অরুন্ধতি রায়-ওদের প্রতিচ্ছবি

মন্ত্রী বলেছেন, ভারতের স্বার্থে জনগণের গ্রাম ছেড়ে শহরে চলে আসা উচিত। তিনি হার্ভার্ড থেকে লেখাপড়া করেছেন। তিনি গতি এবং বড় সংখ্যার জনগণে বিশ্বাস করেন। ৫০ কোটি মানুষ শহরে চলে এলে তা বাণিজ্যের জন্য একটি ভালো উদাহরণ হবে বলে মনে করেন।


অবশ্য, সবাই এ ধারণার সঙ্গে একমত নন যে দরিদ্র জনগোষ্ঠী দিয়ে শহর ভরে উঠুক। মুম্বাইয়ে একজন বিচারক বস্তির মানুষদের কথা বলেছেন, তারা হলো শহরের পিকপকেট বা পকেটমার। অন্য একজন অবৈধ কলোনি উৎখাতে বুলডোজার চালানোর আদেশ দানকালে বলেছেন, যারা শহরে থাকার সামর্থ্য রাখে না, তাদের সেখানে থাকা উচিত নয়।
যাদের উৎখাত করা হয় তারা ফিরে গিয়ে দেখে, নিজের গ্রামটি অদৃশ্য হয়ে গেছে কোনো বাঁধের কারণে। তাদের ঘর ক্ষুধা ও পুলিশের অত্যাচারে জর্জরিত। বনাঞ্চল সশস্ত্র গেরিলাদের দখলে। যুদ্ধের কারণেও অনেকে ঘরবাড়ি ছাড়তে বাধ্য হয়েছে। ভারতের একপ্রান্ত থেকে শুরু করে কাশ্মীর, মনিপুর, নাগাল্যান্ড থেকে শুরু করে ভারতের কেন্দ্রবিন্দু পর্যন্ত। যে কারণে জনগণ আবার শহরের রাস্তা এবং ফুটপাতে ফিরে এসে আশ্রয় নেয়। তারা গাদাগাদি করে ধুলোবালি ভরা কনস্ট্রাকশন কাজের জায়গায় আশ্রয় নিতে চেষ্টা করে, ঘুরতে থাকে এই বিশাল দেশের কোনো একটি জায়গায় আশ্রয়ের জন্য।
মন্ত্রী উল্লেখ করেছেন, 'যারা শহরে আসছে, তাদের অনেকেই অপরাধী। তারা এমন সব আচরণ সঙ্গে নিয়ে আসে, যা আধুনিক শহরের কাছে অগ্রহণযোগ্য।' মধ্যবিত্তরা তাঁর এ দূরদৃষ্টিপূর্ণ কথাকে স্বাগত জানিয়েছে। তাঁর স্পষ্ট বক্তব্যের সাহসের জন্য প্রশংসা করেছে। মন্ত্রী বলেছেন, তিনি শহরের আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করার জন্য আরো বেশি করে পুলিশ স্টেশন তৈরি করবেন, আরো পুলিশ নিয়োগ দেবেন এবং আরো পুলিশের ভ্যানের ব্যবস্থা করবেন।
২০১০ সালের কমনওয়েলথ গেইমসের সময় নয়াদিলি্লকে বিশ্বমানের শহর হিসেবে গড়ে তুলতে যে আইন পাস করা হয়, গরিবদের অদৃশ্য করে ফেলার জন্য। যেন রঙ দিয়ে ধোলাই করা। রাস্তার বিক্রেতাদের অদৃশ্য করে ফেলা হয়, রিকশাচালকরা তাদের লাইসেন্স হারায়, ছোট ছোট দোকান বন্ধ করে দেওয়া হয়। ভিক্ষুকদের ধরে ভ্রাম্যমাণ আদালতের ম্যাজিস্ট্রেট দিয়ে তাদের শহরের বাইরে নিক্ষেপ করা হয়। তার পরও যেসব বস্তি রয়ে গেছে, সেগুলোকে ঢেকে দেওয়া হয় বিলবোর্ড দিয়ে।
নতুন ধরনের পুলিশ রাস্তায় টহল দিতে থাকে। হাতে উন্নত অস্ত্র, পরনে অপেক্ষাকৃত উন্নত পোশাক। তাদের ভেতরের বিষয় যত জ্বালাময়ী হোক_তা যেন বের হয়ে না আসে। সবখানে ক্যামেরা, সব জায়গায় রেকর্ডিং চলতে থাকে।
এমনি এক অবস্থায় পুলিশের জাল থেকে দুটি অপরাধী বাচ্চা মেয়ে বেরিয়ে আসে, যা আধুনিক শহরের কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। ট্রাফিক ক্রসিংয়ে ঝকঝকে গাড়ির ভেতর চামড়ার সিটে উপবিষ্ট সানগ্লাস পরিহিত এক ভদ্রমহিলার কাছে দৌড়ে যায়। নির্লজ্জভাবে তারা পয়সা দাবি করে। সে নারী একজন ধনী ও দয়ালু। এই ক্রিমিনাল মেয়ে দুটির উচ্চতা কোনোক্রমেই গাড়ির কাচের জানালা পর্যন্ত নয়। এই দুই নির্লজ্জের নাম হয়তো রুকমিনি ও কমলি। অথবা মেহেরুনি্নসা এবং শাহবানু (তাতে কার কী আসে-যায়)। মহিলা কমলির হাতে ১০টি রুপি দিয়ে তাদের মায়ের মতো উপদেশ দেন_'ভাগ করে নাও'। তারপর রাস্তার সিগন্যাল বাতি পাল্টে যেতেই হুস করে বেরিয়ে যান।
রুকমিনি এবং কমলি অথবা মেহেরুনি্নসা ও শাহবানু_দুজন যুদ্ধ শুরু করে দেয় গ্লাডিয়েটরের মতো। দ্রুত বেরিয়ে যাওয়া গাড়িগুলো মেয়ে দুটিকে প্রায় চাপা দিতে দিতে পাশ দিয়ে চলে যায়। কাচের মতো গাড়ির দরজায় মেয়ে দুটির যুদ্ধের দৃশ্যের প্রতিফলন ঘটে। ঘটনাক্রমে এই মেয়ে দুটিও চোখের আড়ালে চলে যায় দিলি্লর রাস্তার হাজার হাজার শিশুর মতো।
এর দুই মাস পর ভারতের ৬২তম প্রজাতন্ত্র দিবসে প্যারেড অনুষ্ঠিত হয় এবং সশস্ত্রবাহিনী নতুন অস্ত্র প্রদর্শন করে। রাশিয়ান মাল্টিব্যারেল রকেট লঞ্চার, কমব্যাট এয়ারক্রাফট, লাইট হেলিকপ্টার এবং নৌবাহিনীর পানির নিচের অস্ত্র। নতুন টি-৯০ যুদ্ধ-ট্যাংকের নাম ভীষ্ম (পুরনোটির নাম অর্জুন)। নতুন হেভিওয়েট টর্পেডোর নাম বরুণাস্ত্র। প্রতিপক্ষ থেকে আসা টর্পেডো ধ্বংসকারী সিস্টেমের নাম মরিচ। (কাশ্মীরের জনবিরল রাস্তায় পাহারা দেওয়া সশস্ত্র যানের গায়ে লেখা হনুমান এবং বজ্র। এ নামগুলো হিন্দু মহাকাব্য থেকে নেওয়ার বিষয়টি শুধুই একটি কাকতালীয় ঘটনা। যদি ভারত একটি হিন্দু দেশ হয়, সেটা দুর্ঘটনাবশত।
সেনাবাহিনীর সিগন্যাল কোরের ডেয়ার ডেভিলস রকেট ফর্মে সেজে আসে। তারপর তারা একঝাঁক পাখির আকার গ্রহণ করে এবং অবশেষে মানব নির্মিত পিরামিড।
মাথার ওপর সুখোই জঙ্গি বিমানগুলো ত্রিশূলের আকার ধারণ করে। এর প্রতিটি বিমানের মূল্য ১০০ কোটি ভারতীয় রুপির অধিক। শিবের ত্রিশূলের জন্য খরচ ৪০০ কোটি রুপি।
উত্তেজিত জনতা মাথা উঁচু করে আকাশের দিকে তাকিয়ে হাততালি দেয়। উঁচু আকাশে রুকমিনি এবং কমলির মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জার দৃশ্য ভেসে ওঠে।
সেনাবাহিনীর ব্যান্ড জাতীয় সংগীত বাজায়। প্রেসিডেন্ট শাড়ির আঁচল মাথায় দিয়ে অভিবাদন গ্রহণ করেন।

ভারতের আউটলুক থেকে অনুবাদ : মহসীন হাবিব

No comments

Powered by Blogger.