সন্তানকে কাছে পেতে মায়ের লড়াই by তানজিম আল ইসলাম

মেয়েটির জীবনের দুটি পর্ব। প্রথম পর্বটি অনেক করুণ, অনেক কষ্টের। এ পর্বের পাট চুকিয়ে তিনি এখন দ্বিতীয় পর্বে। এখন নতুন এক যুদ্ধে লিপ্ত এ পর্বে এসে। যুদ্ধটি তাঁর গর্ভজাত সন্তানকে এক পলক দেখার। ছেলেটির বয়স এখন চার। আইন অনুযায়ী সাত বছর পর্যন্ত ছেলেটির মা তাকে নিজের কাছে রাখার হকদার।


আইনের অধিকার থেকে মা বঞ্চিত, এমনকি ছেলেকে জড়িয়ে একটু মমতা ঢেলে দেওয়ার সুযোগও তাঁকে দেওয়া হচ্ছে না। স্নেহময়ী মা নীরবে কাঁদেন। লোকলজ্জার ভয়ে কাউকে কিছু বলতে পারেন না, বললেও জোটে উল্টো অপবাদ। দ্বিতীয় পর্বের গল্পটির আগে প্রথম পর্বের কিছু অংশ তুলে ধরা প্রয়োজন।
মেয়েটি উচ্চশিক্ষিত। ঢাকার এক সম্ভ্রান্ত পরিবারের মেয়ে। সাত বছর আগে ভালোবেসে বিয়ে করেন। কিন্তু ভালোবাসার মর্যাদা ও স্বপ্ন বিয়ের পর থেকেই ম্লান হতে থাকে। বিয়ের আগের মানুষটি বিয়ের পর হয়ে গেলেন বিপরীত মেরুর। বিয়ের তিন বছর পর এল সন্তান। এরপর তাঁর স্বামী আরও কঠিন হয়ে যান। মেয়েটির ভাষায়, সারা দিন বাইরে থেকে পার্টি করে প্রতি রাতে মদ্যপ অবস্থায় ফিরতেন তাঁর স্বামী। স্ত্রী হিসেবে একটু কাছে ডাকা কিংবা কোনো একটি বিকেলে এক কাপ চা খাওয়াও হয়নি তাঁদের। অবশ্য সন্তানটিকে খুব আদর করতেন। তাকে সময় দিতেন মাঝেমধ্যে। ছেলেটি একটু বড় হতেই বাবার খুব ভালো বন্ধু হয়ে ওঠে।
উচ্চবিত্ত পরিবারের ছেলে হিসেবে বড় করতেই বাবার যত প্রয়াস। তাঁর কথায়, তাঁর ছেলে হবে বাবার পরিচয়ে। ছেলেটিও বাবার উচ্চবিত্তীয় গড়নের হয়ে উঠছে। মা নিষেধ করতে পারতেন না। ছেলেকে তার মনের মতো গড়ে ওঠার সুযোগ দিতেন। কিন্তু এই মা তো একজন রক্ত-মাংসের মানুষ। একজন নারী হিসেবে, একজন স্ত্রী হিসেবে তিনি তাঁর সব চাহিদা ও মর্যাদা থেকে বঞ্চিত। অবশেষে দেয়ালে পিঠ ঠেকে যায়। সিদ্ধান্ত নেন তালাক দেওয়ার। তালাক দেন স্বামীকে। কিন্তু এর পরও মেয়েটি মনে করেছিলেন, তাঁর ছেলেকে আইনগতভাবে কাছে পাবেন, তাকে দেখাশোনার সুযোগ পাবেন। মেয়েটির প্রথম জীবনের প্রথম পর্ব এখানেই শেষ।
দ্বিতীয় পর্বটি আরও করুণ! শত হলেও মা তো! তালাক দেওয়ার পর বেশ কয়েক মাস সন্তানকে তিনি কাছে পেতেন। এদিকে মেয়েটি সমাজের নানা কথা শুনতে থাকেন, নিজের ভাইবোনেরাই তাঁকে অপবাদ দেন। মেয়েটি ছোটখাটো একটা প্রতিষ্ঠানে চাকরি করতেন। এর সুবাদে পরিচয় হয় একটি ছেলের সঙ্গে। ওই ছেলের মধ্যে তিনি তাঁর পৃথিবীর পুনর্জন্ম দেখতে পান, স্বপ্নের শুরু খুঁজে পান। বিয়ে হয় তাঁদের। তারপর ছোট্ট একটা সংসার বাঁধেন...। কিন্তু তাঁর সন্তানটিকে আর দেখতে পান না। তাঁর আগের সেই নিষ্ঠুর স্বামীর ও তাঁর আত্মীয়স্বজনের কাছে মিনতি করেন তাঁর ছেলেকে একটিবারের জন্য দেখতে দিতে। মেলে না ছেলের কাছে যাওয়ার সুযোগ। দিন যায়, মায়ের কানে পৌঁছে না আম্মু ডাক।
স্কুলের সামনে এসে গেটে দাঁড়ান। কিন্তু ছেলের আর দেখা মেলে না। একদিন বাড়ির দারোয়ানকে জিজ্ঞেস করে জানতে পারেন, তাঁর সন্তানটি ভীষণ অসুস্থ। মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে গেছে। কিছু খেতে চায় না, স্কুলে যেতে চায় না, অজ্ঞান হয়ে পড়ে। একবার অ্যাপোলো হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। মা আর স্থির থাকতে পারেন না।
মেয়েটির তালাকনামা আমি সম্পন্ন করে দিয়েছিলাম। আমাকে একদিন ফোন করে সব ঘটনা খুলে বললেন। বললাম, তাহলে পারিবারিক আদালতের আশ্রয় নেওয়া যেতে পারে। আমাকে জিজ্ঞেস করেন, কত দিন লাগবে তাঁর ছেলেকে দেখতে। বললাম, কমপক্ষে ছয় মাস তো লাগবেই। ছয় মাস দীর্ঘ সময়, তারপর আদালতের বিষয়টি অনিশ্চিত। ফোনেই কেঁদে কেঁদে বলতে লাগলেন, তাহলে এখন তিনি কী করবেন? তাঁকে বলি, কোনো একটা মানবাধিকার সংস্থায় যোগাযোগ করতে। কথামতো গেলেন একটি এনজিওতে। সালিসের জন্য ডাকা হলো তাঁদের। মেয়েটি এলেও ছেলেটি আসেননি। এখন মেয়েটি কী করবেন। আদালতে যাওয়া ছাড়া আর উপায় নেই। বারবার জানতে চাইলেন। এর মধ্যে একটি জিডি করলেন থানায়। মেয়েটি মনস্থির করলেন, তাঁর মাকে নিয়ে সন্তানকে দেখতে যাবেন। এক পলক দেখা করতে পারলেই শান্তি মিলবে তাঁর। কিন্তু বাড়ির ভেতরে আর ঢুকতে পারলেন না তাঁরা। কোনো উপায় না দেখে মেয়েটি শেষমেশ আদালতের দ্বারস্থ হলেন।
শুরু হলো আদালত-পর্ব। পারিবারিক আদালতে আবেদন করলেন মেয়েটি। নিজের গর্ভজাত সন্তানকে দেখতে শুরু হলো আইনের লড়াই। নিয়মমতো বিবাদীর ওপর সমন গেল। বিবাদী জবাব দাখিল করলেন। শুরু হলো বিচারপূর্ব সালিস। পারিবারিক আদালতে সাক্ষ্য শুরুর আগে প্রিট্রায়াল মানে বিচারপূর্ব সালিস হয়। এতে বিচারক তাঁর খাসকামরায় বাদী, বিবাদী ও তাঁদের নিযুক্ত আইনজীবীকে নিয়ে সালিস করেন। দুই পক্ষের সমঝোতা করার চেষ্টা করেন। সালিসে মেয়েটির পক্ষে আইনজীবী ছিলেন একটি বেসরকারি সংস্থায় নিযুক্ত আইনজীবী। মেয়েটি জানান, সালিসে ঠিক হয় বাবা তাঁর ছেলেকে নিয়ে আসবেন আদালতে, সেখানে মা তাঁর ছেলের সঙ্গে দেখা করবেন। তারিখ নির্ধারিত হয় ১০ দিন পরে...। মেয়েটিকে জিজ্ঞেস করি, আপনি কি এতে রাজি আছেন?
তিনি বললেন, ‘হ্যাঁ, আমি রাজি। আমার ছেলেকে না দেখা পর্যন্ত আমি পাগলের মতো হয়ে আছি।’
বললাম, এই দেখার পর ছেলেটির বাবা আর দেখা না-ও করতে দিতে পারেন। মেয়েটি বললেন, ‘জানি না। আগে ছেলেটিকে বুকে জড়িয়ে ধরি। আমি নিশ্চিত, আমার ছেলে আমাকে ছেড়ে আর কোথাও যাবে না।’
আপনার আগের স্বামী তো অনেক উচ্চবিত্ত এবং ইগো নিয়ে আছেন। তিনি তো পরে আর না-ও আসতে পারেন।
‘হ্যাঁ, আমি জানি। ওর ইগোর কারণেই আমার বাচ্চাটির সর্বনাশ হচ্ছে।’
ছেলেটিও তো আপনার কাছে ফিরে না আসতে চাইতে পারে, তখন?
মেয়েটি কিছুক্ষণ চুপ করে থাকেন। তারপর বলেন, ‘না, আসবেই। আমার ছেলে যতই বাবাকে পছন্দ করুক, সে আমাকে ছাড়া থাকতে পারে না।’
আমি এই ‘মা’কে তাঁর উচ্ছ্বাস থামাতে আর চেষ্টা করিনি। মা অপেক্ষায় থাকেন, তাঁর আদরের ছেলেকে বুকে জড়িয়ে ধরবেন। আর তাঁর ছেলেটি ‘আম্মু’ বলে ডেকে উঠবে...। একদিকে স্ত্রীর মর্যাদা চেয়ে পরাজিত হয়ে আলাদা জীবনযুদ্ধ, অন্যদিকে মাতৃত্বের দাবি।
একটিতে মেয়েটি বেছে নিয়েছেন আলাদা হওয়ার পথ, কিন্তু মাতৃত্বের দাবি থেকে তিনি কি আলাদা হতে পারেন?

পাদটীকা: মুসলিম আইন অনুযায়ী স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে তালাক হয়ে গেলে ছেলেসন্তান সাত বছর পর্যন্ত এবং মেয়েসন্তান সাবালিকা হওয়া পর্যন্ত মায়ের হেফাজতে থাকতে পারে। এর পরও আদালত সন্তানের কল্যাণের কথা চিন্তা করে মায়ের হেফাজতে থাকার নির্দেশ দিতে পারেন। মূলত সন্তানদের আইনগত অভিভাবক বাবা। মায়ের হেফাজতে থাকলেও বাবাকে সন্তানদের ভরণপোষণ দিতে হবে। তালাকের পর মায়ের অন্যত্র বিয়ে হলে মায়ের তত্ত্বাবধানের এবং হেফাজতে থাকার ক্ষমতা হারাতে হতে পারে।
tanzimlaw@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.