ভারত-আম আদমির আন্দোলন ও নেতৃত্ব by সুভাষ সাহা
ভারতের সাধারণ মানুষ তাদের নেতা পেয়ে গেছেন। এই নেতা, দেশের রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী বা মুখ্যমন্ত্রিত্বের পদ প্রত্যাশী নন। গাড়ি-বাড়ি বা পার্থিব সুখ-স্বচ্ছন্দও তার চাহিদার তালিকায় নেই। আমরা যেই অর্থে পরিবার বুঝি, সেই পরিবার-পরিজনও নেই তার। এহেন নেতার আহ্বানেই যেন অনেক যুগ আগের মহাত্মার কণ্ঠস্বর শুনতে পেল মানুষ।
ভারতের শহর থেকে গ্রাম যেন পায়ে পায়ে এগিয়ে এসে বিরাট জনসমুদ্রের ঊর্মিমালা তৈরি করল। এভাবেই আন্না হাজারে নামে নির্ভেজাল অহিংস আন্দোলনের আরেক পথিকৃতের জন্ম হলো ভারতের মাটিতে। শেষ পর্যন্ত তার দুর্নীতিবিরোধী আন্দোলনের কাছে নতি স্বীকার করতে হলো সরকারকে। সংসদকে জনতার সম্মিলিত কণ্ঠস্বরের মর্যাদা দিতে দুর্নীতিবিরোধী নতুন লোকপাল বিল আনার প্রতিশ্রুতি দিয়ে দিলি্লর রামলীলা ময়দানের অনশন ভাঙাতে হলো।
অনশন ভাঙার পর আন্না নিজেই বলেছেন, এবার দুর্নীতি বন্ধে জনগণের চোখ-কান খোলা তো থাকবেই, একই সঙ্গে নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কারের দাবিতে তিনি নতুন নাগরিক আন্দোলন গড়ে তুলবেন। রিকল ব্যবস্থার মাধ্যমে যে কোনো সময় নির্বাচিত প্রতিনিধিদের নির্বাচকমণ্ডলী প্রত্যাহার করার ব্যবস্থা প্রবর্তন ও টাকার জোরে কারও নির্বাচিত হয়ে আসার পথ বন্ধ করা এবং নির্বাচন প্রক্রিয়াকে স্বচ্ছ, নিরপেক্ষ ও কালো টাকার প্রভাবমুক্ত করার দাবিও তার ভবিষ্যৎ আন্দোলনের গুরুত্বপূর্ণ অংশ হবে।
গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা নিজে থেকে যে কাজগুলো সম্পন্ন করার কথা ছিল তা এতদিনেও হয়নি বলেই ভারতের জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে প্রায় সবাই আন্নার দুর্নীতিবিরোধী অহিংস আন্দোলনে শামিল হন। ভবিষ্যৎ অহিংস নাগরিক আন্দোলনের ধারায় গণতন্ত্রকে জনতা তাদের অধিকার, ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার সর্বব্যাপী প্রতিষ্ঠানে পরিণত করবে। অথচ আন্না হাজারের এই যুগান্তকারী নাগরিক আন্দোলনকে কতভাবেই না ব্যর্থ করে দেওয়ার চেষ্টা হয়েছে। আন্না এবং জনতার কণ্ঠস্বর একই স্বরগ্রামে বেজেছিল বলেই সব ষড়যন্ত্র ব্যর্থ হয়ে যায়।
এই সেদিনও আন্না হাজারে বড়, নাকি সরকার ও সংসদ বড়_ এমনতর ভয়ানক প্রশ্ন ছুড়ে দিয়ে মনমোহন সিংয়ের সরকার, কতিপয় রাজনীতিক, বিশিষ্ট সাংসদ, চিন্তাবিদদের গুরুত্বপূর্ণ অংশ গান্ধীবাদী এই নেতার দুর্নীতিবিরোধী জাতীয় নাগরিক আন্দোলনকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে চেয়েছিলেন। নাগরিক আন্দোলনেরও অনেক চেনা ও বিশিষ্ট মুখ আন্নার আন্দোলনকে নিয়ে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করতে কুণ্ঠিত হননি। বুকার পুরস্কারজয়ী লেখিকা ও মানবাধিকার আন্দোলনের নেত্রী অরুন্ধতী রায় তো ব্যাংক ব্যালেন্সবিহীন নিষ্কলুষ সাদাসিধে জীবনযাপনকারী আন্না তার নিজের রাজ্য মহারাষ্ট্রের কৃষকরা যখন আত্মাহুতি দেয়, তখন কেন জোরদার আন্দোলনে নামেন না_ সে প্রশ্ন তুলে টিপ্পনী কাটতে ছাড়েননি।
আন্না কি আসলেই জীবনভর সামাজিক-নাগরিক আন্দোলন এবং জনহিতে বিভিন্ন ধরনের কর্মের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না? তিনি কি একেবারে হাওয়া থেকে এসেই রাতারাতি ভারতব্যাপী একটি ব্যাপকভিত্তিক জাতীয় আন্দোলন গড়ে তুলেছেন? আসলে এ ধরনের প্রশ্ন করা মানেই আন্নাকে মতলববাজ হিসেবে চিহ্নিত করার চেষ্টা ছাড়া আর কিছুই নয়। উচ্চশিক্ষাবিহীন আন্না সারা জীবন কী ধরনের আন্দোলনের ধারায় সিক্ত হয়ে আজকে দুর্নীতিবিরোধী সংগ্রামের প্রতীকে পরিণত হয়েছেন_ সে ইতিহাস মিডিয়ার কল্যাণে প্রায় সবারই জানা হয়ে গিয়ে থাকবে।
বস্তুত একবিংশ শতাব্দীতে পুঁজিবাদী গণতন্ত্রে জনগণের আন্দোলনের রূপ কেমন হবে এবং শক্তিশালী নাগরিক আন্দোলন যে বিদ্যমান গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার ঘাটতিগুলো দূর করে একে আরও জবাবদিহিমূলক, স্বচ্ছ ও জনমুখী করতে পারে, তারই পথ দেখাল আন্না হাজারের দুর্নীতিবিরোধী লোকপাল প্রতিষ্ঠার অহিংস আন্দোলন। প্রকৃত অর্থেই সর্বস্তরের জনগণ সম্পৃক্ত হলে এর শক্তি যে কত ব্যাপক হতে পারে, তার প্রমাণ এই আন্দোলন। বর্তমান যুগে করপোরেট সাম্রাজ্য যখন মানুষের বসতি, নদী, পাহাড় থেকে শুরু করে সবকিছু নিয়ে টান দিয়েও তার খাঁই মেটাতে পারছে না, তখন এই আন্দোলনের তাৎপর্য অপরিসীম। আন্নার নেতৃত্বাধীন এই অহিংস আন্দোলন আন্তর্জাতিক মিডিয়ার কল্যাণে বিশ্ববাসী অবগত হওয়ায় এরপর যুক্তরাষ্ট্র হোক আর ইউরোপীয় যে কোনো গণতন্ত্রই হোক বা চীনের রাষ্ট্রীয় পুঁজিবাদ অথবা একনায়কত্ববাদী কোনো ব্যবস্থাই হোক; কারও পক্ষেই নীরব মেজরিটির মতামতকে হালকাভাবে নিতে চাইবে না।
নাগরিক ও সামাজিক আন্দোলনের ব্যাপারে কোনো কোনো নেতার উপলব্ধির ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধতার প্রসঙ্গটি আলোচনা করা যায়। এটা ঠিক, অরুন্ধতী রায়রা বিভিন্ন সময়ে সরকারি ও সাধারণ মানুষের সম্পত্তি এবং স্বার্থবিরোধী করপোরেট সাম্রাজ্যের লুটের বিরুদ্ধে চরম প্রতিকূল পরিস্থিতিতেও আন্দোলনে অকুতোভয়ে সামনের কাতারে থেকেছেন এবং এখনও রয়েছেন। ভারতের সিভিল সোসাইটির বাঘা বাঘা নেতার আপসহীন আন্দোলন দেশের অনেক আইনকে জনমুখী ও যুক্তিসঙ্গত করতে বাধ্য করেছে। কেন্দ্রীয় ও রাজ্য, এমনকি বিভিন্ন সংস্থার কর্মকর্তাদের জনস্বার্থে কাজ করতে বাধ্য করেছে। মাওবাদী আন্দোলন দমনের নামে সরকার বাধাহীনভাবে করপোরেট হাউসগুলোকে ট্রাইবাল এলাকার পাহাড়-বন-বসতি উজাড় করে প্রাকৃতিক সম্পদ ও ভূমি নামমাত্র মূল্যে দিয়ে দেওয়ার বন্দোবস্ত করতে পারেনি জোরদার সিভিল সোসাইটির আন্দোলন ও ট্রাইবালদের লড়াকু মনোভাবের কারণেই। পশ্চিমবঙ্গের নন্দীগ্রাম, সিঙ্গুরবাসীর শিল্পের জন্য কৃষিজমি অধিগ্রহণবিরোধী সংগ্রাম বামপন্থি সরকারকে পর্যন্ত ক্ষমতাছাড়া করেছে। এভাবে বিভিন্ন রাজ্যে বিভিন্ন সময়ে জমি রক্ষার দাবিতে কৃষক ও জনজাতির রক্ত ঝরানো সংগ্রামের ফলেই আজ ভারতে ভূমি অধিগ্রহণ ও সংরক্ষণ আইন সংশোধন করে কৃষকদের স্বার্থের অনুকূল আইন প্রণয়ন করতে হচ্ছে। এ জন্য ভারতের শক্তিশালী সিভিল সোসাইটি, কতিপয় নেতাকে অভিনন্দন জানাতে হয়।
বিভিন্ন সময়ে ভারতসহ বিভিন্ন দেশে জনস্বার্থ নিয়ে নাগরিক আন্দোলনের গুরুত্বকে খাটো করে দেখার উপায় নেই। আমাদের দেশে যেমন নদী বাঁচাও, জলাশয় বাঁচাও, কৃষিজমি রক্ষা ও মানুষের বসতি, জীববৈচিত্র্য রক্ষা আন্দোলনের গুরুত্বকে আমরা অস্বীকার করতে পারি না। তবে এখানে নিঃস্বার্থ ও যোগ্যতাসম্পন্ন উল্লেখযোগ্য সংখ্যক নাগরিক আন্দোলনের নেতৃত্ব এখনও বেরিয়ে আসছে না। ছাত্ররাজনীতিও স্বার্থের চোরাগলিতে আটকা পড়ার ফলে শিক্ষিত যুবশক্তি আমাদের এখানে শক্তিশালী নাগরিক আন্দোলনের শক্তি হিসেবে ক্রিয়াশীল হতে পারছে না। তবে নানা প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও এখানে নাগরিক আন্দোলন হয়েছে এবং ভবিষ্যতেও অবশ্যই হবে। শক্তিশালী মধ্যবিত্ত শ্রেণী না থাকলেও সাধারণ মানুষের জ্ঞান-বিজ্ঞানের ঘাটতিটা টিভি, মোবাইল, দেশে-বিদেশে পরিবার-পরিজন ও বল্পুব্দ-বান্ধবের সঙ্গে মিথস্ক্রিয়া ও টুইটার-ফেসবুক সংস্কৃতি পূরণ করে চলেছে। সে কারণে একজন প্রত্যন্ত গ্রামের কৃষকও এখন তার নিজের স্বার্থ বুঝে নেওয়ার সামর্থ্য অর্জন করছে আধুনিক প্রযুক্তিলব্ধ জ্ঞানের আলোয়। আরব বিপ্লব সে সাক্ষ্যই দেয়।
আন্না হাজারের দুর্নীতিবিরোধী আন্দোলনে রাজনৈতিক দল হিসেবে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে কংগ্রেস। তাদের নেতৃত্বাধীন ইউপিএ সরকারকে ভারতবাসী দুর্নীতিগ্রস্ত সরকার মনে করছে। ভারতের নাগরিক আন্দোলন সর্বব্যাপী রূপ নিয়ে এখন সে দেশের সরকার, প্রশাসন, রাজনৈতিক দল, সংসদ, বিচার ব্যবস্থা, অর্থনৈতিক ব্যবস্থা, করপোরেট সাম্রাজ্য থেকে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান-সংস্থার প্রতিটি স্তরে ঝাঁকুনি দিয়েছে। সর্বত্র স্বচ্ছ ও জবাবদিহিমূলক সুশাসন নিশ্চিত করার যে তাগিদ আন্না হাজারের আন্দোলন সৃষ্টি করেছে, তাকে কারও পক্ষেই আর অগ্রাহ্য করা সম্ভব হবে না।
সুভাষ সাহা :সাংবাদিক
subashsaha@gmail.com
অনশন ভাঙার পর আন্না নিজেই বলেছেন, এবার দুর্নীতি বন্ধে জনগণের চোখ-কান খোলা তো থাকবেই, একই সঙ্গে নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কারের দাবিতে তিনি নতুন নাগরিক আন্দোলন গড়ে তুলবেন। রিকল ব্যবস্থার মাধ্যমে যে কোনো সময় নির্বাচিত প্রতিনিধিদের নির্বাচকমণ্ডলী প্রত্যাহার করার ব্যবস্থা প্রবর্তন ও টাকার জোরে কারও নির্বাচিত হয়ে আসার পথ বন্ধ করা এবং নির্বাচন প্রক্রিয়াকে স্বচ্ছ, নিরপেক্ষ ও কালো টাকার প্রভাবমুক্ত করার দাবিও তার ভবিষ্যৎ আন্দোলনের গুরুত্বপূর্ণ অংশ হবে।
গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা নিজে থেকে যে কাজগুলো সম্পন্ন করার কথা ছিল তা এতদিনেও হয়নি বলেই ভারতের জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে প্রায় সবাই আন্নার দুর্নীতিবিরোধী অহিংস আন্দোলনে শামিল হন। ভবিষ্যৎ অহিংস নাগরিক আন্দোলনের ধারায় গণতন্ত্রকে জনতা তাদের অধিকার, ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার সর্বব্যাপী প্রতিষ্ঠানে পরিণত করবে। অথচ আন্না হাজারের এই যুগান্তকারী নাগরিক আন্দোলনকে কতভাবেই না ব্যর্থ করে দেওয়ার চেষ্টা হয়েছে। আন্না এবং জনতার কণ্ঠস্বর একই স্বরগ্রামে বেজেছিল বলেই সব ষড়যন্ত্র ব্যর্থ হয়ে যায়।
এই সেদিনও আন্না হাজারে বড়, নাকি সরকার ও সংসদ বড়_ এমনতর ভয়ানক প্রশ্ন ছুড়ে দিয়ে মনমোহন সিংয়ের সরকার, কতিপয় রাজনীতিক, বিশিষ্ট সাংসদ, চিন্তাবিদদের গুরুত্বপূর্ণ অংশ গান্ধীবাদী এই নেতার দুর্নীতিবিরোধী জাতীয় নাগরিক আন্দোলনকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে চেয়েছিলেন। নাগরিক আন্দোলনেরও অনেক চেনা ও বিশিষ্ট মুখ আন্নার আন্দোলনকে নিয়ে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করতে কুণ্ঠিত হননি। বুকার পুরস্কারজয়ী লেখিকা ও মানবাধিকার আন্দোলনের নেত্রী অরুন্ধতী রায় তো ব্যাংক ব্যালেন্সবিহীন নিষ্কলুষ সাদাসিধে জীবনযাপনকারী আন্না তার নিজের রাজ্য মহারাষ্ট্রের কৃষকরা যখন আত্মাহুতি দেয়, তখন কেন জোরদার আন্দোলনে নামেন না_ সে প্রশ্ন তুলে টিপ্পনী কাটতে ছাড়েননি।
আন্না কি আসলেই জীবনভর সামাজিক-নাগরিক আন্দোলন এবং জনহিতে বিভিন্ন ধরনের কর্মের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না? তিনি কি একেবারে হাওয়া থেকে এসেই রাতারাতি ভারতব্যাপী একটি ব্যাপকভিত্তিক জাতীয় আন্দোলন গড়ে তুলেছেন? আসলে এ ধরনের প্রশ্ন করা মানেই আন্নাকে মতলববাজ হিসেবে চিহ্নিত করার চেষ্টা ছাড়া আর কিছুই নয়। উচ্চশিক্ষাবিহীন আন্না সারা জীবন কী ধরনের আন্দোলনের ধারায় সিক্ত হয়ে আজকে দুর্নীতিবিরোধী সংগ্রামের প্রতীকে পরিণত হয়েছেন_ সে ইতিহাস মিডিয়ার কল্যাণে প্রায় সবারই জানা হয়ে গিয়ে থাকবে।
বস্তুত একবিংশ শতাব্দীতে পুঁজিবাদী গণতন্ত্রে জনগণের আন্দোলনের রূপ কেমন হবে এবং শক্তিশালী নাগরিক আন্দোলন যে বিদ্যমান গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার ঘাটতিগুলো দূর করে একে আরও জবাবদিহিমূলক, স্বচ্ছ ও জনমুখী করতে পারে, তারই পথ দেখাল আন্না হাজারের দুর্নীতিবিরোধী লোকপাল প্রতিষ্ঠার অহিংস আন্দোলন। প্রকৃত অর্থেই সর্বস্তরের জনগণ সম্পৃক্ত হলে এর শক্তি যে কত ব্যাপক হতে পারে, তার প্রমাণ এই আন্দোলন। বর্তমান যুগে করপোরেট সাম্রাজ্য যখন মানুষের বসতি, নদী, পাহাড় থেকে শুরু করে সবকিছু নিয়ে টান দিয়েও তার খাঁই মেটাতে পারছে না, তখন এই আন্দোলনের তাৎপর্য অপরিসীম। আন্নার নেতৃত্বাধীন এই অহিংস আন্দোলন আন্তর্জাতিক মিডিয়ার কল্যাণে বিশ্ববাসী অবগত হওয়ায় এরপর যুক্তরাষ্ট্র হোক আর ইউরোপীয় যে কোনো গণতন্ত্রই হোক বা চীনের রাষ্ট্রীয় পুঁজিবাদ অথবা একনায়কত্ববাদী কোনো ব্যবস্থাই হোক; কারও পক্ষেই নীরব মেজরিটির মতামতকে হালকাভাবে নিতে চাইবে না।
নাগরিক ও সামাজিক আন্দোলনের ব্যাপারে কোনো কোনো নেতার উপলব্ধির ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধতার প্রসঙ্গটি আলোচনা করা যায়। এটা ঠিক, অরুন্ধতী রায়রা বিভিন্ন সময়ে সরকারি ও সাধারণ মানুষের সম্পত্তি এবং স্বার্থবিরোধী করপোরেট সাম্রাজ্যের লুটের বিরুদ্ধে চরম প্রতিকূল পরিস্থিতিতেও আন্দোলনে অকুতোভয়ে সামনের কাতারে থেকেছেন এবং এখনও রয়েছেন। ভারতের সিভিল সোসাইটির বাঘা বাঘা নেতার আপসহীন আন্দোলন দেশের অনেক আইনকে জনমুখী ও যুক্তিসঙ্গত করতে বাধ্য করেছে। কেন্দ্রীয় ও রাজ্য, এমনকি বিভিন্ন সংস্থার কর্মকর্তাদের জনস্বার্থে কাজ করতে বাধ্য করেছে। মাওবাদী আন্দোলন দমনের নামে সরকার বাধাহীনভাবে করপোরেট হাউসগুলোকে ট্রাইবাল এলাকার পাহাড়-বন-বসতি উজাড় করে প্রাকৃতিক সম্পদ ও ভূমি নামমাত্র মূল্যে দিয়ে দেওয়ার বন্দোবস্ত করতে পারেনি জোরদার সিভিল সোসাইটির আন্দোলন ও ট্রাইবালদের লড়াকু মনোভাবের কারণেই। পশ্চিমবঙ্গের নন্দীগ্রাম, সিঙ্গুরবাসীর শিল্পের জন্য কৃষিজমি অধিগ্রহণবিরোধী সংগ্রাম বামপন্থি সরকারকে পর্যন্ত ক্ষমতাছাড়া করেছে। এভাবে বিভিন্ন রাজ্যে বিভিন্ন সময়ে জমি রক্ষার দাবিতে কৃষক ও জনজাতির রক্ত ঝরানো সংগ্রামের ফলেই আজ ভারতে ভূমি অধিগ্রহণ ও সংরক্ষণ আইন সংশোধন করে কৃষকদের স্বার্থের অনুকূল আইন প্রণয়ন করতে হচ্ছে। এ জন্য ভারতের শক্তিশালী সিভিল সোসাইটি, কতিপয় নেতাকে অভিনন্দন জানাতে হয়।
বিভিন্ন সময়ে ভারতসহ বিভিন্ন দেশে জনস্বার্থ নিয়ে নাগরিক আন্দোলনের গুরুত্বকে খাটো করে দেখার উপায় নেই। আমাদের দেশে যেমন নদী বাঁচাও, জলাশয় বাঁচাও, কৃষিজমি রক্ষা ও মানুষের বসতি, জীববৈচিত্র্য রক্ষা আন্দোলনের গুরুত্বকে আমরা অস্বীকার করতে পারি না। তবে এখানে নিঃস্বার্থ ও যোগ্যতাসম্পন্ন উল্লেখযোগ্য সংখ্যক নাগরিক আন্দোলনের নেতৃত্ব এখনও বেরিয়ে আসছে না। ছাত্ররাজনীতিও স্বার্থের চোরাগলিতে আটকা পড়ার ফলে শিক্ষিত যুবশক্তি আমাদের এখানে শক্তিশালী নাগরিক আন্দোলনের শক্তি হিসেবে ক্রিয়াশীল হতে পারছে না। তবে নানা প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও এখানে নাগরিক আন্দোলন হয়েছে এবং ভবিষ্যতেও অবশ্যই হবে। শক্তিশালী মধ্যবিত্ত শ্রেণী না থাকলেও সাধারণ মানুষের জ্ঞান-বিজ্ঞানের ঘাটতিটা টিভি, মোবাইল, দেশে-বিদেশে পরিবার-পরিজন ও বল্পুব্দ-বান্ধবের সঙ্গে মিথস্ক্রিয়া ও টুইটার-ফেসবুক সংস্কৃতি পূরণ করে চলেছে। সে কারণে একজন প্রত্যন্ত গ্রামের কৃষকও এখন তার নিজের স্বার্থ বুঝে নেওয়ার সামর্থ্য অর্জন করছে আধুনিক প্রযুক্তিলব্ধ জ্ঞানের আলোয়। আরব বিপ্লব সে সাক্ষ্যই দেয়।
আন্না হাজারের দুর্নীতিবিরোধী আন্দোলনে রাজনৈতিক দল হিসেবে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে কংগ্রেস। তাদের নেতৃত্বাধীন ইউপিএ সরকারকে ভারতবাসী দুর্নীতিগ্রস্ত সরকার মনে করছে। ভারতের নাগরিক আন্দোলন সর্বব্যাপী রূপ নিয়ে এখন সে দেশের সরকার, প্রশাসন, রাজনৈতিক দল, সংসদ, বিচার ব্যবস্থা, অর্থনৈতিক ব্যবস্থা, করপোরেট সাম্রাজ্য থেকে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান-সংস্থার প্রতিটি স্তরে ঝাঁকুনি দিয়েছে। সর্বত্র স্বচ্ছ ও জবাবদিহিমূলক সুশাসন নিশ্চিত করার যে তাগিদ আন্না হাজারের আন্দোলন সৃষ্টি করেছে, তাকে কারও পক্ষেই আর অগ্রাহ্য করা সম্ভব হবে না।
সুভাষ সাহা :সাংবাদিক
subashsaha@gmail.com
No comments