সমকালীন প্রসঙ্গ-ভারতে আন্না হাজারের অনশন ও দুর্নীতি সমাচার by বদরুদ্দীন উমর
রাজনৈতিক প্রতিবাদ ও দাবি আদায়ের পদ্ধতি হিসেবে ভারতে অনশনের প্রচলন করেন কংগ্রেস নেতা গান্ধী। সেই থেকে অনশনকে আন্দোলনের হাতিয়ার হিসেবে অনেকেই অনেক সময় ব্যবহার করে আসছেন। গান্ধীবাদী সমাজকর্মী আন্না হাজারে ভারত থেকে দুর্নীতি নির্মূল করার উদ্দেশ্যে সরকারকে লোকপাল বিল পাস করতে বাধ্য করার জন্য আমরণ অনশন করেন।
বর্তমান বিশ্বে সর্বপ্রধান দুর্নীতিগ্রস্ত দেশগুলোর অন্যতম হচ্ছে ভারত। বিশ্বের এই 'বৃহত্তম গণতান্ত্রিক' দেশে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রকৃত চরিত্র এর মধ্যে প্রতিফলিত হয়_ এ কথা বললে সত্যের কোনো অপলাপ হয় না। ভারত একটি বৃহৎ দেশও বটে। বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা যায়, সুইজারল্যান্ডের ব্যাংকগুলোতে ভারতীয় নাগরিকদের লাখ লাখ কোটি দুর্নীতিলব্ধ ডলার জমা আছে। এদিক দিয়ে বিশ্বে ভারতের স্থান সর্বশীর্ষে! রাজনীতিবিদ, সরকারি আমলা, ব্যবসায়ীদের হিসাবে সেখানকার ব্যাংকগুলোতে এই অর্থ জমা হয়েছে ভারতের শ্রমজীবী কৃষক, শ্রমিক ও মধ্যবিত্তের রক্ত শোষণ করে, তাদের গরিব থেকে আরও গরিব বানিয়ে, অভুক্ত-অর্ধভুক্ত রেখে, ভিটেমাটি থেকে উচ্ছেদ করে, তাদের পকেট মেরে। রাতারাতি এটা হয়নি। দীর্ঘদিন ধরে দুর্নীতির এই প্রক্রিয়া জারি থেকে এখন তা দেশটির সর্বস্তরে, বিশেষত শাসকশ্রেণীর সর্বস্তরে ছড়িয়ে পড়ে যে পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে তারই একটা প্রতিফলন অন্য অনেক কিছুসহ আন্না হাজারের অনশনের মধ্যেও দেখা গেল। অনশন করে ভারতের মতো এক বিরাট দেশে বা অন্য কোনো দেশে দুর্নীতি নির্মূল করা বা কমিয়ে আনা যায়, এটা এক অবাস্তব চিন্তা। যে চিন্তা অবাস্তব তার থেকে প্রসূত কর্মসূচিও যে অবাস্তব ও পরিণামে অকার্যকর হবে এতে সন্দেহ নেই। কিন্তু আন্না হাজারের এই অনশন ভারতে দুর্নীতি নির্মূল করা বা কমিয়ে আনার ক্ষেত্রে কিছু করতে না পারলেও এ দুর্নীতি বিষয়টিকে সামনে আনার ব্যাপারে একটা ভূমিকা পালন করেছে। এর মাধ্যমে বিশ্বের সর্ববৃহৎ গণতন্ত্র হিসেবে ভারতের শাসন ব্যবস্থার শোষণমূলক এবং অগণতান্ত্রিক চরিত্রও অনেকখানি উন্মোচিত হয়েছে। বারো দিন অনশনের পর ভারত সরকার ও তাদের পার্লামেন্ট আন্না হাজারের দেওয়া তিনটি শর্ত মেনে নেওয়ার পর তিনি আজ ২৮ আগস্ট সকালে তার অনশন ভঙ্গ করেছেন। অনশন কোনো বিপ্লবী কর্মসূচি তো নয়ই, এর দ্বারা খুব জোর কিছু সংস্কারমূলক দাবি আদায় হতে পারে। এটা গান্ধীর অনশনের সময়েও দেখা গেছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও আন্দোলনের পদ্ধতি হিসেবে অনশনের একটা ভূমিকা ব্রিটিশ আমলে দেখা দিয়েছিল। ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্টের পর জওয়াহেরলাল নেহরুর কংগ্রেস সরকার পাকিস্তানকে দেয় নির্ধারিত অর্থ দিতে অস্বীকার করে। এর প্রতিবাদে ও ভারত সরকার কর্তৃক দেশ ভাগের সময় গৃহীত সিদ্ধান্ত অনুযায়ী পাকিস্তানকে দেয় টাকা পরিশোধ করতে বাধ্য করার উদ্দেশ্যে গান্ধী অনশন করেন এবং নেহরু সরকার পাকিস্তানকে তাদের প্রাপ্য অর্থ প্রদান করার পর তিনি তার অনশন ভঙ্গ করেন।
দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে ভারতে আসার পর ১৯১৪ সালে তিনি প্রথম অনশন করেন। ১৯৪৭ সালের এ অনশনই ছিল তার জীবনের শেষ অনশন।
গান্ধী ও তার অনুসারীরা যে অনশন করতেন এবং এখন আন্না হাজারের মতো গান্ধীবাদী যে অনশন করেছেন তার মধ্যে কোনো ফাঁকি থাকেনি। এই অনশনের সময় কেউ কেউ নিরম্বু (পানি না খেয়ে) উপবাস করেন। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই শরীরের শুষ্কতা (ফবযুফবঃরড়হ) যাতে না ঘটে এ জন্য তারা পানি খেয়ে থাকেন। গান্ধী জীবনে অনেকবার অনশন করেছেন এবং কখনও সপ্তাহের পর সপ্তাহ। এখন আন্না হাজারে বারো দিন অনশনের পর তা ভঙ্গ করেছেন। কাজেই এই অনশনের কার্যকারিতা অল্পবিস্তর যাই থাকুক, এটা সহজ কাজ নয় এবং এতে জীবনের প্রতি ঝুঁকি থাকে অনেক বেশি।
বাংলাদেশে এখন খুব ঘন ঘন অনশন হয়। কত রকম ইস্যু নিয়ে যে অনশন হয় তারও কোনো ঠিক নেই। কিন্তু দেখা যায়, এসব অনশনে কোনো সময়েই রাত পোহায় না। আগে থেকেই ঘোষণা দেওয়া হয়, সকাল ৮টা বা ১০টা থেকে বিকেল ৪টা বা ৬টা বা ওই ধরনের ছয় ঘণ্টা, আট ঘণ্টা অনশনের! অর্থাৎ সকালে বেশ ভালো করে খাওয়া-দাওয়া করে প্রেস ক্লাবের সামনে, জাতীয় জাদুঘরের সামনে, পুরানা পল্টনে, মুক্তাঙ্গনে অথবা ওই রকম কোনো জুতসই জায়গায় শতরঞ্জি বিছিয়ে, শামিয়ানা টাঙিয়ে এসব অনশন হয়! অর্থাৎ রমজানের সময় ভোর রাতে খেয়ে পরদিন সন্ধ্যা পর্যন্ত রোজাদাররা এক মাস ধরে যেভাবে দিনে উপোস থাকেন সে রকম কিছুও এই তথাকথিত অনশনগুলোতে দেখা যায় না! অনশনকারীরা দিব্যি খাওয়া-দাওয়া করে মজলিসে বসে আড্ডা দিয়ে অনশন পালন করেন! ফলে দেখা যায়, গান্ধী ও গান্ধীবাদীদের অনশনের যে কার্যকারিতা ছিল বা এখনও আছে, যা এখন আন্না হাজারের বারো দিনের অনশনের মাধ্যমে নতুন করে দেখা গেল, তার তিলমাত্র বাংলাদেশি রাজনীতিবিদ ও মানবাধিকার কর্মীদের অনশনের মধ্যে দেখা যায় না। তবে সংবাদপত্রে এর সচিত্র রিপোর্ট ছাপা হয় এবং এর মাধ্যমে অনশনকারীরা একটা প্রচার লাভ করেন। কিন্তু প্রচার লাভ করলেও যে ইস্যুতে তারা অনশন করেন সে ইস্যুর কোনো সুরাহা এই ধরনের অনশনের মাধ্যমে হয় না। এর কারণ, যেভাবে এসব অনশন পালন করা হয় তাতে সংস্কারবাদীরা যেভাবে একে ব্যবহার করে এসেছেন তাকে ব্যঙ্গ করা ছাড়া আর কিছুই হয় না। এর মধ্যে কোনো শক্তি থাকে না। অনশনের ভণ্ডামিপূর্ণ ব্যবহারের মাধ্যমে সংগ্রামের পদ্ধতি হিসেবে একে ভোঁতা ও হাস্যকর ব্যাপারে পরিণত করা হয়। বলাই বাহুল্য, স্বাধীন বাংলাদেশের শাসকশ্রেণী ও তাদের সহযোগী মধ্যশ্রেণীভুক্ত লোকজন এখন যে চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য অর্জন করেছেন, তার সঙ্গে অনশন নিয়ে এ ভণ্ডামি খুবই সঙ্গতিপূর্ণ। শুধু অনশনই নয়, এখন ধর্মঘট ও হরতালের অবস্থাও একই প্রকার। ধর্মঘট ও হরতাল জনগণের এক গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক অধিকার এবং সংগ্রামের এক কার্যকর হাতিয়ার। কিন্তু বাংলাদেশে কারণে-অকারণে, অতি তুচ্ছ থেকে নিয়ে অনেক নির্বোধ লক্ষ্য সামনে রেখে, বিভিন্ন চক্রের স্বার্থে যেভাবে কথায় কথায় হরতাল ও ধর্মঘটের আহ্বান জানানো হয় ও হরতাল পালিত হয়, তাতে হরতালের বা ধর্মঘটের আর কোনো ধার, শক্তি বা কার্যকারিতা থাকে না। কাজেই এসব হরতালকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে সরকার তার নানাবিধ গণবিরোধী তৎপরতা অব্যাহত রাখতে অসুবিধা বোধ করে না। বাংলাদেশে সর্বক্ষেত্রে দুর্নীতি যেভাবে ছেয়ে গেছে এটা সকলেরই জানা। ওপরে অনশন ও হরতাল-ধর্মঘট সম্পর্কে যা বলা হলো সেটা দুর্নীতিগ্রস্ত রাজনৈতিক লোকদের অসৎ রাজনৈতিক আচরণের অন্যতম দৃষ্টান্ত।
ভারতে দুর্নীতি দমনের জন্য আন্না হাজারের অনশনের প্রসঙ্গে ফিরে এসে দেখা যায়, এক্ষেত্রে অনশনের একটা কার্যকারিতা থাকলেও যে উদ্দেশ্যে অনশন করা হয়েছে সে উদ্দেশ্য এর মাধ্যমে অর্জনের সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। যে তিন শর্ত পূরণের পর আন্না তার অনশন প্রত্যাহার করেছেন সেগুলো হলো, প্রধানমন্ত্রী থেকে নিয়ে নিম্নস্তরের আমলাদের লোকপাল আইনের আওতায় আনা, প্রত্যেক রাজ্যে স্বাধীন দুর্নীতি দমন সংস্থা 'লোকযুক্ত' গঠন এবং একটি নাগরিক সনদ গঠন। সরকার ও পার্লামেন্টের দুই কক্ষের সদস্যদের মধ্যে অনেক আলোচনা ও বিতর্কের পর অবশেষে সর্বসম্মতিক্রমে আন্নার দাবি মেনে নিয়ে পার্লামেন্টে প্রস্তাব পাসের পর আন্না কর্তৃক অনশন ভঙ্গের ঘটনার মধ্য দিয়ে একদিকে যেমন ভারতের শাসকশ্রেণীর কৌশলজ্ঞান ও রাজনৈতিক পরিপকস্ফতার (ঢ়ড়ষরঃরপধষ সধঃঁৎরঃু) পরিচয় পাওয়া যায়, তেমনি অন্যদিকে পরিচয় পাওয়া যায় তাদের সুবিধাবাদ এবং অসাধুতার। কারণ এই বিল পাস করা, না করার দ্বারা ভারতে দুর্নীতি দমন যে সম্ভবত সম্ভব নয় এটা কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন কোয়ালিশন সরকার যেমন জানে, তেমনি জানে বিজেপি এবং তাদের চক্রের বিভিন্ন গেরুয়া পার্টি। শাসকশ্রেণীর এসব অংশই প্রবলভাবে দুর্নীতিগ্রস্ত।
এদের মধ্যে যারাই সরকার গঠন করে তারাই নিজেরা দুর্নীতি করে এবং দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে কোনো কার্যকর পদক্ষেপ না নিয়ে তাদের রক্ষা ও লালন করে। কাজেই আন্না হাজারের আন্দোলনের পেছনে থেকে বিজেপি যতই তাতে শক্তির জোগান দিক তারা জানে যে, এর দ্বারা কংগ্রেস সরকারকে রাজনৈতিকভাবে বিড়ম্বিত করা গেলেও দুর্নীতি দমন তো দূরের কথা, কমিয়ে আনাও সম্ভব নয়।
ভারতে দুর্নীতি সরকারি ও বেসরকারি কর্মক্ষেত্রে, সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে যেভাবে ছড়িয়ে পড়েছে তাতে কোনো আইনের দ্বারাই তা নির্মূল, দমন বা হ্রাস করা যায় না। এর বিরুদ্ধে সমাজে যে চেতনা সৃষ্টি ও সঞ্চার করা অপরিহার্য সেটা সম্ভব একমাত্র দেশব্যাপী গণতান্ত্রিক ও বিপ্লবী আন্দোলনের মাধ্যমে, জনগণের শক্তিকে জাগ্রত ও সংগঠিত করে। কাজেই এ সমস্যা আইনের মধ্যমে অথবা কোনো সংস্কারমূলক আন্দোলনের মাধ্যমেও সমাধান হওয়ার নয়। কাজেই লোকপালের আওতায় প্রধানমন্ত্রী থেকে সাধারণ কর্মচারীকে অল্প হলেও দেখা যাবে, এর দ্বারা পরিস্থিতির কোনো উন্নতি হচ্ছে না। শুধু তাই নয়, যে গণতান্ত্রিক ও বিপ্লবী আন্দোলনের মাধ্যম জনগণের শক্তি সংগঠিত করে এই সমস্যার সমাধান সম্ভব তার বিকাশ রুদ্ধ করে, বাধাগ্রস্ত করে যারা নিজেদের শাসন ক্ষমতা টিকিয়ে রাখে তারাই হয় দুর্নীতির জন্মদাতা ও দুর্নীতিবাজদের রক্ষক। এটা এ প্রসঙ্গে মনে রাখা দরকার, আন্না হাজারের লোকপাল আইন প্রয়োগের ক্ষেত্রেও কোনো ম্যাজিক দেখাতে পারে না। ভারতে এমন অজস্র আইন আছে যার ফাঁকফোকর দিয়ে দুর্নীতিবাজদের বের হয়ে যাওয়ার সুযোগের অভাব নেই। এ সুযোগ আগেও ব্যবহার করা হয়েছে এবং লোকপালের আওতায় প্রধানমন্ত্রী থেকে সাধারণ সরকারি কর্মচারীকে আনা হলেও এই সুযোগের ব্যবহার বন্ধ হবে না।
কাজেই আন্না হাজারের অনশন ও আন্দোলনের মাধ্যমে আইনের সংস্কার করে ভারতে দুর্নীতি দমন ও নির্মূল করা যাবে, এমনকি উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস করা যাবে, এ চিন্তা অবাস্তব। অনেক সমস্যার মতো দুর্নীতি মোকাবেলা সমস্যাও হলো এমন এক সমস্যা যার সমাধান রাজনৈতিকভাবে সম্ভব। রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়াশীলতা ও জনগণের সম্পদ অপহরণই যেখানে দুর্নীতির স্রষ্টা সেখানে একমাত্র জনগণের নিজস্ব রাজনৈতিক ক্ষমতার ব্যবহার ছাড়া দুর্নীতি দূরীকরণ সম্ভব নয়। রাজনৈতিক সমস্যার সমাধান রাজনীতির মাধ্যমেই করতে হবে। কাজেই আন্না হাজারের অনশন আন্দোলন ভারতে দুর্নীতি বিষয়টিকে গুরুতর সমস্যা হিসেবে সামনে আনতে পারে। কিন্তু এর সমাধানের যে পথ দেখায় তা শুধু যে অকার্যকর তাই নয়, বিভ্রান্তিকরও বটে।
এ প্রসঙ্গে অন্য যে কথাটি বলা দরকার তা হলো, দুর্নীতি যে ভারতের সকল কর্মক্ষেত্রে রল্প্রেব্দ রল্প্রেব্দ ছেয়ে আছে এ বিষয়ে জনগণকে সচেতন করার জন্য আন্দোলনের কোনো প্রকৃত প্রয়োজন নেই। এদিক দিয়ে আন্না হাজারের আন্দোলন সমস্যাটিকে সাময়িকভাবে সামনে আনলেও এর মধ্যে দুর্নীতির সমস্যা সমাধানের কোনো পথ নেই। উপরন্তু এক্ষেত্রে সমাধানের পথ সম্পর্কে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করে, এর রাজনৈতিক চরিত্র আড়াল করে আন্না হাজারের আন্দোলন দুর্নীতি দমন ও নির্মূলের পরিবর্তে একে জিইয়ে রাখার শর্তগুলো টিকিয়ে রাখার পক্ষেই পরোক্ষভাবে কাজ করছে।
২৮.৮.২০১১
দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে ভারতে আসার পর ১৯১৪ সালে তিনি প্রথম অনশন করেন। ১৯৪৭ সালের এ অনশনই ছিল তার জীবনের শেষ অনশন।
গান্ধী ও তার অনুসারীরা যে অনশন করতেন এবং এখন আন্না হাজারের মতো গান্ধীবাদী যে অনশন করেছেন তার মধ্যে কোনো ফাঁকি থাকেনি। এই অনশনের সময় কেউ কেউ নিরম্বু (পানি না খেয়ে) উপবাস করেন। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই শরীরের শুষ্কতা (ফবযুফবঃরড়হ) যাতে না ঘটে এ জন্য তারা পানি খেয়ে থাকেন। গান্ধী জীবনে অনেকবার অনশন করেছেন এবং কখনও সপ্তাহের পর সপ্তাহ। এখন আন্না হাজারে বারো দিন অনশনের পর তা ভঙ্গ করেছেন। কাজেই এই অনশনের কার্যকারিতা অল্পবিস্তর যাই থাকুক, এটা সহজ কাজ নয় এবং এতে জীবনের প্রতি ঝুঁকি থাকে অনেক বেশি।
বাংলাদেশে এখন খুব ঘন ঘন অনশন হয়। কত রকম ইস্যু নিয়ে যে অনশন হয় তারও কোনো ঠিক নেই। কিন্তু দেখা যায়, এসব অনশনে কোনো সময়েই রাত পোহায় না। আগে থেকেই ঘোষণা দেওয়া হয়, সকাল ৮টা বা ১০টা থেকে বিকেল ৪টা বা ৬টা বা ওই ধরনের ছয় ঘণ্টা, আট ঘণ্টা অনশনের! অর্থাৎ সকালে বেশ ভালো করে খাওয়া-দাওয়া করে প্রেস ক্লাবের সামনে, জাতীয় জাদুঘরের সামনে, পুরানা পল্টনে, মুক্তাঙ্গনে অথবা ওই রকম কোনো জুতসই জায়গায় শতরঞ্জি বিছিয়ে, শামিয়ানা টাঙিয়ে এসব অনশন হয়! অর্থাৎ রমজানের সময় ভোর রাতে খেয়ে পরদিন সন্ধ্যা পর্যন্ত রোজাদাররা এক মাস ধরে যেভাবে দিনে উপোস থাকেন সে রকম কিছুও এই তথাকথিত অনশনগুলোতে দেখা যায় না! অনশনকারীরা দিব্যি খাওয়া-দাওয়া করে মজলিসে বসে আড্ডা দিয়ে অনশন পালন করেন! ফলে দেখা যায়, গান্ধী ও গান্ধীবাদীদের অনশনের যে কার্যকারিতা ছিল বা এখনও আছে, যা এখন আন্না হাজারের বারো দিনের অনশনের মাধ্যমে নতুন করে দেখা গেল, তার তিলমাত্র বাংলাদেশি রাজনীতিবিদ ও মানবাধিকার কর্মীদের অনশনের মধ্যে দেখা যায় না। তবে সংবাদপত্রে এর সচিত্র রিপোর্ট ছাপা হয় এবং এর মাধ্যমে অনশনকারীরা একটা প্রচার লাভ করেন। কিন্তু প্রচার লাভ করলেও যে ইস্যুতে তারা অনশন করেন সে ইস্যুর কোনো সুরাহা এই ধরনের অনশনের মাধ্যমে হয় না। এর কারণ, যেভাবে এসব অনশন পালন করা হয় তাতে সংস্কারবাদীরা যেভাবে একে ব্যবহার করে এসেছেন তাকে ব্যঙ্গ করা ছাড়া আর কিছুই হয় না। এর মধ্যে কোনো শক্তি থাকে না। অনশনের ভণ্ডামিপূর্ণ ব্যবহারের মাধ্যমে সংগ্রামের পদ্ধতি হিসেবে একে ভোঁতা ও হাস্যকর ব্যাপারে পরিণত করা হয়। বলাই বাহুল্য, স্বাধীন বাংলাদেশের শাসকশ্রেণী ও তাদের সহযোগী মধ্যশ্রেণীভুক্ত লোকজন এখন যে চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য অর্জন করেছেন, তার সঙ্গে অনশন নিয়ে এ ভণ্ডামি খুবই সঙ্গতিপূর্ণ। শুধু অনশনই নয়, এখন ধর্মঘট ও হরতালের অবস্থাও একই প্রকার। ধর্মঘট ও হরতাল জনগণের এক গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক অধিকার এবং সংগ্রামের এক কার্যকর হাতিয়ার। কিন্তু বাংলাদেশে কারণে-অকারণে, অতি তুচ্ছ থেকে নিয়ে অনেক নির্বোধ লক্ষ্য সামনে রেখে, বিভিন্ন চক্রের স্বার্থে যেভাবে কথায় কথায় হরতাল ও ধর্মঘটের আহ্বান জানানো হয় ও হরতাল পালিত হয়, তাতে হরতালের বা ধর্মঘটের আর কোনো ধার, শক্তি বা কার্যকারিতা থাকে না। কাজেই এসব হরতালকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে সরকার তার নানাবিধ গণবিরোধী তৎপরতা অব্যাহত রাখতে অসুবিধা বোধ করে না। বাংলাদেশে সর্বক্ষেত্রে দুর্নীতি যেভাবে ছেয়ে গেছে এটা সকলেরই জানা। ওপরে অনশন ও হরতাল-ধর্মঘট সম্পর্কে যা বলা হলো সেটা দুর্নীতিগ্রস্ত রাজনৈতিক লোকদের অসৎ রাজনৈতিক আচরণের অন্যতম দৃষ্টান্ত।
ভারতে দুর্নীতি দমনের জন্য আন্না হাজারের অনশনের প্রসঙ্গে ফিরে এসে দেখা যায়, এক্ষেত্রে অনশনের একটা কার্যকারিতা থাকলেও যে উদ্দেশ্যে অনশন করা হয়েছে সে উদ্দেশ্য এর মাধ্যমে অর্জনের সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। যে তিন শর্ত পূরণের পর আন্না তার অনশন প্রত্যাহার করেছেন সেগুলো হলো, প্রধানমন্ত্রী থেকে নিয়ে নিম্নস্তরের আমলাদের লোকপাল আইনের আওতায় আনা, প্রত্যেক রাজ্যে স্বাধীন দুর্নীতি দমন সংস্থা 'লোকযুক্ত' গঠন এবং একটি নাগরিক সনদ গঠন। সরকার ও পার্লামেন্টের দুই কক্ষের সদস্যদের মধ্যে অনেক আলোচনা ও বিতর্কের পর অবশেষে সর্বসম্মতিক্রমে আন্নার দাবি মেনে নিয়ে পার্লামেন্টে প্রস্তাব পাসের পর আন্না কর্তৃক অনশন ভঙ্গের ঘটনার মধ্য দিয়ে একদিকে যেমন ভারতের শাসকশ্রেণীর কৌশলজ্ঞান ও রাজনৈতিক পরিপকস্ফতার (ঢ়ড়ষরঃরপধষ সধঃঁৎরঃু) পরিচয় পাওয়া যায়, তেমনি অন্যদিকে পরিচয় পাওয়া যায় তাদের সুবিধাবাদ এবং অসাধুতার। কারণ এই বিল পাস করা, না করার দ্বারা ভারতে দুর্নীতি দমন যে সম্ভবত সম্ভব নয় এটা কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন কোয়ালিশন সরকার যেমন জানে, তেমনি জানে বিজেপি এবং তাদের চক্রের বিভিন্ন গেরুয়া পার্টি। শাসকশ্রেণীর এসব অংশই প্রবলভাবে দুর্নীতিগ্রস্ত।
এদের মধ্যে যারাই সরকার গঠন করে তারাই নিজেরা দুর্নীতি করে এবং দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে কোনো কার্যকর পদক্ষেপ না নিয়ে তাদের রক্ষা ও লালন করে। কাজেই আন্না হাজারের আন্দোলনের পেছনে থেকে বিজেপি যতই তাতে শক্তির জোগান দিক তারা জানে যে, এর দ্বারা কংগ্রেস সরকারকে রাজনৈতিকভাবে বিড়ম্বিত করা গেলেও দুর্নীতি দমন তো দূরের কথা, কমিয়ে আনাও সম্ভব নয়।
ভারতে দুর্নীতি সরকারি ও বেসরকারি কর্মক্ষেত্রে, সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে যেভাবে ছড়িয়ে পড়েছে তাতে কোনো আইনের দ্বারাই তা নির্মূল, দমন বা হ্রাস করা যায় না। এর বিরুদ্ধে সমাজে যে চেতনা সৃষ্টি ও সঞ্চার করা অপরিহার্য সেটা সম্ভব একমাত্র দেশব্যাপী গণতান্ত্রিক ও বিপ্লবী আন্দোলনের মাধ্যমে, জনগণের শক্তিকে জাগ্রত ও সংগঠিত করে। কাজেই এ সমস্যা আইনের মধ্যমে অথবা কোনো সংস্কারমূলক আন্দোলনের মাধ্যমেও সমাধান হওয়ার নয়। কাজেই লোকপালের আওতায় প্রধানমন্ত্রী থেকে সাধারণ কর্মচারীকে অল্প হলেও দেখা যাবে, এর দ্বারা পরিস্থিতির কোনো উন্নতি হচ্ছে না। শুধু তাই নয়, যে গণতান্ত্রিক ও বিপ্লবী আন্দোলনের মাধ্যম জনগণের শক্তি সংগঠিত করে এই সমস্যার সমাধান সম্ভব তার বিকাশ রুদ্ধ করে, বাধাগ্রস্ত করে যারা নিজেদের শাসন ক্ষমতা টিকিয়ে রাখে তারাই হয় দুর্নীতির জন্মদাতা ও দুর্নীতিবাজদের রক্ষক। এটা এ প্রসঙ্গে মনে রাখা দরকার, আন্না হাজারের লোকপাল আইন প্রয়োগের ক্ষেত্রেও কোনো ম্যাজিক দেখাতে পারে না। ভারতে এমন অজস্র আইন আছে যার ফাঁকফোকর দিয়ে দুর্নীতিবাজদের বের হয়ে যাওয়ার সুযোগের অভাব নেই। এ সুযোগ আগেও ব্যবহার করা হয়েছে এবং লোকপালের আওতায় প্রধানমন্ত্রী থেকে সাধারণ সরকারি কর্মচারীকে আনা হলেও এই সুযোগের ব্যবহার বন্ধ হবে না।
কাজেই আন্না হাজারের অনশন ও আন্দোলনের মাধ্যমে আইনের সংস্কার করে ভারতে দুর্নীতি দমন ও নির্মূল করা যাবে, এমনকি উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস করা যাবে, এ চিন্তা অবাস্তব। অনেক সমস্যার মতো দুর্নীতি মোকাবেলা সমস্যাও হলো এমন এক সমস্যা যার সমাধান রাজনৈতিকভাবে সম্ভব। রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়াশীলতা ও জনগণের সম্পদ অপহরণই যেখানে দুর্নীতির স্রষ্টা সেখানে একমাত্র জনগণের নিজস্ব রাজনৈতিক ক্ষমতার ব্যবহার ছাড়া দুর্নীতি দূরীকরণ সম্ভব নয়। রাজনৈতিক সমস্যার সমাধান রাজনীতির মাধ্যমেই করতে হবে। কাজেই আন্না হাজারের অনশন আন্দোলন ভারতে দুর্নীতি বিষয়টিকে গুরুতর সমস্যা হিসেবে সামনে আনতে পারে। কিন্তু এর সমাধানের যে পথ দেখায় তা শুধু যে অকার্যকর তাই নয়, বিভ্রান্তিকরও বটে।
এ প্রসঙ্গে অন্য যে কথাটি বলা দরকার তা হলো, দুর্নীতি যে ভারতের সকল কর্মক্ষেত্রে রল্প্রেব্দ রল্প্রেব্দ ছেয়ে আছে এ বিষয়ে জনগণকে সচেতন করার জন্য আন্দোলনের কোনো প্রকৃত প্রয়োজন নেই। এদিক দিয়ে আন্না হাজারের আন্দোলন সমস্যাটিকে সাময়িকভাবে সামনে আনলেও এর মধ্যে দুর্নীতির সমস্যা সমাধানের কোনো পথ নেই। উপরন্তু এক্ষেত্রে সমাধানের পথ সম্পর্কে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করে, এর রাজনৈতিক চরিত্র আড়াল করে আন্না হাজারের আন্দোলন দুর্নীতি দমন ও নির্মূলের পরিবর্তে একে জিইয়ে রাখার শর্তগুলো টিকিয়ে রাখার পক্ষেই পরোক্ষভাবে কাজ করছে।
২৮.৮.২০১১
No comments