চরাচর-তাদের শরীরজুড়ে পেরেক-ক্ষত! by বিশ্বজিৎ ভট্টাচার্য বাপন
গাছগুলো বুকে ক্ষতচিহ্ন নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে! সাইনবোর্ডে ঢেকে যাওয়া এ রকম কোনো কোনো গাছ দৃশ্যমান হলেই সেদিকে আমাদের চোখ আটকে যায়। আমরা রাস্তা দিয়ে যেতে যেতে দেখি, গাছগুলো তাদের শরীরে অসংখ্য পেরেক-ক্ষত নিয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে রয়েছে! শৈশবে মায়ের কাছে প্রথম শুনেছিলাম, গাছদের প্রাণ আছে।
অর্থাৎ গাছরাও দৈহিক ক্ষয়-বৃদ্ধির অধিকারী_এ কথা বিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্র বসু প্রমাণ করেছিলেন। জগদীশ বসুর এই প্রমাণ বৃক্ষ সম্পর্কে জনমনে ইতিবাচক ধারণা তৈরি এবং এর গুরুত্ব এত দিন অনেকাংশে বেড়ে যাওয়ার কথা থাকলেও বিষয়টি সমষ্টিগতভাবে পরিবেশ-সচেতনতার দিকে অগ্রসর হয়নি; বরং বারবার ব্যর্থ হয়েছে এ-সম্পর্কিত বিয়ষটির বাস্তব প্রয়োগ ঘটাতে। দেশের মূল ভূখণ্ডের ৩৩ শতাংশ বনভূমিও আজ আমাদের নেই। অবশিষ্ট রয়েছে ২০ শতাংশেরও কম। আমরা আমাদের চারপাশে ঘটাতে পারিনি ব্যাপক বনায়ন। সৃষ্টি করতে পারিনি পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার আগাম বনজ সম্পদ। প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে একটি একটি করে গাছ কেটে ফেলা হচ্ছে। যেখানে-সেখানে পেরেক ঠুকে সাইনবোর্ড টাঙিয়ে গাছের স্বাভাবিক বৃদ্ধি প্রতিরোধ করা হচ্ছে। গাছের গায়ে পেরেক ঠুকে সাইনবোর্ড গেঁথে দেওয়ার দৃশ্যটি কী মেনে নেওয়া যায়? ব্যাপারটি সন্দেহাতীতভাবে অশোভন, পীড়াদায়ক এবং গাছের স্বাভাবিক গতিবৃদ্ধির জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানগুলো নিজেদের অবস্থান প্রচারের জন্য বেছে নেয় এমন এক অদ্ভুত পদ্ধতি! একেকটি গাছকে চিহ্নিত করে নির্দ্বিধায় পেরেক মেরে তার শরীর ক্ষত করে প্রচারমাধ্যমের সহায়ক পন্থা হিসেবে লাগিয়ে দিচ্ছে রংবেরঙের অসংখ্য আকৃতির বিচিত্র সব বিজ্ঞাপন। অপেক্ষাকৃত জনবহুল এলাকায় যেখানে একটি গাছ কোনো রকমে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে, দেখা যায় তার শরীরজুড়ে গাঁথা রয়েছে অসংখ্য বিজ্ঞাপনী বোর্ড। সবুজ পৃথিবীর ধূসর মাটি স্পর্শ করে চারপাশকে ছায়াময় করার জন্মগত সংকল্প নিয়ে যে গাছটি ধীরে ধীরে বেড়ে উঠছে আমাদের চেনা-অচেনা পথের ধারে; তার বুকে হঠাৎ পেরেক ঠুকে সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত মর্মান্তিক! রাস্তার পাশের অপ্রাপ্ত বয়সের গুরুত্বপূর্ণ একেকটি গাছকে যখন নির্বাচন করে তার শরীরজুড়ে বড় বড় পেরেক মেরে একেকটি বোর্ড ঝুলিয়ে দেওয়া হয়, তখন তার দৈহিক অবস্থা স্বাভাবিক থাকে না। এমন আচরণের ফলে দেশব্যাপী পরিচিত-অপরিচিত কিংবা বিরল প্রজাতির গাছগুলো আজ হুমকির মুখে। সবচেয়ে দুর্ভাগ্যের ব্যাপার, যাঁরা এই বিজ্ঞাপনী বোর্ডগুলো গায়ে জুড়ে দেওয়ার কাজে নেতৃত্ব দেন, তাঁরা সবাই কি জ্ঞানশূন্যহীন? বিবেক-বোধহীন? গাছের শরীর ছিদ্র করে বিজ্ঞাপন টাঙানোর বিষয়টি মর্মান্তিক ও অশোভন, তা কি তাঁরা কখনোই বুঝতে চেষ্টা করেন না? হতভাগ্য সেই সব গাছের শরীর ফুটো করে সাইনবোর্ড টাঙানোর এমন দৃশ্য দেখে তাঁরা কবে সত্যিকারের কাতরতা অনুভব করতে শিখবেন?
বিশ্বজিৎ ভট্টাচার্য বাপন
বিশ্বজিৎ ভট্টাচার্য বাপন
No comments