সরল গরল-রাজনৈতিক প্রশ্নের মীমাংসা আদালতে হতে পারে কি? by মিজানুর রহমান খান

একমত নয়, দ্বিমতই বাংলাদেশের রাজনৈতিক সমাজের বৈশিষ্ট্য। তবে এ নিয়ে কোনো মহলই দ্বিমত করবে না যে তত্ত্বাবধায়ক সরকার একান্তভাবেই একটি রাজনৈতিক প্রশ্ন। আর সুপ্রিম কোর্ট রাজনৈতিক প্রশ্ন বা পলিটিক্যাল কোশ্চেনসের উত্তর দেবেন কি না, সে নিয়ে বিচার বিভাগীয় ইতিহাসে বিতর্ক আছে।


তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে অবৈধ ও ১০ বছরের জন্য বৈধ বলে রায় দিয়ে সুপ্রিম কোর্ট সেই বিতর্কে সুচিন্তিতভাবে পক্ষ হলেন। এ কারণে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ব্যবস্থা ও সুপ্রিম কোর্ট অনিবার্যভাবে মুখোমুখি হলেন। তবে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের ডিগবাজিটা শতাব্দীর সেরা প্রহসন হিসেবেই চিহ্নিত হতে পারে। রাজনৈতিক সুবিধাবাদ ও নীতিহীনতা যে ভয়ংকর পর্যায়ে রয়েছে, তার একটা প্রমাণ আওয়ামী লীগের প্রতিক্রিয়া। তবে আমরা গোড়া থেকেই বলে এসেছি, তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা কোনো বুদ্ধিবৃত্তিক চিন্তার ফসল ছিল না। ছিল কৌশলগত। তবে উভয় দল এখনো নির্বাচন কমিশনকে বাগে রাখার মানসিকতা থেকে মুক্ত নয়।
পঞ্চম সংশোধনী মামলার রায়ের পরে প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক বলেছিলেন, আপিল বিভাগের রায়ের পরে সংবিধান আপনা-আপনি সংশোধিত হয়ে গেছে। বাতিল ঘোষিত আইন নতুন করে আর বাতিল ঘোষণার দরকার নেই। বিশেষজ্ঞরা সংসদীয় কমিটিতে তা সমর্থন করেন।
সে হিসেবে অনেক প্রশ্ন ভিড় করল। আপিল বিভাগের রায়ে বলা হয়েছে, ভাবী সাপেক্ষে ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিল ও এখতিয়ারবহির্ভূত ঘোষণা করা হলো। ১১ মে ডেইলি স্টার-এর প্রতিবেদন বলেছে, আদালতের রায় হলো, ত্রয়োদশ সংশোধনীর আওতায় দশম ও একাদশ সাধারণ নির্বাচন হতে পারে। আর সংসদ প্রধান উপদেষ্টা ও আপিল বিভাগের বিচারকদের বাদ দিয়ে ত্রয়োদশ সংশোধনীর বিষয়ে ‘প্রয়োজনীয়’ সংশোধনী আনতে পারে।
এই রায় পূর্ণাঙ্গ নয়। এমনকি সর্বসম্মত রায়ও নয়। আমাদের পোড়া কপাল, সাত সদস্যের মধ্যে ঠিক কতজন দিয়ে মেজরিটি হলেন, তা কিন্তু জানা গেল না। সংক্ষিপ্ত রায়মতে অর্থ দাঁড়ায়, বাংলাদেশ এখন সাংবিধানিকভাবে তত্ত্বাবধায়ক সরকারমুক্ত। প্রোসপেক্টিভ বা ভাবীসাপেক্ষ বাতিল কথাটি দ্বারা আমরা বুঝতে পারি না যে সুপ্রিম কোর্ট তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বিলোপে সংসদের ক্ষমতাকে খর্ব করেছেন কি না। কেউ কেউ মনে করেন, এই ব্যবস্থা বিলোপে আওয়ামী লীগের নেতাদের যে ব্যাকুলতা ছিল, তা সমর্থিত হয়েছে। অনেকের সঙ্গে টেলিফোন আলাপে ধারণা হলো, তাঁরা আপিল বিভাগের সংখ্যাগরিষ্ঠ রায়ে সন্তুষ্ট। কারণ তাঁরা মনে করেন, দুই মেয়াদে এই ব্যবস্থা বহাল রেখে সুপ্রিম কোর্ট নিরপেক্ষ থেকেছেন। প্রধান বিচারপতি ও আপিল বিভাগের বিচারপতির বিধান বাতিল করার মধ্যেও তাঁরা নিরপেক্ষতার বিষয়টি দেখেন। নীতিগতভাবে এবং বৈধ আকাঙ্ক্ষার দিক থেকে তাঁদের সঙ্গে আমি একমত। কিন্তু সামগ্রিকভাবে ও বাস্তবতার নিরিখে দেখলে রায় সমর্থনযোগ্য নয়।
প্রথমত, ভাবীসাপেক্ষ বাতিল কথাটি কয়েকটি প্রশ্ন ডেকে আনে। তা হলো, কেন এটি পঞ্চম ও সপ্তম সংশোধনীর মতো গোড়া থেকে বাতিল হলো না? সামরিক ফরমান ও সংসদের মধ্যে পার্থক্য রাখতেই কি না, সেই প্রশ্নের জবাব আমরা পূর্ণাঙ্গ রায়ে পেতে চাইব। আরেকটি কথা, ভাবী সাপেক্ষের সংজ্ঞা কী? কবে থেকে শুরু? কবে শেষ? আগামী ও তার পরের সাধারণ নির্বাচন কেয়ারটেকারের অধীনে করা কিন্তু বাধ্যতামূলক নয়। এটা ঐচ্ছিক। সংক্ষিপ্ত আদেশের এই সংশ্লিষ্ট বাক্যটিতে ‘শ্যাল’ নয়, ‘মে’ কথাটি ব্যবহার করা হয়েছে। জনগণকে পিটিয়ে তক্তা করে এবং বহু লাশের বিনিময়ে যাঁরা তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠার কৃতিত্ব দাবি করে আসছিলেন, এখন তাতে তাঁদের অনীহা কারও অজানা ছিল না। কিন্তু তারা সব মহল থেকেই বাধাগ্রস্ত হচ্ছিল। তারা মুখ লুকানোর উপায় পাচ্ছিল না। সুপ্রিম কোর্টের রায়ে তাদের মুখ রক্ষা হয়েছে।
মাননীয় আদালত আসলে এমন এক প্রেক্ষাপটে একটি সর্বোচ্চ স্পর্শকাতর রাজনৈতিক প্রশ্নের মীমাংসা দিলেন, যখন জনগণ জানে যে সরকারি ও বিরোধী দল একমত হয়েছে যে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বহাল থাকবে। অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম আপিল বিভাগের শুনানিতে বলেছিলেন, এই ব্যবস্থা থাকবে। রায়ের পরে তিনি বলেছেন, নীতিগতভাবে সঠিক রায় হয়েছে। তাঁর কথায়, ‘শ্যাল’ ও ‘যদি’র ব্যবহার দেখুন। তাঁর কথায়, ‘পরবর্তী দুই মেয়াদের সংসদ নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে হবে, যদি সংসদ সংবিধান সংশোধন না করে।’ একটা সাংঘাতিক রাজনৈতিক বিষয়ে সরকারের পোয়াবারোটা দেখুন। বিরোধী দল ও জনগণকে তারা একটা দীর্ঘ সময় অন্ধকারে রাখতে পারবে এবং তা ‘বৈধভাবে’। সুপ্রিম কোর্টের রায়কে ‘সাহসী ও দূরদর্শী’ হিসেবে গণ্য করতে তাদের সভা করতে হয়নি। ঠোঁটস্থ ছিল। তত্ত্বাবধায়ক সরকারে কেন তাদের রুচি ছিল, কেন অরুচি ধরল, তার নির্দিষ্ট ব্যাখ্যা মিলল না।
সংসদীয় কমিটি বা সরকারি দলের তরফে এর আগে শঙ্কা ছড়ানো হয় যে, এই ব্যবস্থা তারা সংখ্যাগরিষ্ঠের জোরে বাতিল করতে পারে। এরপর বিএনপির হুমকির মুখে আশ্বস্ত করা হয় যে এটা করা হবে না। সুশীল সমাজের সঙ্গে কমিটির বিরল আলোচনার সময়ও বিড়ালটা থলের ভেতরে ছিল। তাঁদের কেউ কল্পনা করতেও পারেননি যে আদালত একটি জ্বলন্ত রাজনৈতিক প্রশ্ন এমন নাটকীয়তায় সামনে আনবেন। এখন কমিটি কি এই প্রশ্নে সুশীল সমাজের মত নেবে? উত্তর—না।
মার্কিন সুপ্রিম কোর্ট রাজনৈতিক প্রশ্নের বিষয়ে বিধিনিষেধ আরোপ করেছিলেন। তাঁরা বলেছিলেন, রাজনৈতিক প্রশ্নের উত্তর আদালত দেবেন না। তাঁরা আইনগত মীমাংসা দেবেন। আল গোরকে নির্বাচনে হারিয়ে বুশকে জেতানোর ঘটনার পর মার্কিন পণ্ডিতেরা ভাবতে বসেন, সুপ্রিম কোর্টের হলো কী। বিচারিক সংযমের যুগ কি অপস্রিয়মাণ? ১৯৯৫ সালে এক স্পেশাল রেফারেন্সে বাংলাদেশের আপিল বিভাগ অবশ্য বলেন, ‘বিচারিক সংযম রক্ষার ক্ষেত্রে কোনটি “রাজনৈতিক প্রশ্ন”, তা বিবেচনায় কোনো জাদু নেই। রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত হিসেবে দেখা হবে কি না, এমন বিষয় নিষ্পত্তির চূড়ান্ত কর্তৃপক্ষ আদালত।’ (৪৭ ডিএলআর এডি: পৃষ্ঠা-১১১)
মার্কিন রাষ্ট্রপতিরা অনেক সময় বলেছেন, তা হলে সুপ্রিম কোর্টই এসে রায় বাস্তবায়ন করুন। রুজভেল্ট প্রধান বিচারপতি হফের সমালোচনা করে বলেছিলেন, ‘আমরা সংবিধানের অধীনে। অথচ বিচারপতিরা আমাদের বলছেন, সংবিধান মানে সেটাই, যেটা সুপ্রিম কোর্ট বলবেন। আমরা এমন সুপ্রিম কোর্ট চাই, যা সংবিধানের আওতায় বিচার দেবেন, সংবিধানের ঊর্ধ্বে উঠে নয়। আমাদের আদালতসমূহে আমরা আইনের সরকার চাই, ব্যক্তির নয়।’ এই রুজভেল্টই দলীয় বিচারকদের দিয়ে সুপ্রিম কোর্ট বগলদাবার (কোর্ট প্যাকিং) জন্য সমালোচিত হন।
অনেকের মতো আমিও গোড়ায় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা প্রবর্তনের বিরোধিতা করেছি। এটা অবশ্যই সংবিধানের মৌলিক কাঠামোবিরোধী, কিন্তু দরদি শত্রু। যে কারণে এর উদ্ভব, সেটা দূর না করে, কোনো উপযুক্ত বিকল্প বের না করে এটা বিলুপ্ত করে দিলে সমাজে, রাজনীতিতে বিশৃঙ্খলা দেখা দিতে পারে।
সুপ্রিম কোর্টের দ্ব্যর্থক রায় একটি ভ্রান্তি বলেই আমরা মনে করি। মাননীয় বিচারকেরা দুই মেয়াদের কথা বলে প্রকারান্তরে বাস্তবতা মানতে বাধ্য হয়েছেন। তবে সেটা নিয়ে রাজনীতি না করার দায় ক্ষমতাসীন সরকারের। শাসক দল এ নিয়ে রহস্যজনক অবস্থান নিলে সংশ্লিষ্ট সব পক্ষই একদিন হয়তো অনুভব করতে পারবে যে তাঁরা প্রত্যেকে ভুল করেছেন। কিন্তু এর প্রতিকারের সময় পাওয়া যাবে কি?
অনেকের মতে, ক্রমশ সংসদের বিকল্প হয়ে উঠেছেন আদালত। এটা হতে পারে না। দুনিয়ার কোথাও হয়নি। ‘ক্রান্তিকাল’ নিয়ে হারুন আল রশীদ ‘১৯৯০ ও ১৯৯১ সরকারের সাংবিধানিক ভিত্তি প্রশ্নবিদ্ধ’ শীর্ষক প্রতিবেদন লিখেছেন গতকালের প্রথম আলোয়। এই প্রশ্নের জবাব আদালতের কাছেই প্রত্যাশিত। সাবেক আইনমন্ত্রী আবদুল মতিন খসরুর সঙ্গে একমত হতে পারলে বাধিত হতাম। ক্রান্তিকাল মানে মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস। সুপ্রিম কোর্ট সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ক্রমশ রাজনৈতিক প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার প্রবণতা দেখাচ্ছেন। পঞ্চম সংশোধনীর রায়ের একতরফা রিভিউ হলো। বিরোধী দলকে অন্ধকারে রেখে রাষ্ট্র অস্বচ্ছতার সঙ্গে সাংবিধানিক প্রশ্নের সুরাহা করল। সেখানে আপিল বিভাগ বললেন, ভূতাপেক্ষ বৈধতার কোনো জায়গা সংবিধানের চতুর্থ তফসিলে থাকবে না। আজ ত্রয়োদশ সংশোধনীর মামলায় আদালত যাকে ‘ভাবীসাপেক্ষ’ (প্রোসপেক্টিভ) বলছেন, কালই তা ভূতাপেক্ষ (রেট্রোসপেক্টিভ) হবে। তখন এর ধারাবাহিকতার কী হবে? সুপ্রিম কোর্টের রায়ে অবৈধ ঘোষিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা আগামী দুই মেয়াদে হালাল হলে তার জায়গা সংবিধানে কী হবে? এমন বহু প্রশ্ন তৈরি হচ্ছে। উত্তর মিলছে না।
মনে হচ্ছে, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট একটি ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছেন। শনিবার কাকরাইলে বিচারপতিদের জন্য তৈরি নতুন ভবনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বিচার বিভাগের স্বাধীনতার বিষয়ে প্রধান বিচারপতি ও আইনমন্ত্রী বক্তব্য দিয়েছেন। তাঁদের উভয়ের বক্তব্যে যে সত্যতা রয়েছে, তা অস্বীকার করা যাবে না।
 মিজানুর রহমান খান: সাংবাদিক।
mrkhanbd@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.