স্মরণ-সুন্দরবনকে ভালোবাসতেন তিনি by কামাল লোহানী

তোহা খান। সাংবাদিক, লেখক ও প্রগতি চিন্তার এক সচেতন মানুষ ছিলেন। অসাম্প্রদায়িক চেতনা তাঁকে ঋদ্ধ করেছিল প্রবলভাবে। ছোটবেলায় মনুষ্যসৃষ্ট ছিয়াত্তরের (বাংলা সন) মন্বন্তর ও ইংরেজি ছেচল্লিশের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা এবং অখণ্ড ভারতকে সাম্রাজ্যবাদী চক্রান্তে দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে দুই ভাগ করে পাকিস্তান-হিন্দুস্থান করার কারসাজি প্রত্যক্ষ


করেছেন। তখন তিনি কলকাতায় ছিলেন। কারণ, তাঁর বাবা আবদুল হাকিম খান কলকাতা থেকে প্রকাশিত দোর্দণ্ড প্রতাপশালী মুসলিম লীগ-সমর্থক দৈনিক আজাদ পত্রিকার ম্যানেজার ছিলেন।
সাংবাদিকতার পাশাপাশি তাঁকে সবচেয়ে বেশি আকর্ষণ করেছিল এই বাংলার দক্ষিণাঞ্চলের অভূতপূর্ব প্রাকৃতিক সম্পদ ‘সুন্দরবন’। আমি তো মনে করি, পর্যটক এবং শিকারিদের জন্য অতীব আকর্ষণ বন্য প্রাণী ও প্রকৃতির বিস্ময়কর সম্পদের ভান্ডার এই দুর্ভেদ্য সুন্দরবন। ‘বাওয়ালি’ শ্রেণী গড়ে উঠেছিল অনেক আগেই। কিন্তু ওদের জীবন ধারণে সুন্দরী কাঠ, গোলপাতা আর মধু আহরণে বিরাট অংশ জুড়ে আছে। এই জনগোষ্ঠীর কাছে প্রকৃতির এই দুয়ার খুলে দেওয়ার ক্ষেত্রে তোহা খান এক বিরাট দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি সুন্দরবনে গেছেন অসংখ্যবার, প্রায় বছরই। ফিরে এসে তিনি তখনকার সবচেয়ে জনপ্রিয় দৈনিক ইত্তেফাক-এর সাহিত্য সাময়িকীতে লিখতেন। আজ তোহা খান বিস্মৃতির অতলে। কিন্তু তাঁর সুন্দরবন প্রাকৃতিক সম্পদ আর বন্য প্রাণীর মুক্ত জীবন নিয়ে আজও বিশ্বের বিস্ময়, শ্রেষ্ঠ ম্যানগ্রোভ হিসেবে লড়ে যাচ্ছেন বিপর্যয় ও সংকটের বিরুদ্ধে। সাংবাদিকতা তোহা ভাইয়ের পেশা ছিল; কিন্তু নেশায় ধরেছিল সুন্দরবন।
সাংবাদিকতায় আমাদের পূর্বপুরুষ ছিলেন তাঁরা। যাঁদের মধ্যে জাত সাংবাদিক হিসেবে ছিলেন ডা. ফজলুল করিম খান, সিরাজুদ্দীন হোসেন, খোন্দকার আবু তালেব, কে জি মুস্তাফা, আখতার উদ্দিন, আবুল কাশেম, দুদু ভাই, মোজাম্মেল হক, আ. খালেক খান, মোসলেম আলী বিশ্বাস, মোহাম্মদ হোসেন, এস এ মান্নান (লাডু ভাই), সাহাদাত হোসেন, শামসুল আলম খান, হাবিবুর রহমান, মোহাম্মদ উল্লাহ চৌধুরী, শামসুল হক, রোকনুজ্জামান খান, খাদেম ভাই, মিজানুর রহমান, হাসানুজ্জামান খান এবং আরও অনেকে।
তোহা খান ১৯২৭ সালের ১ এপ্রিল তাঁর নানাবাড়ি এখন পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার হাকিমপুরে জন্মগ্রহণ করেন। লেখাপড়া করতে তিনি সাতক্ষীরা প্রাণনাথ হাইস্কুলে ভর্তি হন এবং ১৯৪৩ সালে তিনি প্রবেশিকা পাস করে কলকাতা ক্যাম্বেল হসপিটাল কলেজে চিকিৎসাবিদ্যা অধ্যয়নে আত্মনিয়োগ করেন। কিন্তু চূড়ান্ত পর্বে এসে মনটা যেন ভিন্নপথে বইতে শুরু করে। তিনি চাকরিতে ঢুকে পড়েন। তখন দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের শেষ পর্যায়। ১৯৪৩ সাল তো মহামন্বন্তরের কাল। এ সময় তোহা ভাইয়ের মধ্যে রাজনীতির প্রতি আগ্রহ সৃষ্টি হয়। অখণ্ড ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে তাঁর চিন্তার মিল খুঁজে পান। কারণ, তখন তিনি বাস শ্রমিক ইউনিয়নের সঙ্গে কিছুদিন কাজ করেছিলেন।
তোহা ভাই রাজনীতি এবং পারিবারিক সম্পৃক্ততার সুবাদে সাংবাদিকতায় প্রবেশ করেন ১৯৪৭ সালে দৈনিক আজাদ-এ। আজাদ কলকাতা থেকে প্রকাশিত হতো। তোহা ভাই ১৯৫১ সালে ঢাকা অর্থাৎ পাকিস্তান নামের নতুন মুসলিম রাষ্ট্রের পূর্বাংশের রাজধানী শহরে চলে এলেন। এসে দৈনিক আজাদ-এ যোগ দেন সহসম্পাদক হিসেবে। এমনিভাবে সাংবাদিকতায় অভিজ্ঞতা অর্জন করে সংবাদ, ইত্তেফাক, গণকণ্ঠ-এ সাংবাদিকতায় নিয়োজিত ছিলেন। ১৯৮৮ সাল পর্যন্ত ৪১ বছর এই পেশায় অধ্যবসায় এবং মেধা দিয়ে যেমন সমাজ ও রাষ্ট্রকে সেবা করেছেন, তেমনি বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতার সাক্ষ্যও রেখে গেছেন। ওঁরা সবাই আমাদের অগ্রণী ছিলেন তো বটেই, ছিলেন পথপ্রদর্শকও। সব সংবাদপত্রের সাংবাদিক, সংবাদপত্র কর্মচারী ও প্রেস শ্রমিকদের সৌভ্রাতৃত্বের এক অনুকরণীয় বন্ধনে আবদ্ধ ছিলেন। কোনো দলবাজি বা দলীয় প্রভাব সাংবাদিকতাকে কলুষিত করতে পারত না। সত্যি কথা বলতে কি, তখন সংবাদপত্রের মালিকের দাপট ছিল না, ছিল সাংবাদিকদের সত্যনিষ্ঠতা এবং স্বাধীনতা। কোনো মালিক তাঁর স্বার্থ রক্ষায় পত্রিকাকে ব্যবহার করতে পারতেন না। সংবাদপত্র থেকে বিদায় নিলেও ১৯৯৫ সাল পর্যন্ত তিনি কলাম লিখতেন। নব্যদর্শীর দিব্যদর্শন, ‘আমরা খাসা আছি’। তারপর আমাদের প্রিয় তোহা ভাই মৃত্যুবরণ করেছেন ১৯৯৬ সালের ১৪ এপ্রিল। জন্ম তাঁর পয়লা এপ্রিল, মৃত্যু পয়লা বৈশাখ। এক অদ্ভুত সম্মিলন ঘটেছে এই জন্ম-মৃত্যুতে।
যে সুন্দরবনের কথা শুরুতেই বলেছি, তার সঙ্গে যেন তিনি সব কাজে একাত্ম হয়ে গিয়েছিলেন। গেছেন বারবার। লিখেছেন প্রচুর। গ্রন্থাকারেও বেরিয়েছে সেসব। আশির দশকের প্রথম দিকে সরকারি অর্থানুকূল্যে সুন্দরবন ও জীববৈচিত্র্য নিয়ে একটি প্রামাণ্যচিত্র তৈরি করে জগৎজোড়া সুন্দরবনের প্রচারে সহায়তা করেছেন তিনি। ১৯৪৮ সাল থেকে ১৯৮৫ সাল পর্যন্ত তোহা ভাই নিরন্তর সুন্দরবন সফর করেছেন। সুন্দরবনকে নিখুঁতভাবে অনুসন্ধান ও অনুধাবন করার চেষ্টা করেছেন বলেই একাধিক গ্রন্থ: রূপসী সুন্দরবন, রয়েল বেঙ্গল টাইগার, সুন্দরবনের বাওয়ালী, বাঘের সন্ধানে সুন্দরবনে ইত্যাদি রচনা করেছেন।
তোহা খান জগৎখ্যাত সমাজসেবী হেলেন কেলারের জীবনী অনুবাদ করে গ্রন্থাকারে ছেপেছেন। বেতার নাটকও রচনা করেছেন তিনি। তার মধ্যে বনবিবির কিস্সা ও গাজীকালু চম্পাবতী উল্লেখযোগ্য।
১৯৮২ সালে খুলনা প্রেসক্লাব তোহা ভাইকে শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ সাংবাদিক হিসেবে সংবর্ধনা দেওয়া হয়। ১৯৯০ সালে সাহিত্য ও সাংবাদিকতায় ‘মাহবুবউল্লাহ-জেবুন্নেছা স্বর্ণপদক’ লাভ করেন।
১৯৭৫ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন ও পূর্ব ইউরোপীয় দেশ—জিডিআর চেকোস্লোভাকিয়া, হাঙ্গেরি, পোল্যান্ড সফর করেন।
তোহা ভাইকে দেখেছি বড় ভাইদের বন্ধু হিসেবে, শ্রদ্ধা করেছি অগ্রণী সাংবাদিক হিসেবে এবং সম্মান জানিয়েছি সৎমানুষ হিসেবে।
কামাল লোহানী

No comments

Powered by Blogger.