রাষ্ট্রক্ষমতায় ইন্দ্রজাল by এ কে এম শাহনাওয়াজ
বাংলাদেশের মানুষ অনেকটা খাঁচায় বন্দি পাখি। তেমন একটা বিকল্প না থাকায় কখনো আওয়ামী লীগ আবার কখনো বিএনপির খাঁচাতে ডানা ঝাপটাতে হয়। আর এই দুই দলও জনগণের রাজনীতি করার মতো মানসিক শক্তি হারিয়ে ফেলেছে অনেক আগেই।
তাই হাজার ঝগড়ার পরও অদল-বদল করে রাষ্ট্রক্ষমতায় আসা-যাওয়া করার ব্যবস্থাটাকে মন্দের ভালো হিসেবে মেনে নিয়েছে। এ কারণে নিজেদের রাজনীতিকে জনকল্যাণমুখী আর আদর্শিক করার চেষ্টায় না গিয়ে রাজনীতিতে যাতে বিকল্প শক্তির আবির্ভাব না ঘটে তার জন্য সদা সতর্ক থাকে। এ কারণে খড়গহস্ত হতেও দ্বিধা করে না। এমনি অদ্ভুত গণতন্ত্রের ঝাণ্ডাধারী আমাদের ক্ষমতার রাজনীতির মহিমান্বিতরা!
সবচেয়ে বিস্ময়ের ব্যাপার হচ্ছে ক্ষমতাসীনদের পারফরম্যান্স। অন্যদিকে ক্ষমতায় ফেরার জন্য উদগ্রীবদের পারফরম্যান্স অনেকটা 'মরিয়া' গোছের এবং সে কারণে অনেক ক্ষেত্রে যুক্তিহীন ও ক্ষেত্রবিশেষে হাস্যকর। তবে উভয় পক্ষই যে নির্বাচনের আগ পর্যন্ত জনগণকে শক্তিহীন ক্লীব মনে করে এবং নিজেদের অতিশয় চতুর ভেবে সাধারণ মানুষকে মূর্খ ভাবে_এ ব্যাপারে সাধারণ বুদ্ধির মানুষও সন্দেহ পোষণ করেন না।
তবে আমাদের রাষ্ট্রক্ষমতার আসন যে মায়াবী, ইন্দ্রজালের বলয়ে বন্দি তা ক্ষমতাসীনদের ভাবভঙ্গি, বলা-কওয়া, হাঁটা-চলা দেখলেই বোঝা যায়। কেমন যেন নিশিতে পাওয়া। না হলে আওয়ামী লীগ বিএনপি উভয় দলেরই রাষ্ট্রক্ষমতায় যাওয়া এবং বৃন্তচ্যুত হওয়ার অভিজ্ঞতা রয়েছে। এসব দলের প্রাজ্ঞ নেতা-নেত্রীদের বোঝার কথা সাধারণ মানুষ অতটা সাধারণ নয়। সময়ে মন্দের ভালো বিবেচনায় সমর্থন দেয় আবার কষ্ট পেলে সমর্থন তুলে নিতে দ্বিতীয়বার ভাবে না। না হলে কোনো দলেরই নিশ্চিন্ত থাকার মতো স্থায়ী ভোটব্যাংক নেই কেন? অন্ধ ভোটারের সমর্থন কিঞ্চিৎ স্বস্তি দেয় বটে, তবে চিন্তামুক্ত করতে পারে না। সাধারণ মুক্ত মনের মানুষের পছন্দ দলীয় আদর্শ ও আদর্শ অনুসারী রাজনীতি। আওয়ামী লীগ একটি আদর্শিক দল। মাটি ও মানুষের মধ্য থেকে বেড়ে উঠেছে। আন্দোলন সংগ্রামের দীর্ঘ ঐতিহ্য আছে দলটির। তবে স্বাধীন বাংলাদেশ সৃষ্টির আগে প্রকৃত অর্থে রাষ্ট্র পরিচালনার অভিজ্ঞতা ছিল না দলটির। এ কারণে স্বাধীনতা-উত্তরকালে বিরুদ্ধ পরিবেশে রাষ্ট্র পরিচালনায় সে সময়ের আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব শানিত মেধার পরিচয় দিতে পারেনি। এর পরও প্রয়োজন ছিল জনগণের রাজনীতি করে এবং সেই মতো সরকারি নীতিনির্ধারণ করে সাধারণ মানুষের আস্থা ফিরিয়ে আনা। কিন্তু ইন্দ্রজাল ততক্ষণে গ্রাস করে ফেলেছিল রাষ্ট্রক্ষমতার উঠানকে। সংকীর্ণভাবে নিজ দলে বন্দি হয়ে পড়েছিল। আর এখানেই পথ পেয়ে শক্তিশালী হয়েছে ষড়যন্ত্রকারীরা। ফলে তারা পঁচাত্তর তৈরি করতে পেরেছে সহজেই। রাজনৈতিক আদর্শহীন পঁচাত্তরের সুবিধাভোগীরা রাষ্ট্রক্ষমতায় এসে সুবিধা করতে পেরেছিল তিনটি প্রধান কারণে। ১. আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রকারীদের আশীর্বাদ পেয়েছে; ২. আওয়ামী লীগ ও অন্যান্য অঞ্চলের দলছুট সুবিধাবাদী মানুষদের পাশে পেয়েছে এবং তিন. আওয়ামী লীগ ও আওয়ামী সরকারের কাছ থেকে অবহেলা, অমর্যাদা ও লাঞ্ছনা পাওয়া মানুষদের দলে ভেড়াতে পেরেছে। এই আদর্শহীন সুবিধাবাদী পাঁচমিশেলি দল বিএনপির রাজনৈতিক কোমর তেমন শক্ত হওয়ার কথা ছিল না। কিন্তু আত্মবিশ্বাস হারিয়ে ফেলা আওয়ামী লীগ নিজ রাজনৈতিক আদর্শে বলীয়ান হয়ে আর ফিরে এল না জনগণের কাছে। সংকীর্ণ দলীয়বৃত্তে বন্দি হয়ে গেল। ততটাই দূরদর্শিতা নিয়ে নানা কর্মসূচি গ্রহণ করে জিয়াউর রহমান তাঁর ভুঁইফোড় বিএনপিকে মন্দের ভালো বানাতে লাগলেন। রাজনৈতিক বিশ্লেষক মাত্রই বলবেন আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক ব্যর্থতাই বিএনপির মতো একটি সামরিক ছাউনির দলকে অনেকটা রাতারাতিই বড় দল করে দিল। অনেককাল পর যেন আবার একই প্রেক্ষাপট রচিত হচ্ছে এখন।
যদিও বাস্তবে তেমন দেখা যায় না; তবু সাধারণ মানুষ বিএনপি ও আওয়ামী লীগের মধ্যে গুণগত পার্থক্য আশা করে। বিএনপি স্বাভাবিকভাবেই চাইবে ক্ষমতা আঁকড়ে থাকতে। কারণ একদিকে এই দলটির মূল মাটির গভীরে নেই, অন্যদিকে দমে দমে প্রকাশ করছে ঠুনকো জাতীয়তাবাদী আদর্শের স্লোগান। এই ধারার সমর্থকদের ঐক্যবদ্ধ রাখা কঠিন। তাই রাষ্ট্রক্ষমতার শক্তি ও রসে অস্তিত্ব টেকানো ও বলবন্ত হওয়া ছাড়া তাদের উপায় খুব কম। আর আওয়ামী লীগের শক্তি পুনর্গঠন করার উপায় জনগণের কাছে ফেরা। আদর্শিক জায়গায় দাঁড়িয়ে রাজনীতি করা। জনগণের শক্তি নিয়েই অবধারিতভাবে রাষ্ট্রক্ষমতায় ফিরে আসা। কিন্তু উভয় দলের আত্মবিশ্বাসহীন নেতৃত্বের জনবিচ্ছিন্নতা উভয়কে ভারসাম্যের মধ্য দিয়ে বাঁচিয়ে রাখার একধরনের শক্তি দিয়েছে। কারণ এক দলের ভুল ও বিভ্রান্তি রাজনৈতিক দূরদর্শিতা দিয়ে নিজ অনুকূলে ব্যবহার করতে পারছে না অন্যপক্ষ। ফলে খুঁড়িয়ে চললেও নিশ্চিহ্ন হওয়ার আশঙ্কা নেই কারোর।
যদি তা না হবে তবে সময় ও বাস্তবতার সুবিধায় বিশাল জনসমর্থন পেয়ে এবার ক্ষমতায় এসেও কেন আদর্শিক রাজনীতিতে ফিরে যেতে পারছে না আওয়ামী লীগ? জনগণের বাঁধভাঙা সমর্থন পেয়েও কেন সংকীর্ণ দলীয় রাজনীতিতে আটকে গেল? জনদুর্ভোগকে আমলে না এনে স্বেচ্ছাতন্ত্রকেই যেন প্রতিষ্ঠা করতে চাইছে। দলের আর্থিক পৃষ্ঠপোষক ব্যবসায়ীদের কাছে আত্মসমর্পণ করে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণের লাগাম হাতছাড়া করে ফেলছে। গ্যাস, বিদ্যুৎ, পানির মতো নিত্যসেবার উন্নয়নে কার্যকর পদক্ষেপের ফসল জনগণকে না দেখিয়ে শুধু বক্তৃতায় বাগাড়ম্বর করে বেড়াচ্ছে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির ক্রমাবনতি ঘটিয়েও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক সব সরকারের অভিন্ন ভাষায় 'আগের চেয়ে পরিস্থিতি ভালো' ধরনের বক্তৃতা দিয়ে বেড়াচ্ছে। দলীয় সন্ত্রাসের বাড়বাড়ন্ত দেখেও চোখ বন্ধ করে থাকছে। নানা কর্মকাণ্ডে মানুষ বিশ্বাস করতে চাইছে না যে আইন এখন আপন গতিতে হাঁটছে। দেশজুড়ে মানুষ যে এখন সরকারি ব্যর্থতার সমালোচনায় মুখর ও ক্ষুব্ধ_তোষামোদকারীদের বলয় ভেদ করে জনগণের দল আওয়ামী লীগ আর সরকারের নীতিনির্ধারকরা সে শব্দ শুনতে পাচ্ছেন না। এর চেয়ে তুলনামূলক ভালো অবস্থা ছিল ছিয়ানব্বইয়ের আওয়ামী লীগ সরকারের। অন্তত কিছু সাফল্য দৃশ্যমান ছিল। তবুও সাধারণ মানুষ দলীয় সন্ত্রাসের প্রশ্রয়কে ক্ষমা করতে পারেনি। এবারও কোনো কোনো ক্ষেত্রে সাফল্য নেই তা নয়, দেশে সুশাসন বজায় থাকলে সাফল্যগুলো মানুষের সামনে অনেক বেশি স্পষ্ট হতো। আত্মবিশ্লেষণ করতে পারলে একটি জীবন্ত রাজনৈতিক দল পথের দিশা পেতে পারে। বিশাল জনসমর্থন নিয়ে আসা দলের নীতিনির্ধারকরা এগিয়ে চলার জন্য শক্ত পথ তৈরি করে নিতে পারেন। কিন্তু কার্যত সব ছন্দই যেন হারিয়ে ফেলছেন সরকার পরিচালকরা। এ জন্যই মনে হয়, সরকারের ঝলমলে প্রাসাদে ঢুকলে সবাই যেন ইন্দ্রজালের বলয়ে বন্দি হয়ে পড়েন। আচরণে গণবিচ্ছিন্ন হয়ে যান সহজেই। আর অমনটি ঘটতে পারে বলেই বোধ হয় কবির প্রার্থনা থাকে_'তোমার পতাকা যারে দাও তারে বহিবারে দাও শকতি'।
দেশের লাখো-কোটি মুক্ত মনের দেশপ্রেমিক মানুষের দুঃখ এখানেই যে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের ঐতিহ্যবাহী দল আওয়ামী লীগকে একটি সুবিধাজনক সময়ে বিপুল সমর্থন দিয়ে রাষ্ট্রক্ষমতায় যে উদ্দেশ্যে বসিয়েছিল তার অপচয় করছে সরকার। অন্যায়-দুর্নীতিতে পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে ক্ষমতা থেকে অনেকটা দূরে ছিটকে পড়েছিল বিএনপি। মানুষ ভেবেছিল বিএনপির অপশাসনের প্রতিফল দেখে আওয়ামী লীগ শিক্ষা গ্রহণ করবে। মাঠের রাজনীতি থেকে উঠে এসে সরকার গঠন করেছে, তাই জনগণের মনে স্থায়ী আসন তৈরির পথ খুঁজে পাওয়া অনেক সহজ ছিল। মানুষের প্রত্যাশা ছিল সে পথেই হাঁটবে দলটি। কিন্তু কার্যত মোটেও পট পরিবর্তিত হলো না। ঘুষ-দুর্নীতি পুরনো পথ ধরেই হাঁটছে এখন। সাধারণ মানুষের স্বস্তির জায়গা দিন দিন ছোট হয়ে যাচ্ছে। তবুও ঘুরে দাঁড়ানোর কোনো লক্ষণ নেই। নির্বাচনে প্রবল জনসমর্থন সম্ভবত যুগপৎ উন্নাসিক ও নির্বোধ করে দিয়েছে সরকার পরিচালকদের।
এ অবস্থা আওয়ামী লীগের জন্য কতটা ক্ষতির হবে তা এই দলের নেতারা ভাবুন। আমাদের ভাবনা সরকারি এই দুর্বলতা যদি কোনো অশুভ শক্তিকে আবার মাথা তুলে দাঁড়ানোর সুযোগ করে দেয়! তবুও আমরা প্রত্যাশার জায়গাটিকে বাঁচিয়ে রাখতে চাই। আমরা অপেক্ষা করছি সরকার পরিচালকদের শুভবুদ্ধি উদয়ের। তাঁরা ক্ষমতার প্রাসাদে ইন্দ্রজালমুক্ত হোন। দলীয় সংকীর্ণতা থেকে বেরিয়ে এসে যত তাড়াতাড়ি সুশাসন প্রতিষ্ঠায় মনোযোগ দেবে দেশ, জাতি এবং দল হিসেবে আওয়ামী লীগ_সবার জন্যই তা হবে মঙ্গলের।
লেখক : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
সবচেয়ে বিস্ময়ের ব্যাপার হচ্ছে ক্ষমতাসীনদের পারফরম্যান্স। অন্যদিকে ক্ষমতায় ফেরার জন্য উদগ্রীবদের পারফরম্যান্স অনেকটা 'মরিয়া' গোছের এবং সে কারণে অনেক ক্ষেত্রে যুক্তিহীন ও ক্ষেত্রবিশেষে হাস্যকর। তবে উভয় পক্ষই যে নির্বাচনের আগ পর্যন্ত জনগণকে শক্তিহীন ক্লীব মনে করে এবং নিজেদের অতিশয় চতুর ভেবে সাধারণ মানুষকে মূর্খ ভাবে_এ ব্যাপারে সাধারণ বুদ্ধির মানুষও সন্দেহ পোষণ করেন না।
তবে আমাদের রাষ্ট্রক্ষমতার আসন যে মায়াবী, ইন্দ্রজালের বলয়ে বন্দি তা ক্ষমতাসীনদের ভাবভঙ্গি, বলা-কওয়া, হাঁটা-চলা দেখলেই বোঝা যায়। কেমন যেন নিশিতে পাওয়া। না হলে আওয়ামী লীগ বিএনপি উভয় দলেরই রাষ্ট্রক্ষমতায় যাওয়া এবং বৃন্তচ্যুত হওয়ার অভিজ্ঞতা রয়েছে। এসব দলের প্রাজ্ঞ নেতা-নেত্রীদের বোঝার কথা সাধারণ মানুষ অতটা সাধারণ নয়। সময়ে মন্দের ভালো বিবেচনায় সমর্থন দেয় আবার কষ্ট পেলে সমর্থন তুলে নিতে দ্বিতীয়বার ভাবে না। না হলে কোনো দলেরই নিশ্চিন্ত থাকার মতো স্থায়ী ভোটব্যাংক নেই কেন? অন্ধ ভোটারের সমর্থন কিঞ্চিৎ স্বস্তি দেয় বটে, তবে চিন্তামুক্ত করতে পারে না। সাধারণ মুক্ত মনের মানুষের পছন্দ দলীয় আদর্শ ও আদর্শ অনুসারী রাজনীতি। আওয়ামী লীগ একটি আদর্শিক দল। মাটি ও মানুষের মধ্য থেকে বেড়ে উঠেছে। আন্দোলন সংগ্রামের দীর্ঘ ঐতিহ্য আছে দলটির। তবে স্বাধীন বাংলাদেশ সৃষ্টির আগে প্রকৃত অর্থে রাষ্ট্র পরিচালনার অভিজ্ঞতা ছিল না দলটির। এ কারণে স্বাধীনতা-উত্তরকালে বিরুদ্ধ পরিবেশে রাষ্ট্র পরিচালনায় সে সময়ের আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব শানিত মেধার পরিচয় দিতে পারেনি। এর পরও প্রয়োজন ছিল জনগণের রাজনীতি করে এবং সেই মতো সরকারি নীতিনির্ধারণ করে সাধারণ মানুষের আস্থা ফিরিয়ে আনা। কিন্তু ইন্দ্রজাল ততক্ষণে গ্রাস করে ফেলেছিল রাষ্ট্রক্ষমতার উঠানকে। সংকীর্ণভাবে নিজ দলে বন্দি হয়ে পড়েছিল। আর এখানেই পথ পেয়ে শক্তিশালী হয়েছে ষড়যন্ত্রকারীরা। ফলে তারা পঁচাত্তর তৈরি করতে পেরেছে সহজেই। রাজনৈতিক আদর্শহীন পঁচাত্তরের সুবিধাভোগীরা রাষ্ট্রক্ষমতায় এসে সুবিধা করতে পেরেছিল তিনটি প্রধান কারণে। ১. আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রকারীদের আশীর্বাদ পেয়েছে; ২. আওয়ামী লীগ ও অন্যান্য অঞ্চলের দলছুট সুবিধাবাদী মানুষদের পাশে পেয়েছে এবং তিন. আওয়ামী লীগ ও আওয়ামী সরকারের কাছ থেকে অবহেলা, অমর্যাদা ও লাঞ্ছনা পাওয়া মানুষদের দলে ভেড়াতে পেরেছে। এই আদর্শহীন সুবিধাবাদী পাঁচমিশেলি দল বিএনপির রাজনৈতিক কোমর তেমন শক্ত হওয়ার কথা ছিল না। কিন্তু আত্মবিশ্বাস হারিয়ে ফেলা আওয়ামী লীগ নিজ রাজনৈতিক আদর্শে বলীয়ান হয়ে আর ফিরে এল না জনগণের কাছে। সংকীর্ণ দলীয়বৃত্তে বন্দি হয়ে গেল। ততটাই দূরদর্শিতা নিয়ে নানা কর্মসূচি গ্রহণ করে জিয়াউর রহমান তাঁর ভুঁইফোড় বিএনপিকে মন্দের ভালো বানাতে লাগলেন। রাজনৈতিক বিশ্লেষক মাত্রই বলবেন আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক ব্যর্থতাই বিএনপির মতো একটি সামরিক ছাউনির দলকে অনেকটা রাতারাতিই বড় দল করে দিল। অনেককাল পর যেন আবার একই প্রেক্ষাপট রচিত হচ্ছে এখন।
যদিও বাস্তবে তেমন দেখা যায় না; তবু সাধারণ মানুষ বিএনপি ও আওয়ামী লীগের মধ্যে গুণগত পার্থক্য আশা করে। বিএনপি স্বাভাবিকভাবেই চাইবে ক্ষমতা আঁকড়ে থাকতে। কারণ একদিকে এই দলটির মূল মাটির গভীরে নেই, অন্যদিকে দমে দমে প্রকাশ করছে ঠুনকো জাতীয়তাবাদী আদর্শের স্লোগান। এই ধারার সমর্থকদের ঐক্যবদ্ধ রাখা কঠিন। তাই রাষ্ট্রক্ষমতার শক্তি ও রসে অস্তিত্ব টেকানো ও বলবন্ত হওয়া ছাড়া তাদের উপায় খুব কম। আর আওয়ামী লীগের শক্তি পুনর্গঠন করার উপায় জনগণের কাছে ফেরা। আদর্শিক জায়গায় দাঁড়িয়ে রাজনীতি করা। জনগণের শক্তি নিয়েই অবধারিতভাবে রাষ্ট্রক্ষমতায় ফিরে আসা। কিন্তু উভয় দলের আত্মবিশ্বাসহীন নেতৃত্বের জনবিচ্ছিন্নতা উভয়কে ভারসাম্যের মধ্য দিয়ে বাঁচিয়ে রাখার একধরনের শক্তি দিয়েছে। কারণ এক দলের ভুল ও বিভ্রান্তি রাজনৈতিক দূরদর্শিতা দিয়ে নিজ অনুকূলে ব্যবহার করতে পারছে না অন্যপক্ষ। ফলে খুঁড়িয়ে চললেও নিশ্চিহ্ন হওয়ার আশঙ্কা নেই কারোর।
যদি তা না হবে তবে সময় ও বাস্তবতার সুবিধায় বিশাল জনসমর্থন পেয়ে এবার ক্ষমতায় এসেও কেন আদর্শিক রাজনীতিতে ফিরে যেতে পারছে না আওয়ামী লীগ? জনগণের বাঁধভাঙা সমর্থন পেয়েও কেন সংকীর্ণ দলীয় রাজনীতিতে আটকে গেল? জনদুর্ভোগকে আমলে না এনে স্বেচ্ছাতন্ত্রকেই যেন প্রতিষ্ঠা করতে চাইছে। দলের আর্থিক পৃষ্ঠপোষক ব্যবসায়ীদের কাছে আত্মসমর্পণ করে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণের লাগাম হাতছাড়া করে ফেলছে। গ্যাস, বিদ্যুৎ, পানির মতো নিত্যসেবার উন্নয়নে কার্যকর পদক্ষেপের ফসল জনগণকে না দেখিয়ে শুধু বক্তৃতায় বাগাড়ম্বর করে বেড়াচ্ছে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির ক্রমাবনতি ঘটিয়েও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক সব সরকারের অভিন্ন ভাষায় 'আগের চেয়ে পরিস্থিতি ভালো' ধরনের বক্তৃতা দিয়ে বেড়াচ্ছে। দলীয় সন্ত্রাসের বাড়বাড়ন্ত দেখেও চোখ বন্ধ করে থাকছে। নানা কর্মকাণ্ডে মানুষ বিশ্বাস করতে চাইছে না যে আইন এখন আপন গতিতে হাঁটছে। দেশজুড়ে মানুষ যে এখন সরকারি ব্যর্থতার সমালোচনায় মুখর ও ক্ষুব্ধ_তোষামোদকারীদের বলয় ভেদ করে জনগণের দল আওয়ামী লীগ আর সরকারের নীতিনির্ধারকরা সে শব্দ শুনতে পাচ্ছেন না। এর চেয়ে তুলনামূলক ভালো অবস্থা ছিল ছিয়ানব্বইয়ের আওয়ামী লীগ সরকারের। অন্তত কিছু সাফল্য দৃশ্যমান ছিল। তবুও সাধারণ মানুষ দলীয় সন্ত্রাসের প্রশ্রয়কে ক্ষমা করতে পারেনি। এবারও কোনো কোনো ক্ষেত্রে সাফল্য নেই তা নয়, দেশে সুশাসন বজায় থাকলে সাফল্যগুলো মানুষের সামনে অনেক বেশি স্পষ্ট হতো। আত্মবিশ্লেষণ করতে পারলে একটি জীবন্ত রাজনৈতিক দল পথের দিশা পেতে পারে। বিশাল জনসমর্থন নিয়ে আসা দলের নীতিনির্ধারকরা এগিয়ে চলার জন্য শক্ত পথ তৈরি করে নিতে পারেন। কিন্তু কার্যত সব ছন্দই যেন হারিয়ে ফেলছেন সরকার পরিচালকরা। এ জন্যই মনে হয়, সরকারের ঝলমলে প্রাসাদে ঢুকলে সবাই যেন ইন্দ্রজালের বলয়ে বন্দি হয়ে পড়েন। আচরণে গণবিচ্ছিন্ন হয়ে যান সহজেই। আর অমনটি ঘটতে পারে বলেই বোধ হয় কবির প্রার্থনা থাকে_'তোমার পতাকা যারে দাও তারে বহিবারে দাও শকতি'।
দেশের লাখো-কোটি মুক্ত মনের দেশপ্রেমিক মানুষের দুঃখ এখানেই যে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের ঐতিহ্যবাহী দল আওয়ামী লীগকে একটি সুবিধাজনক সময়ে বিপুল সমর্থন দিয়ে রাষ্ট্রক্ষমতায় যে উদ্দেশ্যে বসিয়েছিল তার অপচয় করছে সরকার। অন্যায়-দুর্নীতিতে পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে ক্ষমতা থেকে অনেকটা দূরে ছিটকে পড়েছিল বিএনপি। মানুষ ভেবেছিল বিএনপির অপশাসনের প্রতিফল দেখে আওয়ামী লীগ শিক্ষা গ্রহণ করবে। মাঠের রাজনীতি থেকে উঠে এসে সরকার গঠন করেছে, তাই জনগণের মনে স্থায়ী আসন তৈরির পথ খুঁজে পাওয়া অনেক সহজ ছিল। মানুষের প্রত্যাশা ছিল সে পথেই হাঁটবে দলটি। কিন্তু কার্যত মোটেও পট পরিবর্তিত হলো না। ঘুষ-দুর্নীতি পুরনো পথ ধরেই হাঁটছে এখন। সাধারণ মানুষের স্বস্তির জায়গা দিন দিন ছোট হয়ে যাচ্ছে। তবুও ঘুরে দাঁড়ানোর কোনো লক্ষণ নেই। নির্বাচনে প্রবল জনসমর্থন সম্ভবত যুগপৎ উন্নাসিক ও নির্বোধ করে দিয়েছে সরকার পরিচালকদের।
এ অবস্থা আওয়ামী লীগের জন্য কতটা ক্ষতির হবে তা এই দলের নেতারা ভাবুন। আমাদের ভাবনা সরকারি এই দুর্বলতা যদি কোনো অশুভ শক্তিকে আবার মাথা তুলে দাঁড়ানোর সুযোগ করে দেয়! তবুও আমরা প্রত্যাশার জায়গাটিকে বাঁচিয়ে রাখতে চাই। আমরা অপেক্ষা করছি সরকার পরিচালকদের শুভবুদ্ধি উদয়ের। তাঁরা ক্ষমতার প্রাসাদে ইন্দ্রজালমুক্ত হোন। দলীয় সংকীর্ণতা থেকে বেরিয়ে এসে যত তাড়াতাড়ি সুশাসন প্রতিষ্ঠায় মনোযোগ দেবে দেশ, জাতি এবং দল হিসেবে আওয়ামী লীগ_সবার জন্যই তা হবে মঙ্গলের।
লেখক : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
No comments