মুক্তিযোদ্ধাদের কল্যাণ-একটু একটু নয়, অনেক কিছুই করা যায় by অজয় দাশগুপ্ত
সোনালী ব্যাংক আগৈলঝাড়া শাখায় ২৪ এপ্রিল মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে ভাতা তোলার জন্য অপেক্ষার সময়টি বেশিক্ষণ স্থায়ী ছিল না। ওই এলাকার কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন। সেদিন আরও ৭-৮ জন মুক্তিযোদ্ধা কিংবা তাদের পরিবারের সদস্যরা এসেছিলেন ভাতা তোলার জন্য।
বয়সের কারণে স্বাভাবিক চলাফেলা করতে পারেন না, এমন কেউ কেউ ছিলেন। দু'জন মহিলা ছিলেন যোদ্ধা পিতার ভাতা তোলার জন্য। একাত্তরে স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ করে যারা এখনও বেঁচে আছেন, তাদের বেশিরভাগ এখন ষাটোর্ধ্ব। সে সময়ে যেসব কিশোর জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মুক্তিবাহিনীকে নানাভাবে সহায়তা করেছেন তাদের বয়স কিছুটা কম হতে পারে। সোনালী ব্যাংকে গিয়ে মনে হলো, সবচেয়ে চটপটে, দক্ষ এবং মানবিক গুণসম্পন্ন অফিসারকেই মুক্তিযোদ্ধাদের ভাতা প্রদানের কাজের সঙ্গে যুক্ত রাখা উচিত। আমাদের জাতীয় ইতিহাসের সবচেয়ে গৌরবের এ অধ্যায়ের সঙ্গে যারা যুক্ত হয়েছিলেন তাদের আবেগ-অনুভূতি অবশ্যই বিবেচনায় নিতে হবে। মুক্তিযোদ্ধদের ভাতা প্রদান কিংবা অন্য কোনো ধরনের সহায়তা প্রদান করুণা করা নয়। ব্যাংকে গেলে অবশ্যই তাদের সম্মানের সঙ্গে বসার ব্যবস্থা করতে হবে এবং অগ্রাধিকার ভিত্তিতে কাজ করে দিতে হবে। শুধু ব্যাংক নয়, প্রতিটি সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানেও এ নিয়ম চালু করা দরকার। শেখ হাসিনার সরকারই ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় এসে 'অসচ্ছল' মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য ভাতা চালু করেছিল। প্রথমে ভাতা নির্ধারণ করা হয়েছিল প্রতি মাসে ৫০০ টাকা। এখন তা দুই হাজার টাকা। আগামী বাজেটে আরও কিছুটা বাড়বে বলে আশা করা হচ্ছে। কিন্তু কত বাড়বে? ভাতা তোলার প্রক্রিয়ায় 'কিছু খরচা' কি বন্ধ হবে?
এ ভাতার সঙ্গে প্রথমে 'দুস্থ' শব্দটি যুক্ত করা হয়েছিল। পরে মনে হয়েছে যে শব্দটি যথেষ্টই অবমাননাকর। কিন্তু এটাও মনে রাখতে হবে যে, করুণার মনোভাব নিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের দেখার লোক আমাদের প্রশাসনের নানা স্তরে অনেক রয়েছে। মুক্তিযুদ্ধ যে কত গৌরবের এবং এর সঙ্গে সরাসরি যুক্ত হওয়ার যে কত বড় সম্মানের সেটা তাদের উপলব্ধিতে আসে না। তারা বরং মনে করে, 'ওই যুদ্ধ যারা করেছে তাদের দিয়ে দাও কিছু টাকা কিংবা ছিটেফোঁটা কিছু সুবিধা।' মুক্তিযোদ্ধারা তো অনেক পেয়ে গেছে এবং তাদের নিয়ে বাড়াবাড়ি করা হচ্ছে_ এমন ধারণা পোষণ করা লোকেরও অভাব নেই। কিছুদিন আগে এক মুক্তিযোদ্ধার মৃত্যু-পরবর্তী রাষ্ট্রীয় সম্মান প্রদর্শনের অনুষ্ঠানে দেখেছি উপজেলা অফিসের যে কর্মকর্তার জাতীয় পতাকা নিয়ে আসার কথা ছিল, তিনি হাজির হয়েছেন জানাজা শেষে। পতাকাটিও বহন করে এনেছেন প্যান্টের পকেটে। তরুণ এ অফিসারের দোষ কী! আমাদের প্রশাসনের যে প্রশিক্ষণ সিলেবাস তাতে কী এমন বিষয় রয়েছে যে, একাত্তরের বীরদের সর্বোচ্চ সম্মান দিতে হবে? স্কুলের পাঠ্যসূচিতে কতজন মুক্তিযোদ্ধার জীবনী রয়েছে? রাজাকার-আলবদরদের প্রতি ঘৃণা জাগ্রত হয়, এমন লেখাও কি রয়েছে?
একবার একটি জেলার একজন অতিরিক্ত জেলা প্রশাসকের সভায় উপস্থিত থাকার কষ্টকর অভিজ্ঞতা হয়েছিল। শ্রোতারা ছিলেন সবাই বিভিন্ন স্কুলের প্রধান শিক্ষক। প্রত্যেকেই ওই কর্মকর্তার চেয়ে অধিক বয়সী। প্রধান শিক্ষকরা বক্তব্য রাখার সময় তাকে 'স্যার' সম্বোধন করছিলেন, বলছিলেন দাঁড়িয়ে এবং ভয়ে ছিলেন কম্পমান। অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক তাদের মাঝে মধ্যে ধমক দিচ্ছিলেন। আর নিজে বলছিলেন চেয়ারে বসে। এটা তো সরকারি কর্মকর্তাদের ট্রেনিংয়েরই অংশ, যা চলে এসেছে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনামল থেকে। কথায় বলে, 'সেই ট্র্যাডিশন সমানে চলিতেছে।'
স্বাধীনতার চলি্লশ বছর পূর্তির বছরেই মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয়ে যেতে হয়েছিল একাত্তরে দেশের জন্য লড়াই করার কারণে সরকার প্রদত্ত সনদ সংগ্রহ করতে। এতদিন কেন সনদ নেইনি, সে প্রশ্ন করেছেন মন্ত্রণালয়ের সে সময়ের সচিব সাহেব। দু'বার গিয়েছি এবং পেশায় সাংবাদিক হওয়ায় তোপখানা রোডের এ মন্ত্রণালয়ে প্রবেশ করতে তেমন বেগ পেতে হয়নি। কিন্তু সে সময় দেখেছি বিভিন্ন জেলা-উপজেলা থেকে নানা প্রয়োজনে আসা অনেক মুক্তিযোদ্ধাকে কী সীমাহীন বিড়ম্বনায় পড়তে হয়। প্রহরায় নিয়োজিত পুলিশের কাছে আমাদের এই রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় মুক্তিযোদ্ধাদের কী অবদান সেটা গুরুত্বপূর্ণ মনে হয় না। তাদের কাছে 'সবাই সমান'। ব্যবসায়িক তদবিরবাজ কিংবা প্রবীণ মুক্তিযোদ্ধা যেই আসুক তাদের কাছে সমান ট্রিটমেন্ট। তবে তদবিরবাজ প্রয়োজনে হাতে একটি নোট ধরিয়ে দিতে পারে। গ্রাম থেকে আসা 'দরিদ্র মুক্তিযোদ্ধার' সে ক্ষমতা কোথায়? একাত্তরে গ্রামের যে কৃষক বা দিনমজুর কিংবা কারখানার শ্রমিক অথবা স্কুল-কলেজের ছাত্র অমিত বিক্রমে পাকিস্তানের সৈন্য এবং জামায়াতে ইসলামী ও মুসলিম লীগের কর্মীদের নিয়ে গঠিত আলবদর-রাজাকার বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়েছে তাদের এখন মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয়ে হাজির হতে হচ্ছে 'নিরস্ত্র' হয়ে এবং ভেতরে প্রবেশের সময় কারও কারও মেলে পুলিশের লাঠির গুঁতা কিংবা হাতের ধাক্কা। এ মন্ত্রণালয়ে যাদের দায়িত্ব দেওয়া হয় তাদের মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে কীভাবে আচরণ করতে হবে সেটা কি বলা হয়? আমি ব্যক্তিগতভাবে যে দু'বার ওই মন্ত্রণালয়ে গিয়েছি তাতে সেটা মনে হয়নি। সোনালী ব্যাংকের আগৈলঝাড়া শাখায় যখন ভাতা তুলতে গিয়েছি, সেখানেও মনে হয়নি। ব্যাংকের ম্যানেজারের সঙ্গে এ বিষয়ে কথা বলার চেষ্টা করেছি। তার যুক্তি একটাই_ লোকবল কম। কিন্তু কর্মী যদি একজনও থাকে, তার তো আন্তরিক ও মানুষের প্রতি দরদি হতে বাধা নেই। আর মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মান ও শ্রদ্ধার প্রসঙ্গ যদি আসে তাহলে বলব যে, এ দেশে অনাগতকালে অনেক গুরুত্বপূর্ণ পদে অভিষিক্ত হবেন অনেক অনেক মানুষ, তারা রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী কিংবা সচিব হবেন; কিন্তু তাদের কেউ তো মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে পরিচয় দিতে পারবেন না! এ পরম মর্যাদা একটি নির্দিষ্ট সময়ে (একাত্তরে) অনন্য এক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারা কিছু লোকের জন্য ফয়সালা হয়ে রয়েছে।
একাত্তরে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের পালাটানার গহিন বনে ২১ দিনের প্রশিক্ষণ শেষে ক্যাম্প কর্তৃপক্ষ হাতে তুলে দিয়েছিলেন ২১ টাকা_ প্রতিদিনের জন্য এক টাকা করে। আর যুদ্ধজয় শেষে যখন বরিশালের গৌরনদী থানার ক্যাম্প থেকে বিদায় নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরে আসি, তখন দেওয়া হয় ৫০ টাকা। এরপর চার দশক অতিক্রান্ত হয়েছে। সরকারের কাছ থেকে প্রথমবারের মতো সম্মানী ভাতা পেয়েছি মাসে দুই হাজার টাকা করে। এ তালিকায় যাতে আমার নাম ওঠে সেজন্য আগৈলঝাড়ার মুক্তিযোদ্ধারা আন্তরিকভাবে চেষ্টা করেছেন। যাদের সঙ্গে একাত্তরে মুক্তিবাহিনী সংগঠিত করেছি এবং পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে লড়েছি তাদের এ আন্তরিকতা ভুলব না। ভাতা আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ কখনোই ছিল না। কিন্তু 'মাসে এক টাকা হলেও ভাতা চাই'_ এমন প্রত্যাশা ব্যক্ত করেছি বিভিন্ন সময়ে। ২৪ এপ্রিল ভাতা গ্রহণের সময় চোখের জল ধরে রাখা কঠিন ছিল। এটা ছিল আনন্দের প্রকাশ। কিন্তু দেশের সর্বত্র অনেক মুক্তিযোদ্ধা রয়েছে যাদের চোখের জল প্রতিনিয়ত পড়ছে কষ্টে। তাদের সংসারে অভাব, সমাজে অবহেলা। অনেকে উপযুক্ত চিকিৎসার অভাবে কষ্ট পাচ্ছেন। কঠিন ব্যাধিতে আক্রান্ত হলে তাদের পাশে রাষ্ট্র পূর্ণ ক্ষমতা নিয়ে দাঁড়াবে, এমন ব্যবস্থা চালু হয়নি এখনও। কিন্তু এটা করা কি অসম্ভব? এক দশক পর এমন সুবিধা দিতে চাইলেও ক'জনকে পাওয়া যাবে? মুক্তিযোদ্ধারা যাতে উপযুক্ত চিকিৎসার অভাবে বা চিকিৎসকের অবহেলায় মারা না যায় সেজন্য নিশ্চিয়ই রাষ্ট্র কিছু করতে পারে। দেশে অনেক প্রাইভেট ক্লিনিক স্থাপিত হয়েছে এবং তাদের ব্যবসাও ভালো। তারাও এগিয়ে আসতে পারে। একাত্তরে সাতক্ষীরার রণাঙ্গনে আমাদের এক সহযোদ্ধা আহত হয়েছিল। তার বুকে গুলি লাগে। কিন্তু নিকটস্থ হাসপাতাল ছিল অনেক দূরে এবং পথ ছিল কেবলই হাঁটার। রণাঙ্গনে অবস্থানের কারণে জানতেও পারিনি সে সময়ে তাকে চিকিৎসা দেওয়া সম্ভব হয়েছিল কি-না। কিন্তু এখন স্বাধীনতার চার দশক পর মুক্তিযোদ্ধাদের তেমন দুর্ভোগ যেন না হয়।
সরকার মুক্তিযোদ্ধাদের 'সুবিধা' বাড়াচ্ছে। মুক্তিযোদ্ধাদের যে তালিকা এখন মোটামুটি চূড়ান্ত, তা একটু ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করলেই দেখা যাবে যে সশস্ত্র লড়াই যারা করেছেন তাদের বেশিরভাগ এসেছে অপেক্ষাকৃত অসচ্ছল পরিবার থেকে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা মুক্তিযুদ্ধের জন্য জনগণকে সচেতন ও সংগঠিত করায় অনন্য অবদান রেখেছে। কিন্তু যখন অস্ত্র তুলে নেওয়ার সময় এসেছিল, তখন এই 'জনগণই' এগিয়ে আসে বিপুল সংখ্যায়। আমি যে ক্যাম্পে প্রশিক্ষণ নিয়েছি সেখানে প্রথম ব্যাচে ১৭শ' জনের মধ্যে মাত্র একজন ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র এবং মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পাস করা ছিল ২০ জনের মতো। পরে ত্রিপুরার মেলাঘর ও পশ্চিমবঙ্গের বাগুনদিয়ার অপারেশন ক্যাম্পে অবস্থানকালেও দেখেছি, বর্ষা ও শীতের মধ্যেও ভূমিশয্যায় থাকা মুক্তিযোদ্ধাদের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশই দরিদ্র পরিবার থেকে আসা। এদের পুত্র-কন্যা এবং নাতি-নাতনিদের পড়াশোনা ও চাকরির ক্ষেত্রে কিছু কোটা রয়েছে। এটা অবশ্যই মনে রাখতে হবে, একাত্তরে যারা লড়েছেন তাদের বেশিরভাগ স্বাধীন দেশে বড় সরকারি পদের জন্য দরখাস্ত করার মতো অবস্থায় ছিলেন না। তাদের সবার 'শিক্ষাগত যোগ্যতা' ছিল না। বয়সের সমস্যাও ছিল। এ কারণে আন্তরিকতা থাকলেও তাদের জন্য বড় কিছু করা সরকারের পক্ষে সম্ভব হয়নি। কিন্তু দেশের দুর্ভাগ্য যে, ১৯৭৫ সাল থেকে সামরিক শাসন এবং সামরিক শাসকদের প্রতিষ্ঠিত দুটি দল বিএনপি ও জাতীয় পার্টির শাসনামলে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য সরকারের তরফে কিছু করার আন্তরিকতারও অভাব ছিল প্রচণ্ড। এখন মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তানদের অনেকে উপযুক্ত হয়েছে। প্রজন্ম '৭১ এবং এ ধরনের আরও সংগঠন মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও আদর্শকে সামনে নিয়ে আসায় অবদান রেখেছে। জামায়াতে ইসলামী এবং তাদের মতো একাত্তরের চেতনার বিরোধী অন্যান্য শক্তি যখন গলা ফাটিয়ে বলতে শুরু করেছিল, 'একাত্তর অতীতের বিষয়' তখন এ নবীন প্রজন্মই আরও বলিষ্ঠ কণ্ঠে বলে ওঠে_ 'একাত্তরের চেতনা অবিনাশী'। মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তানদের জন্য সরকার আরও কিছু করুক, সেটাই চাইব। এতে করুণার বিষয়টি কোনোভাবেই যেন স্থান না পায়। এটা তাদের ন্যায্য পাওনা। যারা নিজেদের যোগ্যতায় সমাজে স্থান করে নিতে পারবে, তাদের নিয়ে ভাবনা কম। কিন্তু দারিদ্র্যের কারণে যাদের নিয়মিত খাবার জোটেনি, শিক্ষার সুযোগ থেকে থাকতে হয়েছে বঞ্চিত এবং এ কারণে পরবর্তী প্রজন্মকেও ঠিকভাবে পড়াশোনা করাতে পারেনি, তাদের বিষয়টি অবশ্যই গুরুত্বের সঙ্গে দেখতে হবে। এদের জন্য কোটা সুবিধা থাকতেই হবে।
মুক্তিযোদ্ধাদের লড়াই কিন্তু এখনও শেষ হয়ে যায়নি। ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বরের সাধারণ নির্বাচনে তারা যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে ঐক্যবদ্ধ অবস্থান গ্রহণ করেছিল এবং দেশবাসী তাকে যথাযথ গুরুত্ব দিয়েছিল। বিএনপির একটি অংশ এবং তাদের নির্বাচনী মিত্র জামায়াতে ইসলামী ও ইমলামী ঐক্যজোট এ বিষয়টি ভালোভাবে গ্রহণ করেনি। মুক্তিযোদ্ধাদের যাতে সম্মানহানি ঘটানো যায় সেজন্য তাদের চেষ্টা রয়েছে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হোক, সেটা কোনোভাবেই চায় না তারা। মধ্যবর্তী নির্বাচনের দাবির মুখ্য কারণ তো এটাই। এজন্য সূক্ষ্ম ও স্থূল কৌশলে অসত্য-বিকৃত প্রচারণায় তারা সদা তৎপর। একাত্তরে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সঙ্গে থাকা কিছু লোক এখন আওয়ামী লীগের সঙ্গেও রয়েছে। তারাও সঙ্গত কারণেই মুক্তিযুদ্ধের চেতনা নিয়ে মাথা ঘামাতে চায় না। দেশের স্বার্থ তাদের কাছে বড় নয়। শ্রমে-ঘামে সমৃদ্ধ দেশ গড়ে তোলার জন্য তাদের মাথাব্যথা নেই। বরং ক্ষমতাসীন দলের আশপাশে থেকে কিংবা স্থানীয় পর্যায়ে নেতৃত্বের পদ দখল করে নিজেদের আখের গোছাতেই তাদের আগ্রহ। এদের বিরুদ্ধে এখনও রক্ষাকবচ কিন্তু একাত্তরের যোদ্ধারাই। যুদ্ধাপরাধী এবং তাদের ঘনিষ্ঠ সহযোগীদের বিরুদ্ধে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহে তারা দেশের সর্বত্র সহায়তা করছে। এ লড়াইয়ে নিশ্চিতভাবেই তারা জয়ী হবে। সরকার যদি তাদের যথাযথ সম্মান না দেয়, সমাজের প্রভাবশালীরা যদি তাদের প্রতি মুখ ফিরিয়ে রাখে তাতেও তারা পিছপা হবে না। কিন্তু এমন অবস্থা তো কোনোভাবেই কাম্য নয়। তাদের একটু কিছু নয়, বরং অনেক কিছু করার রয়েছে এবং তা করতেই হবে। এ কাজ ভালোভাবে করার জন্য মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয় এবং মুক্তিযোদ্ধা সংসদের রয়েছে বিশেষ ভূমিকা। তাদের তৎপরতায় দক্ষতা ও আন্তরিকতা যত বাড়বে, একাত্তরের যোদ্ধাদের 'শেষ জীবন' তত সহজ হতে পারবে।
অজয় দাশগুপ্ত : মুক্তিযোদ্ধা ও সাংবাদিক
ajoydg@gmail.com
এ ভাতার সঙ্গে প্রথমে 'দুস্থ' শব্দটি যুক্ত করা হয়েছিল। পরে মনে হয়েছে যে শব্দটি যথেষ্টই অবমাননাকর। কিন্তু এটাও মনে রাখতে হবে যে, করুণার মনোভাব নিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের দেখার লোক আমাদের প্রশাসনের নানা স্তরে অনেক রয়েছে। মুক্তিযুদ্ধ যে কত গৌরবের এবং এর সঙ্গে সরাসরি যুক্ত হওয়ার যে কত বড় সম্মানের সেটা তাদের উপলব্ধিতে আসে না। তারা বরং মনে করে, 'ওই যুদ্ধ যারা করেছে তাদের দিয়ে দাও কিছু টাকা কিংবা ছিটেফোঁটা কিছু সুবিধা।' মুক্তিযোদ্ধারা তো অনেক পেয়ে গেছে এবং তাদের নিয়ে বাড়াবাড়ি করা হচ্ছে_ এমন ধারণা পোষণ করা লোকেরও অভাব নেই। কিছুদিন আগে এক মুক্তিযোদ্ধার মৃত্যু-পরবর্তী রাষ্ট্রীয় সম্মান প্রদর্শনের অনুষ্ঠানে দেখেছি উপজেলা অফিসের যে কর্মকর্তার জাতীয় পতাকা নিয়ে আসার কথা ছিল, তিনি হাজির হয়েছেন জানাজা শেষে। পতাকাটিও বহন করে এনেছেন প্যান্টের পকেটে। তরুণ এ অফিসারের দোষ কী! আমাদের প্রশাসনের যে প্রশিক্ষণ সিলেবাস তাতে কী এমন বিষয় রয়েছে যে, একাত্তরের বীরদের সর্বোচ্চ সম্মান দিতে হবে? স্কুলের পাঠ্যসূচিতে কতজন মুক্তিযোদ্ধার জীবনী রয়েছে? রাজাকার-আলবদরদের প্রতি ঘৃণা জাগ্রত হয়, এমন লেখাও কি রয়েছে?
একবার একটি জেলার একজন অতিরিক্ত জেলা প্রশাসকের সভায় উপস্থিত থাকার কষ্টকর অভিজ্ঞতা হয়েছিল। শ্রোতারা ছিলেন সবাই বিভিন্ন স্কুলের প্রধান শিক্ষক। প্রত্যেকেই ওই কর্মকর্তার চেয়ে অধিক বয়সী। প্রধান শিক্ষকরা বক্তব্য রাখার সময় তাকে 'স্যার' সম্বোধন করছিলেন, বলছিলেন দাঁড়িয়ে এবং ভয়ে ছিলেন কম্পমান। অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক তাদের মাঝে মধ্যে ধমক দিচ্ছিলেন। আর নিজে বলছিলেন চেয়ারে বসে। এটা তো সরকারি কর্মকর্তাদের ট্রেনিংয়েরই অংশ, যা চলে এসেছে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনামল থেকে। কথায় বলে, 'সেই ট্র্যাডিশন সমানে চলিতেছে।'
স্বাধীনতার চলি্লশ বছর পূর্তির বছরেই মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয়ে যেতে হয়েছিল একাত্তরে দেশের জন্য লড়াই করার কারণে সরকার প্রদত্ত সনদ সংগ্রহ করতে। এতদিন কেন সনদ নেইনি, সে প্রশ্ন করেছেন মন্ত্রণালয়ের সে সময়ের সচিব সাহেব। দু'বার গিয়েছি এবং পেশায় সাংবাদিক হওয়ায় তোপখানা রোডের এ মন্ত্রণালয়ে প্রবেশ করতে তেমন বেগ পেতে হয়নি। কিন্তু সে সময় দেখেছি বিভিন্ন জেলা-উপজেলা থেকে নানা প্রয়োজনে আসা অনেক মুক্তিযোদ্ধাকে কী সীমাহীন বিড়ম্বনায় পড়তে হয়। প্রহরায় নিয়োজিত পুলিশের কাছে আমাদের এই রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় মুক্তিযোদ্ধাদের কী অবদান সেটা গুরুত্বপূর্ণ মনে হয় না। তাদের কাছে 'সবাই সমান'। ব্যবসায়িক তদবিরবাজ কিংবা প্রবীণ মুক্তিযোদ্ধা যেই আসুক তাদের কাছে সমান ট্রিটমেন্ট। তবে তদবিরবাজ প্রয়োজনে হাতে একটি নোট ধরিয়ে দিতে পারে। গ্রাম থেকে আসা 'দরিদ্র মুক্তিযোদ্ধার' সে ক্ষমতা কোথায়? একাত্তরে গ্রামের যে কৃষক বা দিনমজুর কিংবা কারখানার শ্রমিক অথবা স্কুল-কলেজের ছাত্র অমিত বিক্রমে পাকিস্তানের সৈন্য এবং জামায়াতে ইসলামী ও মুসলিম লীগের কর্মীদের নিয়ে গঠিত আলবদর-রাজাকার বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়েছে তাদের এখন মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয়ে হাজির হতে হচ্ছে 'নিরস্ত্র' হয়ে এবং ভেতরে প্রবেশের সময় কারও কারও মেলে পুলিশের লাঠির গুঁতা কিংবা হাতের ধাক্কা। এ মন্ত্রণালয়ে যাদের দায়িত্ব দেওয়া হয় তাদের মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে কীভাবে আচরণ করতে হবে সেটা কি বলা হয়? আমি ব্যক্তিগতভাবে যে দু'বার ওই মন্ত্রণালয়ে গিয়েছি তাতে সেটা মনে হয়নি। সোনালী ব্যাংকের আগৈলঝাড়া শাখায় যখন ভাতা তুলতে গিয়েছি, সেখানেও মনে হয়নি। ব্যাংকের ম্যানেজারের সঙ্গে এ বিষয়ে কথা বলার চেষ্টা করেছি। তার যুক্তি একটাই_ লোকবল কম। কিন্তু কর্মী যদি একজনও থাকে, তার তো আন্তরিক ও মানুষের প্রতি দরদি হতে বাধা নেই। আর মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মান ও শ্রদ্ধার প্রসঙ্গ যদি আসে তাহলে বলব যে, এ দেশে অনাগতকালে অনেক গুরুত্বপূর্ণ পদে অভিষিক্ত হবেন অনেক অনেক মানুষ, তারা রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী কিংবা সচিব হবেন; কিন্তু তাদের কেউ তো মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে পরিচয় দিতে পারবেন না! এ পরম মর্যাদা একটি নির্দিষ্ট সময়ে (একাত্তরে) অনন্য এক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারা কিছু লোকের জন্য ফয়সালা হয়ে রয়েছে।
একাত্তরে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের পালাটানার গহিন বনে ২১ দিনের প্রশিক্ষণ শেষে ক্যাম্প কর্তৃপক্ষ হাতে তুলে দিয়েছিলেন ২১ টাকা_ প্রতিদিনের জন্য এক টাকা করে। আর যুদ্ধজয় শেষে যখন বরিশালের গৌরনদী থানার ক্যাম্প থেকে বিদায় নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরে আসি, তখন দেওয়া হয় ৫০ টাকা। এরপর চার দশক অতিক্রান্ত হয়েছে। সরকারের কাছ থেকে প্রথমবারের মতো সম্মানী ভাতা পেয়েছি মাসে দুই হাজার টাকা করে। এ তালিকায় যাতে আমার নাম ওঠে সেজন্য আগৈলঝাড়ার মুক্তিযোদ্ধারা আন্তরিকভাবে চেষ্টা করেছেন। যাদের সঙ্গে একাত্তরে মুক্তিবাহিনী সংগঠিত করেছি এবং পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে লড়েছি তাদের এ আন্তরিকতা ভুলব না। ভাতা আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ কখনোই ছিল না। কিন্তু 'মাসে এক টাকা হলেও ভাতা চাই'_ এমন প্রত্যাশা ব্যক্ত করেছি বিভিন্ন সময়ে। ২৪ এপ্রিল ভাতা গ্রহণের সময় চোখের জল ধরে রাখা কঠিন ছিল। এটা ছিল আনন্দের প্রকাশ। কিন্তু দেশের সর্বত্র অনেক মুক্তিযোদ্ধা রয়েছে যাদের চোখের জল প্রতিনিয়ত পড়ছে কষ্টে। তাদের সংসারে অভাব, সমাজে অবহেলা। অনেকে উপযুক্ত চিকিৎসার অভাবে কষ্ট পাচ্ছেন। কঠিন ব্যাধিতে আক্রান্ত হলে তাদের পাশে রাষ্ট্র পূর্ণ ক্ষমতা নিয়ে দাঁড়াবে, এমন ব্যবস্থা চালু হয়নি এখনও। কিন্তু এটা করা কি অসম্ভব? এক দশক পর এমন সুবিধা দিতে চাইলেও ক'জনকে পাওয়া যাবে? মুক্তিযোদ্ধারা যাতে উপযুক্ত চিকিৎসার অভাবে বা চিকিৎসকের অবহেলায় মারা না যায় সেজন্য নিশ্চিয়ই রাষ্ট্র কিছু করতে পারে। দেশে অনেক প্রাইভেট ক্লিনিক স্থাপিত হয়েছে এবং তাদের ব্যবসাও ভালো। তারাও এগিয়ে আসতে পারে। একাত্তরে সাতক্ষীরার রণাঙ্গনে আমাদের এক সহযোদ্ধা আহত হয়েছিল। তার বুকে গুলি লাগে। কিন্তু নিকটস্থ হাসপাতাল ছিল অনেক দূরে এবং পথ ছিল কেবলই হাঁটার। রণাঙ্গনে অবস্থানের কারণে জানতেও পারিনি সে সময়ে তাকে চিকিৎসা দেওয়া সম্ভব হয়েছিল কি-না। কিন্তু এখন স্বাধীনতার চার দশক পর মুক্তিযোদ্ধাদের তেমন দুর্ভোগ যেন না হয়।
সরকার মুক্তিযোদ্ধাদের 'সুবিধা' বাড়াচ্ছে। মুক্তিযোদ্ধাদের যে তালিকা এখন মোটামুটি চূড়ান্ত, তা একটু ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করলেই দেখা যাবে যে সশস্ত্র লড়াই যারা করেছেন তাদের বেশিরভাগ এসেছে অপেক্ষাকৃত অসচ্ছল পরিবার থেকে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা মুক্তিযুদ্ধের জন্য জনগণকে সচেতন ও সংগঠিত করায় অনন্য অবদান রেখেছে। কিন্তু যখন অস্ত্র তুলে নেওয়ার সময় এসেছিল, তখন এই 'জনগণই' এগিয়ে আসে বিপুল সংখ্যায়। আমি যে ক্যাম্পে প্রশিক্ষণ নিয়েছি সেখানে প্রথম ব্যাচে ১৭শ' জনের মধ্যে মাত্র একজন ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র এবং মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পাস করা ছিল ২০ জনের মতো। পরে ত্রিপুরার মেলাঘর ও পশ্চিমবঙ্গের বাগুনদিয়ার অপারেশন ক্যাম্পে অবস্থানকালেও দেখেছি, বর্ষা ও শীতের মধ্যেও ভূমিশয্যায় থাকা মুক্তিযোদ্ধাদের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশই দরিদ্র পরিবার থেকে আসা। এদের পুত্র-কন্যা এবং নাতি-নাতনিদের পড়াশোনা ও চাকরির ক্ষেত্রে কিছু কোটা রয়েছে। এটা অবশ্যই মনে রাখতে হবে, একাত্তরে যারা লড়েছেন তাদের বেশিরভাগ স্বাধীন দেশে বড় সরকারি পদের জন্য দরখাস্ত করার মতো অবস্থায় ছিলেন না। তাদের সবার 'শিক্ষাগত যোগ্যতা' ছিল না। বয়সের সমস্যাও ছিল। এ কারণে আন্তরিকতা থাকলেও তাদের জন্য বড় কিছু করা সরকারের পক্ষে সম্ভব হয়নি। কিন্তু দেশের দুর্ভাগ্য যে, ১৯৭৫ সাল থেকে সামরিক শাসন এবং সামরিক শাসকদের প্রতিষ্ঠিত দুটি দল বিএনপি ও জাতীয় পার্টির শাসনামলে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য সরকারের তরফে কিছু করার আন্তরিকতারও অভাব ছিল প্রচণ্ড। এখন মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তানদের অনেকে উপযুক্ত হয়েছে। প্রজন্ম '৭১ এবং এ ধরনের আরও সংগঠন মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও আদর্শকে সামনে নিয়ে আসায় অবদান রেখেছে। জামায়াতে ইসলামী এবং তাদের মতো একাত্তরের চেতনার বিরোধী অন্যান্য শক্তি যখন গলা ফাটিয়ে বলতে শুরু করেছিল, 'একাত্তর অতীতের বিষয়' তখন এ নবীন প্রজন্মই আরও বলিষ্ঠ কণ্ঠে বলে ওঠে_ 'একাত্তরের চেতনা অবিনাশী'। মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তানদের জন্য সরকার আরও কিছু করুক, সেটাই চাইব। এতে করুণার বিষয়টি কোনোভাবেই যেন স্থান না পায়। এটা তাদের ন্যায্য পাওনা। যারা নিজেদের যোগ্যতায় সমাজে স্থান করে নিতে পারবে, তাদের নিয়ে ভাবনা কম। কিন্তু দারিদ্র্যের কারণে যাদের নিয়মিত খাবার জোটেনি, শিক্ষার সুযোগ থেকে থাকতে হয়েছে বঞ্চিত এবং এ কারণে পরবর্তী প্রজন্মকেও ঠিকভাবে পড়াশোনা করাতে পারেনি, তাদের বিষয়টি অবশ্যই গুরুত্বের সঙ্গে দেখতে হবে। এদের জন্য কোটা সুবিধা থাকতেই হবে।
মুক্তিযোদ্ধাদের লড়াই কিন্তু এখনও শেষ হয়ে যায়নি। ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বরের সাধারণ নির্বাচনে তারা যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে ঐক্যবদ্ধ অবস্থান গ্রহণ করেছিল এবং দেশবাসী তাকে যথাযথ গুরুত্ব দিয়েছিল। বিএনপির একটি অংশ এবং তাদের নির্বাচনী মিত্র জামায়াতে ইসলামী ও ইমলামী ঐক্যজোট এ বিষয়টি ভালোভাবে গ্রহণ করেনি। মুক্তিযোদ্ধাদের যাতে সম্মানহানি ঘটানো যায় সেজন্য তাদের চেষ্টা রয়েছে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হোক, সেটা কোনোভাবেই চায় না তারা। মধ্যবর্তী নির্বাচনের দাবির মুখ্য কারণ তো এটাই। এজন্য সূক্ষ্ম ও স্থূল কৌশলে অসত্য-বিকৃত প্রচারণায় তারা সদা তৎপর। একাত্তরে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সঙ্গে থাকা কিছু লোক এখন আওয়ামী লীগের সঙ্গেও রয়েছে। তারাও সঙ্গত কারণেই মুক্তিযুদ্ধের চেতনা নিয়ে মাথা ঘামাতে চায় না। দেশের স্বার্থ তাদের কাছে বড় নয়। শ্রমে-ঘামে সমৃদ্ধ দেশ গড়ে তোলার জন্য তাদের মাথাব্যথা নেই। বরং ক্ষমতাসীন দলের আশপাশে থেকে কিংবা স্থানীয় পর্যায়ে নেতৃত্বের পদ দখল করে নিজেদের আখের গোছাতেই তাদের আগ্রহ। এদের বিরুদ্ধে এখনও রক্ষাকবচ কিন্তু একাত্তরের যোদ্ধারাই। যুদ্ধাপরাধী এবং তাদের ঘনিষ্ঠ সহযোগীদের বিরুদ্ধে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহে তারা দেশের সর্বত্র সহায়তা করছে। এ লড়াইয়ে নিশ্চিতভাবেই তারা জয়ী হবে। সরকার যদি তাদের যথাযথ সম্মান না দেয়, সমাজের প্রভাবশালীরা যদি তাদের প্রতি মুখ ফিরিয়ে রাখে তাতেও তারা পিছপা হবে না। কিন্তু এমন অবস্থা তো কোনোভাবেই কাম্য নয়। তাদের একটু কিছু নয়, বরং অনেক কিছু করার রয়েছে এবং তা করতেই হবে। এ কাজ ভালোভাবে করার জন্য মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয় এবং মুক্তিযোদ্ধা সংসদের রয়েছে বিশেষ ভূমিকা। তাদের তৎপরতায় দক্ষতা ও আন্তরিকতা যত বাড়বে, একাত্তরের যোদ্ধাদের 'শেষ জীবন' তত সহজ হতে পারবে।
অজয় দাশগুপ্ত : মুক্তিযোদ্ধা ও সাংবাদিক
ajoydg@gmail.com
No comments