দিবস-ছয় দশকের দীপ্ত পথচলা by মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম
২৬ এপ্রিল কেন্দ্রীয় কর্মসূচি হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাস্কর্যের সামনে সকাল ১১টায় ছাত্র ইউনিয়ন পরিবারের হাজার হাজার সদস্যের একটি সমাবেশ অনুষ্ঠিত হবে। সেখানে এক ঘণ্টার অনুষ্ঠান শেষে একটি সুসজ্জিত র্যালি বের করা হবে।
তারপর বিশ্ববিদ্যালয় খেলার মাঠের বিশাল প্যান্ডেলে বিকেল ৩টায় শুরু হবে 'পুনর্মিলনী অনুষ্ঠান
আজ এপ্রিলের প্রথম দিন। এই এপ্রিল মাসের ২৬ তারিখে এবার পালিত হতে যাচ্ছে ছাত্র ইউনিয়নের ৬০তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী। ১৯৫২-এর এই দিনে ভাষা আন্দোলনের অভিজ্ঞতা, শিক্ষা ও সংগ্রামী প্রেরণায় উজ্জীবিত হয়ে ছাত্রসমাজের অতি প্রিয় এবং অনন্য ঐতিহ্যমণ্ডিত এ সংগঠনটির পথচলার সূচনা হয়েছিল। বহুবর্ণের রত্নময় গৌরবগাথায় রচিত তার পরবর্তী ছয় দশকের চলার পথ।
জন্মলগ্ন থেকে আজ পর্যন্ত শত-সহস্র ছাত্রছাত্রী শাণিত দেশপ্রেম, প্রগতিমুখিনতা ও সংগ্রামী একাগ্রতায় 'ঐক্য-শিক্ষা-শান্তি-প্রগতি'র মূলমন্ত্রে দীক্ষা নিয়ে ছাত্র ইউনিয়নের নীল পতাকাতলে সমবেত হয়েছে। তাদের অনেকেই আজ প্রয়াত। অনেকেই এখন অশীতিপর বৃদ্ধ। কেউ বা সবে কচি বয়সের কিশোর-তরুণ। তারা সবাই আদর্শের বাঁধনে একই পরিবারের সদস্য। আমিও তাদেরই একজন। সেই 'ছাত্র ইউনিয়ন পরিবারের' একজন সদস্য হতে পারাটা আমাদের আত্মপরিচয়ের অমূল্য সঞ্চয়, আমাদের পরম গৌরব।
২৬ এপ্রিল ঢাকায় ধুমধামের সঙ্গে বেশ বড় করে ছাত্র ইউনিয়নের ৬০তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী পালন করা হবে। গোলাম আরিফ টিপুকে চেয়ারম্যান করে জাতীয় উদযাপন কমিটি গঠন করা হয়েছে। সেই কমিটির পরিচালনায় ২৬ এপ্রিলের অনুষ্ঠানাদির প্রস্তুতি কাজ শুরু হয়ে গেছে। ২৬ এপ্রিলের পরও জাতীয় উদযাপন কমিটি সারাবছর ধরে নানা কাজের পরিকল্পনা নিয়েছে। জেলায় জেলায় এবং প্রবাসেও উদযাপন কমিটি গঠন করা হয়েছে। তাদের উদ্যোগেও নিজ নিজ এলাকায় পুনর্মিলনীসহ বছরব্যাপী নানা কর্মসূচি গ্রহণ করা যাবে।
২৬ এপ্রিল কেন্দ্রীয় কর্মসূচি হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাস্কর্যের সামনে সকাল ১১টায় ছাত্র ইউনিয়ন পরিবারের হাজার হাজার সদস্যের একটি সমাবেশ অনুষ্ঠিত হবে। সেখানে এক ঘণ্টার অনুষ্ঠান শেষে একটি সুসজ্জিত র্যালি বের করা হবে। তারপর বিশ্ববিদ্যালয় খেলার মাঠের বিশাল প্যান্ডেলে বিকেল ৩টায় শুরু হবে 'পুনর্মিলনী অনুষ্ঠান'। সেখানে সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত পর্যন্ত চলবে অনেক বছর ধরে না-দেখা বন্ধুদের সঙ্গে সাক্ষাৎ, ফেলে আসা দিনগুলো নিয়ে গল্প-গুজব, স্ত্রী-পুত্র-কন্যাদের নিয়ে চেনা পরিচয়ের পালা, ছবি তোলা, আড্ডা ইত্যাদি। মঞ্চ থেকে চলবে গান, কবিতা পাঠ, স্মৃতিচারণ ইত্যাদি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান।
২৬ এপ্রিলকে ঘিরে এখন থেকেই ছাত্র ইউনিয়ন পরিবারের সদস্যদের মাঝে জাগতে শুরু করেছে আবেগ-অনুভূতির গভীর স্পন্দন। ছয় দশকের এ অনন্য গৌরবগাথার অমর স্রষ্টা ও অমৃত সন্তান হলো '৫২ থেকে ২০১২ পর্যন্ত ছাত্র ইউনিয়নের 'ঐক্য-শিক্ষা-শান্তি-প্রগতি'র মূলমন্ত্রে দীক্ষিত শত-সহস্র সাথী। এই পরিবারের সন্তানরা আজ যে যেখানেই আছেন, তাদের খুঁজে বের করে পারিবারিক বন্ধনে সংযুক্ত করার কাজটি আজ আপনার, আমার বিশেষ কর্তব্য। ২৬ এপ্রিলের আগেই এ কাজটি যত বেশি সম্ভব এগিয়ে নিতে হবে।
২৬ এপ্রিল ঢাকায় একত্রিত হয়ে ৬০তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী পালন, ছাত্র ইউনিয়নের প্রতি আমাদের ভালোবাসা ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশের সুযোগ করে দেবে। সে সুযোগটি আমাদের নিতে হবে। অন্যরাও যেন সে সুযোগ নিতে পারে সে জন্য ২৬ এপ্রিলের পুনর্মিলনী অনুষ্ঠানের বার্তা তাদের কাছে পেঁৗছে দিতে হবে। এটি আজ আমার, আপনার দায়িত্ব।
ছাত্র ইউনিয়ন বছর পরম্পরায় লাখ লাখ তরুণ ছাত্রছাত্রীকে নির্ভেজাল দেশপ্রেম, গণতন্ত্র, অসাম্প্রদায়িকতা, সাম্রাজ্যবাদ বিরোধিতা, বিশ্বশান্তি, আন্তর্জাতিকতাবাদ, প্রগতিশীলতা, সমাজতন্ত্র, মানবমুক্তি ইত্যাদি সুমহান আদর্শ ও চেতনায় দীক্ষিত করেছে। ছাত্রসমাজের মাঝে প্রজ্বলিত করেছে জাগরণের অগি্ন-মশাল। অজেয় ও অনির্বাণ সেই চেতনার আলোকচ্ছটায় বায়ান্ন থেকে দীপ্ত হয়েছে অগণিত ছাত্রছাত্রী। ছাত্র ইউনিয়নের শিক্ষা তাদের শ্রেষ্ঠ মানবিক গুণাবলি আত্মকরণে ও নিজ নিজ পেশায় উৎকর্ষ অর্জনে পথ রচনা করে দিয়েছে।
ছাত্র ইউনিয়ন তার সদস্যদের শিক্ষা দিয়েছে প্রজ্ঞা, প্রগতিমুখিনতা, মুক্তবুদ্ধির চর্চা, সাহসিকতা, দৃঢ়তা, নিষ্ঠা, আত্মত্যাগের মনোবৃত্তি, উন্নত চারিত্রিক গুণাবলি, সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক বোধ, উন্নত রুচিশীলতা, শ্রমের প্রতি মর্যাদা, শোষিত-অবহেলিত মানুষের প্রতি শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার বোধ ইত্যাদি। উদার মানবপ্রেম ও র্যাডিকেল প্রগতিমুখিনতা নিয়ে দেশ, জাতি, জনগণ ও সভ্যতার অনন্ত অগ্রযাত্রার সাহসী সৈনিকের ব্রত গ্রহণ করতে ছাত্র ইউনিয়ন তার সদস্যদের উদ্বুদ্ধ করেছে। ছাত্র ইউনিয়ন শিখিয়েছে, বিদ্যমান প্রতিকূলতার কাছে মাথানত না করতে। শিখিয়েছে প্রতিক্রিয়াশীল স্থিতাবস্থাকে অথবা গণশত্রুর আঘাতকে চ্যালেঞ্জ করতে। মাঝে মাঝে নেমে আসা ঘোর কৃষ্ণপক্ষের মাঝেই ছাত্র ইউনিয়ন সব সময় থেকেছে (এবং আজও আছে) আদর্শবাদের উজ্জ্বল আলোকবর্তিকার অনন্ত প্রবহমান উৎস হয়ে। বর্তমানের মাঝে ভবিষ্যতের প্রতিনিধি হয়ে বহন করে চলেছে মুক্তির পতাকা।
ছাত্র ইউনিয়ন সবসময় ছিল এবং আজও রয়েছে ছাত্রসমাজেরই সংগঠন রূপে। সাধারণ ছাত্রসমাজের প্রকৃত স্বার্থ, আশা-আকাঙ্ক্ষা, প্রত্যাশা-স্বপ্নসাধ ইত্যাদিকে অবলম্বন করেই ছাত্র ইউনিয়নের ভিত্তি রচিত। তাই শিক্ষার দাবিতে, উন্নত একাডেমিক পরিবেশের জন্য, উপযুক্ত শিক্ষানীতি রচনার জন্য, ছাত্র হিসেবে সমাজের কাছে প্রাপ্য অধিকার আদায়ের জন্য ও সমাজের প্রতি ছাত্রসমাজের দায়িত্ববোধ সৃষ্টির জন্য ছাত্র ইউনিয়ন সবসময় নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করেছে। হোস্টেলের পাতলা ডাল ঘন করতে হবে, টয়লেটের ভাঙা দরজা মেরামত করতে হবে, সিলেবাসকে জাতীয় প্রয়োজনীয়তার সঙ্গে মিলিয়ে সুবিন্যস্ত করতে হবে, পরীক্ষা পদ্ধতি ঢেলে সাজাতে হবে, নকল প্রবণতা বন্ধ করতে হবে_ ছোট-বড় এসব প্রশ্ন সবসময়ই থেকেছে ছাত্র ইউনিয়নের কর্মকাণ্ডের কেন্দ্রীয় বিষয়বস্তু। এসব কারণে ছাত্র ইউনিয়ন থাকতে পেরেছে ছাত্রসমাজের নিজস্ব স্বাধীন সংগঠন হয়ে।
ছাত্রসমাজের মৌলিক স্বার্থগুলো পূরণ করার পথে প্রচলিত সামাজিক-অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক বিধি-ব্যবস্থাগুলো যে প্রতিবন্ধক, সে উপলব্ধিকে ছাত্র ইউনিয়ন তার জন্মলগ্ন থেকেই ব্যক্ত করেছে। এ উপলব্ধি থেকেই জাতীয় ঘটনাপ্রবাহে, সামাজিক-রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায়, শোষণমুক্তির সংগ্রামে, সমাজতন্ত্র ও মেহনতি মানুষের পক্ষে অবস্থান গ্রহণে রচিত হয়েছে ছাত্র ইউনিয়নের সুনির্দিষ্ট ভূমিকা। ছাত্রসমাজের মধ্যে রক্ষণশীলতা, কূপমণ্ডূকতা, প্রতিক্রিয়াশীলতা, সুবিধাবাদ, ক্যারিয়ারিজম প্রভৃতি প্রবণতার বিরুদ্ধে র্যাডিকেল বামধারার বিপ্লবী প্রেরণাকে সবসময় ঊধর্ে্ব তুলে ধরেছে ছাত্র ইউনিয়ন। এ মৌলিক বৈশিষ্ট্য অর্ধশতাব্দীর বেশি সময় ধরে ছাত্র ইউনিয়নের প্রতি আকর্ষণ করেছে ছাত্রসমাজের একটি প্রধান অংশকে। ব্যতিক্রম ঘটেছে কেবল তখনই যখন ক্ষমতাসীনদের মদদে জাতীয় ক্ষেত্রের পাশাপাশি ছাত্রসমাজের মধ্যে সুবিধাবাদ, ক্যারিয়ারিজম ইত্যাদি অবক্ষয়ের ধারা প্রবল হয়ে উঠতে সক্ষম হয়েছে। কিংবা যখন ছাত্র ইউনিয়ন তার ঐতিহ্যমণ্ডিত র্যাডিকেল বিপ্লবী ধারা অগ্রসর করতে দ্বিধা-দুর্বলতা দেখিয়েছে।
অর্ধশতাব্দীর বেশি সময়কাল ধরে শিক্ষার দাবিতে, স্বৈরাচার-সাম্প্রদায়িকতা-সাম্রাজ্যবাদ-সন্ত্রাস-লুটপাটতন্ত্রের বিরুদ্ধে সংগ্রামে, সর্বোপরি আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে ছাত্র ইউনিয়নের অগণিত নেতাকর্মী শহীদ হয়েছেন, জেল-জুলুম-নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। সত্য ও ন্যায়ের জন্য আত্মোৎসর্গের অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করে রেখেছে ছাত্র ইউনিয়ন।
ছাত্র ইউনিয়ন ঐতিহ্যগতভাবেই হয়ে উঠতে পেরেছে মননশীলতা, বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার এক ফলবান ক্ষেত্র। যারা গভীর চিন্তা করে, যারা মেধাবী, যারা বই পড়ে, যারা ভালো বিতর্ক করে, গান গায়, আবৃত্তি করে, নাটক করে, যারা সৎ, ত্যাগী, সাহসী, গরিবের দুঃখ দেখলে যাদের মন কাঁদে, যারা দুনিয়ায় জ্ঞান-বিজ্ঞানের অনেক খবর রাখে_ তারা সবাই সাধারণভাবে ছাত্র ইউনিয়ন করে। এটিই ছাত্রসমাজের মাঝে প্রচলিত ধারা হয়ে উঠেছে। 'বিপ্লবের আবেগ' তো বটেই, তবে তা-ই শুধু নয়, উচ্ছ্বাসমুক্ত গভীর বাস্তব বিশ্লেষণ ও যুক্তি-চিন্তার পথ ধরেই গড়ে উঠেছে ছাত্র ইউনিয়নের বিপ্লবী ঐতিহ্য ধারা।
তার বিপ্লবী ধারা সুদৃঢ়ভাবে অগ্রসর করার সঙ্গে সঙ্গে ছাত্র ইউনিয়ন আশু সংস্কারমূলক কোনো কাজকে কখনোই অবহেলা করেনি। বরং বন্যা ত্রাণের কাজ, দাঙ্গা প্রতিরোধ প্রভৃতি ক্ষেত্রে সবসময়ই ছাত্র ইউনিয়ন অগ্রবর্তী। এসব কাজ ভালোভাবে করার জন্য তার ঐতিহ্যের ধারা থেকে ছাত্র ইউনিয়নকে দূরে সরে আসতে হয়নি, বরঞ্চ সেই ধারা উজ্জীবিত থাকার কারণেই সে সংস্কারমূলক এসব কাজ নিষ্ঠার সঙ্গে এবং সুচারুভাবে করতে পেরেছে।
চেতনার যে দীপ্ত মশাল, ব্যাপক ও বহুমুখীন কর্মযজ্ঞের যে ঐতিহ্য-অভিজ্ঞতা গত ৬০ বছর গৌরবের সঙ্গে সমুজ্জ্বল রেখেছে ছাত্র ইউনিয়ন, তা চির অম্লান-চিরঞ্জীব। এই চেতনা ও ঐতিহ্যের মশালকে বহন করে এগিয়ে যেতে হবে নতুন প্রজন্মকে, আজকের দিনের ছাত্রসমাজকে।
২৬ এপ্রিল ঢাকায় যে মিলনমেলায় আমরা একত্রিত হতে চলেছি তা কেবল ছয় দশকের ঐতিহ্য ও গৌরবকে প্রতিবিম্বিত করবে না, তা হয়ে উঠবে ভবিষ্যতের নবজাগরণের উজ্জীবক। হাতে আর মাত্র ২৫ দিন। আসুন, সবাই সব শক্তি উজাড় করে নেমে পড়ি ২৬ এপ্রিলের ছাত্র ইউনিয়নের ৬০তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী পালনের কেন্দ্রীয় কর্মসূচি সফল করতে।
মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম :সাবেক সভাপতি
বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন এবং
সাধারণ সম্পাদক, সিপিবি।
আজ এপ্রিলের প্রথম দিন। এই এপ্রিল মাসের ২৬ তারিখে এবার পালিত হতে যাচ্ছে ছাত্র ইউনিয়নের ৬০তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী। ১৯৫২-এর এই দিনে ভাষা আন্দোলনের অভিজ্ঞতা, শিক্ষা ও সংগ্রামী প্রেরণায় উজ্জীবিত হয়ে ছাত্রসমাজের অতি প্রিয় এবং অনন্য ঐতিহ্যমণ্ডিত এ সংগঠনটির পথচলার সূচনা হয়েছিল। বহুবর্ণের রত্নময় গৌরবগাথায় রচিত তার পরবর্তী ছয় দশকের চলার পথ।
জন্মলগ্ন থেকে আজ পর্যন্ত শত-সহস্র ছাত্রছাত্রী শাণিত দেশপ্রেম, প্রগতিমুখিনতা ও সংগ্রামী একাগ্রতায় 'ঐক্য-শিক্ষা-শান্তি-প্রগতি'র মূলমন্ত্রে দীক্ষা নিয়ে ছাত্র ইউনিয়নের নীল পতাকাতলে সমবেত হয়েছে। তাদের অনেকেই আজ প্রয়াত। অনেকেই এখন অশীতিপর বৃদ্ধ। কেউ বা সবে কচি বয়সের কিশোর-তরুণ। তারা সবাই আদর্শের বাঁধনে একই পরিবারের সদস্য। আমিও তাদেরই একজন। সেই 'ছাত্র ইউনিয়ন পরিবারের' একজন সদস্য হতে পারাটা আমাদের আত্মপরিচয়ের অমূল্য সঞ্চয়, আমাদের পরম গৌরব।
২৬ এপ্রিল ঢাকায় ধুমধামের সঙ্গে বেশ বড় করে ছাত্র ইউনিয়নের ৬০তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী পালন করা হবে। গোলাম আরিফ টিপুকে চেয়ারম্যান করে জাতীয় উদযাপন কমিটি গঠন করা হয়েছে। সেই কমিটির পরিচালনায় ২৬ এপ্রিলের অনুষ্ঠানাদির প্রস্তুতি কাজ শুরু হয়ে গেছে। ২৬ এপ্রিলের পরও জাতীয় উদযাপন কমিটি সারাবছর ধরে নানা কাজের পরিকল্পনা নিয়েছে। জেলায় জেলায় এবং প্রবাসেও উদযাপন কমিটি গঠন করা হয়েছে। তাদের উদ্যোগেও নিজ নিজ এলাকায় পুনর্মিলনীসহ বছরব্যাপী নানা কর্মসূচি গ্রহণ করা যাবে।
২৬ এপ্রিল কেন্দ্রীয় কর্মসূচি হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাস্কর্যের সামনে সকাল ১১টায় ছাত্র ইউনিয়ন পরিবারের হাজার হাজার সদস্যের একটি সমাবেশ অনুষ্ঠিত হবে। সেখানে এক ঘণ্টার অনুষ্ঠান শেষে একটি সুসজ্জিত র্যালি বের করা হবে। তারপর বিশ্ববিদ্যালয় খেলার মাঠের বিশাল প্যান্ডেলে বিকেল ৩টায় শুরু হবে 'পুনর্মিলনী অনুষ্ঠান'। সেখানে সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত পর্যন্ত চলবে অনেক বছর ধরে না-দেখা বন্ধুদের সঙ্গে সাক্ষাৎ, ফেলে আসা দিনগুলো নিয়ে গল্প-গুজব, স্ত্রী-পুত্র-কন্যাদের নিয়ে চেনা পরিচয়ের পালা, ছবি তোলা, আড্ডা ইত্যাদি। মঞ্চ থেকে চলবে গান, কবিতা পাঠ, স্মৃতিচারণ ইত্যাদি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান।
২৬ এপ্রিলকে ঘিরে এখন থেকেই ছাত্র ইউনিয়ন পরিবারের সদস্যদের মাঝে জাগতে শুরু করেছে আবেগ-অনুভূতির গভীর স্পন্দন। ছয় দশকের এ অনন্য গৌরবগাথার অমর স্রষ্টা ও অমৃত সন্তান হলো '৫২ থেকে ২০১২ পর্যন্ত ছাত্র ইউনিয়নের 'ঐক্য-শিক্ষা-শান্তি-প্রগতি'র মূলমন্ত্রে দীক্ষিত শত-সহস্র সাথী। এই পরিবারের সন্তানরা আজ যে যেখানেই আছেন, তাদের খুঁজে বের করে পারিবারিক বন্ধনে সংযুক্ত করার কাজটি আজ আপনার, আমার বিশেষ কর্তব্য। ২৬ এপ্রিলের আগেই এ কাজটি যত বেশি সম্ভব এগিয়ে নিতে হবে।
২৬ এপ্রিল ঢাকায় একত্রিত হয়ে ৬০তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী পালন, ছাত্র ইউনিয়নের প্রতি আমাদের ভালোবাসা ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশের সুযোগ করে দেবে। সে সুযোগটি আমাদের নিতে হবে। অন্যরাও যেন সে সুযোগ নিতে পারে সে জন্য ২৬ এপ্রিলের পুনর্মিলনী অনুষ্ঠানের বার্তা তাদের কাছে পেঁৗছে দিতে হবে। এটি আজ আমার, আপনার দায়িত্ব।
ছাত্র ইউনিয়ন বছর পরম্পরায় লাখ লাখ তরুণ ছাত্রছাত্রীকে নির্ভেজাল দেশপ্রেম, গণতন্ত্র, অসাম্প্রদায়িকতা, সাম্রাজ্যবাদ বিরোধিতা, বিশ্বশান্তি, আন্তর্জাতিকতাবাদ, প্রগতিশীলতা, সমাজতন্ত্র, মানবমুক্তি ইত্যাদি সুমহান আদর্শ ও চেতনায় দীক্ষিত করেছে। ছাত্রসমাজের মাঝে প্রজ্বলিত করেছে জাগরণের অগি্ন-মশাল। অজেয় ও অনির্বাণ সেই চেতনার আলোকচ্ছটায় বায়ান্ন থেকে দীপ্ত হয়েছে অগণিত ছাত্রছাত্রী। ছাত্র ইউনিয়নের শিক্ষা তাদের শ্রেষ্ঠ মানবিক গুণাবলি আত্মকরণে ও নিজ নিজ পেশায় উৎকর্ষ অর্জনে পথ রচনা করে দিয়েছে।
ছাত্র ইউনিয়ন তার সদস্যদের শিক্ষা দিয়েছে প্রজ্ঞা, প্রগতিমুখিনতা, মুক্তবুদ্ধির চর্চা, সাহসিকতা, দৃঢ়তা, নিষ্ঠা, আত্মত্যাগের মনোবৃত্তি, উন্নত চারিত্রিক গুণাবলি, সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক বোধ, উন্নত রুচিশীলতা, শ্রমের প্রতি মর্যাদা, শোষিত-অবহেলিত মানুষের প্রতি শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার বোধ ইত্যাদি। উদার মানবপ্রেম ও র্যাডিকেল প্রগতিমুখিনতা নিয়ে দেশ, জাতি, জনগণ ও সভ্যতার অনন্ত অগ্রযাত্রার সাহসী সৈনিকের ব্রত গ্রহণ করতে ছাত্র ইউনিয়ন তার সদস্যদের উদ্বুদ্ধ করেছে। ছাত্র ইউনিয়ন শিখিয়েছে, বিদ্যমান প্রতিকূলতার কাছে মাথানত না করতে। শিখিয়েছে প্রতিক্রিয়াশীল স্থিতাবস্থাকে অথবা গণশত্রুর আঘাতকে চ্যালেঞ্জ করতে। মাঝে মাঝে নেমে আসা ঘোর কৃষ্ণপক্ষের মাঝেই ছাত্র ইউনিয়ন সব সময় থেকেছে (এবং আজও আছে) আদর্শবাদের উজ্জ্বল আলোকবর্তিকার অনন্ত প্রবহমান উৎস হয়ে। বর্তমানের মাঝে ভবিষ্যতের প্রতিনিধি হয়ে বহন করে চলেছে মুক্তির পতাকা।
ছাত্র ইউনিয়ন সবসময় ছিল এবং আজও রয়েছে ছাত্রসমাজেরই সংগঠন রূপে। সাধারণ ছাত্রসমাজের প্রকৃত স্বার্থ, আশা-আকাঙ্ক্ষা, প্রত্যাশা-স্বপ্নসাধ ইত্যাদিকে অবলম্বন করেই ছাত্র ইউনিয়নের ভিত্তি রচিত। তাই শিক্ষার দাবিতে, উন্নত একাডেমিক পরিবেশের জন্য, উপযুক্ত শিক্ষানীতি রচনার জন্য, ছাত্র হিসেবে সমাজের কাছে প্রাপ্য অধিকার আদায়ের জন্য ও সমাজের প্রতি ছাত্রসমাজের দায়িত্ববোধ সৃষ্টির জন্য ছাত্র ইউনিয়ন সবসময় নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করেছে। হোস্টেলের পাতলা ডাল ঘন করতে হবে, টয়লেটের ভাঙা দরজা মেরামত করতে হবে, সিলেবাসকে জাতীয় প্রয়োজনীয়তার সঙ্গে মিলিয়ে সুবিন্যস্ত করতে হবে, পরীক্ষা পদ্ধতি ঢেলে সাজাতে হবে, নকল প্রবণতা বন্ধ করতে হবে_ ছোট-বড় এসব প্রশ্ন সবসময়ই থেকেছে ছাত্র ইউনিয়নের কর্মকাণ্ডের কেন্দ্রীয় বিষয়বস্তু। এসব কারণে ছাত্র ইউনিয়ন থাকতে পেরেছে ছাত্রসমাজের নিজস্ব স্বাধীন সংগঠন হয়ে।
ছাত্রসমাজের মৌলিক স্বার্থগুলো পূরণ করার পথে প্রচলিত সামাজিক-অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক বিধি-ব্যবস্থাগুলো যে প্রতিবন্ধক, সে উপলব্ধিকে ছাত্র ইউনিয়ন তার জন্মলগ্ন থেকেই ব্যক্ত করেছে। এ উপলব্ধি থেকেই জাতীয় ঘটনাপ্রবাহে, সামাজিক-রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায়, শোষণমুক্তির সংগ্রামে, সমাজতন্ত্র ও মেহনতি মানুষের পক্ষে অবস্থান গ্রহণে রচিত হয়েছে ছাত্র ইউনিয়নের সুনির্দিষ্ট ভূমিকা। ছাত্রসমাজের মধ্যে রক্ষণশীলতা, কূপমণ্ডূকতা, প্রতিক্রিয়াশীলতা, সুবিধাবাদ, ক্যারিয়ারিজম প্রভৃতি প্রবণতার বিরুদ্ধে র্যাডিকেল বামধারার বিপ্লবী প্রেরণাকে সবসময় ঊধর্ে্ব তুলে ধরেছে ছাত্র ইউনিয়ন। এ মৌলিক বৈশিষ্ট্য অর্ধশতাব্দীর বেশি সময় ধরে ছাত্র ইউনিয়নের প্রতি আকর্ষণ করেছে ছাত্রসমাজের একটি প্রধান অংশকে। ব্যতিক্রম ঘটেছে কেবল তখনই যখন ক্ষমতাসীনদের মদদে জাতীয় ক্ষেত্রের পাশাপাশি ছাত্রসমাজের মধ্যে সুবিধাবাদ, ক্যারিয়ারিজম ইত্যাদি অবক্ষয়ের ধারা প্রবল হয়ে উঠতে সক্ষম হয়েছে। কিংবা যখন ছাত্র ইউনিয়ন তার ঐতিহ্যমণ্ডিত র্যাডিকেল বিপ্লবী ধারা অগ্রসর করতে দ্বিধা-দুর্বলতা দেখিয়েছে।
অর্ধশতাব্দীর বেশি সময়কাল ধরে শিক্ষার দাবিতে, স্বৈরাচার-সাম্প্রদায়িকতা-সাম্রাজ্যবাদ-সন্ত্রাস-লুটপাটতন্ত্রের বিরুদ্ধে সংগ্রামে, সর্বোপরি আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে ছাত্র ইউনিয়নের অগণিত নেতাকর্মী শহীদ হয়েছেন, জেল-জুলুম-নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। সত্য ও ন্যায়ের জন্য আত্মোৎসর্গের অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করে রেখেছে ছাত্র ইউনিয়ন।
ছাত্র ইউনিয়ন ঐতিহ্যগতভাবেই হয়ে উঠতে পেরেছে মননশীলতা, বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার এক ফলবান ক্ষেত্র। যারা গভীর চিন্তা করে, যারা মেধাবী, যারা বই পড়ে, যারা ভালো বিতর্ক করে, গান গায়, আবৃত্তি করে, নাটক করে, যারা সৎ, ত্যাগী, সাহসী, গরিবের দুঃখ দেখলে যাদের মন কাঁদে, যারা দুনিয়ায় জ্ঞান-বিজ্ঞানের অনেক খবর রাখে_ তারা সবাই সাধারণভাবে ছাত্র ইউনিয়ন করে। এটিই ছাত্রসমাজের মাঝে প্রচলিত ধারা হয়ে উঠেছে। 'বিপ্লবের আবেগ' তো বটেই, তবে তা-ই শুধু নয়, উচ্ছ্বাসমুক্ত গভীর বাস্তব বিশ্লেষণ ও যুক্তি-চিন্তার পথ ধরেই গড়ে উঠেছে ছাত্র ইউনিয়নের বিপ্লবী ঐতিহ্য ধারা।
তার বিপ্লবী ধারা সুদৃঢ়ভাবে অগ্রসর করার সঙ্গে সঙ্গে ছাত্র ইউনিয়ন আশু সংস্কারমূলক কোনো কাজকে কখনোই অবহেলা করেনি। বরং বন্যা ত্রাণের কাজ, দাঙ্গা প্রতিরোধ প্রভৃতি ক্ষেত্রে সবসময়ই ছাত্র ইউনিয়ন অগ্রবর্তী। এসব কাজ ভালোভাবে করার জন্য তার ঐতিহ্যের ধারা থেকে ছাত্র ইউনিয়নকে দূরে সরে আসতে হয়নি, বরঞ্চ সেই ধারা উজ্জীবিত থাকার কারণেই সে সংস্কারমূলক এসব কাজ নিষ্ঠার সঙ্গে এবং সুচারুভাবে করতে পেরেছে।
চেতনার যে দীপ্ত মশাল, ব্যাপক ও বহুমুখীন কর্মযজ্ঞের যে ঐতিহ্য-অভিজ্ঞতা গত ৬০ বছর গৌরবের সঙ্গে সমুজ্জ্বল রেখেছে ছাত্র ইউনিয়ন, তা চির অম্লান-চিরঞ্জীব। এই চেতনা ও ঐতিহ্যের মশালকে বহন করে এগিয়ে যেতে হবে নতুন প্রজন্মকে, আজকের দিনের ছাত্রসমাজকে।
২৬ এপ্রিল ঢাকায় যে মিলনমেলায় আমরা একত্রিত হতে চলেছি তা কেবল ছয় দশকের ঐতিহ্য ও গৌরবকে প্রতিবিম্বিত করবে না, তা হয়ে উঠবে ভবিষ্যতের নবজাগরণের উজ্জীবক। হাতে আর মাত্র ২৫ দিন। আসুন, সবাই সব শক্তি উজাড় করে নেমে পড়ি ২৬ এপ্রিলের ছাত্র ইউনিয়নের ৬০তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী পালনের কেন্দ্রীয় কর্মসূচি সফল করতে।
মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম :সাবেক সভাপতি
বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন এবং
সাধারণ সম্পাদক, সিপিবি।
No comments