মিনার ভাই :যদ্যপি আমার গুরু by অম্লান দেওয়ান

বুকভরা অভিমান নিয়ে চলে গেলেন আশির দশকের আলোচিত সাপ্তাহিক পত্রিকা 'বিচিন্তা'র সম্পাদক মিনার মাহমুদ। বৃহস্পতিবার বিকেলে পুলিশ রাজধানীর একটি হোটেল থেকে তার লাশ উদ্ধার করে। পুলিশ ও পরিবারের ধারণা, মিনার মাহমুদ আত্মহত্যা করেছেন। তার বয়স হয়েছিল ৫০ বছর।


মিনার মাহমুদের জন্ম ফরিদপুর শহরে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হন। কবি রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহসহ তার সমবয়সী বিশ্ববিদ্যালয়পড়ূয়া তরুণদের নিয়ে প্রেমে পড়েছিলেন কবিতা ও দেশের। আর দ্রোহের বার্তা পেঁৗছে দিতে যোগ দেন সাপ্তাহিক বিচিত্রায়। সেনাশাসক হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের আমলে ১৯৮৭ সালে তার সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় সাপ্তাহিক বিচিন্তা। একঝাঁক নবীন সংবাদকর্মীর সম্মিলনে গড়ে তোলেন বিচিন্তা পরিবার। এ পরিবারের সদস্য হিসেবে খুঁজে নেন প্রগতিবাদী ও উদারপন্থি তরুণদের। ফ্রেশ ব্লাড_ কোনো অভিজ্ঞতার দরকার নেই; এটিই ছিল বিচিন্তা পরিবারের ভাতের হাঁড়ির অধিকার পাওয়ার প্রধান শর্ত। রাজনৈতিক দলাদলি কিংবা প্রেস ক্লাবকেন্দ্রিক সাংবাদিকতার বাইরে স্বতন্ত্র এক পরিচয়ে প্রকাশিত হয়েছিল বিচিন্তা। অতি দ্রুত পাঠকপ্রিয়তাও পায় তা।
সামরিক শাসনবিরোধী একটি রিপোর্টের জন্য মিনার মাহমুদকে ১৯৮৮ সালের জানুয়ারিতে গ্রেফতার করা হয়। বন্ধ হয়ে যায় এর প্রকাশনা। ১৯৯০ সালের গণঅভ্যুত্থানে এরশাদ সরকারের পতন হলে আবারও প্রকাশিত হয় বিচিন্তা। তবে সে বছরই এর প্রকাশনা বন্ধ করে দেশ ছেড়ে যুক্তরাষ্ট্র চলে যান মিনার মাহমুদ। ১৮ বছর পর ২০০৯ সালে তিনি দেশে ফেরেন। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত দেশের অগণিত পাঠকের কাছে তিনি পরিচিত ছিলেন সাপ্তাহিক বিচিন্তার সম্পাদক হিসেবেই। 'আমাকে বলতে দাও, আমাকে লিখতে দাও'_ স্ট্যাচু অব লিবার্টির লোগো দিয়ে তৈরি এ স্লোগানের বাস্তবায়নই ছিল ধ্যানজ্ঞান।
সমাজবিজ্ঞানের ছাত্র ছিলেন তিনি। তবে সাংবাদিকতা ছিল তার রক্ত-মাংসে। অর্থশাস্ত্র, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, সমাজবিজ্ঞান, ইতিহাস, খেলাধুলা, ধর্ম-সংস্কৃতি, বিশ্বায়ন কিংবা বাণিজ্য_ এ সব বিষয়েই তিনি বিশেষজ্ঞের মতো মতামত দেওয়ার ক্ষমতা রাখতেন। বাংলা বাক্যরীতির নতুন ঘরানা তৈরিতে তার খ্যাতি ছিল সর্বজনবিদিত। মানুষকে প্রভাবিত করার জাদুকরি ক্ষমতা ছিল তার। মুহূর্তের মধ্যে জমিয়ে তুলতেন আড্ডা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র থাকাকালে যোগ দেন সাপ্তাহিক বিচিত্রায়। সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে রিপোর্ট ছাপতে গিয়ে কাভারে একটি সন্ত্রাসীর মডেল প্রয়োজন হয়। অনেক খোঁজাখুঁজির পর ঝামেলায় পড়বেন এ ভয়ে কেউই মডেল হতে রাজি হচ্ছিলেন না। মিনার মাহমুদ নিজেই দাঁড়িয়ে পড়লেন রাজপথে। মাথায় গামছা, হাতে হকিস্টিক, পরনে জিন্স প্যান্ট, রোদের তাপে শরীর থেকে ঝরছে ঘাম। নিজের রিপোর্টে মডেল হলেন নিজেই। এ সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অস্ত্রের রাজনীতি, ইমদু, গালকাটা কামালসহ দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসীদের জীবনচিত্র, মুহসীন হলের আলোচিত সেভেন মার্ডার, বানীশান্তা পতিতালয়সহ বিভিন্ন বিষয়ে আলোচিত সব অনুসন্ধানী রিপোর্ট তৈরি করেন তিনি।
তসলিমা নাসরীন তখন কেবল ডাক্তারি পাস করে ঢাকা মেডিকেল কলেজের অ্যানেসথেশিয়া বিভাগে কর্মরত। কবি রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহর মাধ্যমেই সম্ভবত তসলিমার সঙ্গে মিনার ভাইয়ের পরিচয়। সে সূত্রে বিয়ে। সে বিয়ে টেকেনি বেশিদিন।
১৯৯১ সালের ১২ জুলাই সংখ্যার বিচিন্তায় হিন্দু ধর্মের অবতার শ্রীকৃষ্ণকে নিয়ে আমার একটি লেখার কারণে পত্রিকাটি আবারও নিষিদ্ধ হয়ে যায়। সারাদেশে মামলা হয় প্রায় ২৮টি। শুরু হয় মিনার ভাই আর আমার ফেরার জীবন। পুলিশ তালা ঝুলিয়ে দেয় বিচিন্তা অফিসে। এরই এক পর্যায়ে বিচিন্তার স্বত্ব কিনে নেয় কসমস গ্রুপ। মিনার ভাই পাড়ি জমান 'ইয়াংকির দেশ' যুক্তরাষ্ট্রে। ট্যাক্সি চালানো থেকে শুরু করে নানা কাজ তাকে করতে হয় জীবিকার তাগিদে। স্বেচ্ছানির্বাসনের এ সময়টাতে নিজেকে দেশ থেকে প্রায় বিচ্ছিন্ন করে ফেলেন। যদিও মন পড়ে থাকত দেশেই। যেসব তরুণ সংবাদকর্মী পেশাগত কাজে যুক্তরাষ্ট্র কিংবা নিউইয়র্কে যেতেন তাদের এয়ারপোর্ট থেকে নিজের ট্যাক্সি চালিয়ে নিয়ে যেতেন তার বাসায়। মহা ধুমধাম করে নানা আয়োজনে জমিয়ে তুলতেন আড্ডা। আড্ডায় আড্ডায় কাটিয়ে দিতেন ঘণ্টার পর ঘণ্টা। সম্ভবত ২০১০ সালের শুরুতে হঠাৎ মোবাইলে ফোন পাই_ আমি মিনার মাহমুদ। দেশে ফিরেছি। ৪ নম্বর সেক্টরের অমুক নাম্বার বাড়িতে ৭টার মধ্যে চলে আসেন। খুব জরুরি ... বলেই ফোন রেখে দেন। যথারীতি হাজির হলাম সেই বাড়িতে। বিয়ের পোশাকে আমাদের মিনার ভাই। মাথায় পাগড়ি। দুলার বেশে হাস্যোজ্জ্বল। সে অনুষ্ঠানে হাতেগোনা যে ক'জন স্বজন ছিলেন তাদের মধ্যে দেশের বিশিষ্ট ব্যবসায়ী নেতা এ. কে. আজাদও ছিলেন। বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা শেষ হলে ফিরে আসি যে যার বাড়ি। থেকে যান মিনার ভাই। তার সর্বশেষ স্ত্রী পেশায় চিকিৎসক ডা. লুবনার বাসায়।
সর্বশেষ গত বুধবার লুবনাকে বিদায় জানিয়ে বাসা থেকে বের হন। গিয়ে ওঠেন রিজেন্সি হোটেলের একটি কক্ষে। অতিরিক্ত ঘুমের ওষুধ সেবনে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন।
মনে পড়ে বিচিন্তার নিয়োগ পরীক্ষায় তিন-চারটি বিষয়ের ওপর হাজারখানেক শব্দে লিখতে বলেছিলেন মিনার ভাই। ১৯৮৯-এর গোড়ার দিকে। তার একটি ছিল অনেকটা এ রকম : 'ধরুন টাইম মেশিনে চড়ে আপনি চলে গেছেন এখন থেকে ২০ বছর সামনে। আপনি তখন দেশের প্রতিষ্ঠিত বহুল প্রচারিত কোনো দৈনিকের ডাকসাইটে সম্পাদক। তখনকার আপনাকে নিয়ে লিখুন ...।'
আজ ২০ বছরেরও বেশি সময় পেরিয়ে গেছে। মিনার ভাইয়ের অনুসারীদের অনেকেই ডাকসাইটে সম্পাদক। আর মিনার ভাই 'টাইম মেশিনে' চড়ে অসময়ে অবেলায় চলে গেলেন না ফেরার দেশে। টাইম মেশিনের সুইচটা চালু করে দিলেন সময়ের আগেই_ তার খুশিমতো, অন্যায়ভাবে, অনেকটা স্বার্থপরের মতোই। মৃত্যুর আগে হোটেল রুমের বাইরে লাগিয়ে রাখেন 'ডোন্ট ডিস্টার্ব' সাইন।

অম্লান দেওয়ান :ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক

No comments

Powered by Blogger.