বন্ধুর বর্ষাবিলাস

এই মেঘলা আলসে দুপুরে বর্ষা এসে মনে জাপটে ধরেছে। সমস্ত আকাশ দখল করে কালো হয়ে বসে আছে পাগলা মেঘ। আমার বড় চোখ ডানাভেজা পাখির মতো বেলকনির রেলিং ধরে ঠায় দাঁড়িয়ে। সেটা যে ছিল আষাঢ়। স্কুলের শেষ বেঞ্চে আমি। মুষলধারে বৃষ্টি। ভেসে যাচ্ছে স্কুলের উঠোন, বাগান, চৌকাঠ, টিনের চাল। ব্ল্যাকবোর্ডে জটিল পাটিগণিত।


আমার কাছে ভরা পুকুর। সেখানে সংখ্যাগুলো কই, পুঁটি, চিংড়ি হয়ে বৃষ্টির মতো লাফাচ্ছে। মা বলে দিয়েছেন, স্কুল থেকে সোজা বাড়ি। তালপুকুরে যাবে না, বড়শি ছুঁতে পারবে না, বৃষ্টিতে ভেজা যাবে না একদম, ইন্দিরার সঙ্গে নদীতে গেলে তোর একদিন না-হয় আমার...!
আমি বর্ষায় মায়ের অবাধ্য প্রতিদিন।

২.
সেবার রথের মেলায় বৃষ্টি আর থামলই না। সাত দিন অনবরত-ঝরল। তাই কাগজের নৌকায় ভেসে গেল স্কুলের রাস্তা। বাবা মেলা থেকে কিনে দিলেন সিন্দাবাদের জাহাজ। কেরোসিনচালিত যান—টিনের লঞ্চ। আমাদের মেঠোপথ তখন নদী। জাহাজের পেছনে প্রদীপ জ্বালিয়ে আমি এক ভাসমান নাবিক। অদ্ভুত ভটভট সুর, কালো কালো ধোঁয়া। একদিন দেখলাম, তিরের মতো একটি মাছরাঙা আকাশ থেকে খসে পড়ল মেঠোপথে, তার তলোয়ারের মতো ঠোঁটে রুপালি পুঁটি। আমাদের ছিল বাঁশ দিয়ে গড়া ঘর। তাই আকাশে অন্ধকার নামলে ভীষণ হুলস্থুল। দাদু বলতেন, ‘তুফান এলে ঠাকুর দেবতার নাম নিবি।’ কিন্তু তুফান এলেই আমার মনে পড়ত টিনের টুলিতে জোড়া শালিকের ছানা, তালপুকুরের বাবুই পাখি, পশ্চিমের বাঁশঝাড়ে বকের সংসার। ইন্দিরাদের খুব নড়বড়ে গোয়ালঘর। কাউকে কখনো বলা হয়নি আমার স্বপ্নের সেই ঘরগুলোর কথা—ঘুমিয়ে ছিল যেখানে অবাধ আসা-যাওয়া।
এক কালরাতে মাতাল ঝোড়ো হাওয়া উড়িয়ে নিল আমার দুই চোখের মণির মতো জোড়া শালিক।
সে রাতে আমার আর ঘুম হলো না। এক কাঁথার ভেতর আমি আর দাদু। আমাদের গা-ঘেঁষে বড়দা। আমার বুকে মা-শালিকের আর্তনাদ। ছানার কথা ভেবে নিঃশব্দে কাঁদতে কাঁদতে ভোর হলো।

৩.
তারপর একদিন আমাদের ভরা গাঙে স্পিডবোট উড়ে এসে জুড়ে বসে। তুফানের আওয়াজ তুলে শিকারি পাখির মতো জল ঝাপটিয়ে যায়। আমার কত ইচ্ছে হয়েছে সেই পক্ষিরাজে ওড়ার। কত রাত ঘুমে পাড়ি দিয়েছি শত শত পুকুর। সেই ভেজা স্যাঁতসেঁতে ইচ্ছেগুলো আজও বাক্সবন্দী। মনসামঙ্গলের দিনগুলো এখন মনে হয় রূপকথা। আমার কচুরিপানার বেহুলা-লখিন্দর, সবুজ রঙের কালনাগ, পাটকাঠির হাজারো স্বর্ণমুদ্রা, ভেলা।
এক অবাক কচুরিপানার পুতুল গড়ত বড়দা। একটা ছেলে, অন্যটা মেয়ে। আমি সব সময় মেয়ের বাবা। বড়দা চাঁদ সওদাগর। কলাপাতার সানাই বাজিয়ে বিয়ে হতো। বরযাত্রী, হাতি, ঘোড়া, সিপাই—সবাই আমাদের অতিথি। পেট ভরে খাওয়া-দাওয়া। শাপলার ডাঁটা আমাদের কাছে হরিণের মাংস, চালের তুষে পোলাও, লাল ইট সর্ষে ইলিশ—সে এক এলাহি কারবার। কিন্তু দিনশেষে যখন বৃষ্টি নামত, উঠোনের হাঁটুজলে তখন কোথাকার এক নাগ এসে ছেলে পুতুলকে কেটে দিত। আমরা এক বুক মন খারাপ নিয়ে পাটপাঠির ভেলা সাজিয়ে বেহুলা-লখাইকে ভাসিয়ে দিতাম দারুণ উঠোনে।

৪.
যাই-যাচ্ছি করে যাওয়া হয়নি বাড়িতে। অথচ কদম ফুটেছে সেই কবে। বৃষ্টিতে কদম ছিঁড়তে গিয়ে একবার হাত ভেঙে যায়। বাবা কঠিন সিদ্ধান্ত নিলেন। আজ হাত ভেঙেছে, কাল পা ভাঙবে। গাছটা কাটা দরকার। পরের দিন দৈত্যের মতো দুজন লোক হাজির। দেখে চোখ মাথায় তুললাম, আকাশ কাঁপিয়ে চিৎকার। চিৎকার শুনে প্রতিবেশীরা জড়ো হয়ে গেল। সে যাত্রায় প্রতিবেশীদের কল্যাণে গাছটি বেঁচে গেল। তার পর থেকে পরিবার বুঝে গেল বর্ষায় আমার দুর্বলতা। এক মাঠ কাদা নিয়ে খেলাশেষে ঘরে ফিরলেই বাবা দৈত্যদের ইশারা করতেন। বিকেলে প্রাইভেট পড়তে আমার ভালো লাগে না। দাদুকে কত করে বললাম, দাদু শুনলেনই না। গাছ কাটার ভয় দেখালেন। দাদুকে কী করে বোঝাই, এক তোড়া কদম পেলে ইন্দিরা কতটা খুশি হয়। তার সারা বেলা কেটে যায় কদমের মালা বুনতে বুনতে। বাইরে অঝোর বৃষ্টি। আমি বেলকনি ছেড়ে ছাদে এসে দাঁড়াই। বৃষ্টিতে আমার শরীর ভেসে যায়। চোখ ঝাপসা হয়ে ওঠে। আমি চোখ বন্ধ করে দেখতে পাই ক্লাসরুম, ভরা উঠোন, মাছরাঙা, রথমেলা, কাগজের নৌকা, ভেলা, পুকুর, কচুরিপানা, কদমগাছ। হাজারো কদমের সমারোহ যেন আমাকে ডাকছে।

No comments

Powered by Blogger.