্যবসাক্ষেত্রও এত দিন ছিল এককভাবে পুরুষ অধ্যুষিত। এখন এ সেক্টরে নারী উদ্যোক্তা, পরিচালক, ব্যবস্থাপক, সিইও-এর পদচারণ বেশ দাপটের সঙ্গেই অনুভূত হচ্ছে। পুরুষের কর্মক্ষেত্র হিসেবে বিবেচিত গণমাধ্যম, সাংবাদিকতা ও টেলি-সাংবাদিকতা, বিমান চালনা, এমনকি পূর্ণাঙ্গ পত্রিকা সম্পাদক হিসেবেও নারীর পেশাদারি ভূমিকা হাল আমলে অবিদিত নয়। নারীর অগ্রযাত্রার এ পর্যায়ে এসে 'নারীরা শিক্ষকতা ও চিকিৎসা পেশায়ই উপযুক্ত'_এ ধরনের মনোভঙ্গি এখন আর্কাইভে সংরক্ষণের বিষয়।
কালের কণ্ঠের বর্ষপূর্তি সংখ্যায় একসঙ্গে এসব বিষয়ের নাতিদীর্ঘ বয়ান পাঠকের কাছে একটি সুদীর্ঘ অভিজ্ঞতার স্বাদ এনে দিয়েছে। এক শ একজন লেখকের লেখা সংগ্রহ ও সম্পাদনা করা চাট্টিখানি কথা নয়। কেবল সম্পাদকই বোঝেন এর মর্ম! লেখকরা সবাই জাতীয় পর্যায়ে কম-বেশি পরিচিত, অনেকে উজ্জ্বল নক্ষত্র। সম্পাদকের অসামান্য কৃতিত্ব এই যে সুদূর ময়মনসিংহ ও সুনামগঞ্জের মতো প্রত্যন্ত অঞ্চলের নিভৃতচারী প্রবীণ নারী নেত্রীদেরও তিনি উপস্থাপন করেছেন পাঠকের সামনে। বাদ পড়েননি ব্যস্ত সংসদ সদস্য, হুইপ এমনকি প্রধানমন্ত্রী ও বিরোধীদলীয় নেত্রীও। নারী ক্রীড়াবিদ, ডিজাইনার, রূপবিশেষজ্ঞ, ফ্যাশন ডিজাইনার, ফুলসজ্জা ও রন্ধনবিশেষজ্ঞের ভাবনাচিন্তার সঙ্গেও পরিচিত হয়েছেন পাঠক। বস্তুত বিশেষ সংখ্যাটি হয়ে উঠেছে নারী উন্নয়ন ও অগ্রযাত্রার বিশদ বিবরণের একটি মূল্যবান দলিল।
এই অসাধ্য কর্ম সম্পাদন করার জন্য কালের কণ্ঠের সম্পাদক আবেদ খানকে জানাই শ্রদ্ধা ও শুভেচ্ছা। যাঁরা অন্তরালে থেকে এই মহাযজ্ঞ বাস্তবায়িত করেছেন, তাঁদেরও অভিনন্দন। সব শেষে একটি ব্যক্তিগত প্রসঙ্গ কালের কণ্ঠের জন্মদিন থেকেই আমার তিন সদস্যের পরিবার এই পত্রিকার 'পাঁড় পাঠক'। আমার প্রতি আমার সদ্য কলেজপড়ুয়া মেয়ের সতর্কবাণী_'কালের কণ্ঠ ছাড়া আমার এক দিনও চলবে না।' জয়তু কালের কণ্ঠ!
লেখক : সহযোগী অধাপক, বাংলা বিভাগ, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর
প্রকাশিত নিবন্ধগুলোকে বিষয় অনুযায়ী ১৯টি শ্রেণীতে বিন্যস্ত করা চলে। বিষয়ভিত্তিক নাম ও তার সংখ্যভিত্তিক পরিচয় এ রকম_১. নারী জাগরণের অগ্রপথিক বিষয়ে অন্তর্ভুক্ত রচনা তিনটি। ২. নারী অধিকার, জেন্ডার-বৈষম্য, আইন এবং মানবাধিকার প্রসঙ্গ আটটি। ৩. নারীর অতীত ও বর্তমান অবস্থা এবং বৈশিষ্ট্য সম্পর্কিত নিবন্ধ-চারটি। ৪. নারীর কর্মোদ্দীপনা, জীবনসংগ্রাম ও নারীকর্মীর দৃঢ় পথচলার শপথ-বিষয়ক রচনা আটটি। ৫. বর্তমান সমাজচিত্র ও যুবসমাজ প্রসঙ্গ দুটি। ৬. ইভ টিজিং এবং সামাজিক অপরাধ ও মাদকদ্রব্য প্রতিরোধ সম্পর্কিত প্রবন্ধ পাঁচটি। ৭. রাজনীতি প্রসঙ্গ চারটি। ৮. নারী নেতৃত্ব বিষয়ে লেখা চারটি। ৯. বিজ্ঞান নিবন্ধ চারটি। ১০. শিক্ষা সাতটি। ১১. নারী ব্যবসায় উদ্যোগ ও নেতৃত্ব প্রসঙ্গ চারটি। ১২. নারী ক্রীড়াবিদ-বিষয়ক একটি। ১৩. প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও রং একটি। ১৪. শিল্প-সংস্কৃতি-ভাস্কর্য-নাটক-সংগীত-নৃত্য ও সাংস্কৃতিক অঙ্গন বিষয়ে নিবন্ধ ১৪টি। ১৫. নারী পুলিশের ভূমিকা-বিষয়ক লেখা চারটি। ১৬. নৃগোষ্ঠী প্রসঙ্গ একটি। ১৭. মুক্তিযুদ্ধকেন্দ্রিক প্রবন্ধ তিনটি। ১৮. যুদ্ধাপরাধীর বিচার প্রসঙ্গে একটি এবং ১৯. সুন্দর ভবিষ্যতের জন্য স্বপ্ন ও আকাঙ্ক্ষা বিষয়ে ২৩টি নিবন্ধ এই বিশেষ আয়োজনের অন্তর্ভুক্ত। এ ছাড়া রয়েছে নবাব ফয়জুন্নেসা চৌধুরানী (১৮৩৪-১৯০৩) ও রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন (১৮৮০-১৯৩২) থেকে শহীদ সাংবাদিক সেলিনা পারভীন (১৯৩১-১৯৭১) পর্যন্ত নারী জাগরণের ১২ অগ্রপথিক মহীয়সীর সংক্ষিপ্ত জীবনকথা এবং মহান মুক্তিযুদ্ধের বিজয়িনী ১২ নারীর সংক্ষিপ্ত পরিচিতি ও আলোচনা।
যাঁরা এই এক শ একটি নিবন্ধ লিখেছেন, তাঁদের পেশাগত এবং সামাজিক মর্যাদাকেন্দ্রিক পরিচয় এ রকম_১. আইনজীবী পাঁচজন। তাঁদের মধ্যে রয়েছেন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ব্যক্তিত্বও। ২. রাজনীতিবিদ ছয়জন। তাঁদের মধ্যে রয়েছেন দুজন সংসদ সদস্য, একজন প্রবীণ কমিউনিস্ট নেত্রী এবং একজন ভাষাসৈনিক। ৩. নারী নেত্রী ১১ জন। তাঁদের মধ্যে অন্যতম বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী এবং একজন সাবেক প্রধানমন্ত্রী। ৪. শিক্ষাবিদ ১৬ জন। তাঁদের মধ্যে ১১ জন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। ৫. পত্রিকার সম্পাদক তিনজন। ৬. প্রথিতযশা সাহিত্যিক দুজন। ৭. বিজ্ঞানী একজন। ৮. ব্যবসায়ী নারী নেত্রী ও উদ্যোক্তা চারজন। ৯. মেয়র একজন, কাউন্সিলর একজন। ১০. সাংবাদিক দুজন। ১১. ভাস্কর্যশিল্পী একজন। ১২. সরকারি আমলা তিনজন। ১৩. ক্রীড়াবিদ তিনজন। ১৪. উন্নয়নকর্মী ও সমাজ সংগঠক তিনজন। ১৫. আলোকচিত্রী দুজন। ১৬. উচ্চপদস্থ পুলিশ কর্মকর্তা চারজন। ১৭. নাট্য পরিচালক ও নির্মাতা তিনজন। ১৮. কৃতী ছাত্রী ছয়জন। ১৯. ফ্যাশন ডিজাইনার, রূপবিশেষজ্ঞ ও রন্ধনবিশারদ সাতজন। ২০. সংগীত, অভিনয়শিল্পী ও সাংস্কৃতিককর্মী ১৭ জন।
উলি্লখিত ২০টি পেশা বা কর্মের সঙ্গে সম্পৃক্ত নারী লেখকের ১৯টি বিষয়ে ১০১টি নিবন্ধে বাংলাদেশের আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক (কৃষি ও শিল্প ব্যতীত) প্রায় সব নির্দেশক (Indicator) অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। বলাবাহুল্য, লেখকরা প্রধানত নারী অধিকার, নারী উন্নয়ন ও সুন্দর সমাজব্যবস্থার স্বপ্ন ও আকাঙ্ক্ষার চিত্রই তুলে এনেছেন তাঁদের সৃষ্টিতে। নারী লেখকদের পেশা-বৈচিত্র্যের প্রতি লক্ষ করলে প্রতীয়মান হয় যে নারী অগ্রগতির ধারাটি এখন পূর্ণ বিকশিত। দেশের সব ধরনের পেশায় সফল অংশগ্রহণের কৃতিত্বের ফসল হাতের মুঠোয় তুলে এনেছেন নারী।
'কালের কণ্ঠ' বিশেষ আয়োজনের প্রারম্ভে অনিবার্যভাবেই রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের প্রবন্ধ (স্ত্রীজাতির অবনতি) পত্রস্থ করেছে। নারী জাগরণ এবং নারী-ভাবনায় আত্মোপলব্ধির জন্য এ নিবন্ধ অসাধারণ ক্ষমতাধর। নারী উন্নয়নের পথে এ সূচনার পথ ধরেই একটির পর একটি নিবন্ধ-প্রবন্ধ অগ্রযাত্রার ইতিহাসকে করেছে উন্মোচিত। এর পরই আছেন বেগম রোকেয়ার প্রদীপ এগিয়ে নেওয়া আরেক মহীয়সী নারী সুফিয়া কামাল (রোকেয়ার শিক্ষা)। আছেন আলোকপ্রাপ্ত জননীতুল্য নারী জাহানারা ইমাম। প্রথম পাতায়ই বাংলাদেশের 'বৃহৎ জনগোষ্ঠীর জন্য উন্নয়ন'-এর কথা বলেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। গণতন্ত্র, নারী নেতৃত্ব ও অগ্রযাত্রার আধুনিক পুরোধা যিনি। নিজের রাজনীতি ও দল সম্পর্কে লিখেছেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী, আপসহীন নেত্রী খালেদা জিয়া।
অবশিষ্ট একাত্তর পাতাজুড়ে স্থান পেয়েছে নারী অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের কথা। এ দেশের অপার সম্ভাবনার নানা প্রসঙ্গ, নারী শিক্ষার আবশ্যকতার বিবরণ, গণতন্ত্র ও মাথা উঁচু করে বেঁচে থাকার সাহসের অঙ্গীকার, বিজ্ঞান সাধনা ও নব নব আবিষ্কারের প্রসঙ্গ, নারীবাদের (Feminism) প্রকৃত স্বরূপ, বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বের অনিবার্যতা, নারীর রাজনীতি ও সংসদ, বিচার বিভাগ ও মানবাধিকার, নারী নেতৃত্বের প্রাসঙ্গিকতা, সন্ত্রাস ও দুর্নীতিমুক্ত একটি দেশের প্রত্যাশা, নতুন প্রজন্মের জন্য স্বপ্ন ও আকাঙ্ক্ষা, মুক্তিযুদ্ধ ও নারী, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার, পাটের জিন-রহস্যের সন্ধান, এনার্জি ও প্রযুক্তি ভাবনা, ব্যবসা ও বাণিজ্যে নারীর অংশগ্রহণ, ইভ টিজিং ও সামাজিক অবক্ষয় প্রসঙ্গ, শিল্প-সাহিত্য-সংগীত-নৃত্য-নাট্যভাস্কর্যে নারীর ভূমিকা ও নেতৃত্ব, প্রতিকূল সামাজিক-রাষ্ট্রিক প্রেক্ষাপটে অন্ধকার সরিয়ে নারীর এগিয়ে চলার ইতিকথা_এসব প্রসঙ্গ প্রতিফলিত হয়েছে সংকলিত নিবন্ধমালায়।
সাম্প্রতিক সময়ে সশস্ত্রবাহিনী ও পুলিশবাহিনীতে নারী কর্মকর্তার প্রশংসনীয় ও কৃতিত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন তাঁদের অগ্রযাত্রাকে করেছে ত্বরান্বিত। বিশেষ সংখ্যার আয়োজনে চারজন সিনিয়র নারী পুলিশ অফিসারের নিবন্ধে তাঁদের দুঃসাহসিকতাপূর্ণ দায়িত্ব পালনের বিবরণ বিশেষভাবে উল্লেখের দাবি রাখে। তাঁদের কেউ কেউ জাতিসংঘের 'শান্তি মিশনে' চ্যালেঞ্জিং ভূমিকা পালন করেছেন। এ সংকলনে সেনাবাহিনী ও বিচার বিভাগের নারী কর্মকর্তাদের নিবন্ধ না থাকলেও আমাদের অজানা নেই যে এ শাখায়ও নারী ব্যক্তিত্বের উজ্জ্বল উপস্থিতি কম নয়। এখন আর নারী জেলা প্রশাসক, বিচারপতি বা সচিবকে প্রদীপ জ্বালিয়ে খোঁজার প্রয়োজন হয় না, তাঁরা নিজেরাই আলোকিত করছেন দেশের সব অঙ্গন। কেবল প্রধানমন্ত্রী নন, আরো বহু আলোকিত নারী হরহামেশা 'পলিসি মেকিং' ও বাস্তবায়নে রাখছেন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। ব্যবসাক্ষেত্রও এত দিন ছিল এককভাবে পুরুষ অধ্যুষিত। এখন এ সেক্টরে নারী উদ্যোক্তা, পরিচালক, ব্যবস্থাপক, সিইও-এর পদচারণ বেশ দাপটের সঙ্গেই অনুভূত হচ্ছে। পুরুষের কর্মক্ষেত্র হিসেবে বিবেচিত গণমাধ্যম, সাংবাদিকতা ও টেলি-সাংবাদিকতা, বিমান চালনা, এমনকি পূর্ণাঙ্গ পত্রিকা সম্পাদক হিসেবেও নারীর পেশাদারি ভূমিকা হাল আমলে অবিদিত নয়। নারীর অগ্রযাত্রার এ পর্যায়ে এসে 'নারীরা শিক্ষকতা ও চিকিৎসা পেশায়ই উপযুক্ত'_এ ধরনের মনোভঙ্গি এখন আর্কাইভে সংরক্ষণের বিষয়।
কালের কণ্ঠের বর্ষপূর্তি সংখ্যায় একসঙ্গে এসব বিষয়ের নাতিদীর্ঘ বয়ান পাঠকের কাছে একটি সুদীর্ঘ অভিজ্ঞতার স্বাদ এনে দিয়েছে। এক শ একজন লেখকের লেখা সংগ্রহ ও সম্পাদনা করা চাট্টিখানি কথা নয়। কেবল সম্পাদকই বোঝেন এর মর্ম! লেখকরা সবাই জাতীয় পর্যায়ে কম-বেশি পরিচিত, অনেকে উজ্জ্বল নক্ষত্র। সম্পাদকের অসামান্য কৃতিত্ব এই যে সুদূর ময়মনসিংহ ও সুনামগঞ্জের মতো প্রত্যন্ত অঞ্চলের নিভৃতচারী প্রবীণ নারী নেত্রীদেরও তিনি উপস্থাপন করেছেন পাঠকের সামনে। বাদ পড়েননি ব্যস্ত সংসদ সদস্য, হুইপ এমনকি প্রধানমন্ত্রী ও বিরোধীদলীয় নেত্রীও। নারী ক্রীড়াবিদ, ডিজাইনার, রূপবিশেষজ্ঞ, ফ্যাশন ডিজাইনার, ফুলসজ্জা ও রন্ধনবিশেষজ্ঞের ভাবনাচিন্তার সঙ্গেও পরিচিত হয়েছেন পাঠক। বস্তুত বিশেষ সংখ্যাটি হয়ে উঠেছে নারী উন্নয়ন ও অগ্রযাত্রার বিশদ বিবরণের একটি মূল্যবান দলিল।
এই অসাধ্য কর্ম সম্পাদন করার জন্য কালের কণ্ঠের সম্পাদক আবেদ খানকে জানাই শ্রদ্ধা ও শুভেচ্ছা। যাঁরা অন্তরালে থেকে এই মহাযজ্ঞ বাস্তবায়িত করেছেন, তাঁদেরও অভিনন্দন। সব শেষে একটি ব্যক্তিগত প্রসঙ্গ কালের কণ্ঠের জন্মদিন থেকেই আমার তিন সদস্যের পরিবার এই পত্রিকার 'পাঁড় পাঠক'। আমার প্রতি আমার সদ্য কলেজপড়ুয়া মেয়ের সতর্কবাণী_'কালের কণ্ঠ ছাড়া আমার এক দিনও চলবে না।' জয়তু কালের কণ্ঠ!
লেখক : সহযোগী অধাপক, বাংলা বিভাগ, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর
No comments